শেষ দেখা
শেষ দেখা
আমার আর নীলাঞ্জনার শেষ দেখাটা এতটাই অপ্রত্যাশিত হয় যে, শেষবারের মতো ‘বিদায়’ বলারও সুযোগ পাওয়া যায় নি। নারী,, ততক্ষণই আপনার, যতক্ষণ সে রাগ করে, অভিমান করে, অধিকার খাটায়, বিরক্ত করে, ভালবাসে, খেয়াল রাখে, কিন্তু যখনই আপনি একবার তার আত্মসম্মানে আঘাত করবেন,, অবহেলা করবেন, ব্যস্ততা দেখাবেন দিনের পর দিন। তখন যদি একবার সে নিজেকে গুটিয়ে নেয়, আপনার সবকিছুই থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়, বিশ্বাস করেন তখন হাজারবার চাইলেও আগের সেই মানুষটাকে আর ফিরে পাবেন না।
ওকে কেউ বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল আমার বাইরে কারো সাথে সম্পর্ক আছে। নারী যেমন ভালবাসতে পারে, তেমন ঘেন্না ও করতেও পারে। যদিও সে তার শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে যায় ভালবাসার সম্পর্কটা আগলে রাখার, কিন্তু আমি শত অপমান সহ্য করেও চেষ্টা করেছিলাম বাচিয়ে রেখতে সম্পর্কটা। কিন্তু পারি নি।
শেষ দেখাটা শুধু একটি শারীরিক দূরত্ব তৈরি করে না, এটি দুটি আত্মার মধ্যে এক গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করে। সেইদিন রাতে শেষ বার ও আমাকে ৎআদরে আদরে ভরিয়ে দিয়ে ছিলো। তাই হয়তো ওকে ছাড়া আমার ঘরে শুন্যতাটা বড় বেশি কাদায় আমাকে।
আসলে সম্পর্কটা আমি শেষ করতে চাই নি। কারণ আমি আশা করেছিলাম ও একদিন না একদিন জানতে পারবে আমি ওকে ছাড়া কাউকে ভালোবাসি নি। ডিভোর্স পেপারে আমি সাইন করলাম না, কিন্তু ওর নতুন বয়ফ্রেন্ড কি কারসাজি করে ঠিক ডিভোর্সটা নিয়ে নিলো। আমি আমার দুঃখ কথা স্মৃতি গুলো সোসাল মিডিয়া ভাগ করে নিতাম। সেখানে ওর বন্ধুরা না না কুট উক্তি করতে থাকলো। বিভিন্ন চরিত্র গুলো আমাদের সম্পর্কটা আরো বিষাক্ত করে দিতে চাইলো। ওরা আমার সম্পর্ক ভাঙার নতুন কারণ আবিষ্কার করলো। আমাকে পুরুষত্বহীন বলেই প্রমানিত করতে চাইছিলো নীলাঞ্জনার শুভাকাঙ্ক্ষীরা। দাম্পত্য সুখ দিতে পারি নি বলে চলে গেছে এমন দাবি করছিলো। একটা সম্পর্ক ভাঙলে অনেকে মানুষের সাথে সম্পর্ক ভেঙে যায়। আত্মীয়তা শত্রুতে পরিনত হয়।
আমি বাড়ি ছেড়ে বিদেশে পাললাম। কারণ আমাকে তখন বাড়ি বিয়ের জন্য চাপ দিতে শুরু করলো বাড়ি থেকে। কারণে ওরা চাইলো একটা কোন মেয়েকে বিয়ে করে একটা সন্তান জন্ম দিয়ে প্রমাণ করি আমি একটা পুরুষ। তাই আমি বাড়ি ছাড়া সিদ্ধান্ত নিলাম। কারণ আমি আমার পুরুষত্ব প্রমাণ দিতে একটি মেয়েকে ভালোবাসাহীন সম্পর্কে বন্ধনে আবদ্ধ করতে চাইছিলাম না।
