ওরা কারা ?
ওরা কারা ?




সময়টা ছিল গ্রীষ্মকাল, মাসটা ছিল বৈশাখের প্রায় মেঘ, দিনের দিকে সূর্যের দাবদাহ এতই বেশি ছিল যে মনে হতাে উদ্দীরণ করছে। কাজেই দিনে তাে স্বস্তি নেই ই, এমনকি টানা কয়েকদিনের প্রচণ্ড গরমে রাতে ঘুম নেই। চারিদিকে যেন এক অস্বস্তিকর পরিবেশ।
এইরকম কিছুদিন তীব্র গরমের পর হঠাৎ একদিন বিকেলে কালবৈশাখীর তাণ্ডবে ঘন্টাখানেক শিলাবৃষ্টির পর চারিদিক কিছুটা ঠাণ্ডা হল। তাই পরিকল্পনা করলাম বারান্দায় না শুয়ে উপরে তলায় কোঠায় ঘরের জানালার সামনে ঘুমাবাে। মা তাতে রাজি হয়ে তাড়াতাড়ি ভাত বসিয়ে দিলেন। তখন হবে রাত ৯টা। আমি বিছানা-পত্তর সব ঠিক করছি। আমরা বিছানায় শুলাম প্রায় রাত ১০-৩০ টায়।
আমাদের বাড়ির পিছনদিকে একটি বহু প্রাচীন বটগাছ ছিল। সেই গাছটায় একটা ফোকর ছিল, তাই
আমরা গাছটিকে ফোকলা বুড়াের গাছ বলতাম, সেখানেই আমাদের খেলার আয়ােজন হত। অনেকে আবার
রাতে সেখানে বাঁধা খাটিয়ে শুতে। কিন্তু বর্তমানে বিজ্ঞান বিশ্বাসী মানুষদের প্রভাবে রাত্রে সেখানে আর
কাউকে ঘুমোতে দেখা যায় না। কিন্তু সেদিন রাতে ১০-৩০ টাতেও বেশ কয়েকজন লােককে সেখানে আড্ডা দিতে দেখেছিলাম। মনে হল তারা অন্ধকারে বসেছিল। অবশ্য এক পশলা শিলাবৃদ্টি বিকেলে হয়ে যাওয়ায় আকাশে হাল্কা মেঘের আনাগােনা ছিল। কিন্তু জ্যোৎস্নার মিষ্টি আলােয় বাইরেটা বেশ দেখা যাচ্ছিল জানালা থেকে। পরিষ্কার দেখা গেলেও চেনা যাচ্ছিল না। তাছাড়া বিকেলে একটু দমকা ঝড়ের প্রভাবে বৈদুত্যিক সংযােগ বিচ্ছিন্ন ছিল, তাই রাস্তাঘাটে কোনাে আলাে ছিল না। আমি ভাবলাম ওপারের বিয়েবাড়ির লােকজন হবে হয়তাে কেননা সেখানে একটা বিয়ের নৈশ ভােজনের আয়ােজন পুরােদমে চলছিল। তাই বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে আমরা ঘুমের
স্থিতিকাল কমাতে চাইলাম না। পরদিন অন্যান্য দিনের চেয়ে আগেই ঘুম ভেঙে গেল। এদিক ওদিক থেকে বেশ কোলাহলের জন্য প্রথমে একটু বিরক্তি অনুভব করলাম। পরে নীচে নামতেই একটা অন্য আলােচনার প্রতি কৌতুহল জাগল। তাই নিজের মুখটি না ধুয়েই মায়ের আতঙ্কগ্রস্ত মুখ কাছে এসে বলল – “গ্রামের প্রধান খুন হয়েছে।"
কথাটা বলতেই আমার ঘুমের রেশটুকু চোখ থেকে উধাও হয়ে গেল। তাই ফের প্রশ্ন করলাম "কী করে খুন হল ?" মা আবার আগের মতাে জবাব দিল - "একদল দুষকৃতি এই কাজ করেছে”। শুনে আর স্থির থাকতে পারলাম না। তাই পরনে যা ছিল, তাই পরেই বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পরলাম। ও পাড়ার এক বন্ধুর পথ থেকে জানলাম একদল ভাড়াটে গুণ্ডা দল এসে প্রধানকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গ্রামের বাইরে
