দাঁড়িপাল্লা
দাঁড়িপাল্লা


"মুখ তোল সুভা… ভালো করে দেখ... শুভদৃষ্টির ক্ষণ বার বার আসবে?"
রাঙামামীর কথাতে অপরিচিত মানুষটির চোখে চোখ রাখল সুভাষিনী
চোখ ছাপিয়ে জল নামল। ইতি উতি খুঁজে বেড়াল সেই শ্যামল মুখখানাকে।
"ওরে ও হাড়হাবাতে- মুখপোড়া মিনসে! মরবি রে তুই ওলাউটো হয়ে, মুখে রক্ত উঠে… খা তুই ওই আমসত্ত্ব।"
উফ! পিসিমার চিৎকারে সকাল শুরু হয়… রাতও এসে যায়। বুড়ি পারে বটে। আলোচালের সেদ্ধভাত… সে'ও শুধু একবেলা! তাইতেই তাঁর যা গলার জোর…
বই রেখে উঠলেন বিধুশেখর।
"কী হলো পিসিমা, সক্কাল সক্কাল কাকে গাল পাড়ছ?"
"ও মা, বিদু যে! তোর নেকাপড়ার অসুবিদে কল্লুম বুজি? আর বলিস কেন… পাশের ওই ঘোষেদের মাণিক! কতদিন ধরে আমের কাথ বার করে করে আমসত্ত্ব দিচ্ছি… তা সে হতভাগা পাঁচিল টপকে এসে, দেখ না দেখ খেয়ে যাচ্ছে... এঁটোকাটা, বাসি কোনও বিচের নেইকো। আরে হতে দে, তোদের জন্যিই তো কচ্চি বাপু।"
"তা সে আবার মিনসে কীগো? সবে তো বারো… ওদের জন্যেই যখন করছ, খাক না..."
কেউই বুঝতে পারেন না এই আমসত্ত্ব চুরি করে তাদেরই বাড়ির মেয়ে সুভা, তার জন্ম সাথী মাণিকের জন্যে।
পুরনো কলকাতার গায়ে গায়ে লাগা বাড়ি। স্কুলের পরে বাড়ির ছাদেই খেলাতে মেতে ওঠে বাচ্চা দুটো... তাদের আর কোনও বন্ধু নেই।
মাণিক গল্প বলে, সুভা গান গায়। দু'জনেরই গল্পবইয়ের খুব নেশা… লাইব্রেরির বই বদলা বদলি করে পড়ে তারা।
পড়াশোনায় খুব মাথা মাণিকের, প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয় না কখনও।
বিধুশেখর বলেন "সুভাকে একটু দেখিয়ে দিস তো মণি… ওর নিরেট মাথায় যে কিছুই ঢোকে না।"
লম্বা জিভ বার করে ভেংচি কাটে সুভা, তার বাবার পিঠ পিছে।
বিরাট একান্নবর্তী পরিবার ঘোষেদের, ভাঙন ধরতে শুরু করেছে। কিছু নিষ্কর্মার ভার কেন বহন করবে অন্যেরা, যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে চলেছে।
সবে প্রোমোটর নামক জীবের উদয় হয়েছে শহরে। স্থির হয়, পায়রার খোপের মতো ফ্ল্যাটবাড়ি যাদের পছন্দ তারা থাকবে এখানেই, বাকিরা যাক তাদের ভাগের টাকা নিয়ে।
মাণিকের মামাবাড়ি বেশ বর্ধিষ্ণু। বিরাট বাড়ি তাঁদের শহরতলিতে… সেখানে গিয়ে থাকার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান ক'রে, পাশেই জমি কিনে বাড়ি তোলার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন মাণিকের বাবা।
মাণিক এসে দাঁড়ায় সুভার ঘরের দরজায়।
মুখ ফেরায় সুভা, তার মুখ লাল। নাক টানছে সে।
"সর্দি বাধালি? চল খুড়িকে বল, আদা- তুলসী- গোলমরিচ দিয়ে ভালো করে চা বানাতে।"
রান্নাঘরের দরজায় সুগন্ধের ধাক্কা প্রবল হয়ে ওঠে।
"আচার বানাচ্ছ খুড়ি?"