পুরুষত্ব কি?? এ যুগের পুরুষ জানে কি! একজন সুযোগ্য নেতা এবং স্বৈরাচারীর মাঝে পার্থক্য ঠিক কোথায়। নিয়ন্ত্রণ করবার চাহিদা কোন মুহুর্তে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে, অথবা সহানুভূতিশীল হতে গিয়ে কখন নিজের আত্মসম্মানবোধ বিসর্জন দেয়া হয়ে যায়। নিয়ন্ত্রণহীন ক্ষোভ আর সময়ের প্রয়োজনে নেয়া দুঃসাহসিক আক্রমণাত্মক পদক্ষেপে নিয়ে নেয়। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে কি করা উচিত বিভ্রান্তির শেষ নেই আমাদের। পুরুষ' শব্দটি সংস্কৃত 'পুরুষ' থেকে এসেছে। ব্যাকরণে এটি ক্রিয়ার কর্তা ও কর্মের বিশেষ রূপকে বোঝায়।আর বাস্তবে পুরুষ কত্রীত্ব ফলাতে চেষ্টা করা একটি নাম ।
জীবনের প্রতিটি সম্পর্কের একদিন হয়তো শেষ দেখা হয়ে যায়। কেউ চলে যায় দূরে, কেউ হারিয়ে যায় সময়ের স্রোতে। কিন্তু সেই শেষ দেখার মুহূর্তটা-যেখানে চোখে জল, মনে অস্থিরতা আর ঠোঁটে জমে থাকা হাজারটা কথা-সবচেয়ে গভীর ও স্মরণীয় হয়ে থাকে। শেষ দেখা মানেই হয়তো তাই শেষ না, কিন্তু সেই সময়টা হয়ে ওঠে এক চিরন্তন অনুভূতির প্রতীক। স্মৃতি হয়ে ফিরে আসে বারবার।
যাইহোক ডাইরি লেখা শেষ হতে না হতে, একটা পোড়া পোড়া গন্ধ নাকে এলো। উঠানে উনানের ছুটে গিয়ে দেখি বেগুনের তরকারি পুড়ে কয়লা। ভাত পুড়ে গেছে। একসাথে রান্না বসানো উচিত হয় নি আমার । তাড়াতাড়ি হাড়ি নামাতে গিয়ে হাত ছেকা খেলাম। পিছন থেকে হঠাৎ শিউলি এসে ও গুলো নামিয়ে দিলো। তারপর পুরোনো স্বভাব মতো মুখে শুনলো। যার সারাংশ আমার আবার বিয়ে করে নেওয়া উচিত। আমার মতো ক্যাবলা কান্ত দ্বারা একা একা ঘর কন্যা কাজ করা সম্ভব নয়।
আমি ওর খোঁজ নিলাম , আমাদের শেষ দেখা হয়েছিল বছর দশকে আগে বোধহয়।
পিসি তুতো ভাই সোমনাথের বিয়েতে। তখন ওর সবে বিয়ে হয়ছে। ওকে বরের কথা জিজ্ঞাসা করতেই ওর মুখের রঙটা বদলে গেলো। ও কথা ঘুরিয়ে বললো " বুবাইদা , সোমনাথের বৌ বললো তুই নাকি বৌ দুঃখে , দেবদাস হয়েছিস। নীলাঞ্জনা দিদি সত্যি কি অনেক সুন্দর দেখতে ছিলো। "
আমি বললাম " তুই ওর থেকে অনেক সুন্দর দেখতে। কিন্তু ভালোবাসা কি সৌন্দর্য দেখে হয় না।"
ও কেমন একটা উদাস ভাবে বললো " তা কি করলে পুরুষ মন পাওয়া যায়। তুই আমাকে বিয়ে করলি না কেন জানি না। দেখ আমার পেটেটা এক বাচ্চার মা কেউ বলবে, দক্ষিণে নায়িকাদের মতো ফিগার মেনটেন করি। তবুও বরের মন পাই না। "
