সমাধান
সমাধান
না! এভাবে আর চলতে পারে না–সতেরো বছর আগে অভি আর মিতার ভাবনা ফিরে এলো আজ তন্বীর জীবনে।
সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে অভি আর মিতা দুজনেই আজ দুই মেরুতে অবস্থান করে; একসাথে পথচলার শপথ করে অগ্নিকে সাক্ষী রেখে সাতপাঁক ঘুরলেও বিয়ের দু'বছর যেতে না যেতেই শুরু হয় ভুল বোঝাবুঝি-দ্বন্দ্ব। সম্পর্কটা শিউলির ফুলের মতন ফুটলেও তা ঝরে পড়ল ভোর হতেই। তন্বীর বয়স যখন মাত্র চারমাস তখনই হঠাৎ একদিন হারিয়ে গেল অভি-সে আজও নিখোঁজ। সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ল মিতার উপর; অন্ধকার ক্রমাগত গভীর হতে লাগল। ঐ ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাবে-কি করবে কিছুই সে বুঝে উঠতে পারছিল না, অগত্যা দ্বারস্থ হল সে বাপের বাড়ির। অভি-মিতার বিয়ে কোনো বাড়িতেই মেনে নেয়নি, জাতি নামক এক শক্ত দেয়াল দাঁড়িয়ে ছিল মাঝে। দুর্ভাগ্যবশত এই দুঃসময়েও মিতাকে না-ই শুনতে হল। খালি হাতে কাঁদতে কাঁদতে সে আবার বাড়ি ফিরে এলো। সময়ের সাথে সাথে নিজেকে শক্ত করে তুলল সে, তন্বীকে মানুষ করতে হবে আর নিজেকেও পরিচয় করাতে হবে সমাজের সামনে। সিঙ্গেল মাদার কথাটা তার কাছে গর্বের মনে হল। অভি যেতে যেতে এইটুকুই তো পরিচয় উপহার দিয়ে গেছে তাকে। একটা ছোট্ট কোম্পানিতে কাজে ঢুকল সে, যা আসে তাতে দুজনের চলে গেলেই হবে। তন্বীও এবার ধীরে ধীরে বড়ো হতে লাগল, মা-মেয়ে মিলে একটা কান্নাচাপা হাসির সংসার গড়ে তুলেছিল।
সময়ের চেয়ে শক্তিশালী আর কিছুই হয় না পৃথিবীতে, আবারও শুরু হল একটা লুকোচুরি খেলা। তন্বীর জীবনে তার মা কখনোই সেভাবে কোনো অভাব রাখতে চায়নি, যথাসম্ভব চেষ্টা করেছে প্রতিমুহূর্তে তাকে একটা সুস্থ সুন্দর জীবন দেওয়ায়।
ক্লাস ইলেভন। গুটিগুটি পায়ে সেই দৈত্যের বাগানের পাঁচিলের ফুটো দিয়েই বসন্ত এলো তন্বীর জীবনেও। আবীর রাঙা আকাশ-লাল পলাশীর অভিসার; সমান্তরাল ভাবেই চলতে থাকে পাতাঝরা বসন্ত। তন্বী আর সূরজ যেন আয়নার অন্যপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা অভি আর মিতা। ভালোবাসা মানুষকে অন্ধ করে দেয় নাকি অন্ধ মানুষের জীবনেই ভালোবাসা আসে-এ হিসেব মেলেনি কখনোই। তন্বীও ঠিক সেভাবেই সূরজকে তার সবটুকু উজাড় করে দিয়ে ভালোবাসতে থাকে; আবেগপ্রবণ স্পর্শের ফলস্বরূপ তন্বী সন্তানসম্ভবা হয়ে ওঠে যা অপ্রকাশিতই থেকে যায় ময়নাতদন্তের রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত। মিতার তিলতিল গড়ে তোলা সকল স্বপ্নের ছাই হতে সময় লাগে মোটে বিশটা মিনিট; অভি হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে মিতা বারবার ভেবেছে তন্বী একদিন ঠিক করবেই সব। ভালোবাসা যে ছাই চাপা আগুনের মতন; একটু হাওয়া দিলেই স্ফুলিঙ্গ উড়ে যায়।
চারদিন হয়ে গেল তন্বীর বালিশটা ফাঁকা আছে, সে আর কোনোদিনই মাথা রাখবে না। ভুল তো মানুষ মাত্রই হয়, কিন্তু ভুলের মাশুল জীবনের মূল্য দিয়ে মেটানো তো যায় না কখনো। তুমি একটা ভুলকে ঢাকতে পাপকে জড়িয়ে ধরছ; ভুলের ক্ষমা হয়-পাপের শাস্তি হয়। মিতার জীবনটা আবার ঠিক ঘড়ির কাঁটার মতন ঘুরে দাঁড়িয়ে পড়েছে সতেরো বছর আগেই, অভি অন্ধকারে মিলিয়ে গেছল আর তন্বী হাওয়ায় মিশে গেল। মাত্র চারমাস বয়সের তন্বীকে কোলে নিয়ে সেদিন যে মিতা ভেবেছিল, এটা আমার হার নয়-আমার নতুন যুদ্ধের সূচনা সেই মিতাই আজ মেয়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে একটাই প্রশ্ন রাখল - এভাবে আমাকে হারিয়ে দিয়ে তুই কি জিততে পারলি তন্বী?