স্কুলজীবন
স্কুলজীবন
হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা
যাও বারো তেরো করে আন...'
ছোট মেয়েটি হাঁ করে তাকিয়ে থাকে বক্তার দিকে। তারপরে চোখ নামিয়ে দেখে তার হাতে ধরিয়ে দেওয়া বইটার দিকে, আবার মুখ তুলে চায় একটু দূরে বসে থাকা মায়ের দিকে। তাকে একটা আধো অন্ধকার ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। খাতা- পেন্সিল ধরিয়ে দেওয়ার পরেও সে বুঝে উঠতে পারে না তাকে কী করতে হবে...
স্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়ে মালবিকা তুলে আনেন কিছু কিছু মণিরতন। প্রৌঢ়ত্বের চৌকাঠে পা দিয়ে পেছনে ফিরে দেখতে বেশ ভালই লাগে তাঁর।
এই ঘটনাটা আগে নাকি সাদা ফ্রক, নীল বেল্টের লরেটো স্কুল… ঠিক মনে পড়ে না। একটু পরেই চোখ মুছতে মুছতে মেয়েটি এসে দাঁড়ায় সেইখানে, যেখান থেকে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল। মা জিজ্ঞেস করেন, 'কী হল, কান্না কেন?'
'বারো- তেরো জানি না...'
স্মৃতি শত্রুতা করে, বাকি সব ঝাপসা। বরঞ্চ মনে পড়ে, মার হাত ধরে ট্রেনে করে শেয়ালদার লরেটোতে পড়তে যাওয়ার কথা। নার্সারি ক্লাস। যখন ইচ্ছে ব্যাগ থেকে আপেল বা কমলালেবু বার করে খেলেই হল। বালির পাহাড় বানিয়ে চলে খেলা। কী জানি কেন যেন সে স্কুলের পাট চুকে যায়। মলির মা’কে সিস্টাররা নাকি কথা দিয়েছিলেন ভর্তির সময়ে, ছ'মাসের মাথায় প্রোমোশান দেওয়া হবে… তা দেওয়া হয়নি তাছাড়া মা’র কথামত সে স্কুলে পড়াশোনা কিছুই হতো না। চার বছরের বাচ্চাকে কী এমন পড়াশোনা করাবে, সেযুগে তো আজকের মত এত চাপও ছিল না।
বাবার পোস্টিং হয়ে যায় এয়ারপোর্টে, অতএব এয়ারপোর্ট স্কুল। সেখানে তো অবাধ স্বাধীনতা, ছাড়া গরু। বাড়ি থেকে দল বেঁধে হাঁটতে হাঁটতে স্কুলে যাওয়া, ঘন কদম বনের মাঝে সরু পায়ে হাঁটা রাস্তা ধরে। বড় রাস্তায় উঠে, রাস্তাটা বেঁকে যায় গোরস্থানের ধার ঘেঁসে। হাঁটার সাথে সাথে চলতে থাকে, যতরকম মুখোরোচক ভূতের গল্প।গল্প তো শোনাতো বকুল মামাও। তখন এয়ারপোর্ট কোয়ার্টার্সে। বিরাট বাড়ি। বাবা প্রায়ই বাড়ি থাকেন না, ওইটুকু ছোট মেয়ে নিয়ে অল্প বয়েসী মায়ের ভয় করে, তাই একটি পরিবারকে থাকতে দেওয়া হয়। সেই কাকিমার ভাই মাঝে মাঝে থাকতে আসেন দিদির বাড়ি… মা’কেও তিনি দিদি বলে ডাকেন।
সেই রাতে আলো ছিল না। মা ইলিশ মাছ রান্না করেছিলেন। পেটির মাছের তলার দিকটাকে মলি বলতো 'ধোপার বাঁশ'। মা খাইয়ে দিচ্ছেন। গলায় অসম্ভব ব্যথা, কিছু গিলতে পারছে না, জ্বরও এসেছে। বকুলমামা ডেকে নিলেন। গরমের দিন, শুধুমাত্র ইজের পরা টিংটিংএ রোগা গল্প পাগল মেয়েটাকে নিজের পাশে বিছানায় শুইয়ে গল্প শোনাতে লাগলেন। অন্ধকার রাতে তাঁর আগ্রহী হাতদুটো পাঁচ বছরের মলির খোলা বুকে কী যেন খুঁজে বেড়িয়েছিল সেদিন… আজ মলি বুঝতে পারে, সে যেন নিছক মামার আদর ছিল না।
পরের দিন জানা গেল গলা ব্যথার কারণ 'মাম্পস'। মার হাতের মুসুরের ডাল দিয়ে রাঁধা সাবুর খিচুড়ি আজও যেন মুখে লেগে আছে। টনসিলের সমস্যা ছিল, প্রায়ই সে ভুগতো জ্বরে। মা জোর করে দুধ সাবু খাওয়াতেন, খেতেই হোত কিন্তু তার পরে আলুমরিচের আশায় দুধ সাবুটা ঢক ঢক করে গিলে ফেলতে অসুবিধে হতনা। প্রায়ই স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে আসতে হত, গলা- কান ব্যথা আর জ্বর...
