শহরের উষ্ণতম দিনে
শহরের উষ্ণতম দিনে
ওই যে চৌকো দীঘিটা দেখা যাচ্ছে ওটাই আমাদের বিখ্যাত কলেজ স্কোয়ার। কলকাতার বই বাজার, কলেজ স্ট্রিটের সংলগ্ন এই কলেজ স্কোয়ার। শরৎ-নবরাত্রির সময়, শিয়ালদাহ অ্যাথলেট ক্লাব, সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার আর মহামাদালি পার্কের সাথে এখানেও প্রতিমা দেখার ভিড় হয়। তবে শুধু পুজো বা বইয়ের জন্যে এই জায়গা বিখ্যাত, তেমনটা নয়। হেদুয়ার মতোই এটাও একটা বড় সাঁতারের ক্লাব।
মাসটা আষার হলেও বর্ষণ মুখরিত দিন আজকে নয়। দিনের শুরুর দিকে বৃষ্টিতে কলকাতা ভিজলেও এই ব্যাস্ত শহর দুপুরে আবহাওয়ায় যথেষ্ট উষ্ণ।
দীঘি ঘেরা ছোটো-ছোটো গ্রিলের বেঞ্চিতো আছে কিন্তু সবই ভরা। অগত্যা ওরা একজোড়া অন্য কাপেলের সাথে বেঞ্চি শেয়ার করেই বসলো। এই আইনের ছাত্র-ছাত্রীটিকে দেখলে বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রন্ড ভেবে যেকেউ ভুল করবে। কিন্তু এককালের প্রেম এখন শুধুই অতীত। তাই আজ শুধুমাত্র মনের অতল গহ্বরে তলিয়ে ঝাপসা হওয়া পুরনো স্মৃতি দুচোখে ভরে নিয়ে চিরদিনের মতো একে-অপরকে বিদায় জানতে তাদের পুনরায় এখানে দেখা করা।
চার বছর আগে, এমনই সমস্ত দিনে, কলেজ শেষ হলেই ওদের এখানে আগমন ঘটতো। জায়গাটা তাই আজও এত চেনা। পরিবেশে সেই পুরোনো ছাপ। "তোমার চুলেও কি সেই পুরোনো গন্ধের সুবাস আজও আছে সুলগ্না" প্রশ্ন করে সুনির্বাণ। মধ্যাহ্ণের প্যাচপ্যাচে গরমে, স্নিগ্ধ হাওয়া ছুয়ে গেল সুলগ্নার চুল। চুলের ডগা কানের পৃষ্টে। তারপর দীঘির জলে সূর্যের আভা দেখতে-দেখতে বলে, এই গন্ধের টান শাম্পুর পারফিউমের থেকেও বেশি সুনির্বাণ। নইলে আজ এতো বছর পরে আমরা আবার এখানে আসতাম না"। সুনির্বাণ একটু হেসে বলে, "বড়ো হয়ে গেছো তুমি"। সুলগ্না তার দিকে ফিরে বলে, "তুমিওতো দাইত্তবান হয়েছো"।
এর মধ্যেই পাশের বেঞ্চিটা খালি যাওয়ায়, ঠিক বছর চারেক আগের মতোই সুলগ্নার নেতৃত্বে তার সেখানে একটু দূরত্ব রেখেই বসে। দূরত্বটা আসলে মনের। অনেকটা সময়ের ব্যবধানে ফিকে হয়ে গেছে স্মৃতিগুলো। কিন্তু এই ঝাপসা হয়ে যাওয়া স্মৃতি আজ চাইছে, আজকের এই দিনটা কটাদিন আগেওতো আসতে পারতো। মাস দুয়েক আগেও যদি এই দিনটা আসতো তাহলে হতে কিছুটা সময় থাকতো। আসলে পিছনে ফিরে যাওয়া দুজনের পক্ষেই খুব কঠিন। তবুও স্মৃতিতে ভর দিয়ে যতটা হৃদয়ের অন্তরালে ডুব দেওয়া সম্ভব ততটুকুই যথেষ্ট। ভালোবাসা আর সেটাকে আদায় করার পদ্ধতির জন্য আজ সুনির্বাণ সত্যিই ক্ষমাপ্রার্থী। মনের মণিকোঠায় সুলগ্না থাকলেও তার কাছে নিজেকে অনিচ্ছাসত্বেও বারবার বর্বর প্রমাণ করেছে। সেই কারণেই আজ ছেলেটা লজ্জিত। সন্দেহ আর প্রিয় মানুষটাকে হারানোর দুশ্চিন্তায় অকারণ ঝগড়া আর মন কষাকষিগুলো মনে পড়ে যায় সুলগ্নার। কথাগুলো বলতে-বলতে এক বুক আবেগে ভেসে ওঠে দুজনেই। অতএব ভুল ছিলো দুজনেরই। কেউই ছাড়তে চায়নি, কেউই যেতে চায়নি। ধরা আর ছাড়ার মাঝের চুলচেরা ফাঁক দিয়ে অদৃশ্য কোনো মায়ায় আচ্ছন্ন হতে-হতে বিপত্তি উপস্থিত হলো।