"না তো।"
"তবে কীসের গন্ধ?"
"আমি তো ডালে সম্বার দিচ্ছি মণি, পাঁচফোড়ন আর শুকনো লংকা দিয়ে… খাবি দুটো ভাত, ডাল আর বেগুন ভাজা দিয়ে?"
মাণিকের মুখের হাসি কান পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তাক থেকে থালা টেনে নিয়ে বসে পড়ে সে।
"এ মা! দেখ… মণির হাত টাত ধোওয়ার বালাই নেই... বসে পড়ল হ্যাংলা, খেতে।"
ক্রন্দনরত সুভারও মুখ ভরে ওঠে হাসিতে।
"তা তোরা যাচ্ছিস কবে, মণি?"
"কে জানে… বুঝব যেদিন স্কুল থেকে নাম কাটা হবে।"
"খুব মজা না! খাস আমসত্ত্ব, আচার, ডালভাত… " কলা দেখায় সুভা।
"মামাবাড়ি যাব, মজা হবে না? কেমন পুকুরে নাইব, সাইকেল চালাব, আম পাড়ব… তোমরা আসবে তো খুড়ি আমাদের নতুন বাড়িতে?"
ছাতে দেখা হয় বিকেল বেলা। সুভার মুখ তখনও লাল।
"তুই কাঁদছিস… কেন?"
"তোর না'হয় দুঃখ হচ্ছে না, মামাবাড়ি যাওয়ার আনন্দে… তাই আমাকেও নাচতে হবে? আমার মন খারাপ।"
"আমার জন্যে? আমি আসব তো, তোরাও যাবি… কেমন একটা বেড়ানোর জায়গা হলো বল। আমার তো ভালো লাগছে... নতুন স্কুল, নতুন পোশাক, নতুন বন্ধু।"
"নতুন বন্ধু! আমাকে ভুলে যাবি?"
"ভুলব কেন…"
"চোখের বাইরে হলেই মনেরও বাইরে…"
নিচে নেমে যায় সুভাষিণী মুখার্জি।
আলাদা আলাদা বড় হয়ে উঠতে থাকে সেই এককালের হরিহর আত্মাদুটো। কদাচিৎ পালা- পার্বণে দেখা হয় তাদের।
মাণিকের জগৎ এখন বিস্তৃত হয়েছে। সাইন্স পড়ার চাপ বেড়েছে।
অনেকদিন বাদে দেখা হয় দুজনের… মাণিকের বড় জেঠার মেয়ের বিয়েতে।
বড় হয়েছে ছেলে মেয়ে দুটো।
অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে মাণিক তার বাল্য সখীর দিকে। বিশ্বাস হয় না এই সেই সুভা… কোন জাদু কাঠির ছোঁয়ায় সে আজ অপরূপা।
"ঘনিষ্ঠ হয় সুভা... আমাকে নিয়ে যাবি তো, তোদের বাড়ি?"
"হ্যাঁ, কেন যাব না? কবে যাবি বল।"
"সে'রকম যাওয়া নয়… সানাই বাজবে... তুই বর বেশে আসবি, আমাকে একেবারে নিয়ে যেতে।"
মাণিকের চোখের পলক পড়ে না। বলে কী এই মেয়ে? সে তো এ'সব ভেবেই দেখেনি কখনও।
"সে তো অনেক দেরি রে... পড়াশোনা শেষ হবে, চাকরি পাব তবে তো! তোকে নিয়ে গিয়ে খাওয়াব কী?"
"আমি তোর মতো অত খাই না, কাকা যা আনবে তাই দিয়েই হয়ে যাবে…"
মাণিকের হাঁ করা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে সুভা, বলে ল্যাদাড়ুসের মতো তাকিয়ে আছিস কেন… জিবেগজা খাবি? নাকী বিয়েবাড়ির খাওয়া ছেড়ে এ'সব রচবে না মুখে..."
"পিসি ঠাকমা করেছেন? দে…"
হাত বাড়ায় মাণিক।
"না রে, মা বানিয়েছেন। খেয়ে দেখ।"
আসা যাওয়া কম হয়ে যায়, দুই বাড়ির লোকের... 'আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড…'
এম এস সি'তে মাণিকের প্রথম স্থান অধিকার করার কথা কানে এসেছিল মুখার্জি বাড়ির সকলের।
বিধুশেখর খুশি হয়ে বলেছিলেন "যাক, সুবোধ দাদার হাতে হাত দেওয়ার লোক তৈরি হয়ে গেল। এবারে খুব ভালো চাকরি পাবে মাণিক।"
"আমি বুঝলামই না, অত ভালো ছেলে… ডাক্তার- ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে সাধারণ লাইনে পড়তে গেল কেন?"
"সব ভালো ছাত্রই যদি ডাক্তার- ইঞ্জিনিয়ার হয়, তাহলে পড়াবে কারা? মাণিকের অধ্যাপনা করার ইচ্ছে। খুব উন্নতি করবে ও জীবনে।"
ফিক করে হেসে সরে যায় সুভা।
কলেজে কলেজে ইন্টারভিউ দিয়ে বেড়াতে থাকল মাণিক, কোথাও থেকেই কোনও শুভ সংবাদ পাওয়া গেল না। সব জায়গাতেই এক ধরনের কথা শুনল সে…
"এত ভালো ফল করেছেন, আপনি তো ভালো অফার পেলেই চলে যাবেন… আপনাকে রাখব কেন?"
কেউ আবার বলল "আপনার তো উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশ যাওয়া স্থির, তাহলে বৃথা কারো ভাত মারবার চেষ্টা করছেন কেন?"
মাণিকের চোখের পলক পড়ল না।
"আমার বিদেশে যাওয়া স্থির… অথচ আমিই জানি না।"
সুভার বিয়ের কথাবার্তা চলতে থাকে। মাণিককে চিঠির পরে চিঠি লিখতে থাকে সুভা, কোনও জবাব আসে না।
স্ত্রী'র কাছে গিয়ে দাঁড়ান বিধু।
"মা হয়ে মেয়ের মনের খবর রাখ না? তোমার মেয়ের মন যে মাণিকে সমর্পিত… বুঝতে পার না?"
"তা কী করে হবে, ওরা তো আমাদের পাল্টি ঘর নয়…"
"তাহলে যাক তিনটে জীবনই নষ্ট হোক।"
শয্যাশায়ী পিসিমার গলার জোর কমেনি এখনও, দাপটও রয়েছে তেমনই। ভাইপোর কথায় নড়ে চড়ে শুলেন তিনি।
"বলিস কী বিদু, আমাদের ওই সুন্দরী রাদিকের অমন কেলেকুষ্টি বর?"
"তোমার রাদিকের কেষ্ট তো কালোই গো পিসিমা।"
"... বেরাম্বনের মেয়ে যাবে শুদ্দুরের ঘরে? সে যে বড় অসৈরন্ হবে বাবা… পিতিলোম বিবাহ।"
"আজকাল আর ওসব মানে না কেউ, পিসিমা, ভালো বংশের সন্তান… পড়াশোনায় চৌকস, চেনা ঘর! আর কী চাই?"
কোথাও কোনও আশার আলো না দেখে ছাত্র পড়াতে শুরু করল মাণিক।
সুভার চিঠি এসে পড়ে আছে, উত্তর দিতে হাত সরে না… কীই বা লিখবে?
বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র নিয়ে আসে বিধুশেখরের ছোট ভাই।
ব্রাহ্মণ, আই এ এস পাত্রের সঙ্গে বিয়ে স্থির হয়েছে সুভাষিণী মুখার্জির।