Aparna Chaudhuri

Comedy

3  

Aparna Chaudhuri

Comedy

সাবান বিভ্রাট

সাবান বিভ্রাট

7 mins
1.0K


সেই ছোটবেলা থেকে আমার জীবনের সমস্ত বিপত্তির কারণ হল সাবান। সত্যি বলছি ! সাবানের সঙ্গে আমার ছত্তিস কা আঁকড়া। ওই কি যেন বলে না আমার ভাগ্যে সাবানে শনি। বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে খুলেই বলি।

সেই কবেকার কথা! তখন সবে সবে আমি হাফপ্যান্ট ধরেছি। মা দাদার হাফপ্যান্টগুলো দড়ি দিয়ে বেঁধে আমায় পরিয়ে দিত। তাই ছোটাছুটি করার সময় লজ্জা নিবারণার্থে বেশীরভাগ সময়ই একহাতে হাফপ্যান্ট টা ধরে থাকতে হত।

তখন দাদাদের পাড়ার ক্রিকেট টিমে আমি টুয়েফথ ম্যান (মানে এলেবেলে) হিসাবে জয়েন করেছি। আমার দায়িত্ব ছিল বল মাঠের বাইরে গেলে (মানে মাঠের পাশের নালায় পড়ে গেলে) তা উদ্ধার করে আনা। এই রকম কাজে রিস্ক এবং হেলথ হ্যাজার্ড অনেক, তাই যখন বাড়ী ফিরতাম মা খিড়কীর দরজা দিয়ে ঢুকিয়ে সোজা কলঘরে নিয়ে গিয়ে ভালো করে সাবান দিয়ে হাতপা ধুইয়ে তবে ঘরে ঢুকতে দিত । একদিন মা কাজে ব্যস্ত থাকায় আমি নিজেই সাবান দিয়ে হাত পা ধুয়ে ভিতরে ঢুকে এসেছি। ছোটবেলা থেকেই আমি যে কাজই করি, খুবই কনফিডেন্সের সঙ্গে করি। সেদিনও তাই করেছি। কিন্তু বাবা স্নান করতে গিয়ে কলঘর থেকে হেব্বি চেঁচামিচি করতে করতে বেরিয়ে এলো। দেখা গেলো বাবার হাতে গায়ে ভর্তি কালো কালো পাঁক।

“ কোন হতচ্ছাড়া সাবানটায় পাঁক মাখিয়ে রেখেছে?”

সবার সঙ্গে আমিও কলতলার সামনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছি। বাবার পরনে গামছা, হাতে সাবান, একেবারে রুদ্রমূর্তি।

“ নিশ্চয়ই তুই?” বলেই ছুটে এসে আমায় ধরে রাম ধোলাই দিতে শুরু করলো। ভাগ্যিস মা এসে গেছিল তাই আমি অল্পের ওপর দিয়ে রক্ষা পেলুম।

“ আঃ! কি হচ্ছে কি ছেলেমানুষ!” বলে মা আমাকে সে যাত্রায় বাঁচিয়ে দিল।

এই পুরো ঘটনাটায় একটা জিনিষ দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম, এতো দৌড়োদৌড়ি মারামারি সব করে ফেলল বাবা, কিন্তু গামছা এদিক থেকে ওদিক হলনা! আমার হাফপ্যান্ট হলে অন্তত পাঁচবার খুলে যেত। নাঃ! বাবার কাছে আর কিছু না হোক গামছা বাঁধাটা শিখতেই হবে।

যে যাই বলুক, আমি জানি সেদিন দোষটা আমারও পুরোপুরি ছিলনা । এমন কেলোকুচ্ছিত দেখতে নিম সাবান, যে তাতে পাঁক লেগে আছে না নেই তা বোঝাই মুশকিল। তাই আমি ঠিক করলাম এবার থেকে আর নিম সাবান নয় মায়ের জন্য যে সাদা-গোলাপি গন্ধ সাবান আসে আমি সেই সাবান ব্যবহার করব। 

