রাতের মতোই কালো
রাতের মতোই কালো
গত ১৫দিন ধরে নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছিল। কারণ কিছু তেই রাতের ঘুম হচ্ছিল না।সেই একই আওয়াজ রোজ শুনতে আর ভালো লাগছিল না।
রাত সাড়ে 11 টার পর থেকে আওয়াজ টা শুরু হয় এবং ভোর রাত অব্দি আওয়াজটা মাথার ভিতরে ঢুকে পাগল করে দিচ্ছে আমায়।
১৫দিন আগে টিউশন দিয়ে বাড়ি আসার সময় রাস্তার ধারে দেখি দুটো কালো বিড়াল মারামারি করছে। দুটো বিড়ালের মারামারি এতটাই হচ্ছিল দুজনে মারামারি করতে করতে রাস্তার উপরে আমার পায়ের কাছে চলে এসেছিল। আমি ঘাবড়ে গিয়ে রাস্তা সাইট থেকে একটা অর্ধেক ইট তুলে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ওদের পাশে ফেলবো ওরা ভয় পেয়ে পালিয়ে যাবে ।
আমার টিপ টা এতটাই খারাপ ছিল ভুলবশত একটি বিড়ালের মাথায় লেগে যায়।
বিড়ালটির মাথায় লাগার সাথে সাথে কাঁপতে কাঁপতে ওখানেই পড়ে নিথর হয়ে যায়। এবং আরেকটি বিড়াল পালিয়ে যায় ওখান থেকে ।এবং দূরে কি আমার দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে এক দৃষ্টিতে।
আমার অনিচ্ছার সত্ত্বেও বিড়ালটিকে আমি মেরে ফেলেছিলাম। বিড়ালটি কে মারার পর মনটা একদম খারাপ হয়ে যায়। আমি কখনোই কোন প্রাণীকে এভাবে মারিনি। আমি মারতেও চাইনি ওকে ইচ্ছা করে ! নেহাত ঘাবড়ে গিয়েছিলাম তাই।
তখন কি করব বুঝতে পারছিলাম না। মরা বিড়াল টার দিকে তাকিয়ে দেখি মুখটা হা হয়ে আছে আর বিড়লটির চোখের কোনে বিন্দু বিন্দু জল। দেখে এতটাই খারাপ লাগছিল আমার চোখ থেকেও টপ টপ করে কয়েক ফোঁটা জল পড়তে লাগলো।
আমার ব্যাগে জলের বোতল ছিল। জলের বোতলের ছিপি টা খুলে বিড়ালটির মৃত মুখে কিছুটা জল দিয়ে দিলাম। মনে মনে তার কাছে ক্ষমা চাইলাম নিজের কৃতকার্যের জন্য।
হঠাৎ রাস্তার সাইডে কিছু ঝোপের থেকে অনেকগুলি বিড়ালের একসাথে মিউ মিউ ডাক শুনতে পেলাম।
অবাক হয়ে ভালোভাবে তাকাতেই দেখি ওখানে কতগুলি বাচ্চা বিড়াল ছানা ডাকাডাকি করছে। হয়তো এই যে বিড়ালটিকে আমি মেরে ফেলেছি এর বাচ্চা,,,,
নিজেকে কেমন পাপী মনে হচ্ছিল।
অনেক কষ্ট করে মনটাকে সামলে বাড়ি চলে এলাম।
বাড়ি এসে সব কথা মাকে বললাম। মায়ের ও মনটা খারাপ হয়ে গেল কথাটা শুনে। রাতে খাবার খেয়ে শুয়ে পড়েছি। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম যে, আজ যেটা করলাম সেটা ঠিক হয়নি।
হয়তো এই কাজের শাস্তি আমি একদিন ঠিক পাব। এসব ভাবতে ভাবতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম,,,,
ঠিক কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম খেয়াল নেই।
হঠাৎ কিসের একটা শব্দে আমার ঘুমটা ভেঙে যায়।
পাশের টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালালাম, চোখ খুলে চারিদিকে দেখতে থাকি । কানে শুনতে পেলাম বাইরের বৃষ্টির অবিরাম চিৎকার । তার সাথে বিদ্যুতের চমক, হাওয়ার দাপটে
জানলার পাল্লা টা খুলে গিয়ে হয়তো এমন শব্দ হচ্ছিল।এটা ভেবে নিয়ে উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম।
বিছানায় শুয়ে হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে চোখ গেল সামনের দেয়ালে। মনে হল দেয়ালের উপর ঠিক লিকলিকে লম্বা একটা প্রতিকৃতি ফুটে উঠল।
