স্মৃতি যখন বেদনার
স্মৃতি যখন বেদনার
জীবনে সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, বিরহ-মিলনের কত ঘটনাই না রােজ ঘটছে। চলছে স্বরণ-বিস্মরণে নিরলস মালাগাথা। জীবন মানেই তাে নিরলস ঘটনার নিত্য নতুন অভিজ্ঞতা। এরই মধ্যে দু-একটি ঘটনা, অভিজ্ঞতা আমাদের জীবনপাত্রকে স্মৃতি-সুধারসে ভরিয়ে রাখে। সেই সুধারস পান করেই আমানের বেঁচে থাকা যথার্থ হয়ে ওঠে। একটানা জীবন প্রবাহে এরকম অনেক ঘটনা বুদবুদের মত ক্ষণিক। কিন্তু তারই মধ্যে দু-একটা ঘটনা ভােলা যায় না। আবার কিছু ঘটনার অভিজ্ঞতা আমাদের মনকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়, মনে পড়লে শিউড়ে উঠতে হয়, বেদনায় দীর্ণ হতে হয়। মনে হয় যেন দুঃস্বপ্ন দেখে এখনই জেগে উঠেছি।
আমার জীবনেও এরকম একটি ভয়ঙ্কর ঘটনার অভিজ্ঞতা স্মরণীয় হয়ে আছে। আমার কাছে আজও তা দুঃস্বপ্ন। তারপরে জীবনের চড়াই-উৎরাই এর পথে আরও কত ঘটনাই না ঘটা । কিন্তু সেদিনের সেই ঘটনাটা আজও আমাকে আনমনা করে: করে উদাস, বিষণ্ণ। সময়ের প্রলেপ সেই স্মৃতি আজও অমলিন। সেই স্মৃতির পাত্র থেকেই তােমাদের সেই করুণ, বেদনাভুর অভিজ্ঞতার কথা শােনাব। আমার মনে হয় তোমরাও শিউরে উঠবে সেই মর্মস্পর্শী ঘটনা শুনে। ঘটনার উৎসস্থল আমার মামারবাড়ি: উখরা। তােমাদের অবগতির জন্য জানাই, উখরা বর্ধমান জেলার
অগ্র থানায় অবস্থিত একটি অতি ব্যস্ত শহর। অনেকেই জানে কোলফিল্ড এলাকা বলে সবসময় রাস্তায় যানজট, শ্রমিক ধর্মঘট এবং নানারকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতেই থাকে।
আমার মামার বাড়িটি শহরের মধ্যস্থলে রথতলা পাড়ায় মেন রােডের উপর অবস্থিত। বাড়ির সামনের রাস্তায় ট্রাক, বাস, ট্যাক্সি সর্বদা যাতায়াত করে। রিক্সা-মােটর সাইকেলের কথা তাে বলারই নেই।
প্রতি বছর অ্যানুয়াল পরীক্ষার পর আমরা ভাই-বােনে মায়ের সঙ্গে মামার বাড়ি বেড়াতে যেতাম। পুরাে ছুটি কাটিয়ে রেজাল্টের আগে বাড়ি ফিৱতাম। তখন তো আর আমরা তােমাদের মতাে একটা ক্লাসের পরীক্ষা দিয়েই পরের ক্লাসের পড়া শুরু করতাম না। তখন অত চাপও ছিল না যে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে। বাবা মায়েরও চাপ ছিল না, চাপ ছিল না কোচিং-এরও। তাে সেবারও অষ্টম শ্রেণীর পরীক্ষা দিয়ে আমরা মামার বাড়ি গিয়েছি। দেখলাম, মামার বাড়ির চার-পাঁচটি বাড়ির আগে রবীন মামাদের বিশাল ফ্ল্যাট টায় সংস্করণ হচ্ছে। সুন্দর নতুন বাড়ি। কিন্তু হাতে পর্যাপ্ত টাকা এবং যথেেষ্ট শখ থাকলে যা হয়। সেই সুন্দর ছবির মত ফ্ল্যাটটারই এদিক ওদিক ভেঙে নতুন করে আরাে আধুনিক মডেলে তৈরি করা হচ্ছে। চলছে ভারই প্রস্তুতি। সবসময় মিস্ত্রিদের হাঁকডাক লেগেই আছে। বালি, সিমেন্ট অনবরত ট্রাক থেকে নামছে। রাস্তায়।
যাতায়াত দুষ্কর হয়ে পড়েছে। জ্যাম লেগে যাচ্ছে আর পথচারীদের পরস্পর ঝগড়া তাে আছেই।