ক্যানেলপাড়ের রাস্তার মােড়ে কাঁচাপুকুরের উত্তরপারে এনে মেরেছে। তার মস্তিষ্ক বিহীন নিথর দেহটা সেখানে পড়ে আছে। কাছে যেতেই, দেহটা দেখতেই মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করে উঠল। সেখানে বন্ত লােকের ভিড়ে চুপটি করে একপাশে বসে পড়লাম।
দেখতে দেখতেই পুলিশ সেখানে এসে পৌঁছাল। সেখানে ও পরে প্রধানের বাড়িতে গিয়ে নানা জিজ্ঞাসাবাদ করল। বাড়িয় লােকেরা যথারীতি শােস্ত থাকায়, আবেগে ঠিকমতাে জবাব দিতে পারছিল না। | কিন্তু এক প্রবীণ প্রতিবেশী কমলবাবু সংযত হয়ে যা যা বললেন, তা এই হল যে - মানুষটা খুবই দয়ালু এবং প্রকৃত সমাজসেবী ছিলেন। সর্বদা তিনি হাসি-খুশি থাকতেন। অপার দয়া শুধু এ গ্রাম কেন-আশেপাশের গ্রামগুলিতেও হাসি, সুখ এনে দিয়েছিল। তার কোনওরকম নেশা ছিল না। গ্রামের মন্দিরের আটচালায় সন্ধ্যা হলেই খােল-করতাল নিয়ে কীর্তনে বসতেন। এছাড়া এইসব নিয়ে পদাবলি, জীবনমুখী গান শুনতেন। আজকালকার দিনে যেখানে সদস্যারা বাদশাতে পরিণত হচ্ছে সেখানে তিনি একদমই রাজনৈতিক কু-পরামর্শের দিকে যেতেন না। তার অন্যের দুঃখে কাতর হওয়ার স্বভাব তৈরি হয়েছিল। তাই এই এলাকার মানুষ তার নামে আত্মহারা, তাঁর জনপ্রিয়তার অভাব ছিল না।
কিন্তু, এই আপনভােলা লােকটি বিগত কয়েকমাস থেকে কেমন যেন শুমড়ে গুমড়ে থাকতেন। কাৱো সঙ্গে ঠিক মতো কথাবার্তা বলতেন না। মন্দিৱেও আসতেন না। জিজ্ঞাসা করলেও কখনাে কিছু বলতেন না। কিন্তু আমরা সবাই জানলাম পাশের গ্রামের বিরােধী দলনেতা দুঃশাসনবাবু তাকে ভালাে নজরে দেখত না। ইদানীং তার দলের সঙ্গে তার প্রায়ই এই গ্রামে এসে বিরোধ হত, তখন ওরা কখনাে এনাকে, কখনাে ওনাকে বা সাধারণ মানুষদের হুমকি দিয়ে যেত।
তার উপর ঘটনার দিন তিনেক আগে থেকে গোটা দশেক অজানা ছােকরা গ্রামের অলি গলিতে ও জমায়েত হয়ে আজ্ঞা দিত। কখনও বা প্রধানের বাড়িটাকে লক্ষ্য করে নিজেদের মধ্যে ইশারায় কিছু আলােচনা করত। এমনি ঘটনার কিছুদিন আগেই তিনি এক বিধবা মেয়েকে বিবাহ করেছিলেন। তাই, এত ভালাে মানুষটার এই হালে সবাই মাথায় হাত দিয়ে বসেছে।
সেদিন গ্রামের সব দোকান বাজার বন্ধ হয়ে গেল। স্কুল খােলা থাকলেও গ্রামের শিক্ষক, ছাত্ররা একানে এসে হাজির। সবার মুখে দুঃখের ছায়া। আমার মনও তার অনুপস্থিতিতে ব্যাকুল হয়ে উঠল। বাড়ি ফিরে সােজা উপরে গিয়ে যেখান থেকে আগের রাতে ঐ রহস্যজনকভাবে বটগাছতলায় জনাদশেক
লােককে দেখেছিলাম, তেমনি আবার ঐ স্থানটা ভালাে করে লক্ষ্য করলাম। আর মনে মনে নিজেকে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম - ওরা কারা ছিল? সত্যিই কি ওরা বাইরের মানুষ। তাহলে কি ওরাই প্রধানকে খুন করেছে? আর অনুশোচনীয় মনে হতে লাগলাম। আর আমি বললাম - কেন আমি ঐ সময় গলা ফাটিয়ে জানতে চাইলাম না। -"এত রাত্রে তােমরা এখানে কী করছ? তােমরা কারা ?"