রহস্য ও সত্যান্বেষী
রহস্য ও সত্যান্বেষী


পর্ব - এক
এই নতুন সমাজ ব্যবস্থা একটু ভিন্ন ধরনের। নিজেকে লেখক হিসেবে পরিচয় দিলে হয়ত মানুষ ভালো চোখে দেখবেন না। এ সমাজে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হলে বেশি সম্মান লাভ করা যায়। এই ইন্টারনেট এর যুগে সাহিত্যের দাম খুব একটা নেই। তবু এই সাহিত্য বাঙ্গালির রক্তের সাথে মিশে আছে।
আমার নাম অনিমেষ দত্ত। বয়স 28। কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি একটা পুরনো দোতলা বাড়িতে ভাড়া থাকি। বেশ কিছু বছর বাংলা সাহিত্যের সাথে খুব গভীর ভাবে জড়িয়ে থাকার পর ভেবেছিলাম জীবনটা লেখক হিসেবে অতিবাহিত করব। আমার লেখা বেশ কিছু কবিতা ও ছোটগল্প খবরকাগজে প্রকাশিতও হয়েছে
ইতিমধ্যে কিন্তু লেখক হিসেবে খুব একটা নাম এখনো হয়নি।
বাবা সরকারি কর্মচারী হিসেবে কর্মরত। খুব পরিশ্রম করে বড়ো করেছেন আমায় কিন্তু কোনোদিন অভাব বুঝতে দেননি। মাসে মাসে আমার বাড়িভাড়া আর খরচের টাকা পাঠিয়ে দেন। যতো সময় অতিবাহিত হয় ততই বাবার রিটায়ারমেন্ট এর দিন এগিয়ে আসতে থাকে। বুঝলাম এই সাহিত্য আর বেশিদিন পেট ভরাবেনা। কিছু একটা চাকরির খুবই প্রয়োজন। খবরের কাগজে চাকরির বিজ্ঞাপন গুলোয় চোখ বোলাতে বোলাতে একটা অদ্ভুত বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে গেল।
লেখা " জায়গা খালি " (কাজ করার ইচ্ছে থাকলে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন নেই । ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। যোগাযোগ করুন। টেলিফোন নম্বর- 980043***9)
"সত্যান্বেষী"
অবাক হলাম এ আবার কি ধরনের বিজ্ঞাপন ? না আছে কাজের কোন বিবরণ না কোন পারিশ্রমিক এর উক্তি। কিন্তু একটা জিনিস বারবার চোখের সামনে ভাসতে থাকল ওই নামটা "সত্যান্বেষী"।
আমি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের খুব বড়ো ভক্ত। ওনার লেখা অনেক উপন্যাস আমি পড়েছি। তার মধ্যে সবার শ্রেয় "সত্যান্বেষী"(1934) (বোমকেশ বক্সির রহস্য উদ্ঘাটনের কয়েকটি দুর্দান্ত গল্প)
তাই বেশিকিছু না ভেবে চট করে মোবাইল ফোনে নাম্বার লিখে কল বোতাম টা টিপে ফেললাম।
হ্যালো?
কে বলছেন?