আধো আলো অন্ধকারে মনে হল একটা বড় বিড়াল। Normal বিড়ালের আকৃতির তুলনায় এটা আকারে বিশাল। আকৃতিতে সামনের পুরো দেয়াল জুড়ে রয়েছে। হঠাৎ যেন সেই ছায়াটা আস্তে আস্তে আবার ছোট আকার ধারণ করে জমাট বাঁধা অন্ধকারের মতো একটু একটু করে খসখস শব্দ করে আমার বিছানার তলায় চলে গেল।
চোখের ভুল ভেবে আলো নিভিয়ে শুয়ে পরলাম।
কিছুক্ষণ চোখ বুজে এপাশ-ওপাশ করার পরেও ঘুম এলো না। নাকে এলো কেমন একটা আঁশটে গন্ধ।
ঘরের ভিতর কেমন একটা কালো জমাট বাঁধা অস্বস্তিকর হাওয়া যেন ঘুর পাক খাচ্ছে।
নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতে থাকলো।
কিছুক্ষণ এইভাবে এপাশ-ওপাশ করে অবশেষে উঠে বসলাম।
দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি ১:১৭
ভাবলাম ঘুম যখন আসছে না একটা বই নিয়ে পড়তে থাকি । পাশের টেবিল থেকে একটা বই তুলে নিয়ে পড়তে থাকি। এভাবে কিছুক্ষণ করতে থাকার পর অবশেষে ক্লান্তিতে আবার ঘুম পেতে লাগল।
সবে বই রেখে শুতে যাব ঠিক এমন সময়
ঘুমাচ্ছন্ন চোখে কান পেতে শুনতে পেলাম ,,,,আমার ঘরের দরজার ঠিক বাইরে একটা বিড়াল ডাকছে, প্রথমটা ভেবেছিলাম হয়তো ভুল শুনছি। ধীরে ধীরে আওয়াজটা যেন বাড়তে লাগলো। ধীরে ধীরে আওয়াজটা এতটাই জোরে হতে শুরু করল যে। দুকান চেপে ধরে রাখার পরেও আওয়াজটা প্রচন্ড কানে লাগছিল।একটানা কান্নার মতো শুনাচ্ছিল।
আমি বেড রুমের লাইটটা জ্বালিয়ে ঘরের দরজাটা খুললাম। ঘরের সামনে একটি শিউলি ফুলের গাছ ছিল। গাছটার নিচে আধো আলো অন্ধকারের মধ্যে দেখি দুটো চোখ একটানা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ঘুম চোখে ভুলভাল দেখছি ভেবে চোখ দুটোকে রগড়ে নিয়ে আবার ভাল করে তাকালাম। না ঠিক দেখছি চোখের সামনে,
আধো অন্ধকার হলেও আমি বুঝতে পারলাম একটা বেড়াল ,,এটা অন্য কোনো বিড়াল না সেই বিড়ালটা যেটাকে আমি আজ সন্ধ্যায় মেরেছিলাম। কারন বিড়ালটির মুখের একপাশ থেতলে আছে ।
বুকটা ঠান্ডা হয়ে গেল। শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত এর ধারা নেমে গেল। কবে যেন ইতিহাস বই তে পড়েছিলাম মিশরের লোকেরা বিশ্বাস করত সব প্রাণীরই মরে যাবার পরে তার পেতাত্মা পৃথিবীতে থেকে যায়।
বিড়ালটা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে এক পা এক পা করে আমার দিকে আসতে লাগলো। দেখতে পেলাম বৃষ্টির জলধারার সাথে বয়ে চলেছে বিড়ালটা মাথা থেকে বেরিয়ে আসা রক্তের ধারা।
আমার পা দুটো যেন কোন অলৌকিক শক্তির কারণে সেখান থেকে নড়তে পারলাম না। বিড়াল টা আস্তে আস্তে একটা গোঙানির শব্দ করে এগিয়ে আসছে । ঠিক এখন আমার থেকে ঠিক পাঁচ হাত দূরে। শরীরে যত টুকু শক্তি অবশিষ্ট ছিল সবটুকু দিয়ে সাহস করে
দরজার পাল্লাটা দুম করে বন্ধ করে দিলাম। দৌড়ে এসে খাটের উপর উঠে বিছানার চাদরের ভেতর মুখ ঢুকিয়ে চুপ করে শুয়ে থাকলাম,,,
বিড়ালটি তখন এর মত আবারও একই রকম ভাবে ডাকতে শুরু করেছে,,,,,, একটানা মেউ মেউ মেউ,,,,,
তারপর থেকে রোজ রাতে ওই আওয়াজটা হতে থাকে,,,,, আমি যেখানেই যাই আমি যত দূরেই যাই ওই আওয়াজটা রোজ আমাকে অনুসরণ করতে থাকে,,,,,রাতের অন্ধকারের মতো সে রোজ ফিরে ফিরে আসে।
আমি কিছুতেই ওর থেকে নিস্তার পাই না,অনেক থেরাপিস্ট দেখিয়োও কোন লাভ হয়নি,
হয়তো আমার মৃত্যুর আগে অব্দি এটা চলতে থাকবে।

