Jeet Guha Thakurta

Classics Comedy

4  

Jeet Guha Thakurta

Classics Comedy

রম্যকথা: ডাক্তার

রম্যকথা: ডাক্তার

6 mins
781


হাসি কান্না হীরা পান্না : ডাক্তার


পৃথিবীর সবচেয়ে গম্ভীর, সিরিয়াস, নীরস মানুষদের লিষ্ট বানালে আমি স্থির-নিশ্চিত যে ডাক্তাররা সেই লিষ্টের উপরের দিকেই থাকবেন। তবু দুনিয়ায় যত যা মজার কৌতুকী আছে, তার সিংহভাগই ডাক্তারদের নিয়ে কেন বানানো হয়, তার ব্যাখ্যা আমার সত্যিই জানা নেই।


ডাকাডাকির সাথে ডাক্তারদের একটা মিল আছে, সেটা বোঝাই যায়। রাতে-বিরেতে যাকে ডাকতে হয়, হঠাৎ বুকে ব্যাথা উঠলে কি পেট কনকনালে বলতে হয় "ডাক তারে, ডাক", তিনিই হলেন ডাক্তার। তবে তত্ত্বকথা বলছে যে এই ডাক্তার শব্দটি আদতে ইংরাজী ডক্টর শব্দের বাংলায় রূপান্তরমাত্র।


ইংরেজী ভাষার প্রচলনের আগে ডাক্তারদের বলা হতো কবিরাজ বা বৈদ্য। এই উপাধির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ অবশ্য আমার জানা নেই। কবিরাজ অর্থাৎ কবিদের যিনি রাজা। আরেকভাবে দেখলে, যিনি রাজা তিনিই কবি। অথবা রাজা হতে গিয়ে কবি। কবি কবি ভাব, রাজার অভাব। যেভাবেই ভাবার চেষ্টা করি না কেন, কোনো জায়গা থেকেই তো ডাক্তার বেরোচ্ছে না। কবিতার সাথে ডাক্তারকে এইভাবে বেঁধে দেওয়ার কী কারণ থাকতে পারে, আমার কিছুতেই বোধগম্য হয় না। আমি আমার দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারি না যে কোনো ডাক্তার তার চেম্বারে বসে প্রেসক্রিপশান লেখার প্যাডে কবিতা লিখছেন - 'ওগো সুন্দরী, দেখেছিনু তোমায়, ইনফ্লুয়েঞ্জায়- বুকে স্টেথো চেপে ধরি।' কল্পনা করা যায় না। তাহলে ডাক্তারদের নাম কবিরাজ কীভাবে হয়, কীভাবে হতে পারে, পাঠকেরা কেউ আমাকে জানালে আমি কৃতজ্ঞ থাকবো।


আর রইলো বৈদ্য। ব্যাকরণগতভাবে দেখলে, বৈদ্য মানে যিনি বেদ পড়েছেন, উপনিষদ পড়েছেন। কিন্তু লে হালুয়া। বেদ পড়েছেন, মন্ত্র-তন্ত্র জানেন, এরকম একজন তো আমাদের বাড়ি লক্ষ্মীপুজো করতে আসেন। তিনি ডাক্তার তো নন। তিনি স্রেফ ঠাকুরের পূজার্চনা করেন। কিন্তু তাই বলে তিনি নিজে ঠাকুর অবশ্যই নন। যিনি আসলে ঠাকুর, যাকে আমরা ঠাকুর বলে ডাকি, তিনি আবার রান্না করেন। অর্থাৎ তিনি রাঁধুনি। কিন্তু রাঁধুনি বলতে বোঝায় একরকম মশলা যা কিনা তরকারিতে দেয়। কী আর বলবো, ব্যাপারগুলো যত ভাবতে যাই, ততোই যেন গুলিয়ে যায়। তার চাইতে আসুন ব্যুৎপত্তি ছেড়ে বরং ডাক্তারদের প্রতিপত্তি নিয়ে কথা বলা যাক।