সেই যুগের কোএডুকেশন স্কুল। মালবিকার তো প্রায় সব বন্ধুই ছেলে- যতরকমের বাউন্ডুলেপনা আর তার ফলস্বরুপ শাস্তিলাভ! সবই সাথে সাথে চলতে থাকে। স্কুলে কোনও বাউন্ডারি ওয়াল নেই, নেই দুষ্টুমিরও। যখন ইচ্ছে ক্লাস থেকে বেরিয়ে ঘুরে বেড়াও, নেই কোনও রোক টোক। বনে- বাদাড়ে, আঁদাড়ে- পাঁদাড়ে ঘুরেই সময় কাটে। রেসাল্ট তো জানা যাবে রিপোর্ট এলে… স্কুল থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তা পার হওয়ার সময়ে একদিন ক্যাচ কট কট… বাবা অফিস বাসে ডিউটিতে যাচ্ছিলেন।
'কোথায় যাচ্ছিস?'
'আমার খিদে পেয়েছে।'
বাবা সঙ্গে করে দোকানে নিয়ে গিয়ে খাবার কিনে দিয়ে আবার খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে দেন। টিফিনের ছুটিতে আবার পলায়ন… পালাবার কি আছে, ছুটিই তো।
দুই বন্ধুতে মাটির জন্তু জানোয়ার বানিয়ে, একমাত্র প্রাপ্ত রঙ, কাপড়ের নীলে ডুবিয়ে তাদের নীলবর্ণ শৃগালে রূপান্তরিত ক'রে তাদের সৌন্দর্যে আর নিজেদের শিল্পীসত্ত্বার অভাবনীয়তায় বিহ্বল হয়ে গিয়ে মনেই থাকে না টিফিন শেষের ঘন্টা কখন যেন বেজে গেছে। ছোট ছোট দুই পড়ুয়া, শ্রেণীর দরজার দুপাশে দ্বাররক্ষীর কাজ পেয়ে সেদিনের মত শেষ করল স্কুল। ফেরৎ পথে কতরকম লোভনীয় ব্যাপার যে হাতছানি দেয়। কারুর বাড়ির বারান্দায় দোলনা বাঁধা… সে কী ছাড়া যায়? কালো কারেন্ট নুন মাখানো ছোট ছোট কুল, হজমি, আলু কাবলি… কিন্তু পয়সা কই?
একবার অনেক সাহস করে, বাবার রাখা খুচরো পয়সা থেকে সরানো একটা পাঁচ নয়া- ছোট্ট একটা কৌটোতে করে স্কুলের ব্যাগে ভরে নিয়ে স্কুলে গেল সে, অনেক আশা নিয়ে। হজমি খাবে। কি আপদ! সেদিন বাবা নিতে এলেন স্কুল থেকে।পয়সার কৌটোটা বন্ধুর হাতে তুলে দিতে গিয়ে হৃদয়টা যে বাইরে বেরিয়ে আসছিল ঝটফট করতে করতে… কিন্তু প্রমিস তো প্রমিস, তাও আবার বন্ধুদের কাছে।
খুব ছোট বয়েসেই পড়াশোনা শুরু করেছিলো মালবিকা। এয়ারপোর্ট স্কুলে ক্লাস ফোরে প্রোমোশন পেল সে, সেই সময়েই বাবারও বদলি হয়ে গেল। এয়ারপোর্টেই আলাপ হয়েছিলো প্রেস্টোনউড ব্যাপ্টিস্ট চার্চের সিস্টার সেবাস্টিয়ানের সঙ্গে। বাবা তাঁকে অনেক ভাবে সাহায্য করেছিলেন, সিস্টার চাইলেন কোনোভাবে তা ফিরিয়ে দিতে।
'তুমাকে হামি কীভাবে হেল্প করিতে পারি ব্যান্ডোপাঢ্যায়...?'