মায়ের সাবানটা একটা সাবান কেসের মধ্যে আলাদা করে কলতলার তাকে রাখা থাকে। পরেরদিন খেলে এসে আমি আমার, দাদার আর বাবার ‘কমন’ সাবানের দিকে না তাকিয়ে সোজা মায়ের সাবানকেসটা পেড়ে নিলাম তাক থেকে। কেসটা খুলতেই একটা সুন্দর ফুলের গন্ধে আমার মন প্রাণ সব ভরে গেল। মাখতে হলে এইরম সাবানই মাখা উচিৎ। ভালো করে হাত পা ধুলাম। সেদিন বল তুলতে গিয়ে পা হড়কে নালার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। তাই হাফপ্যান্টটার অবস্থা অত্যন্ত খারাপ ছিল। ভাবলাম হাতপা ধুতে পারি আর প্যান্ট ধুতে পারি না? যাক সব ধোয়াধুয়ি শেষ করে, শেষে সাবানটাকেও পরিষ্কার করে ধুয়ে সাবানের কেসের মধ্যে ভরে কলঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। প্যান্টটা ধোবার পর সাবানটা কি একটু সরু হয়ে গেছে? না না ও আমার মনের ভুল!

কিন্তু মনের ভুল যে না তা পরেরদিন মায়ের কানমলা খেয়ে পরিষ্কার বুঝে গিয়েছিলাম।

“তুই কি মেয়ে যে গন্ধ সাবান মাকছিস? মেকেছিস মেকেছিস কিন্তু তা বলে সাবানটাকে আদ্দেক করে দিবি? নিজের গায়ে মেকেচিস নাকি মোষকে সাবান মাকিয়ে ফর্সা করছিলিস শুনি? ”

বোঝ! সাবানের আবার ছেলে মেয়ে হয়? সেটাই তো জানতাম না।         

তারপর সেবার স্কুল পিকনিকে? সে কি কাণ্ড!

আমরা ক্লাস ফাইভের ছেলেরা সবাই স্কুল থেকে পিকনিকে গেছি। যে বাগানবাড়ীটায় আমরা গেছি সেখানে একটা বিরাট কলতলা বানানো আছে সেখানে সবাই একসাথে জল ছোঁড়াছুঁড়ি করে স্নান করা হবে। আমরা সব বন্ধুরা নিজেদের সাবান আর গামছা নিয়ে স্নানে যাচ্ছি এমন সময় আমার বন্ধু প্রবীর আর অরূপ বলল, “একবার রান্নাবান্নার খবরটা নিয়ে যাই? কি বলিস?”

আমি ভেবে দেখলাম আইডিয়াটা খারাপ না। তিনজনে মিলে গেলাম দেখতে। গাছের তলায় চাঁদোয়া খটিয়ে রান্না হচ্ছে। ঠাকুর বিরাট কড়ায় ডাল চড়িয়ে কোথাও গেছে। আমি সবে ডালের গন্ধটা শুঁকব বলে ঝুঁকেছি, ব্যাস। একটা টিকটিকি গাছ থেকে পড়লো সোজা অরূপের ঘাড়ে। অরুপ লাফিয়ে পড়লো প্রবীরের ঘাড়ে আর প্রবীর আমার ঘাড়ে। নিজেকে বাঁচাতে আমি তাড়াতাড়ি ডালের হাতাটাকে চেপে ধরলাম কিন্তু আমার হাতের সাবান আর গামছাটা গিয়ে পড়লো ডালের কড়াইয়ে।

টিকটিকিটারও বলিহারি সেন্স অফ টাইমিং! আর কয়েক সেকেন্ড বাদে পড়লে কি হত? কিন্তু না...।

যাই হোক, হাতা দিয়ে কোনও রকমে গামছাটা উদ্ধার করা গেলেও সাবানটাকে আর খুঁজে পাওয়া গেলো না, কারণ-

“অ্যাই তোমরা একেনে কি করতিচ?” বলে বামুনঠাকুর কোথা থেকে যেন তেড়ে এলো, কাজেই আমাদের রণে ভঙ্গ দিতে হল।

গোল বাঁধল খেতে বসে। ডালে বিশ্রী সাবানের গন্ধ। কেউ ডাল খেতে পারছেনা। স্যারেরা ঠাকুরকে ডেকে পাঠালেন।

“ আমি তো সব ঠিকঠাকই দিইচি। কিন্তু তিনটে ছেলে ডালের হাতা নিয়ে নাড়ানাড়ি করতেছিল।“ মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলল ঠাকুর।