অভিজ্ঞতার সেই অভিশপ্ত দিনে প্রতিদিনের মত সেদিনও বিকেলবেলা আমি মামাতাে বােনেদের সঙ্গে রাস্তার ধারের বারান্দায় বসে গল্প করছি। দিনটা রবিবারই হবে বােধ হয়। গল্প করতে করতে হঠাৎ কানে এল বিভিন্ন মিলিত কণ্ঠের ভয়ার্ত চিৎকার; আতঙ্কিত মানুষজনের আর্তনাদ। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি রাস্তায় মানুষজন এলােপাথারি ছুটোছুটি করছে। কিছু বােঝার আগেই চিৎকার কোলাহলে মাঝে দৌড়ে রা্তায় নেমে দেখি এক ভয়ঙ্কর হাড়হিম করা দৃশ্য! মাথাহীন এক মােটরসাইকেল আরােহী উর্ধ্বশ্বাসে মােটর সাইকেল চালিয়ে | মামার বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে ছুটে আসছে। গলা থেকে ফিনকি দিয়ে রাস্তায় রক্ত ছিটকে পড়ছে। মাথা নেই, অথচ এক কবন্ধ মােটর সাইকেল চালাচ্ছে ! দৃশ্যটা একবার ভাব। আর এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে লােকজন আতঙ্কে যেদিকে পারছে ছুটে পালাচ্ছে। সামনে আসা একটি ট্রাক অবস্থার সামাল দিল। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে 1. ধাক্কা দিয়ে মােটর সাইকেল চালককে ফেলে দিল। তা না হলে মােটর সাইকেলটা কোথায় থামত কে জানে। লিখতে সময় লাগলেও ঘটনাটা ঘটে গেল পলকের মধ্যেই। এখন টিভির নানা ভৌতিক শাে দেখার দৌলতে এই দৃশ্য মােটামুটি অনেকের পরিচিত। কিন্তু আজ প্রায় ১৭ বছর আগে এই ঘটনা সত্যিই মারাত্মক।
পরে জানলাম, আসলে হয়েছে কী জানাে ? আগেই বলেছি, রবীন মামাদের বাড়ি মেরামতের কাজ চলছে। ওদের বাড়ির সামনের রাস্তায় ট্রাক থেকে রড নামানাে হচ্ছিল। সেই সময় ঐ হতভাগ্য মােটর সাইকেল আরােহী পাশ দিয়ে আসছিল। কিন্তু ট্রাকের উপরের এক শ্রমিকের হাত থেকে হঠাৎ একটি ভারী রড সেই আরােহীর ঘারে এসে পড়ে। রড মানে কিন্তু সরু শিকগুলাে নয়, খুব ভারী ধারালাে রড। মুহর্তের মধ্যেই ধড় থেকে মাথাটা আলাদা হয়ে ছিটকে পড়ে রাস্তায়। কিন্তু যেহেতু মােটর সাইকেল চালু ছিল এবং হাত দুটি শক্ত করে হ্যান্ডেল ধরে ছিল তাই ঐ অবস্থাতেও মােটর সাইকেল চলতে থাকে। এগুলি পরে অবশ্য প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে জানতে পারলাম। আর পরের ঘটনার তাে আমিই প্রত্যক্ষ্যদর্শী। ট্রাকটা ধাক্কা দিয়ে মােটর সাইকেলটা না থামালে এই বীভৎস ঘটনার ইতি কখন হত তা ঈশ্বরই জানেন। সেদিন যে ভয়ঙ্কর দৃশ্য আমি প্রত্যক্ষ করেছিলাম কি করে তা বিস্মৃত হই? মনে আছে পর পর চার রাত ঘুমােতে পারিনি। চোখ বুজলেই চোখের সামনে ভেসে উঠত সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য। আমার অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে এখনও পর্যন্ত আর এমন বেদনার্ত ঘটনা ঘটেনি। আর যেন না ঘটে তা পরম-করুণাময় ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি।