বিষয়বুদ্ধিহীন, সংসারে উদাসীন... মলির বাবার মাথায় হঠাৎ শুভবুদ্ধির উদয় হল।
'আমার মেয়েকে যদি তোমাদের স্কুলে নাও...' সিস্টার তখনই কথা দিতে না পারলেও আশ্বাস দেন। কিছুদিন পরেই ডাক আসে এডমিশন টেস্টের। তাড়াহুড়ো করে একজন শিক্ষক ঠিক করে ফেলেন মা, মলিকে তৈরী করতে।
মা নিজেও তখন একটি স্কুলে পড়াতে শুরু করেছেন, তাঁর একদমই সময় হয় না।
প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা মাষ্টারমশাই আসেন। আগের দিনের দিয়ে যাওয়া কাজ কিছুই মলি করে রাখে না… সারাদিনে কত রকমের কাজ যে তাকে করতে হয়... মিটার বাক্স থেকে টিকটিকির ডিম খুঁজে বার করা, রাস্তা সারানোর পিচের গাড়ি থেকে গলা পিচ নিয়ে তাই দিয়ে বল বানানো, কাঁচের বোতলে রাজ্যের ব্যাঙ্গাচি এনে জমা করা… তারা নাকি মাছ। প্রজাপতি ধরে তার পায়ে ফুলের ডাঁটি ধরিয়ে দিলে সে কেমন সে ডাঁটি ঘোরাতে থাকে। চীজের খালি টিনের কৌটোতে চাল আর জল দিয়ে রোদে রেখে এসে বার বার দেখা, ভাত হতে কতক্ষণ লাগে। পোষা কুকুর বুকুর ভরণ পোষণ… মার চোখ এড়িয়ে নিজের ভাগের মাছ- মাংস- ডিম তাকে খাওয়ানো। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে চুটিয়ে গুলি আর ডাঙ্গুলি খেলা… সব কটি এক্টিভিটির পরেই ফিরে এসে খালি বাড়িতে মায়ের হাতখোলা মার। মারে তো তার কিছুই যায় আসে না, পার্ট অফ লাইফ! কিন্তু অত কষ্টে জিতে আনা গুলি গুলো যে মা টান মেরে ভাগাড়ে ফেলে দিলেন...
পড়তে বসেই মলি ঢুলতে থাকে, মাষ্টারমশাই কী সব যেন বলে যান, মলি খাতার পাতার ওপরের দিকে লিখতে শুরু করে... আঁকড়ি বাঁকড়ি নীচের দিকে নামতে থাকে। মাষ্টারমশাই তো তাঁর সম্মানমূল্য পেয়েই খুশি।
প্রবেশ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের লেখাগুলো কালো পিঁপড়ের মত চোখের সামনে নাচতে থাকে… কিছুই বোধগম্য হয় না। সাহায্যের আশায় সে বাইরে বেরিয়ে আসে। নজর যায় নীচে অপেক্ষারত মা- বাবার দিকে… ব্যাস! আর তাকে পরীক্ষা কক্ষে ঢোকানো যায় না।
চতুর্থ শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়া মলিকে কলকাতার নামী স্কুলটি ভর্তি নিতে চাইলো দ্বিতীয় শ্রেণীতে। বাবা নারাজ, মা বোঝালেন, 'বয়েস কম আছে... ভাল, কড়া স্কুল; ছেড় না।