এক ভদ্রলোকের গলা পাওয়া গেল। বেশ ভারী।
বললাম আমি অনিমেষ দত্ত বলছি খবরের কাগজে আপনার বিজ্ঞাপন দেখলাম
সেখান থেকেই নাম্বার নিয়ে ফোন করছি।
বিজ্ঞাপন পরে বিস্তারিত কিছু বুঝলাম না। যদি বিস্তারিত জানাতেন উপকৃত হব।
ভদ্রলোক বললেন ফোনে সবকিছু জানানো সম্ভব নয়।আপনার নাম্বারে
একটা ঠিকানা পাঠাচ্ছি অবসরে চলে আসুন বিস্তারিত আলোচনা করবো। ধন্যবাদ।
এই বলে ফোনটা কেটে দিলেন।
ফোনটা হাতে ধরে ভাবছি কি করব হঠাত্ একটা মেসেজ এল।
লেখা, বাড়ি নং-34, আদি মা কালি মন্দির থেকে সোজা হেটে গিয়ে বাঁদিকে 200 মিটারের মধ্যে। উত্তর কাশিপুর, রাজারহাট,
কলকাতা-700135
"সত্যান্বেষী"
ব্যাপারটা হেঁয়ালি মনে হলো। আমার এই খারাপ সময়ে এইভাবে হঠাত্ কোনোপদক্ষেপ নেওয়া অনুচিত মনে হল। কিন্তু আমার চোখটা বারবার
ওই নামটার দিকেই চলে যাচ্ছিল। "সত্যান্বেষী"
ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল করিনি। ঘুম ভাঙল সকাল সাড়ে সাতটায়। রেডি হয়ে চায়ের দোকানে গিয়ে এক কাপ চা খেলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম আজ একবার যাব ভদ্রলোকের বাড়ি। দেখিই না
গিয়ে কি বিস্তারিত জানান ভদ্রলোক।
পর্ব- 2
( সত্যান্বেষীর সন্ধানে)
বেরিয়ে পড়লাম সত্যান্বেষীর সন্ধানে।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে শহরের লম্বা রাস্তা দিয়ে হেঁটে গিয়ে পৌচলাম যাদবপুর 8b বাসস্ট্যান্ড,
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই পেয়ে গেলাম রা
জারহাট যাবার বাস। বাস থামল গিয়ে রাজারহাট চৌমাথাতে।
ঠিকানাটা জিগ্গেস করে শেষমেশ গিয়ে উপস্থিত হলাম সত্যান্বেষীর বড়ির সামনে বাড়ি নং-34,উত্তর কাশিপুর, রাজারহাট, কলকাতা।
বাড়িটা বেশ পুরনো ঠিক আগেকার পুরনো দিনের জমিদার বাড়ির মতো। সামনে একটা বর লোহার গেট, গেটে ঠোকা দিতেই গেট খুলে গেল। সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে ফুলের বাগান কতো ধরনের ফুল ফুটেছে সেই বাগানে, বসন্ত যেন এখানে চির বিরাজমান। আর তারই মাঝ বরাবর একটি ইটের রাস্তা গিয়ে উঠেছে বাড়ির সদর দরজায়।
রাস্তা ধরে সদর দরজায় দিকে পা বারালাম। একটা সুন্দর গান ভেসে আসছে কানে
দোলে দোদুল দোলে ঝুলনা ।
দোলে দোদুল দোলে ঝুলনা ।
দোলে কৃষ্ণ দোলে ঝুলনা ।
দোলে রাই দোলে ঝুলনা ।
দোলে দোদুল নাই তুলনা তুলনা ।।
রাঁধার আধরে জাগে হাসি ।
রাঁধার আধরে জাগে হাসি ।
কহিছে ডেকে শ্যামের বাঁশি ।
কহিছে ডেকে শ্যামের বাঁশি ।
এ লগন রাই ভুল না ।।
মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় আর শ্যামল মিত্রের গাওয়া দেয়া নেয়া সিনেমার
গান। আমার বরবরই গানটা খুব প্রিয়। গান শুনতে শুনতে সদর দরজায় পৌচে গেলাম।
দুবার হাক দিলাম, কেউ আছেন? সত্যান্বেষী বাবু? এখানেও একই অবস্থা টোকা দিতেই দরজা খুলে গেল বুঝলাম ভেতর থেকে দরজায় ছিটকিনি লাগানো নেই অল্প চাপ দিয়ে দরজাটা খুললাম।
ভেতরের পরিবেশ বেশ মনোরম, বরো বৈঠকখানা তিনটে বরো জানালা রয়েছে এই বৈঠকখানাতে, লম্বা একটা কাঠের সিরি উঠেছে বৈঠকখানা বেয়ে দোতলায়।
ঈশান কোণের জানালার সামনে একটা কাঠের আরামকেদারা, আরামকেদারাতে শুয়ে ঘুমে মগ্ন এক ভদ্রলোক বয়েস 34-35 হবে
পরনে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি, চোখে একটা মোটা ফ্রেম এর চশমা যা ঘুমের ঘোরে নাক পর্যন্ত এসে নেমেছে, হাতে একটা জলন্ত সিগারেট এর আগুন ঠিক ফিল্টারের কাছ পর্যন্ত পৌচে গেছে। কিছু ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়েছেন বোধোহয়। সামনে একটা কাঠের গোল টেবিল তাতে একটা রেডিও, ওই রেডিওতেই বাজছে গানটা, একটা ছায়দানি আর তারই ওপর সিগারেটের ছোট ছোট অনেক পোরা ফিল্টার।
আমি নীচু গলায় ডাকলাম "দাদা শুনছেন"?
