আস্তিক না নাস্তিক
আস্তিক না নাস্তিক
বিশ্বাস
'হে ভগবান, তুই আবার আমার পুজোর আসন থেকে টাকা সরিয়েছিস?'
প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়ে মালতী।
দূরে দাঁড়িয়ে দাঁত বার করে হাসছে তার ছেলে বাদল।
কত শখ করে নাম রাখা হয়েছিল, প্রথম সন্তানের... কালো মেঘে ভরা এক বাদল দিনেই জন্ম হয়েছিল তার।
স্কুলে যায় না, পড়াশোনায় মন নেই... পাড়ার বখাটে ছোঁড়া গুলোর সঙ্গেই যত মাখামাখি। মা বুঝিয়ে, বকে কোনভাবেই সুপথে ফেরাতে পারে না, আত্মজকে।
স্বামী মাধব হঠাৎ করেই চলে গেল, তাদের অকূল দরিয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে।
সংসারে অনভিজ্ঞ মালতী বুঝেই পেল না কী করবে... কোত্থেকে যোগাড় করবে দু- দুটো পেটের ভাত।
কিছুদিন চলল, আশেপাশের প্রতিবেশীদের দয়া দাক্ষিণ্যে... কিন্তু তাদের মধ্য বেশীরভাগেরই তো চলে দিন এনে দিন খেয়ে।
চৌধুরী বাবুর বাড়িতে সারাদিনের কাজ পেয়ে হাতে চাঁদ পেল মালতী।
পেট দুটোর চিন্তা তো আর করতে হতো না, তবে সারাদিনে অবসর জুটত না মালতীর, সারা বাড়ির লোকের ফরমায়েশ খাটতেই দিন শেষ হয়ে যেত... ছেলেটা কোথায় যায়, কীভাবে বড় হচ্ছে দেখার সময় বা সুযোগ কোনটাই ছিল না তার।
দুবেলা ঠাকুরের কাছে হাত জোড় করে প্রার্থনা জানাত মালতী... আমি সামলিয়ে নেব সব, আমার ছেলেটাকে মানুষের মতো মানুষ কর ঠাকুর।
বাড়ির বাবুদের হাতে পায়ে ধরে, কাছাকাছির এক স্কুলে ভর্তি করে দিল বাদলকে।
নানারকম কথা কানে আসতে থাকে মালতীর। পড়াশোনা কিছুই করে না বাদল, স্কুলেও যায় না ঠিকমতো... অদ্ভুত সব সঙ্গী জুটেছে, এই বয়েসেই নেশা- ভাঙ- জুয়ায় জড়িয়ে পড়েছে সে।
চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না মালতীর।
রাতে শুয়ে বাদলকে বোঝাতে চেষ্টা করে মালতী
'কী করছিস বাবু তুই? তোর বাবা নেই, আমি খেটে মরছি সারাদিন... তুই আমার কথা একটুও ভাবিস না? ভগবানে ভয় নেই তোর?'
'ভগবান বলে কিছু নেই মা, থাকলে আমাদের এই দশা হয়? আমি ভগবান মানি না...'
হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে নেয় মালতী... বাদল অবুঝ ঠাকুর, ওকে মাফ করে দাও।
দুদিন হয়ে গেছে, বাদল ঘরে ফেরেনি।
কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে মন দৌড়ে বেড়াচ্ছে... বাদলের চিন্তায় অধীর হয়ে উঠেছে মালতী। কী করবে, কোথায় যাবে... কার কাছে খোঁজ নেবে সে?
চার দিনের মাথায় খবর এল... মেজ দাদাবাবু এলেন মালতীর কাছে...
'কী আর বলি তোমাকে, মালতী... বাদলকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে... হাজতে আছে সে। কোথায় কী সব কুকর্মের জন্যে... এখন কোর্ট-এ উঠবে কেস। ওর জন্যে আমরা কোনও পয়সা খরচ কিন্তু করতে পারব না।'
চোখের জল গোপন করল মালতী।
'না মেজদা বাবু, আমিও চাই না একটা সমাজবিরোধীর জন্যে আপনাদের টাকা নষ্ট হোক.