আমরা তিনজন ধরা পড়ে গেলুম। শাস্তি স্বরূপ ওই বিশাল কড়াই আমাদের মেজে পরিষ্কার করতে হয়েছিল।

কিন্তু এখানেই শেষ না। কলেজে, আমার একজন গার্ল ফ্রেন্ড হয়েছিল। ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে। ক্লাসের বাকি ছেলেগুলো জ্বলে আংড়া হয়ে যাচ্ছিল।

“তোর মধ্যে সুজাতা কি এমন দেখলো, যা ক্লাসের আর কোনও ছেলের মধ্যে নেই?” সবার চোখে এই প্রশ্ন দেখতে পেতাম আমি। ঠারে ঠোরে সবাই বলতো কিন্তু ডাইরেক্টলি আমায় কেউ চার্জ করতে সাহস পেতো না।

আর জিজ্ঞাসা করলেই বা আমি কি বলতাম? ও আমার মধ্যে কি দেখেছে তার আমি কি জানি ? আমি ওর মধ্যে কি দেখেছি (যেটা আমার ক্লাসের বাকি ছেলেরাও দেখেছে) তা আমি জানি।

যাইহোক একদিন অনেক চেষ্টা চরিত্র করার পর ও আমার কলেজ হোস্টেলের রুমে আসতে রাজি হল। উউউফফফফফ......!!!! আমার সে কি আনন্দ!

এতো আনন্দ হচ্ছিল, যে মনে হচ্ছিল, এবার পাগল না হয়ে যাই। ক্লাসের বাকি ছেলেগুলো আমারদিকে কেমন একটা শকুনি শকুনি দৃষ্টি দিচ্ছিল। আমি ওসব গায়ে না মেখে মন দিয়ে আমার ঘর পরিষ্কার করছিলাম। কাজ তো কম না। দেয়াল থেকে আমার আর আমার রুমমেট বিরিন্দরের সব অ্যাডাল্ট পোস্টার সরানো, আমাদের দুজনের সারা সপ্তাহের ব্যবহার করা আন্ডারওয়্যার আর গেঞ্জির পাহাড় লোকানো, চাদর বদলানো, তারপর নিজে তৈরি হওয়া। শেষে দেখি করিডোরের দিকের জানালার কাঁচটা একটু ভাঙা রয়েছে। সেটার ওপরও একটা কাগজ সাঁটলাম। যতই হোক একজন মহিলা আসছে, তার একটা প্রাইভেসির ব্যাপার তো আছে।

ঠিক সময়মত সুজাতা এসে গেলো। আমি সুজাতার জন্য ফুলের বোকে আর চকোলেট এনে রেখেছিলাম। সব কিছু পারফেক্ট ছিল। ও আমার ঘরে ঢুকতেই আমি ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিলেম। ওর ঠোঁটে খেলে গেলো একটা প্রশ্রয়ের হাসি।

ও মিষ্টি হেসে আমায় বলল,” আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসি?”

“হ্যাঁ যাও না, ঘরের সঙ্গে অ্যাটাচ টয়লেট।“ আমার বুকের হাতুড়ির আওয়াজ বোধহয় পাড়ার মোড় থেকে শোনা যাচ্ছিল।

ও টয়লেট থেকে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বেরিয়ে এলো। সেই মিষ্টি হাসি কোথায়? তার জায়গায় ওর চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে। ওর হাতে একটা গায়ে মাখার সাবান আরে তাতে জড়িয়ে আছে লম্বা একটা চুল। ও চুলটা টেনে বার করে আমার নাকের সামনে ঝুলিয়ে ধরে হিসহিসে গলায় বলে উঠলো,” ওঃ! এই ব্যাপার। তাহলে আমিই প্রথম নই? এর আগেও অনেকে এসেছে?”

