STORYMIRROR

Arpita Pal

Tragedy Crime Others

3  

Arpita Pal

Tragedy Crime Others

রংবদল

রংবদল

1 min
280

আজ সকালে ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছে। তাই শিখা নিজেকে তাড়াতাড়ি তৈরি করছিল। হয়তো সকালে জল-খাবার খাওয়ারও সময় পাবে না। বাসে আধ ঘণ্টা যাত্রা করে রেল স্টেশন, সেখান থেকে ট্রেন ধরে ৪৫ মিনিট পর একটি নির্দিষ্ট স্টেশনে নেমে টোটো করে আরও ১৫ মিনিট গিয়ে তারপর স্কুল। এখন এতো দেরি হয়ে গেছে যে আজ নির্ঘাত স্কুলের আ্যটেনডেন্সের খাতায় লেট্ মারকিং পড়ে যাবে, যেটা শিখার একেবারেই পছন্দ নয়। এমন সময় কলিং বেলটা বেজে উঠল। শিখা বরাবরই একজন আত্মনির্ভরশীল ও স্বাধীনচেতা প্রকৃতির মানুষ। তার নিজের জীবনে কোনো ব্যাক্তির অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ সে একেবারেই বরদাস্ত করতে পারে না। এই নিয়ে মা-বাবার সাথে বহুবার তর্কবিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। বৈবাহিক সম্পর্কটাও দু-বছরের বেশি স্থায়ী হল না তার। মা-বাবা পরলোক গমন করার পর একতলার ছোট ছিমছাম বাড়িটাতে এখন সে একাই থাকে। সকালে শুধু মিনু মাসি এসে বাড়ির সব কাজ আর রান্না-বান্না করে সন্ধ্যেবেলায় শিখা আসার পর বিদায় নেয়। আজ তিনদিন হল মিনু মাসি আর কাজে আসছে না। তার নাকি খুব জ্বর। তাই এখন কলিং বেল বাজার পর দরজা খুলে দেওয়ার জন্য ঘরে শিখা ছাড়া আর কেউ নেই। তাড়াতাড়ি করে চুল বেঁধে শাড়ির আঁচলটা কোনোরকমে ঠিকঠাক করে দরজাটা খুলে দেখে সামনে প্রায় বছর দশের একটি মেয়ে কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে একটা আধ ময়লা ফ্রক, সেইরকমই তার গায়ের রং আর চুল গুলো উসকো খুসকো। মুখে একটা মিষ্টতার ছাপ থাকলেও সেটা ভয় আর লজ্জার আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে।   

শিখা মেয়টিকে দেখে একটু বিরক্ত হয়েই বলল- 

   “ এখন মাপ কর। কিছু দিতে পারব না। বড্ড তাড়া আছে। “

এই বলে দরজাটা প্রায় বন্ধই করে দিচ্ছিল। কিন্তু মেয়েটা সাথে সাথেই বলে উঠল- 

   “ না না। আমার কিছু চাই না। “ 

শিখা একটু অবাক হয়ে অর্ধেক বন্ধ হওয়া দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল- 

   “ তাহলে কিসের জন্য এসেছ? “ 

মেয়েটা সেরকমই কাঁচুমাচু মুখ করে বলল- 

   “ তোমার বাড়িতে কাজ করার জন্য। “ 

এই কথাটা শোনার পর শিখার অবাক হওয়াটা আরও এক ধাপ বেড়ে গেল। এই ছোট্ট মেয়েটা নাকি এসেছে তার বাড়িতে কাজ করবে বলে! কিন্তু আপাতততো মিনু মাসি আছে। যদিও সে তিন দিন ধরে আসছে না। তবে সেটা সাময়িক। 