জোড়া শালিককে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সদ্য কলেজ পড়ুয়া-প্রথম বর্ষ না হলেও দ্বিতীয় বর্ষের বেশি হবেনা। ওরাও নিজেদের স্মৃতি হাতড়াতে-হাতড়াতে সময়ের ফাঁকে অনেকটা পিছিয়ে গেছে। বিশ-একুশ বছরের মান-অভিমান যদি ওরা বুঝতো আর বোঝাতে পারতো, তাহলে আজ এই চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়সে হতাশা আর প্রক্তনকে বর্তমানের সাহায্যে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের করে নেওয়ার কথা ভাবতে হতোনা।
দীঘির জলে সূর্যের তেজ যেনো একটু দমে গেছে। সুলগ্না-সুনির্বাণও জেগে-জেগে স্বপ্ন দেখছে। হুশ ফিরল দুটো ভিখারী ছেলের ডাকে। সুনির্বাণ আজ একটু বেশিই চুপচাপ তাই ছেলে দুটোকে সুলগ্নাই কাটিয়ে দিলো। চার বছর আগে হলে সুনির্বাণই এই কাজটা করতো, কিন্তু সময়ের ভারের তুলনায় প্রয়োজনের বেশিই বৃদ্ধ হয়ে গেছে সে। সুলগ্নাও বাস্তবরূপের একজন পরিণীতা নারী আজ। পুরুষ স্বশিত সমাজকে খুব একটা গ্রাহ্য করেনা সে এখন, কিন্তু মনের পুরুষটার অদৃশ্য টান অনুভব করছে আজ। গাল ভরতি দাড়ির দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে বললে সুনির্বাণ বলে, "অনেক সময় বক্তারা শ্রোতা হতে চায়। তারাও শুনতে চায়। শুনে যেতে চায় অনেক না শোনা কথা, যেগুলো হয়ত আর কোনোদিনও শোনা হবেনা"। পাতিয়ে আঁচড়ানো চুল, চোখের কোলে কালি আর চতুর্ভুজ চশমার ফ্রেমে বন্দি চোঁখের আবেগ আদান-প্রদানের সাথেই সুনির্বাণের একটা হাত এগিয়ে যায় সুলগ্নার দিকে। সেও অনেকক্ষণ একটা পুরনো ছোঁয়া পেতে চাইছিলো। হাতে হাত বেশিক্ষন থাকলো না। আজ যেনো সত্যিই আর কলেজ প্রেমের বয়স নেই তাদের। এমনই বা কি বয়স হয়ে গেছে। সেই ভিখারী বাচ্চা দুটো আবার এসেছে। এবারেও সুলগ্নাকেই তাড়াতে হলো, সুনির্বাণ যথারীতি চুপ করেই বসে আছে। এরপর বাচ্চা কোলে করে আরেক ভিখারীর আবির্ভাব। তারপর এক পেনওয়ালির আবির্ভাব। এইসবের পরে সুলগ্না জিজ্ঞেস করলো, "তুমি কিছু খেয়েছো, না এতক্ষণ খালি পেটেই আছো?" সুনির্বাণ পুরনো স্মৃতি হাতড়ে বিস্কুট খাওয়ার কথা জানাতেই নিজে থেকে আবার বলে ওঠে, "তুমিতো আবার বিস্কুট খাওনা, নইলেতো খাওয়াতেই পারতাম"। "সেই বিস্কুট ছেড়ে বেরোতে পারনি তুমি, তাইনা" বললো সুলগ্না। সুনির্বাণ একটা ম্লান হাসি হেসে বললো, "ছেড়ে দিয়ে দেখলামতো, একা থাকতে আর পারলাম কই"। কিছুক্ষণের নিরবতা কাটিয়ে উঠে সুলগ্নার ফোনটা বেজে উঠলো। ডিজিটাল স্ক্রীনে মায়ের নম্বর দেখেই কানে ধরতে ওদিকের কোনো কথায় 'হ্যাঁ' বলে ফোনটা কেটে দিলো। সুনির্বাণ বলে উঠলো, "কটায় বাড়ি যাবে বলে এসেছো?" "এই চারটে, সোয়া চারটে নাগাদ, কেনো বলতো?" সুলগ্নার পাল্টা প্রশ্নে সুনির্বাণ বললো, "নাহ, এমনই জানতে চাইলাম আর কতক্ষন সময় আছে"। সুলগ্না বললো, "বড়ো দেরি করে ফেলেছি আমরা। আর যে সত্যিই সময় নেই সুনি"। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে সুলগ্না আবার বললো, "এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হও যাতে তোমার সময় পাওয়াই অসাধ্য হয়ে ওঠে "। সুনির্বাণ বলে, "তাতে কি লাভ। এমন অসাধ্য কাজের কি অর্থ যাতে সাধনের সময় লক্ষ আলোকবর্ষ পেরিয়ে যায়"। সুলগ্না আর উত্তর খুঁজে পেলনা। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় দীঘি অনেকটা কালচে হয়ে উঠেছে। এই দৃশ্যপট আর ভালো লাগছে না তার। করপোরেশন স্কুল গুলোও এতক্ষনে ছুটি হয়ে গেছে। একদল স্কুল পড়ুয়া তাদের সামনে দিয়ে হেটে চলে গেলো। "নাহ কোমরটা এবার সত্যিই ধরে গেলো দেখি সুনি এবার উঠি চলো" বলেই সুলগ্না উঠে পড়ল। সুনির্বাণও তাকে অনুসরণ করল। তারপর দীঘিটাকে এক চক্কর দিয়ে ওরাও একটা ছোট রেলিংয়ের গেটের বাইরে বেরিয়ে গেলো, চতুষ্কোণ গেরেটপের নাগালের বাইরে।
উন্মাদের মতো ট্যাক্সি চালিয়ে, চালকটি ব্রেক কসলো। সুলগ্নার একটা হাতও ছুলো সুনির্বাণের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটাকে। তারপর বাঁদিকের ফুটপাত ধরে হেঁটে রাস্তা ক্রস করে বই বাজারকে অনেক পিছনে ফেলে শিয়ালদহর দিকে এগিয়ে গেলো তারা। মধ্যে-মধ্যে নিজেদের সম্পর্কে তাদের অনেক কথাই হয়েছে। যেমন, সুলগ্নার মনে ছিল সুনির্বাণের ভারতীয় সেনা বাহিনীতে যোগ দেওয়ার কথা। আর সুনির্বাণ সুলগ্নার বিবাহ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল। কিন্তু সুনির্বাণের প্রতিটি এটেম্পটই বিফলে গেছে। ফলে সেনা বাহিনীতে যোগ দেওয়া তার আর হয়নি। আর সুলগ্নার বিলেত ফেরত ফার্মাসিস্টকে সে নিজেই রিজেক্ট করে দিয়েছিল।
ইতি মধ্যে স্টেশনের বিপরীতের ফুটপাতে যুগলে হাজির হয়েছে। সুলগ্না বললো, "এবার যে বিদায়ের সময় শুরু হয়েছে"। সুনির্বাণ বললো, "কিন্তু মন যে মানছে না"। "তুমি আজও আমায় নাম ধরে ডাকলে না সুনী"। সুলগ্নার কথায় সুনির্বাণ একটু হেসে বলে, "বাবাও তো মাকে নাম ধরে ডাকে না"। সুলগ্না বলে, "আমাদের ফের দেখা হওয়াটাই অসম্ভব"। "মার্কশিট আর ফারেওয়েলের দিনে তোমার সাথে আমার রাস্তা আবার এক হবে"। ইতি মধ্যে সুলগ্না দুটো বাস মিস করেছে। তাই সুনির্বাণের কথার উত্তরে সে বলে, "তুমিও তো বাড়ি যাবে"। সুনির্বাণ তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, "আগে তোমায় বাসে তুলে দি, ঠিক আগে যেমন দিতাম"। দুশো সাতাশে ওঠার আগে সুনির্বাণের গলা জড়িয়ে ধরে সুলগ্না। গলা ভারী হয়ে আসে বলে আর কোনো কথা বলেনা সে। "আই মিস ইউ সো মাচ" ধ্বনিটা কানে যেতেই এক ছুটে সুলগ্না বসে উঠে পরে। বাঁদিকের জানলার ধার গুলো রিজার্ভ দেখে জানলা ছেড়েই সে বসলো। তারপর পিছন ফিরতেই সুনির্বাণকে একটু দূরে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ডাকে। সুনির্বাণও জানলার কাছে ছুটে যায়, হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চায় সুলগ্নাকে। সেও আঙ্গুলগুলো ছুঁয়ে ফেলে। গলা খাকারি দিয়ে আওয়াজটা সহজাত করে বলে, "আমাদের দেখা হওয়াটাই প্রায় অসম্ভব"। সুনির্বাণ মুখে হাসি নিয়ে বলে, "আমি চেষ্টা করবো সময় বের করার"।