তারপর আমাকে কোনোরকম সাফাই দেবার সময় না দিয়ে, ফুলের বোকে আর চকোলেটটা আমার মুখের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে ধাঁ করে ঘরের দরজাটা খুলে দিল। দরজার বাইরে কান লাগিয়ে যারা আমদের প্রেমালাপ শোনার চেষ্টা করছিল তারা স্বাভাবিক নিয়মেই ভারসাম্য রাখতে না পেরে হুড়মুড় করে ঘরের ভিতর এসে পড়লো। সুজাতা তাদেরকে রাস্তায় পড়ে থাকা জঞ্জালের মত ডিঙিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেলো। 

আমি নিজেকে সামলে কোনোরকমে ঘর থেকে বেরিয়ে ওর পিছন পিছন ছুটলাম, “ ওটা বিরিন্দরের সাবান। বিরিন্দর সিং, আমার রুমমেট । ওর চুল লম্বা ... সুজাতা শোনো।“

কিন্তু সুজাতা আর ফিরল না।

এই কয়মাস হল আমি চাকরিতে ঢুকেছি। মুম্বাইয়ের একটা ‘চল’এ থাকি। যারা ‘চল’ দেখেছেন তারা বুঝবেন এখানে একটা টানা বারান্দা ধরে সারি সারি ঘর থাকে আর বারান্দার শেষে থাকে কয়েকটা টয়লেট আর বাথরুম। ভাবছি কিছুদিন বাদে একটু টাকা জমিয়ে একটা ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া নেবো। এখানে থাকতে আর ভালো লাগে না। না, লোকজন সবাই ভালো কিন্তু পাশের বাড়ীর ভাবীটা বড্ড ঢলানি। কোনও কাজ নেই কম্ম নেই খালি খালি ঘরে ঢুকে আসে। এসব আমার একদম পছন্দ না। বিশেষ করে সুজাতার ঘটনাটার পর থেকে আমি মেয়েদের থেকে একটু দূরে দূরেই থাকি। 

পরশু আমার মাসতুতো ভাই এসেছে। আমার কাছেই আছে। আজ আমরা মুম্বাই দেখতে বেরুবো।

আমি বললাম, “চল, জল এসেছে, তাড়াতাড়ি স্নান করে নে।“

আমার ভাই দারুণ কায়দা করে সব লাইন টপকিয়ে স্যাট করে একটা বাথরুমের সামনে পৌঁছে গেলো।

“ শিগগির সাবান আর তোয়ালেটা দে।“ আমার ভাই চেঁচাল।

আমি টিপ করে তোয়ালেটা ছুঁড়লাম, আমার ভাই লুফে নিল। এবার সাবান। আবার সাবান!

“ কিরে ছোঁড় না সাবানটা!”

একটু দোনমনো করে সাবানটা ছুঁড়লাম। আমার ভাই হাতটা তুলল সাবানটা লোফার জন্য কিন্তু না একদম ঠিক সময়ে আমার পাশের ঘরের ভাবী হাজার ভোল্টের একটা ঢলানি হাসি নিয়ে মাঝখানে এসে গেল, “ দেবর জী......!”

ফলে যা হওয়া উচিৎ ছিল না তাই হল। আমার ছোঁড়া সাবানটা চ্যাম্পিয়নের মারা বিলিয়ার্ডের বলের মত ভাবীর কাঁধের সামনের দিকে ধাক্কা খেয়ে সোজা ঢুকে গেলো ভাবীর শাড়ীর আঁচলের মধ্যে ‘অ্যান্ড ইট ইস আ পট ’।

আমার পিছনে কিছু একটা দেখে ভাবীর মুখের হাসিটা আতঙ্কে পরিবর্তিত হয়ে গেলো। আমার কি রকম একটা সন্দেহ হল। আমি পিছন ফিরলাম। ফিরে যা দেখলাম তাতে আমার মাথার সবকটা চুল একসাথে খাড়া হয়ে গেলো। ভাবীর বর (যার হাতের গুলির মাপ সাড়ে ষোলো ইঞ্চি), ফুল স্পীডে আমার দিকে ছুটে আসছে। আমি এখন প্রাণ বাঁচাতে আপ্রাণ দৌড়োচ্ছি।

“ মা বিপত্তারিণী...! মা! মাগো! আজ আমাকে রক্ষা কর মা!! ওর হাতে পড়লে আমার এই লিকলিকে হাত পায়ের একটাও হাড় আসতো থাকবে না মা......! মাগো! আমি তোমায় এক ডজন গন্ধসাবান দিয়ে পুজো দেবো মা...! জীবনে আর কখনও সাবান মাখবো না মা......! বাঁচাও......!"


Rate this content
Log in