খা একটু ভ্রু কুঁচকে বলল- 

   “ হ্যাঁ......কিন্তু তুমি কি করে জানলে? “ 

মেয়েটি এবার খিল খিল করে হেসে বলল- 

   “ আমি তো তারই মেয়ে গো। আমার নাম সীমা। মা খুব অসুস্থ বলে তাইতো আমাকে তোমার কাছে পাঠাল। “ 

শিখা জানে যে মিনু মাসির এক মেয়ে আর এক ছেলে আছে। মেয়েটি বড়ো। নাম সীমা। আর ছেলেটি ছোট। নাম শঙ্কর। সীমা অনেক ছোট থাকতে তাকে কোলে করে নিয়ে কয়েকবার শিখার বাড়িতে কাজ করতে এসেছিল মিনু মাসি। তারপর আর তাকে শিখা কখনও দেখেনি। তাই এখন এতো বছর পর সীমাকে সে চিনতে পারেনি। 

মেয়েটি আবার বলে উঠল- 

   “ তুমি কিচ্ছু চিন্তা কোরো না শিখা দিদি। আমি বাড়ির সব কাজ পারি। মা যখন বাড়ি থাকে না তখন তো আমাকেই    সব কাজ করতে হয়। ভাইকে তো দেখাশোনা আমিই করি। “ 

সীমার এই কথা শুনে শিখা না হেসে থাকতে পারল না। মেয়েটা কাজ কতটা জানে সেটা জানা না থাকলেও তবে কথা ভালই বলতে পারে। পাকা বুড়ি একটা।

                                           


                                                                      • • • • • • • 

 

রাতে খাওয়ার শেষে শিখা স্কুলের পরীক্ষার খাতা গুলো চেক্ করছিল। এমন সময় মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে। ফোনটা হাতে নিয়ে সে দেখল মিনু মাসি ফোন করেছে। ঘড়িতে তখন রাত ১০ঃ৩০ টা বাজে।  

ফোনটা রিসিভ করে শিখা বলল- 

   “ হ্যাঁ বলো মিনু মাসি। এতো রাতে ফোন করলে যে? আবার কি কাল আসবে না? দেখ আমি কিন্তু...... “ 

কথাটা শেষ হলো শিখার। তার আগেই ফোনের ওপার থেকে ভেসে এল কান্নার শব্দ। শিখা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল-  

   “ আবার বুঝি শয়তানটা এসেছে? উফ্! তোমাকে কতবার বলেছি ওকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দাও। “ 

মিনু মাসির স্বামী রমেশ, দুজনে ভালবেসে একে অপরকে বিয়ে করলেও ছেলে মেয়ে হওয়ার পর সংসারে আরও টাকার যোগান দিতে গিয়ে ঘটনাচক্রে অসামাজিক কাজকর্মে যুক্ত হয়ে যায়। তাই মাঝে মধ্যেই কয়েক মাসের জন্য কোথায় উধাও হয়ে যায়। আবার হঠাৎ করেই বাড়ি ফেরে। মিনুমাসির কাছে টাকা চায়। কিন্তু তা দিতে অস্বীকার করলে রমেশ নিজের স্রীকে এমনকি নিজের ছেলে মেয়েকেও পর্যন্ত মারধর করে।   