আমরা সবাই জানি, কোনো ডাক্তারের হাতের লেখা যত খারাপ, তার প্রতিপত্তি ততোই বেশী। আমার ঠিক কোনো ধারণা নেই ডাক্তারদের পড়াশুনার সিলেবাসে হাতের লেখা খারাপ বানাবার কোনো সাবজেক্ট আছে কিনা, কিন্তু আমি আমার অভিজ্ঞতায় আজ পর্যন্ত কোনো ডাক্তারকে দেখিনি যিনি পঠনযোগ্য হাতের লেখায় কিছু লেখেন। কোনো ডাক্তার না। আর সত্যিই যদি ধরুন কোনো ডাক্তার গোটা গোটা ভীষণ সুন্দর হস্তাক্ষরে ঝকঝকে প্রেসক্রিপশান লিখে দেন, আমাদের ভরসা হবে সেই ডাক্তারের উপর ? আপনাদের কথা জানি না, কিন্তু আমি তো আর কোনোদিন সেই ডাক্তারের ধারেকাছেও বোধহয় যাবো না। এ কেমন ডাক্তার যার হাতের লেখা পড়া যায় ?


এই তো কিছুদিন আগে একদল ডাক্তার আন্দোলন করছিলেন সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার গাফিলতির বিরুদ্ধে। হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে মিছিল করছিলেন তারা। তাদের দাবী হলো স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে ডাক্তারদের সংখ্যা বাড়াতে হবে, পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি ও রোগীদের নিরাপত্তার সুযোগ দিতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, খুবই সাধু উদ্যোগ। কিন্তু সাধারণ মানুষ কেউ তাতে সামিল হননি। কেউ সমর্থন করে তাদের সঙ্গে এক পা-ও হাঁটেননি।। কেন ? কী ব্যাপার ? শেষমেশ জানা গেলো, ওই প্ল্যাকার্ড-ব্যানার-ফেস্টুন সব আসলে ডাক্তাররা নিজেরাই নাকি রঙ-তুলি দিয়ে লিখেছিলেন। ডাক্তারদের হাতের লেখা। ফলে কেউ বুঝতেই পারেনি কী নিয়ে আন্দোলন চলছে।


এর চাইতেও ভয়ানক অবস্থা হয়েছিলো দক্ষিণ ভারতের একটি গ্রামে। গ্রামের যিনি প্রধান, বা মুখিয়া, তারই বাড়িতে একদিন রাত্রে বড়সড় একটা চুরি হয়ে যায়। পুলিশ এসে তদন্ত করে শেষে ওই গ্রামেরই একমাত্র ডাক্তারকে ধরে বেঁধে কোর্টে হাজির করে। সে বেচারা ডাক্তার বুঝতেও পারে না যে তাকে কেন ধরা হলো।


জজ সাহেবও অবাক। তিনি বললেন, "চুরির কী প্রমাণ আছে ডাক্তারের বিরুদ্ধে ?"


পুলিশকর্তা তখন খোলসা করলেন ব্যাপারটা। যেদিন চুরি হয়েছে, সেদিন চোর শুধু চুরিই করেনি, চুরি করে চলে যাওয়ার সময় মুখিয়ার বাড়ির দরজায় চোর কিছু লিখে রেখেও গেছে। সেই লেখাই তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।


জজ সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, "কী লেখা ছিলো সেখানে ?"


পুলিশের স্পষ্ট উত্তর - "সেই লেখার পাঠোদ্ধার করা যায়নি বলেই তো আমরা বুঝে গেছি চোর কে হতে পারে।"


এও তাও বাহ্য। আমি সেদিন শুনলাম গুগল তাদের ক্যাপচা টেকনোলজিতে যে ত্যাড়াব্যাঁকা লেখাগুলি ব্যবহার করে, সেগুলি আদতে নাকি বিভিন্ন ডাক্তারদের লেখা। বুঝুন একবার কান্ডটা।