ওর নাভির গভীরতা পাতাল ফরসা পেটটা যে আমার পুরনো দুর্বলতা ও সেটা ভালো করেই জানতো। কিন্তু ওদিকে আমার নজর গেলো না।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম " তোকে কষ্ট দিয়েছি বলেই, তোর অভিশাপে হয়তো আজ এতো কষ্ট পাচ্ছি। "
ও ছুটে এসে জরিয়ে ধরলো। ' তুই এমন ভাবে বলিস না। আমি তোকে ভালোবাতাম, আমি কোন দিন তোকে অভিশাপ দিই নি। তোকে আজো আমি ভালোবাসি। "
আমি ওকে ছাড়াতে চাইলাম না বরং আমার হাত দুইটো আমার অজান্তেই ওকে জরিয়ে ধরলো। ও বললো " আজো আমি ওই রাতের কথা ভুলি নি। তুই রাতে যাত্রা যাবার নাম করে যখন আমাদের বাড়ি এসেছিলি তখন বুঝতে পেরেছিলাম তুই কতোটা শয়তান। আমার মন ছটফট করছিলো আমি জানতাম আমার মরণ হবে তোর হাতে। রাতে তুই যাত্রা দেখতে গেলি না। আমি সবকিছু দিলাম তোকে। তুই তারপর থেকে নিয়মিত আসতিস আমাকে পড়ানোর নাম করে , প্রেম করতিস আমার সাথে। আমি স্বপ্ন দেখতাম তুই আমাকে তোর মতো করে তৈরি করছিস ভেবে। কিন্তু আমাদের গল্প জানাজানি হতেই তুই আসা বন্ধ করে দিলি। আমার বিয়েটা হুট করে দিয়ে দিলো। সেনাবাহিনী কাজ করা বাবা, ওনার কাছে আত্মসম্মানটা বেশি ছিলো তো তাই। নয়তো আমি তোর জন্য অপেক্ষা করতাম। কারণ তুই তো শেষবার যখন দেখা হয়ছিলো বলসি নি এটাই আমাদের শেষ দেখা। তাই আমি সত্যিই তোকে কোন দিন অভিশাপ দিইনি। "
আমার বুক ওর চোখের জলে ভিজে গেলো। আমি বললাম " আমি ও তো তোর ভালোবাসাটা বুঝতে পারি নি। ভেবেছিলাম তোর শারীরিক চাহিদা পূরণ করছিস শুধু তোর আত্মসমর্পণের মূল্য দিই নি। সবার কথা শুনে ভুল ভেবেছিলাম। আসলে মদন বলেছিলো। তোর সাথে ওর সম্পর্কে হয়েছে কয়েক বার হালকা পাতলা। তাই তোর মনটা আমি বুঝতে পারি নি কোন দিন। তোর বয়স সন্ধিক্ষনের মেয়ে হয়ে ওঠার সময় টুকু সুযোগ হিসাবে কাছে লাগিয়ে শরীরের চাহিদা মিটিয়েছি ,তোর মনের খবর নেবার সুযোগ হয় নি।"
ও বললো " সেটাই, মদন,শ্যামল, ঘেঁটু সবাই বলছে ওরা আমার নাগর। তুই মেনেও নিয়েছিস। সত্যি তো সেকেন্ড হ্যান্ড মাল কি বিযে করা যায়। থাক সে পুরনো কথা। ছোট বেলায় খেলনা বাটি খেলার সময় কত বার তো আমার বর হয়েছিস তুই। আজ একটা দিনের জন্য আমাকে তোর বৌ হতে দিবি? তোর এদিকে তো কেউ আসে না। বদনাম হবার ভয় নেই। বাপের বাড়ি লোকজন জানে আমি শশুর বাড়ি চলে গেছি। আসলে যাওয়া পথে তো তোর সাথে শেষ বারে মতো দেখা করে যেতে চাইলাম। আজ তোকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবো তোর এটো বাসন মেজে দেবো, তোর বিছানা করে দেবো, তোর কাপড় ধুয়ে দেবো, রাতে সোহাগ করবো। একদিনের বৌ হতে দিবি তোর।এটাই তো হয়তো আমাদের শেষ দেখা।"