 সেই মিনু মাসির থেকেই শিখা জানতে পারল যে রমেশ আজ অনেক সকালে বাড়ি ফিরেছিল। বেশ খোশ মেজাজেই ছিল নাকি। মিনু মাসি কাজের জন্য শিখার বাড়িতে চলে আসে। সন্ধ্যের পর ফিরে দেখে বাড়িতে কেউ নেই। এক প্রতিবেশীর থেকে জানতে পারে রমেশ নাকি সীমা আর শঙ্করকে নিয়ে কোথায় যেন গেছে। কাউকে কিছু বলে যাইনি। এমনকি মিনু মাসিকেও কিছু জানায়নি। মিনু মাসি ভীষণ ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। রমেশকে অনেকবার ফোন করেও তাকে পাওয়া যাইনি। তার ফোন বন্ধ। মিনু মাসির আশঙ্কা হতে থাকে এক মাস আগে রমেশের বলা কথাটা মনে পড়তেই। রমেশ বলেছিল সীমা আর শঙ্করকে নাকি একটা ভাল জায়গায় কাজে ঢুকিয়ে দেবে। তাতে নাকি অনেক পয়সা পাওয়া যাবে। মিনু মাসি কিছুতেই এই কথায় রাজি হয়নি। তারা শিখার তত্ত্বাবধানে পুরো দমে পড়াশুনো শিখছে। তাই কিছুতেই তাদের ভবিষ্যত নষ্ট হতে দেওয়া যায়না। সেইদিন রাতে মিনু মাসির সাথে রমেশের এই নিয়ে অনেক ঝগড়া হয়। এমনকি নিজের স্বামীর হাতে তাকে মারও খেতে হয়। কিন্তু মিনু মাসি সেদিন সব অপমান, সব যন্ত্রনা সহ্য করে নিয়েছিল শুধুমাত্র নিজের ছেলে মেয়ের কথা ভেবেই। তবুও সে সীমা আর শঙ্করকে তাদের লোভী স্বার্থপর বাবার হাত থেকে বাঁচাতে পারল না। আসলে সে কখনও ভাবতেই পারেনি যে একজন বাবা হয়ে নিজের সন্তানদের এতো বড়ো ক্ষতি করতে পারে। 

শিখার চোখের সামনে এখন সীমা আর শঙ্করের মুখটা ভেসে উঠছে। ১০ বছরের সীমা যেদিন প্রথম শিখার বাড়িতে এসেছিল সেদিন তার কথার ফুলঝুরি শুনে তাকে বেশ ভালো লেগে যায়। মেয়েটা কাজেও ভীষণ চটপটে। সেই থেকে সীমার প্রতি এক অদ্ভুত মায়া তৈরি হয় মনে। সীমা আর শঙ্করের স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব নিতে গিয়ে একজন “ Single Independent Woman “ হিসেবে শিখা একবারের জন্যও পিছপা হয়নি। সে অনেকবার মিনু মাসিকে বলেছিল যে সে যাতে নিজের ছেলে মেয়েকে নিয়ে শিখার বাড়িতে থাকে। স্বামীর প্রতি ভালোবাসা থেকে না হোক হয়তো আত্মসম্মানের বোধ থেকেই হয়তো অন্যের বাড়িতে আশ্রিত হয়ে থাকতে চায়নি মিনু মাসি। 

 

শিখা জানে না সীমা আর শঙ্করকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে কিনা। এইরকম ঘটনাতো প্রায়শই দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘটে চলেছে। এর জন্য যা যা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সেটা সে নেবে। তবে এইসব ঘটনাগুলো থেকে একটা প্রশ্নই চিন্তার কুঠিরে উঁকি মারে যে আমাদের দেশ বহিরাগত শক্তি গুলো থেকে মুক্তি পেতে পারলেও দেশের এক শ্রেনির মানুষ কি দারিদ্রতার হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে? হতভাগা দরিদ্রগুলো আইনের ফাঁক গলে সীমানার কাঁটা তার পেরিয়ে অন্য দেশে চলে যেতে পারলেও তাদের বেঁচে থাকার অধিকারগুলো কখনও দারিদ্র সীমার কাঁটা তার পেরোতে পারে না। দারিদ্রতার চক্রব্যুহে থাকা মানুষগুলোর জীবনের রঙ কখনও বদলায় না। আকাশের পূর্ণিমার চাঁদ তাদের কাছে সারাজীবন ঝলসানো রুটিই থেকে যায়। রামধনুর সাতটা রং যেদিন এই কপাল পোড়া মানুষগুলোর জীবনে এসে লাগবে সেদিন আমাদের তথাকথিত স্বাধীন ভারতকে বলা হবে # Free India from “ POVERTY “ ।।

  


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy