আগন্তুক, ক্ষণিকের অতিথি
আগন্তুক, ক্ষণিকের অতিথি


রোজই দেরি হয়ে যাচ্ছে, অফিস থেকে বেরতে। তার মধ্যে মা'র ফোনের আর শেষ নেই। নিজের মনেই গজগজ করতে করতে অটো স্ট্যান্ডের দিকে এগলো মনীষা।
কী খাচ্ছিস, কখন খাচ্ছিস, এখনও অফিসে কেন... বিয়ের কথা ভাবলি কিছু? প্রশ্নের কোনও শেষ নেই। বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেও শান্তি নেই... এত খবরদারি সহ্য হয় না। নিজে তো বলেই, বাবার জীবনও অতিষ্ঠ করে তোলে মা। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বাবাকে দিয়েও বিয়ের কথা বলে বলে মাথাটা খারাপ করে দেয়। বিয়ের কথা সে ভাবেই নি, বাপরে! চারদিকে যা দেখছে, শখ মিটে গেছে।
নিজের মতো থাকে, খাচ্ছে কি খাচ্ছে না, কতক্ষণ ঘুমোচ্ছে ... টিক টিক করার কেউ নেই। নিজের মা'কে নিয়েই ব্যতিব্যস্ত... আবার অন্যের মা। রক্কে করো রগুবীর।
তালা খুলে ঘরে ঢুকল মনীষা।
আহ, কাল শনিবার... কী মজা। খুব ঘুমোবে সে।
ফোন বাজতে শুরু হলো আবার। ধ্যাৎ ধরবেই না। বলবে চানে গেছিল। পায়ের জুতো জোড়া খুলে ছুঁড়ে মারল সে র্যাকের দিকে। ঘরের অবস্থা শোচনীয়... একটু ঠিক ঠাক করতে হবে কাল।
আসার পথে, একটা রোল কিনে এনেছে, আজকের মতো হয়ে গেল। কালকের কথা কাল ভাবা যাবে।
আবার ফোন বাজছে... ধরতেই হবে। কত আর এ্যাভয়েড করা যায়।
'হ্যাঁ মা, বল...'
'আমি কি মনীষার সঙ্গে কথা বলছি?' ভারী আওয়াজ কাঁপিয়ে দিল মনীষাকে।
'বলছি! আপনি?
'আমি পদ্মরাগ... '
বাপরে, ভাগ্যে পদ্মলোচন না, নিজের মনেই হাসল মনীষা।
'বলুন...'
'আপনার মা আমাকে আপনার নম্বর দিয়েছেন। আমার মা'র পরিচিত উনি।'
দাঁত কিড়মিড়িয়ে উঠল মনীষার। তার জীবন শেষ না করে ছাড়বেই না মা।
'তো?'
'কাল কি আপনি ফ্রি, একবার দেখা হতে পারে?'
'কেন বলুন তো, দেখা করবই বা কেন?'
'আমার মা'র হাতে আপনার জন্যে কিছু পাঠিয়েছেন আপনার মা। তাছাড়া, উনি চান আমরা দেখা করি।' আমি আগ্রহী।
আমার কোনও আগ্রহ নেই দ্যো... মা যখন বলেছে একবার দেখা করতেই পারি... মনে মনে আওড়াল মনীষা।
মুখে বলল 'ঠিক আছে, কোথায় বলুন!'
'যে কোনও কারুর বাড়িতেও দেখা হতে পারে... আমার মা আছেন, আপনি আমার ফ্ল্যাটে আসতে পারেন, চাইলে... বা, আপনার আপত্তি না থাকলে আমিই আসব...'
' না না, বাড়িতে না। একটা কমন প্লেস এ আসুন। আপনি কোথায় থাকেন? আমি ওয়েস্ট আন্ধেরি...'
'ওহ, আমি ওয়াশিতে থাকি। অসুবিধে নেই, এসে যাব। কোথায় বলুন।'
'লোখণ্ডওয়ালার সি সি ডি তে... ১২ টায়! অসুবিধে হবে?'
'না, দেখা হবে। হোয়াটসঅ্যাপ এ এ্যাড করে নেবেন, ছবি আছে... চিনতে সুবিধে হবে।'
'ওকে, সি ইউ টুমরো...'
হোয়াটসঅ্যাপ এ এ্যাড করে ছবিটা দেখল মনীষা, বাহ বেশ হ্যাণ্ডু তো... কত লোকের সঙ্গেই তো পরিচয় হয়... হোক না।
আধ ঘন্টা হলো মনীষা বসে কফি-শপে।
এই ছেলেগুলোর আর সময় জ্ঞান হলো না... আসুক, এমন ঝাড় দেবে... আর কখনও লেট করবে না।
কফি-শপের বাইরে জোর আওয়াজ হলো, গাড়ি ব্রেক দিল না কি টায়ার গেল কে জানে... হই হই শুনে গলা বাড়াল মনীষা। কিছুই দেখা যাচ্ছে না এখান থেকে।
ঠিক সেই সময়েই ঢুকল পদ্মরাগ।
বাহ, বেশ দেখাচ্ছে তো, নেভী ব্লু শার্ট আর সাদা জিন্স এ।
'হ্যালো,' টেবলের কাছে এসে হাসল পদ্মরাগ।
'হ্যালো... ' হাত বাড়াল মনীষা।
পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখ মুছতে ব্যস্ত হলো সে। বাড়ানো হাত গুটিয়ে নিল মনীষা।
'বসুন...' মনীষা চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করল।
'আমার একটা সমস্যা হয়েছে, খুব খারাপ লাগছে বলতে... আমি বসতে পারব না, আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে... আমি ক্ষমা চাইতে এলাম। মাফ করে দিন প্লিজ।'
হাত জোড় করল পদ্মরাগ।
রাগ করতে পারল না মনীষা।
অল্প হেসে বলল 'ঠিক আছে।'
'আসি?'
মনীষার চোখের সামনেই দেওয়াল গলে বেরিয়ে গেল সে।
অবাক মনীষা কিছু বুঝে ওঠার আগেই, লোকজনের কথাবার্তা থেকে বুঝে গেল বাইরে জোরদার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, বাস আর গাড়ি মুখোমুখি। গাড়ির চালক মারা গেছে স্পটেই।
বাসের চালক পালিয়েছে।
হঠাৎ গায়ে কাঁটা দিয়ে শীত করল মনীষার। ধীরে টেবিল ছেড়ে উঠে বাইরে বেরল সে। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল অ্যাক্সিডেন্টের স্থানে। গাড়ি চালকের দেহ বার করা হচ্ছে, নেভী ব্লু শার্ট আর সাদা জিন্স। মুখ দেখা গেল না, ক্ষত বিক্ষত হয়ে গেছে।
মাথা ঘুরে পড়ে গেল মনীষা, রাস্তার ওপরে।