সৌভাগ্যবতী
সৌভাগ্যবতী
সুমিতার শাশুড়ি আভারাণীর সাথে পাশের বাড়ির হাসি ঠাকরুণের ভাব একেবারে গলায় গলায়। দুজনেই দুজন কে চোখে হারান একরকম। আবার ঝগড়ার বেলায়ও দুজনেই সমান পটু। সুমিতা যখন প্রথম এ বাড়ির বৌ হয়ে এসেছিল, ঘটা করে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন শাশুড়ি," এই দেখো, এই আমার বন্ধু শশী। প্রণাম করো দেখি" । প্রণাম করে উঠতেই, পান ঠাসা মুখে শশী বলে উঠেছিলেন," উঁউঃ! গায়ের রংটা বেজায় চাপা। তবে মুখশ্রী খারাপ নয়" ।
বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই সুমিতা বুঝে নিয়েছিল, কেমন জায়গায় এসে পড়েছে সে। সুমিতার বর পল্লব বড় মাতৃভক্ত। মা যা বলবে তাই শিরোধার্য। সুমিতা আসার পর রান্নাঘরের সমস্ত কাজ থেকে ছুটি নিলেন আভা। একা হাতে সব দিক সামলাতে হিমশিম অবস্থা। তবুও সুমিতা মুখ বুজে করে গিয়েছে সব। "বৌমা, রান্না শেষ হলো? লাইটের বিলটা কিন্তু দিয়ে আসতে হবে আজ" । "বৌমা, ফোনের বিল টা কিন্তু এসে গেছে। কবে যাবে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ এ।" "বৌমা, আজ কিন্তু বাজার যেতে হবে" । শ্বশুর মশাই বাতে পঙ্গু। এক এক সময়ে বলতেন, "এই কাজগুলো তো বাবুসোনা কে দিয়েও করাতে পারো" খেঁকিয়ে উঠতেন আভা ।
" তুমি চুপ করো তো। বাবুসোনা সারাদিন কলেজে পড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে ফেরে। ওকে কি এসব বলা যায়! "
" আরে, এইসব ফোনের বিল, গ্যাস বুকিং, লাইটের বিল এসব ফোনেই করা যায়। বাবুসোনা তো করে দিতেই পারে"।
" তাহলে তোমার বৌমা শুধু শুধু ঘরে বসে করবেটা কি! হুঁঃ। তুমিও যেমন। বৌমার প্রতি দরদ একেবারে উথলে উঠছে "।
সুমিতার বাপের বাড়ির লোকজনও আস্তে আস্তে বুঝতে পারছিল, তাদের মেয়ে খুব একটা ভালো নেই। অবস্থাপন্ন ঘর ওদের ।ইচ্ছে করলেই যথেষ্ট ভালো পরিবারে সম্বন্ধ করাই যেত। কিন্তু ওই যে, কপাল বলে একটা বস্তু আছে না! সেটা খন্ডাবে কে।
দুবছরের কন্যা সন্তান কে রেখে মাত্র চার দিনের জ্বরে সুমিতা যখন মারা গেল, শাশুড়ি আভা রাণী এমন মড়াকান্না জুড়লেন, যে শশী ঠাকরুণ বলতে বাধ্য হলেন, "এমন কান্না জুড়েছো যেন তোমার মেয়েই মরেছে"। কাঁদতে কাঁদতে আভা বললেন, "সে তোমরা যে যাই বলো, মেয়েই তো ছিলো আমার"
"মেয়ে ই বটে ! সম্পর্ক ছিল তো আদায় আর কাঁচকলায় "।
ফোঁস করে উঠলেন আভা , "হ্যাঁ ।দোষ তো শুধু আমার তাই না! পাঁচ বছর হয়ে গেল বিয়ে হয়েছে, এখনো একটা নাতির মুখ দেখাতে পারল না।"
" সে আর কি করবে বলো। মানুষটাই তো আর রইলো না। কপাল! কপাল! না হলে এই সামান্য জ্বরে কি কেউ মরে! এখন আর এসব কথা বোলো না। এখনও তোমার বৌ এর মড়া পড়ে রয়েছে। কোথা থেকে কি হবে কে বলতে পারে"! কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়ালেন শশী ঠাকরুণ ।
" একি! চলে যাচ্ছ! আমি কি তবে একা থাকব নাকি এই মড়া আগলে?"