কিন্তু সুধী পাঠকবৃন্দ, আমার ডাক্তারবন্ধুরা আমার বাড়ি চড়াও হয়ে আমাকে মারধর করবার আগে স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে এগুলি সবই গল্পগাঁথা বা গুজব। আমার নিজের শরীর খারাপ করলে সেই ডাক্তারদের শরণাপন্নই তো হতে হবে। অতএব উদ্ভট কল্পকাহিনী আর নয়। আমরা বরং বাস্তবে যাই চলুন।


বাস্তবের কাহিনীটিও এইরকমই এক ডাক্তারকে নিয়ে, যার বিশাল প্রতিপত্তি, ভীষণ পসার। প্রাসাদের মতো বাংলো বাড়ি, চার-চারটে প্রাইভেট গাড়ি, মানে প্রচুর টাকাপয়সা। কিন্তু ডাক্তারি করতে করতে তার আর বিয়েই করা হয়নি সারা জীবন। ৬৫ বছর বয়সে গিয়ে তার মনে হলো এবার একজন জীবনসঙ্গী দরকার। টাকার জোর থাকলে সবই হয়। মাত্র কুড়ি বছর বয়সী সুন্দরী এক নার্সকে বিয়ে করবেন বলে ঠিক করলেন তিনি। তাকে বিবাহপ্রস্তাব দেবার আগের দিন রাত্রে ডাক্তারবাবু নিজের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে খুলে বললেন তার পরিকল্পনার কথা। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, "কী মনে হয়, আমি যদি আমার বয়স কমিয়ে পঁয়তাল্লিশ বলি, তাহলে কি মেয়েটার রাজী হয়ে যাবার চান্স বেশি ?"


ডাক্তারবাবুর বন্ধুটি সেদিন মদ্যপান করে ছিলো। মদ পেটে না গেলে মানুষ সচরাচর সত্যি কথা বলে না। তো নেশাসক্ত গলায় বন্ধুটি মোক্ষম কথাটা বললো - "তোমার যা টাকা-পয়সা বিষয়-সম্পত্তি, তাতে বয়স কমিয়ে পঁয়তাল্লিশ বললে রাজী হবে কিনা জানি না, কিন্তু বাড়িয়ে নব্বই বললে সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে যাবে।"


জীবনসঙ্গীর কথায় মনে পড়লো আমারই এক ডাক্তারবন্ধুর কথা। সে তখন সবে সবে ডাক্তারি পাশ করেছে। আশেপাশের চেনাশোনা লোক সবাই অদ্ভুত অদ্ভুত কারণে তাকে ফোন করে, বিরক্ত করে। এইরকমই কোনো এক মহিলা একদিন ফোন করেছে। "তাতান, শোনো না, তোমার দাদা না ভুল করে একটা স্যারিডন ট্যাবলেট খেয়ে ফেলেছে, কী করি বলো তো বাবু ?"


তাতান, মানে আমার বন্ধু একটু ভেবে বললো, "আপনি এক কাজ করুন, বাড়িতে তুমুল অশান্তি শুরু করে দিন যাতে ওনার মাথা যন্ত্রনা শুরু হয়ে যায়। তাহলেই স্যারিডন ঠিক কাজ করবে।"


একথা সত্যি যে ডাক্তারদের রসিকতা সহজে বোঝা যায় না। তাদের রসিকতাও সেই লেভেলের হয়। যেমন এক ডাক্তারের কাছে ফোন এসেছে। ফোনের ওপাশ থেকে কোনো ব্যক্তির আর্ত-চিৎকার ভেসে এলো - "ডাক্তারবাবু, আমি একটা পেন দিয়ে দরকারি কিছু লিখছিলাম, আমার পাশে আমার চার বছরের ছেলে বসে খেলা করছিলো। সে হঠাৎ আমার পেনটা মুখে ঢুকিয়ে খেয়ে ফেলেছে। আমি এখন কী করবো ? তাড়াতাড়ি বলুন।"


ডাক্তারবাবু আশ্বস্ত করার সুরে বললেন, "আপনি ততক্ষণ পেন্সিল দিয়ে লিখুন, আমি আসছি।"


