পর্যটন: রুদ্ধশ্বাস রত্নেশ্বর
পর্যটন: রুদ্ধশ্বাস রত্নেশ্বর
মুরশিদাবাদের আকাশে বাতাসে ফিসফাস ইতিহাস
ভট্টমাটির রত্নেশ্বর ব্রাত্য... রুদ্ধশ্বাস
ভোরের আলো তখন ভাগীরিথীর জলকে সোনার রাশিতে পরিণত করে তুলেছে, যখন আমরা নদী পার হয়ে এলাহীগঞ্জে পৌঁছলাম, ঐতিহাসিক মুরশিদাবাদের শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে আরও নিবিড়ভাবে পরিচিত হওয়ার জন্য।
নদীটির ওপরে কোনও সাঁকো গড়া হয়নি, কিন্তু তার জন্যে পারাপারে কোনই বিঘ্ন হয় না। ভটভটি নৌকোর ওপরে টোটো চাপিয়ে আমাদের কাণ্ডারি, বাচ্চুবাবু আমাদের নিয়ে পৌঁছে গেলেন বহুদিনের পুরোনো কিন্তু তুলনামূলক ভাবে অখ্যাত রত্নেশ্বর শিবের মন্দিরে।
খোসবাগ থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে লালবাগ- নবগ্রাম পাকা সড়ক থেকে অনেকখানি ভেতরে অবস্থিত ভট্টবাড়ী বা ভট্টমাটির রত্নেশ্বর শিবমন্দির।
গৌড়ের বাদশা আলাউদ্দিন হোসেন শাহের রাজত্বকালে(১৪৯৪-১৫১৯) দাক্ষিনাত্যের কর্নাট থেকে প্রায় ১২০০(কেউ বলেন ৪০০) দক্ষিণী ব্রাহ্মণ বঙ্গদেশে আসেন। বাদশার প্রধান আমাত্য শ্রী সনাতন গোস্বামী তাঁদের বসবাসের ব্যবস্থা করেন ভাগীরথী তীরের এই গ্রামে। ভট্ট ব্রাহ্মণদের বাস তাই এই গ্রামটির নাম হয়ে যায় ভট্টবাড়ি বা ভট্টমাটি। ডাহাপাড়ার বঙ্গাধিকারীদের ছ'আনা তরফের দ্বিতীয় কানুনগো জয়নারায়ণ কানুনগো ভট্টবাড়িতে বাস করতেন। শোনা যায়, আঠেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে কালীনারায়ণ কানুনগো ত্রিশ ফুট দীর্ঘ টেরাকোটার কাজে সমৃদ্ধ একদ্বারী এই মন্দিরটির নির্মাণ করেন। দক্ষিণমুখী এই মন্দিরটিকে পঞ্চরত্ন শিবমন্দির ও বলা হয় মন্দিরটির পাঁচ- মিনারী স্থাপত্য কলার জন্য। প্রধান মিনারটিকে ঘিরে রয়েছে চারটি ছোট মিনার। বাংলার একান্ত নিজস্ব শিল্প পোড়ামাটির মন্দিরটির গঠনশৈলিতে কিন্তু এ্যাংলো- বাংলার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ইতিহাসকে ধরে রাখা মুরশিদাবাদের এই মন্দিরটির জরাজীর্ণ অবস্থা দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়, যদিও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুরাতত্ব বিভাগের দ্বারা সংরক্ষিত রত্নেশ্বর শিবের এই মন্দির।
ঐতিহাসিক মুরশিদাবাদের ব
িভিন্ন সৌধ গুলির রক্ষনাবেক্ষনের অবস্থা সম্বন্ধে কিন্তু আমার কোনও অভিযোগ নেই, যদিও পুরো মুরশিদাবাদের বিভিন্ন যায়গায় ছড়ানো ছিটোনো পড়ে আছে মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। মন্দির হিসেবে না হলেও, প্রাচীন সৌধ হিসেবেও কী তাদের রক্ষা করা যায়না?
রত্নেশ্বর মন্দিরে নিত্য পূজা হয় এখনও। পুরোহিত হাত পেতে বসে থাকেন। খুব কম ভ্রমনার্থীই পৌঁছোন সেখানে। কেউ কিছু দিলে ভাল না দিলেও কিছুই বলার নেই।
আজকের মোদিজীর আহ্বান 'স্বচ্ছ ভারত' বা যাঁহা সোচ ওহাঁ শৌচালয় এর আওয়াজ সেখানে পৌঁছোয়নি। স্থানীয় পঞ্চায়েতের কাছে অনবরত অনুরোধ জানিয়েও আজ পর্যন্ত গড়ে তোলা যায়নি একটি শৌচালয়। পুরোহিত মশাই ও তাঁর সাঙ্গ পাঙ্গরা, যাঁরা মন্দিরের দেখাশোনা করেন একঝুড়ি আক্ষেপ ও অভিযোগ নিয়ে এগিয়ে এলেন।মন্দিরটি দর্শনীয় স্থানের মধ্যে পড়ে না বললেই চলে। খুব কম জনই এই স্থানটির সন্ধান জানেন। তবে সময়ে সময়ে অনেকেরই আগমন ঘটেছে, যাঁদের মধ্যে নাকি সাংবাদিকের দলও ছিলেন, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। প্রচারের আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠেনি বহু প্রাচীন এই মন্দির... রত্নেশ্বর মন্দিরের নবীকরণ তো দূরের কথা সংরক্ষণের ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি… যদিও মুরশিদাবাদ জেলার টেরাকোটা মন্দিরের অন্যতম নিদর্শন এই মন্দির।
প্রায় ১০ মিটার দীর্ঘ খিলান গুলি নৃত্য-গীতরতা রমনী, মহিলা তবলিয়া ও বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র ও বাদক দিয়ে সাজান। টেরাকোটার অপূর্ব শিল্পের মাধ্যমে পরিচয় পাওয়া যায় তদানীন্তন সমাজ ব্যবস্থার। পারিষদ-আমাত্য সমভিব্যাহারে রাজা ও রানীদের অভিজাত জীবন যাপন, বিবাহের নানাবিধ রীতি রেয়াজের নিদর্শন পাওয়া যায়, প্রায় ভগ্ন টেরাকোটা শিল্পের মাধ্যমে। মঙ্গল ঘট, বিভিন্ন প্রকার পশু পাখির অভূতপূর্ব গঠনশৈলী দর্শকদের আনন্দ... সবথেকে শেষে আসি পৌরাণিক ও মহাকাব্যের ঘটনাবলীর বিন্যাসে তৈরি টেরাকোটা শিল্পের নিদর্শনের কথায়। অন্যান্য টেরাকোটা মন্দিরের মতই রত্নেশ্বর শিব মন্দিরটি সাজান রয়েছে রামায়নের গল্প, কৃষ্ণের জীবন বৃত্তান্ত ও দশাবতারের কাহিনী দিয়ে...যার বেশিরভাগ অংশই আজ বিলুপ্ত... সংহারের দেবতা মহাদেবের মন্দিরটি আজ ধ্বংসের পথে, রক্ষাকর্তা দেব বিষ্ণুর দশটি অবতারও পারেনি তাকে রক্ষা করতে।