সুমিতার সদ্য দেহমুক্ত আত্মা তখন দুই বুড়ির রঙ্গ দেখে হাসছিল।এবার বলে উঠল," কেন গো বুড়ি! ভয় লাগছে! যখন জ্বরে অচেতন হয়ে পড়েছিলাম, ছেলেকে তো ডাক্তার ডাকতেও দিলে না। মাথায় একটু জলপটি দেবার ব্যবস্থাও তো করোনি। ভয় তখন করেনি!"
কথাগুলো কে বলল ! শশী তো চলে গেল ! তাহলে ! শিউরে উঠলেন আভা ।
কয়েকদিন হল সুমিতার শ্রাদ্ধের পাট চুকেছে । নাতনীটাও মামার বাড়িতে রয়েছে। এখন থেকে মামার বাড়িতেই থাকবে বাচ্চাটা। আভা তাই এখন একদম ফ্রি। আজ নিজের মেয়েকে নিয়ে উনি এসেছেন সুমিতার ঘরে। আলমারি খুলে একটা একটা করে শাড়ি বার করছেন, আর মেয়ে রূপা হামলে পড়ছে সেগুলো দেখে। আভা বলেন, "এই পাঁচ বছরে শাড়ি জমিয়েছিল বটে মেয়েটা। আমি এত পাইনি কখনো। মেয়েটার সৌভাগ্য ছিল বটে।" শাড়ি ঘাঁটতে ঘাঁটতে একসময়ে সুমিতার বিয়ের বেনারসিটা বেরিয়ে এল ।হামলে পড়ল রূপা , ও মা, এটা আমি নেবো। আমার বিয়ের শাড়িটা কি জঘন্য। খুব কমদামী তো। আক্ষেপ ঝরে পড়ে আভার গলায়," সত্যিই তো। তোকে তো তেমন কিছুই দিতে পারিনি। তবে জামাই তো দিচ্ছে এখন তোকে "। মুখের এক বিচিত্র ভঙ্গি করে রূপা বলে, "তা দিচ্ছে বৈকি। সংসারে খাটিয়েও নিচ্ছে তেমন। "
" যাক ।ছাড় ওসব কথা। এই শাড়ি গুলো তোরা দুই বোনে ভাগ করে নিস। আলমারি টা ফাঁকা করতে হবে।বৌমার গয়নাগাটিও প্রচুর আছে।ওগুলো এখন আমার কাছেই থাকবে ।পরে ওসব তোরাই পাবি। বাবুসোনার আবার বিয়ে দেব আমি । আহা রে, বাছার আমার এই তো বয়স। এই বেনারসিটা তুই নিবি বলছিলি, এই নে, রাখ। শাড়িটা রূপার হাত অবধি পৌঁছনোর আগেই ককিয়ে উঠলেন আভা , "ওরে বাবা রে ! মেরে ফেললে রে! কোমরের কাছটায় কে যেন চিমটি কেটে ধরে আছে।"
রূপা অবাক, বলে, "কোথায় মা ! কে তোমাকে চিমটি কাটছে? "
"ওরে বাবা রে! এ ওই লক্ষ্মীছাড়ি বৌ এর কাজ "।
"কে! "
"ওরে । সে যে মরেও মরেনি। সেই দিনই টের পেয়েছিলাম আমি।" খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে রূপা, কালো মেঘে ছেয়ে গিয়েছে আকাশটা। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ঘন ঘন। ঝড় আসছে। বাতাসের মতো বয়ে যেতে যেতে আভার কানে কানে বলে যায় কেউ," কি গো বুড়ি! বড্ড বাড় বেড়েছে না তোমার! আমার বরের আবার বিয়ে দেবে! ওটা হচ্ছে না। আর আমার শাড়ি, গয়না সব ভাগ করে দেবার তুমি কে? ওগুলো সব আমার মেয়ের জন্য থাকবে । বেশি বেগোড়বাঁই দেখলে না মেনিমুখোটাকে সোওজা ওপরে তুলে নিয়ে চলে যাব। "
ছিটকে উঠে দাঁড়ালেন আভা ,বিছানা থেকে নেমে চলে যেতে যেতে বললেন, "চল, চল এঘর থেকে। ওসব কিছুই নিতে হবে না তোদের । ও যেমন আছে থাক।"রূপা অবাক। কি হল হঠাৎ! কেমন একটা ঝড় উঠল, আবার থেমেও গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। মাও যেন কিরকম অদ্ভুত আচরণ করছিল। কি যে হচ্ছে এসব, কে জানে