স্কুলের প্রথম দিনেই মালবিকা খেল জোর ধাক্কা। পুরো লাইন ভরে লিখতে দেখে শিক্ষিকা তো এই মারেন কি সেই মারেন। সেলাই ক্লাসে, ক্লাস টু এর ছাত্রীকে শাস্তি পেতে হল কেন না সে উল্টো বুনতে পারে না… কে জি ক্লাসে নিয়ে গিয়ে নীল ডাউন করিয়ে রাখা হল। ক্রস স্টিচের ব্যাগ পুরোটাই কিন্তু ঠাম্মি করে দিলেন, তাতে কোনও দোষ হল না। বছরের শেষে কাজ দেখাতে পারলেই হল।
বখতিয়ার খিলজি মালবিকার কপালে শাস্তি জোটে রোজই, কথা বলার জন্যে। পাতার পর পাতা 'ক্লাসে কথা বলিব না' লিখেই সব খাতা শেষ। উপরি পাওনা ছিল ছুটির পরে আটকে থাকা… এছাড়াও অভাবনীয় সব শাস্তি ছিল তার রোজকার প্রাপ্য। ক্লাস চলাকালীন টিনের সুটকেসে হাত দেওয়ার ফল… সুটকেস মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। জুতোতে হাত দেওয়ার ফল, 'জুতো হাতে করে দাঁড়িয়ে থাকা'
বাড়িতেও শাস্তির বহর কম ছিল না কিন্তু মারধোর, চেঁচামেচি কোনও কিছুই তার সন্ন্যাসী মনটাকে বাঁধন দিতে পারত না। পাড়ার যত ছেলে মেয়ে, সকলেই তার বন্ধু… বয়েস বা শ্রেণীভেদ নেই। মা স্কুলে বেরিয়ে যান, ঠাম্মি তাকে সামলিয়ে উঠতে পারেন না। কিন্তু মা বাড়ি ফিরলেই তাঁকে শুনতে হয় রাজ্যের নালিশ… মা ও বুঝে উঠতে পারেন না মেয়েটা কি ধাতুতে তৈরি। এত মারের পরেও তার চোখ দিয়ে একফোঁটা জল বেরোয় না, তাকে শোধরানোও যায় না… অরণ্যে রোদন।জন্মপ্রেমিক, রোগা প্যাংলা- ফুটফুটে মেয়েটার দুচোখ ভরা বিস্ময়। যা দেখে, যাকে দেখে… প্রেমে পড়ে সে। মানুষ, গাছ, পুকুর, প্রজাপতি, আকাশ, কুকুর, টিকটিকির ডিম কিছুই বাদ নেই। সবকিছুই তাকে প্রচণ্ড ভাবে আকর্ষণ করে। বাড়ির লোক, পাড়ার লোকজন বলে 'পাকা- ডেঁপো মেয়ে… ছেলে ঘেঁষা।’
ক্লাস ফোর থেকেই সে নাকি প্রেম করছে। তারা বুঝতে অপারগ, মানুষে মানুষে কত তফাৎ, মলির যে সকলকেই ভাল লাগে। কেউ ভাল গল্প বলে, কেউ ভাল গান গায়, কেউ ভাল ব্যাডমিন্টন খেলে, কেউবা খুব সুন্দর দেখতে... প্রকৃতির অসীম আকর্ষণ তো আছেই। আর আছে তার এক প্রবল বিদ্রোহী মন। যা করতে তাকে বাধা দেওয়া হবে তা তো তাকে কর সব বাধাতেই সে প্রশ্ন তোলে, 'কেন, কী হয় করলে?' ঠাম্মি বোঝাবার চেষ্টা করেন, তাঁর ক্ষমতা মত, 'পা ছড়িয়ে বসে খাবে না, দূর দেশে বিয়ে হবে' ভালই তো!