ঘুম থেকে উঠে চোখে চশমাটা ঠিক ভাবে পরে আমার দিকে ইতস্তত ভাবে তাকালেন ভদ্রলোক। আমি বললাম সিগারেটটা ফেলুন আপনার আঙ্গুল পুড়ে যাবে, ভদ্রলোক তারাতারি সিগারেটটা জানালা দিয়ে বাইরে ছুড়ে ফেলে দিলেন। আর আমায় ধন্নোবাদ বললেন।
তারপর আমায় জিজ্ঞেস করলেন
আপনি?
আমি অনিমেষ দত্ত।
পুরো পরিচয় দিলাম আর বললাম আমায় সত্যান্বেষী বাবু ডেকে পাঠিয়েছেন।
ভদ্রলোক আকস্মিক ভাবে খুব জোরে হেসে উঠলেন, আমি বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে।
হাসি থামিয়ে বললেন আপনার কি মনে হয় সত্যান্বেষী কারো নাম?
আমি বললাম হতেও পারে অস্সাভবিক কিছু কি?
বললেন না না অস্সাভবিক হতে যাবে কেন? তবে বাবুটা শুনে হাসি
পেল।
নমস্কার আমিই সত্যান্বেষী।
মুখে একটা প্রবল আকর্ষক হাসি দিয়ে বিনম্র ভাবে বললেন ভদ্রলোক।
আমি বললাম বিজ্ঞাপন দেখে আপনাকে ফোন করেছিলাম, আমার কথা শেষ করতে না দিয়ে ভদ্রলোক বললেন তা আমি আগেই বুঝেগেছি অনিমেষ বাবু কিন্তু যেটা এখনও বুঝতে পারছি না সেটা বললেই ভালো হয়।
আমি বললাম কি বুঝতে পারেননি বলুন?
বললেন আমার যে কয়েকটা প্রশ্ন করার আছে আপনাকে ভায়া তা আপনি সাক্ষাত্কার হিসেবেও নিতে পারেন।
আমি বললাম কি প্রশ্ন বলুন?
আপনি বিংশ শতাব্দীতে যে বিজ্ঞাপন পড়েন সেটা জেনে অবাক হলাম
তা কোনো বিশেষ কারন?
আমি আমার বর্তমান অবস্থার কথা ওনাকে বললাম। উনি একটা সিগারেট ধরিয়ে আমার কথাগুলো খুব মন দিয়ে শুনতে লাগলেন।
কয়েকটি জিনিস লক্ষ্য করলাম লোকটা বুদ্ধিমান ও সল্পভাষী, একটু রসিক ও বটে।
আমি জিগ্গেস করলাম আপনার আসল নাম টা জানতে পারি?
বললেন আরে হ্যাঁ জানতে পারেন না কেন,
পৈতৃক নাম "রুদ্রনীল ঘোষ"
কাজ বলতে আমি একটা প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সী চালাই।
চা চলে?
খাবেন?