সাইকো
সাইকো
এটা একটা মেন্টাল আ্যসাইলাম। দীর্ঘদিন ধরে এখানে ভর্তি রয়েছে লোকটা । নাম সুগত চ্যাটার্জি। শান্ত স্বভাবের মানুষ সুগত। চুপ করে নিজের সেলে বসে থাকে। দেওয়ালের গায়ে লেপটে থাকা নিজের ঘন কৃষ্ণ বর্ণের ছায়াটার সাথে আপন মনে কথা বলে। ছায়া টা দিনের বেলায় আর থাকে না ঘরের ভেতর। তখন ভয়ানক ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে মানুষ টা। কোথায় গেল ছায়া! তখন ওকে বাইরে সূর্যের আলোয় আনতে হয়। ছায়া কে ফিরে পেয়ে শান্ত হয়ে যায় মানুষ টা।
ছোট থেকেই একটু অন্যরকম স্বভাব। অসাধারণ মেধাবী। কারো সাথে বন্ধুত্ব বিশেষ ছিল না। সহপাঠীরা দূরে সরে থাকলেও একটু সমীহ করে চলত ছেলেটাকে। অসাধারণ মেধার জোরে সেই শান্ত ছেলেটা একদিন হয়ে উঠল গবেষক সুগত চ্যাটার্জি। গরীব মা বাবার ঘরে পালিত ছেলেটাকে আর ছোট্ট চৌহদ্দিতে বেঁধে রাখা গেল না। আমেরিকায় পাড়ি দিল সুগত।
বাবা মৃত্যু শয্যায়, খবর পেয়ে দশ বছর পর নিজের বাড়িতে ফিরল সুগত। মল্লিকা, সুগতর মা জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ রে বাবা, তোর লাগেজ কোথায়? তোর ঘরে ঢুকিয়ে দিতে বলি। ছোট্ট উত্তর সুগতর, হোটেলে আছে।
মল্লিকা অবাক। সেকিরে! হোটেলে কেন? তোর ঘরটা তো আমি কানুকে দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে রেখেছি। একরকম জোর করেই ছেলেকে হোটেল থেকে বাড়িতে আসতে বাধ্য করেন মল্লিকা। সেই রাতেই মারা যান সুগতর বাবা শেখর। শেখর মারা যাবার পর, মল্লিকা লক্ষ্য করলেন, ছেলে নিজের ঘরেই বসে থাকে দরজা বন্ধ করে। খেতে ডাকলে খেতে আসে। কথা বিশেষ বলে না। একদিন জিজ্ঞেস করলেন, বাবু, কবে ফিরবি বাবা। বৌমাকে তো আনলি না এবারে। এরপরে একবার বৌমা কে নিয়ে আসিস। ওদেশে গিয়ে ছেলে একটা বিয়ে করেছে জানতেন মল্লিকা। শেখর কিংবা ওঁর, কারোরই আপত্তি ছিল না এই মেয়ে কে মেনে নিতে। তোর বাবার সাথে তো দেখা হলো ওর। আমিও কবে আছি, কবে নেই কে জানে। একবার দেখে যেতে চাই। কেমন যেন চমকে উঠল সুগত। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, আর ওখানে ফিরব না ভাবছি। এখানেই তো কাজ পেয়ে গেছি। আর ফিরে কি করব।
মল্লিকা অবাক। সে কিরে! বৌমা ওখানে একা!
হুঁ। আর ছাড়ো না মা। ও সামলে নেবে ঠিক। জানো মা। এখানকার সব চাইতে নাম করা কলেজে ফিজিক্সের অধ্যাপকের পদ পেয়েছি আমি। কেমন একটা চকচকে চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে সুগত। আশঙ্কায় বুক কেঁপে ওঠে মায়ের। সম্পর্ক টি ভেঙে গেল না তো!
সেদিন সুগত কলেজে চলে যাবার পর কারা যেন এসেছিলেন । খোঁজ করছিলেন সুগতর। ছেলে বাড়ি নেই শুনে ওঁরা মল্লিকার সাথেই কথা বলতে চাইলেন। ভেতরে ওনাদের এনে বসালেন মল্লিকা। আচ্ছা মাসীমা ।আপনি কি জানেন, আপনার পুত্রবধু, বৈজ্ঞানিক পূজা সিনহা বেশ কিছুদিন ধরে নিখোঁজ।আমেরিকা থেকে খবর এসেছে।
চমকে উঠলেন মল্লিকা। কি বলছেন! পাওয়া যাচ্ছে না তাকে?
হ্যাঁ। পাওয়া গিয়েছে। আপনার ছেলের আ্যপার্টমেন্টে ফ্রীজের ভেতর থেকে তার দেহাবশেষ পাওয়া গিয়েছে। ম্যাডাম কে খন্ড খন্ড করে কেটে ফ্রীজের ভেতরে ঠেসে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। আপনার ছেলের কীর্তি। পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিতে পারে নি। ও দেশের পুলিশ টীম আর কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসছে এখানে। প্লেন টা এতক্ষণে ল্যান্ড করে গেছে। দমদম এয়ারপোর্ট থেকে আসতে যতটুকু সময় লাগে। খবরটা শুনে মাথা টা ঘুরে উঠেছিল মল্লিকার। এটাও সম্ভব! হা ভগবান! খানিক পরে নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, এই জঘন্য কাজ যে আমার ছেলেই করেছে, কোনও প্রমাণ আছে কি?
সামনে বসে থাকা পুলিশ অফিসারটি একটু হাসলেন। আপনার ছেলে এই কাজে যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। তবু শেষ রক্ষা করতে পারেন নি।
আমেরিকার পুলিশ সেদিন কলেজ থেকেই আ্যরেষ্ট করে নিয়ে যায় সুগত কে। তারপর ওর স্থান হয় এই আ্যসাইলামে। বিচারাধীন বন্দি। তাই সতর্ক প্রহরার মধ্যে আলাদা সেলে রাখা হয় তাকে। আস্তে আস্তে আরো ভায়োলেন্ট হয়ে উঠছে বন্দি সুগত চ্যাটার্জি। এক একটা সময়ে নিজের ছায়া কেই নির্দয় ভাবে মারতে থাকে। তখন ইনজেকশন দিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হয়। বলাই বাহুল্য খুনের অপরাধ স্বীকার করে নি সুগত। ছায়ার সঙ্গে তার সমস্ত কথোপকথন, তার বডি ল্যাঙ্গোয়েজ, নিয়মমাফিক রেকর্ড করা হয়েছে। সেগুলো পর্যালোচনা করে পুলিশ এবং ডাক্তার একই মত প্রকাশ করেন, যে সুগতই খুনি। তার আচরণের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে তার সমগ্র পারিবারিক ও কর্ম জীবনের অনেক কথা। সেগুলো কে অস্বীকার করা যায় না কিছুতেই।
রাত দুটো পনেরো নাগাদ ঘুমটা ভেঙে গেল ।ঘরের মধ্যে কম পাওয়ারের হলদে আলোটা জ্বলছে এখনও। বেড থেকে নেমে দাঁড়াল সুগত চ্যাটার্জি । ছায়া টা আর দেখা যাচ্ছে না। কোথায় গেল ছায়া টা! কদিন ধরে তো খুব শাশাচ্ছিল। এখন কোথায় গেল! আসলে নিজের ছায়া কে খুঁজতে খুঁজতে, নিজেই কখন ছায়া হয়ে গেছেন টেরই পাননি সুগত চ্যাটার্জি।