'বালিশে বসবে না, পাছায় ফোড়া হয়'
বসে দেখি, হয় কি না... এইসব ধ্যাষ্টামো বরদাস্ত হয় না মায়ের, সপাটে গালে এক বিরাশি সিক্কা হাঁকিয়ে বলেন,' প্রশ্ন করবে না, করতে হয় না বলছি… সেটাই যথেষ্ট। করবে না।'
এই কথাটাই মলি সারাজীবনে বুঝে উঠতে পারে না, নিষেধের সঠিক কারণ কেন কেউ দেখাতে পারে না।
মিশনারী স্কুল, অন্য স্কুলের মত শাড়ি পরা কম্পালসারি নয়, তবে কিছু গোঁড়া পরিবারের মেয়েরা ক্লাস নাইন থেকে শাড়ি পরে আসে স্কুলে।
ক্লাস ফাইভের মালবিকাও বায়না ধরে, শাড়ি পরে স্কুলে যাবে। আরও দুই বন্ধুকেও পটিয়ে ফেলে সে। মা স্কুল ফ্রকের ওপরেই পরিয়ে দেন শাড়ি। সিস্টারের ঘরে তলব হয়, শাড়ি ছাড়িয়ে দেওয়া হয়, শাস্তির ব্যবস্থা তো থাকেই। শাড়ির তলায় স্কুল ড্রেস থাকায় সমস্যা হয় না।
অতি কড়া সেই মেয়েদের স্কুলে এক ঝলক টাটকা হাওয়ার মত হাজির হয়ে যান দুই অবাঙ্গালী শিক্ষিকা... সালোয়ার কামিজ, হাতকাটা ব্লাউজ। কী করে সিস্টাররা মেনে নিয়েছিলেন তা জানা যায়নি, কিন্তু ক্লাস সিক্সের মেয়েদের চোখ গোল হয়ে উঠেছিল। তাদের সংস্পর্শে, মালবিকা অন্য সংস্কৃতির জীবনধারার আলোয় আলোকিত হল...পড়া হল সংস্কৃতির আদান প্রদানের প্রথম পাঠ। তাঁদেরও কি কম জ্বালাতন করা হয়েছিল! ক্লাসের গণ্ডগোল তাঁরা সামলে উঠতে পারতেন না, ক্লাসের মধ্যেই টিফিনের বাক্স খুলে খাবার খেয়ে, মোজা নামিয়ে পায়ে হাত টাত মুছে সাফ হয়ে বসা হত।
অপরাধের দিকেও মন যেতে শুরু করলো। হেডমিস্ট্রেস, সিস্টার প্যাট্রিসিয়া এ্যালজ্যাব্রা আর জিওমেট্রির ক্লাস নিতেন। অঙ্ক মালবিকার মাথায় কোনদিনই স্থান পায়নি, মাথার বদবুদ্ধির আবর্জনা পরিস্কার করলে আর ঢোকাবার ইচ্ছে থাকলে তবে না ঢুকবে!
বাবার অসাধারণ ধৈর্যের কাছে হার মেনে, এরিথমেটিকের অসম্ভব বাজে অঙ্কগুলো- চৌবাচ্চায় জল ঢোকা আর বেরোনো, পুরুষ- মহিলা- বাচ্চার একসঙ্গে করা কাজের হিসেব...তাও কিছু কিছু কব্জাতে এল। জিওমেট্রির আঁকা টাঁকাগুলোও ভালই লাগে কিন্তু ঐ এ্যালজেব্রার এ বি সি +1 2 3 আর মাথায় ঢোকে না। অঙ্কের শিক্ষিকা মা কিছুতেই বুঝে উঠতে চান না, বলেন 'বোকা এই অঙ্কগুলোই তো সবথেকে সোজা। ফর্মূলায় ফেলে করবি তো!'
ফর্মূলা মাফিক জীবন আর চলল কবে? সেই ফর্মূলায় ফেলা অঙ্কগুলি সারাজীবন অধরাই থেকে গেল।
জিওমেট্রির টিচার তো কোনও দিনই বোর্ডে জিওমেট্রিক ড্রয়িং গুলো মেলাতে পারতেন না, তাতে বুঝি কোনও দোষ হয় না? যত দোষ হয় এ্যালজেব্রায় পনেরোতে আড়াই পাওয়া নম্বরটির আগে অন্যরকম লাল কালিতে একটি ১ আঁকাতেই।
বাবাকে বিশেষ ভয় পাওয়ার কিছু নেই, কিন্তু যমরাজের দোসর মা? বাবা সবই বুঝলেন। সাহসী হওয়ার শিক্ষা পেল সেদিন সে বাবার কাছে। 'ঠকিও না কাউকে, নিজেই ঠকবে। ঠকানোর থেকে ঠকে যাওয়া অনেক ভাল।'
বাবা নিজে সারাজীবন ধরে ঠকেই গেলেন, তাঁর আদরের প্রিন্সেস মলিও।