আমার বাড়িটা একটা পুরনো নীলকুঠি। অনেক জমি একটা পুকুর, ,চারিদিক নানা ফলগাছে ফেরা একটা খামার।কাচারী আর একটি সুন্দর প্রাসাদের মতো বাড়ি জীবনের সব সঞ্চিত অর্থ দিয়ে কিনেছি। যদিও জলের দর পেয়েছি। একটা ভুতুড়ে জায়গা বলে কেউ আসে না এদিকে। যদিও সবাই কাছারি বাড়িতে আর মুল বাড়িতে ভুত দেখেছে। তাই আমি আলাদা করে দুটো ঘর বানিয়ে আমার রাধামাধবকে নিয়ে থাকি পুকুরে পাড়ে।মাঝে মাঝে সুটিং পার্টি, পিকনিক পার্টিকে ভাড়া দিই। তবে সবাইকে বলা থাকে বিকালের মধ্যে জায়গা খালি করে দিতে। তেনাদের কোন দিন আমি বিরক্ত করি নি। তেনারাও আমাকে করে নি। পাঁচ ছয়মাস ভালোই কাটিয়ে দিলাম আমার এই নতুন ঠিকানায়।
আদর মাখা ভোরে ওকে বললাম ' যখন তোর বর অন্য মেয়ের সাথে দিন কাটাছে । তখন তুই তোর বরকে ডিভোর্স ছেড়ে দিয়ে চলে আয় আমার কাছে। "
ও বললো " আমার একটা মেয়ে আছে। ভুলে যেও না "
আমি ওকে আরো বেশি করে জরিয়ে ধরে বলাম। "ভালো তো আর বাচ্চা কাচা লাগবে না আমার। বাচ্চা হয়তে গেলে তোর কত কষ্ট, তোর সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবারও ভয় আছে। তোর মেয়েকে আমার নিজের মেয়ে ভাবতে আপত্তি কোথায় আমার? "
ও বুকে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো।
' আমার বর একটা দশ লাখ টাকার চেক, একটা ফ্লাটের দলিল আর ডিভোর্স পেপার আমার শোবার ঘরে রেখে গেছে গত ছয় মাস আগে। তাই সাতদিন সময় দাও আমি ফিরে আসবো।"
ওটা আমার শেষ দেখা নয় ভেবে মন খুশি হয়ে গেলো। দিন কাটছিল না সাতদিন সাত বছরের মতো। সাত দিনের মাথায় আমি ছুটে গেলাম ওদের বাড়িতে, দরাজাতেই আমাকে ঢুকতে বাধা দিলো একটা পুচকি মেয়ে । পাক্কা বুড়ি সে অচেনা মানুষকে কিছুতে ঢুকতে দেবে না। শিউলির মা আমাকে চিনতে পারলো না । ওর বাবা মারা যাবার পর বোধহয় শরীরটা ভেঙে পরেছে। ওনাকে দেখে মন খারাপ হলো। কিন্তু মন ভেঙে গেলো যখন শুনলাম। শিউলি ছয়মাস আগে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। ওর যে রূপে জন্য এ গ্রাম পাগল ছিলো। আগুনে পুড়ে নাকি বিভৎস হয়ে গেছিলো।
বাড়ি ফিরে এসে দেখি ও উঠানে বসে। ও বললো " আমার মেয়েকে দেখলি। মায়ের দিন ফুরিয়ে গেছে আর এক মাসের মধ্যে মারা যাবে, তুই আমার মেয়েটাকে দেখবি রে? "
আমি ওকে গিয়ে জরিয়ে ধরলাম " হু দেখাবো। কিন্তু আমরা দেখবো। কথা দে আমাদের জীবনে শেষ দেখা বলে কোন শব্দ থাকবে না "

