আধ্যাত্মিকতা
আধ্যাত্মিকতা
'টিকেট তো হয়েছে, উত্তর বঙ্গের ট্রেনে যায়গা পাওয়া... বাপরে বাপ!'
অনিমেষ জানাল স্ত্রী'কে।
মনীষা রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিল... খুশী হয়ে বলল, 'এই সময়ে বেশ ঠাণ্ডা হবে... বল? আমি নতুন জ্যাকেটটা নিয়ে যাব... আর একটা জিন্সের প্যান্ট কিনেছি অনলাইনে, সেটাও।'
'এবারে টাইগার হিল যেতেই হবে... আমি যাইইনি কখনও... লাক ভাল থাকলে দেখা দেবেন তিনি।'
অনিমেষ আশান্বিত হলো।
'হ্যাঁ, দারুণ লাগে... আমি দেখেছি। আকাশ পরিষ্কার থাকলে, এভারেস্ট ও দেখা যায়... জান?'
ভাল লাগায় আপ্লূত হয় মনীষা।
'কালিম্পং ও যাব... মর্গ্যান হাউসে যায়গা পাওয়া গেছে...'
'তাই!! মর্গ্যান হাউসে নাকি ভূত আছে? বন্ধুদের সঙ্গে যেবারে গিয়েছিলাম, কালিম্পং ঘোরাবার সময়ে দেখিয়েছিল বাইরে থেকে... উল্টোদিকেই গল্ফ গ্রাউন্ড... কী সুন্দর।'
কালিম্পং-এর মর্গ্যান হাউসে পৌঁছে আনন্দে বিহ্ব্ল হয়ে পড়ে স্বামী- স্ত্রী... চোখের সামনে মহিমময় কাঞ্চনজঙ্ঘা, অষ্টপ্রহর।
'এ্যাই দেখ, বাথরুম থেকেও দেখতে পাচ্ছি তাঁঁকে... এত সুন্দর ভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘা কখনও দেখিনি এর আগে... থ্যাংক ইউ ডিয়ার। আমাদের ম্যারেজ এ্যানিভার্সারি দারুণ কাটল এবারে, জীবনের সব থেকে দামী আর সুন্দর উপহার।' অনিমেষের কাঁধে মাথা রেখে বলে মনীষা।
'আজ একটা কন্ডাক্টেড ট্যুর নিয়েছি, আমি তো আগে আসিনি... ঘুরে নিই। ডেলো আছে আমাদের প্রোগ্রামে, সেই ই বিতর্কিত ডেলো।' হাসল অনিমেষ।
মনীষার খুব ইচ্ছে ছিল প্যারাগ্লাইডিং করার, অনেক কষ্টে বরকে রাজি করিয়ে, করে ফেলল সে। অনিমেষ গেল না অবশ্য।
সবশেষে তারা গিয়ে পৌঁছল ডেলো পার্কে। কী সুন্দর পরিবেশ, মনমোহক।
ঘুরতে ঘুরতে একটা ছোট ভীড় দৃষ্টি আকর্ষণ করল মনীষার। ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে দেখল বিরাট জটাধারী, নীল কাপড় পরিহিত এক বাবা... জিজ্ঞে
স করে নাম জানা গেল "কূলবাধূত সৎপূর্ণানন্দ"
উনি কালিম্পং-এর মানুষের কাছে খুব পরিচিত। আস্তে আস্তে ভীড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ল মনীষা। সব ব্যাপারেই তার কৌতুহল অসীম।
আশেপাশের ফিসফাসে জানতে পারল মনীষা, উনি এক তন্ত্রসাধক। হিন্দু, ইসলামী, বৌদ্ধ, খ্রিস্টীয়... সব প্রথা মেনে সবরকমের অনুষ্ঠান পালন করেন তিনি... সকলের প্রিয় বাবা।
খানিক্ষণ কান পেতে শুনে মোহিত হয়ে গেল মনীষা... তাকে বড় সহজেই বশ করা যায়, কথায়।
এত গুণী মানুষ, বিখ্যাত ব্যক্তি... অথচ কী সহজ সরল তাঁর ব্যাখ্যা।
ধর্ম আর আধ্যাত্মিকতার কথা বলছিলেন তিনি।
"ধৃ এর সঙ্গে মন জুড়ে হয় ধর্ম... ধৃ অর্থ ধারণ আর মন হলো অন্তর, আত্মা, পরমাত্মা। মন যাকে গ্রহণ ক'রে শান্তি লাভ করে সে ই হলো ধর্ম, হতে পারে সেই ধর্মের আরাধ্য সাকার বা নিরাকার... সব ধর্মের মূল কথা একই কিন্তু ধর্মাবলম্বীদের আচার আচরণ বিভিন্ন রকম হতেও পারে।
আধ্যাত্মিকতা হলো বোধ- অনুভূতি... যা নাকি অতিচেতন মনে প্রভাব ফেলে। আধ্যাত্মিকতা যদিও নির্ভরশীল ধর্ম ও দর্শনের ওপরে, তাদের মধ্যে মিল আর তফাৎ দুইই আছে।
আত্মার সঙ্গে দেহ আর মনের অনুভূতির সম্পর্ক মিলে গেলেই আসে আধ্যাত্মিকতা... যা অত্যন্ত ব্যক্তিগত।
সোজাভাবে বললে, ধর্ম হলো জীবন প্রণালী আর আধ্যাত্মিকতা হলো আত্মানুসন্ধান..."
বিবশ হয়ে পড়েছিল মনীষার চেতন- অবচেতন। এত সহজ করে কোনদিন কেউ ভাবতে শেখায়নি তাকে... ধার্মিক সে কিন্তু আধ্যাত্মিক কী না সে ব্যাপারে কখনও মনে কোনও চিন্তাই আসেনি।
ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না, কিন্তু আর পাঁচজনের সঙ্গে জুড়ে থাকা... যেতে তো হবেই।
বাবার ছবি মন জুড়ে রইল... দীক্ষার আর দরকার হবে না... বাবা যেন দীক্ষিত করে গেলেন তাকে।
কাঞ্চনজঙ্ঘার মহানতার পাশে আরও এক মহান হৃদয়ের পরশ নিয়ে ঘরে ফিরল মনীষা।