আজ মালবিকা শিক্ষিকা। নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছে সে কিভাবে পড়ালে ছাত্র ছাত্রীদের মনের গভীরে সে জ্ঞান দাগ রেখে যায়। যে জিওগ্রাফীকে আজ সে এত ভালবাসে, নিজের ছাত্রী জীবনে সেই বিষয়টিকে একেবারেই ভালবাসতে পারেনি, শিক্ষিকাই পায়নি।
মনে পড়ে, মণিকা দিদিকে। তাঁর সাজগোজ, চলাফেরা, কথা বলা সবকিছুই ছাত্রীগুলিকে এক নতুন দুনিয়াতে নিয়ে যায়। উঁচু ক্লাসে অবশ্য আরও অনেক শিক্ষিকাই তার মনে দাগ রেখে গেছিলেন, যা তাকে পরবর্তী জীবনে এক সফল শিক্ষিকা হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। মনে পড়ে ক্লাস সেভেনে মাত্র কিছুদিনের জন্যে ইংরিজি পড়াতে আসা ব্যানার্জী মিসকে। গরুর রচনা যে তার লেজ- কান- শিঙ এর বর্ণনা বাদ দিয়েও লেখা যায়, তার হাতেখড়ি হল। সেই প্রথম, স্কুলে মালবিকা ইংরিজি সাহিত্যকে ভালবাসতে শিখল। বাড়িতে বাবা সব সময়েই উৎসাহ যোগাতেন। মা ভালবাসতে শিখিয়েছিলেন, বাংলা সাহিত্যকে। ছোটবেলায় সে কখনও বই ছাড়া অন্য কিছু উপহার পায়নি, মা- বাবার কাছে। কিন্তু যখন পড়ার নেশাটা ধরে গেল, তখন আবার চেঁচামে...
'আমার বিদূষী মেয়ে রাতদিন পায়ের ওপরে পা তুলে, বই মুখে বসে আছেন। কোনও রকম সাহায্যের আশা নেই, তোমার কাছে!
তবে মনে পড়ে, ঘরের কাজে মাকে সাহায্য না করলেও, যখনই মা ভালমন্দ খাবার বানাতেন তার ডাক পড়ত।'এখানে বোস, আমি করছি দেখ অন্তত...'
বই মুখে করেই মা’র পাশে বসে থাকতো মলি কিন্তু বড় হওয়ার পরে বুঝতে পারল কত দূরদৃষ্ট ছিলেন মা, নিজে হাতে করে না করলেও সেই রন্ধন প্রক্রিয়া গুলি বইয়ের ফাঁক দিয়ে গলে কেমন করে জানি মস্তকে প্রবেশ করেছিল।
ক্লাস ফাইভ সিক্সে কলেজ স্টুডেন্টস দের জন্যে নির্দেশিত স্বপনকুমারের দুর্ধর্ষ রোমাঞ্চকর গোয়েন্দা কাহিনী পড়ার সে কি ধূম... ক্লাস সেভেনেই শরৎ চন্দ্র প্রায় শেষ। ক্লাস নাইনে পক্স হল মলির, মায়ের তখন বি এড পরীক্ষা, বাড়ি রঙ হচ্ছে… কি করে যে সামলাতেন মা! তবে মলি বিছানায় বসে বসে মার বায়োলজির চার্টগুলো সব এঁকে দিত। রঙের সময়ে বইয়ের তাক থেকে বেরলো মায়ের প্রাইজ পাওয়া বই 'গুড আর্থ'।
'এখন পড়ো না বুঝতে পারবে না।'
মা স্কুলে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে বই শেষ। নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি টানটা যে জন্মগত... কিন্তু সত্যিই কিছু বোঝেনি সে তখন।
কলেজে পড়ার সময়ে এক বন্ধু বলছিলো, 'সব মা জাতীয় ভদ্রমহিলারা এক স্কুল থেকে পাস করেছেন... শুনে তখন খুব হাসি পেলেও এবং তাকে সমর্থন করে যার যার নিজের অভিজ্ঞতার কথা শোনানো হলেও নিজে মায়ের চরিত্র চিত্রণ করার সময়ে বোঝা যায় কথাটা কতোটা সত্যি। যখন তখন বাচ্চাদের মুখে শুনতে পাওয়া যায়...
'তুমি! তুমি একদম দিম্মার মত। এক কথা কতবার যে ঘ্যান ঘ্যান করতে পারো, ভালো লাগে?'
সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলতেই থাকে।