.. বাজে কাজ করেছে, শাস্তি পাক। শিক্ষা হয় যদি... ঈশ্বর সুমতি দিন ওকে।'
বছর খানেকের সশ্রম কারাদণ্ড সেরে বাড়ি ফিরে এল বাদল।
বাড়ির কেউই তাকে বাড়িতে থাকতে দেওয়ার অনুমতি দিতে চাইলেন না।
মালতীকেও বেরিয়ে যেতে হলো, তার কাজ ছেড়ে।
ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল সে, 'জন্ম দিয়েছি তোকে, এতটা বড় করে তুলেছি... এবার আমার দায়িত্ব তোর। ভাল পথে রোজকার করে খাওয়াতে পারিস, খাব... নয়তো চলে যাব যেদিকে দুচোখ যায়... মরতে তো পারবই। পুকুরে জল আছে, রেল লাইন আছে... আমার জন্যে তোর মনে যদি একটুও ভালবাসা থাকে, চিন্তা করে দেখ...'
বাদল চুপ করে তাকিয়ে থাকে দূরের অন্ধকারের দিকে। তার ভবিষ্যৎটাও বোধহয় এইরকমই কালো... আলোর হদিস পাচ্ছে না সে।
ছেলের ভাবান্তর লক্ষ্য করে, অল্পকিছু জমা টাকা তুলে দেয় ছেলের হাতে। গাছতলাতেই স্থান হয় তাদের, কোথাও যাওয়ার নেই।
মা- ছেলে ভাবতে বসে, কী করা যায় এইটুকু মূলধন নিয়ে...
'আমি রান্না করে দিতে পারি বাবু, তুই নিয়ে অফিসের সামনে বসে বিক্রি করতে পারবি?'
বাদলের সঙ্গীরা কয়েকদিন ঘুরঘুর করে যখন বুঝে গেল আর কিছুই পাওয়ার আশা নেই, রণে ভঙ্গ দিল তারা।
একটু হলেও বদল দেখল মালতী, ছেলের মধ্যে।
ইঁটের উনুনে কাঠকুটো দিয়ে আগুন করে, কলাপাতা, মাটির বাসনে করে রুটি তরকারি করে দিল মালতী... অনিচ্ছা সত্বেও নিয়ে গিয়ে বসল বাদল, কাছের এক অফিসের সামনে।
এক দুই করে লোক জমা হয়ে খাবার খেয়ে ভাল লাগল তাদের... পেটভরা মোটা খাবার, কম দাম।
গাছতলায়ই একটা ঝুপড়ি বানিয়ে নিল বাদল, মা- ছেলের অস্থায়ী বাসস্থান।
রোজের লাভের টাকায় কাঁচামাল নিয়ে এসে খাবার তৈরি করতে থাকল মালতী।
ধীরে ধীরে, তার খাবারের চাহিদা বাড়ল... নানারকম মুখরোচক খাবারও বানিয়ে দিতে থাকল সে।
কয়েক মাসের মধ্যেই, জবরদখল কলোনির এক ঝুপড়িতে যায়গা পেল তারা। স্টোভে রান্না শুরু করল মালতী।
আজকাল আর খাবার তৈরি করে সামাল দিতে পেরে উঠছে না মালতী। আশেপাশের দু- একজন মেয়েকে নিয়ে বাড়িয়ে ফেলল তাদের ব্যবসা।
বাদল বদলে গেছে, পাশের ঝুপড়ির এক মাস্টার মশাইয়ের কাছে রোজ একটু বসে বই নিয়ে... হিসেবটা তো শিখতেই হবে ভাল করে। লেখা পড়া জানা মানুষকে চট করে বোকা বানানো যায় না, এই কথাটা শিখিয়েছে তার মা।
সুন্দর পরিবেশে, এক কামরার এক বাড়িতে উঠে এসেছে মা- ব্যাটা।
সন্ধ্যের শাঁখের আওয়াজে, চমকিত হয় বাদল... তুলসী তলায় মায়ের অনিন্দ্য মূর্তি তার মনের হৃত বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়।
মা'র পাশে গিয়ে দাঁড়ায় বাদল... হাত জোড় করে।
শ্রদ্ধায় মাথা ঝুঁকে আসে তার।