কিন্তু ডাক্তারদের এরকম আশ্বাসবাক্যে যেন ভুলবেন না। তারা সবসময় সব কথা রোগীকে প্রথমে বলেন না। এই যেমন এক ডাক্তার একদিন তার এক মরণাপন্ন রোগীকে পরীক্ষা করে বললেন, "আমি দুঃখিত - আমি জানাতে বাধ্য হচ্ছি যে আপনার হাতে খুবই কম সময় অবশিষ্ট আছে।"


রোগী বিচলিত হয়ে বললো, "আমি জানি আমার আয়ু বেশী নেই। আমি আমার সমস্ত সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারা করে যেতে চাই। আমার মেয়ের বিয়েটা অন্তত দিয়ে যেতে চাই। আপনি বলুন ডাক্তারবাবু, ঠিক কতটা সময় আছে আমার হাতে ?"


ডাক্তারবাবু বললেন, "দশ... "


রোগী উৎকষ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, "দশ কী ? দশ মাস ? দশ দিন ? দশ ঘন্টা ? সত্যি বলুন।"


ডাক্তারবাবু রোগীর অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে অম্লানবদনে বলতে থাকলেন, "নয়... আট... সাত... "


তো আবার ফিরে আসি আমার আরেক ডাক্তারবন্ধুর কথায়। বন্ধু মানে ইনি আমার পরিচিত ডাক্তার। আমাদের বাড়ির কাছাকাছিই বসেন। একদিন কথা প্রসঙ্গে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, "আচ্ছা - কখনো কারুর উপর খুব রাগ হলে আপনারা কী করেন ? তোর ক্যান্সার হোক, এই বলে গাল দেন ?"


ডাক্তারবাবু আমার এই প্রশ্নে একগাল হেসে বললেন, "না না - মানুষের জীবন রক্ষা করাই আমাদের ধর্ম, আমাদের কর্তব্য। ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য রোগ কখনোই আমরা কামনা করি না।"


"তাহলে ?"


"আমরা মনে মনে শুধু বলি, তোর পেট খারাপ আর কাশি একসাথে হোক।"


খুব সাধারণ শুনতে এই কথাটা ভেবে দেখুন, কী মারাত্মক। ধরুন আপনার পেটটা গড়বড় করছে। অফিস ফেরত ভিড় ট্রেনে কোনোমতে পেট কুঁকড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রকৃতির ডাক আসবো আসবো করছে। আপনি ভাবছেন কতক্ষণে বাড়ি পৌঁছে বাথরুমে ঢুকবেন। এমন সময় শুরু হলো কাশি। দমকে দমকে কাশি। ভাবলেই আতঙ্কে ঘুম চলে যাবে আপনার।


ডাক্তারের কথা তো অনেক হলো। শেষ করি এক রোগীর কাহিনী দিয়ে। চোখ থেকে ঘুম উড়ে গিয়েছিলো সেই রোগীর। পরদিন সকালেই তার অপারেশান হবার কথা। অত্যন্ত চিন্তিত সেই রোগীর চোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই। কী এক দুশ্চিন্তায় তিনি মগ্ন। ব্যাপার-স্যাপার দেখে একসময় হাসপাতালের মেট্রন নিজে এলেন রোগীর কাছে।


'কী হয়েছে, এতো কী ভাবছেন না ঘুমিয়ে ?'


রোগী বললেন, "এক নার্স বলছিলো, এটা নাকি খুবই সহজ অপারেশান, এতো চিন্তার কিছু নেই। প্রথম প্রথম এরকম হয়, কিন্তু দেখবেন কাল সব ঠিক মতোই হয়ে যাবে। তো সেই কথা শোনার পর থেকেই - "


মেট্রন বললেন, "ঠিকই তো বলেছে। এতে এতো চিন্তার কী আছে ?"


"না মানে, উনি এই কথাগুলো আমাকে নয়, আমার ডাক্তারকে বলছিলেন।"


~ সমাপ্ত


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics