মর্গের কান্না
মর্গের কান্না
মাসটা ছিল ডিসেম্বর হার কাপানো শীত তবুও এক অকাল ঝড়বৃষ্টির কারণে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। শহরের বিভিন্ন জায়গায় জল জমেছে আর গাড়িঘোড়ার কোন পাত্তা নেই । হাসপাতালের অর্ধেক কর্মচারি অনুপস্থিত আজ, ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না।
আমার নাম সুভাষ দত্ত এই সরকারি হাসপাতালে বেসরকারি চাকরি করি, মানে কনট্যাক্ট বেতন পাওয়া এক কর্মী। খুব সীমিত জায়গার মধ্যে অবস্থিত এই হাসপাতাল। হাসপাতালের সাথে এমারজেন্সি আর তারই পেছনে রয়েছে মর্গ। হাসপাতালের সামনে একটি বটগাছ আছে আর তারই লাগোয়া একটি চায়ের দোকান। তিনদিন টানা বৃষ্টির কারণে বোধহয় দোকান খোলা সম্ভব হয়নি।
হাসপাতালের ভেতর থেকে ছাতা মাথায় দিয়ে বেরিয়ে এলাম।
বাউন্ডারির বাইরে বেরিয়ে এসে একটা সিগারেট ধরিয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে সিগারেটে মনের সুখে টান দিতে থাকলাম।
একটা গাড়ির লাইট চোখে লাগল। ডাইভার গাড়ি গেটে থামাল আর আমায় জিজ্ঞেস করল দাদা মর্গ টা কোনদিকে?
আমি বললাম সোজা গিয়ে বাঁদিকে বেঁকে পেছনে।
লোকটা কিছু না বলে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে গেল। আমি ভাবতে থাকি
এই দুর্যোগ এ কে মারা গেলো আবার কি জানি?
ভেতরে গিয়ে জানতে পারলাম যে একটা ডেডবডি এনেছে গাড়িটাতে।
সুইসাইড কেস। এক বয়স পঁয়তিরিশ এর মহিলা গলায় দঁরি লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
নিয়ম মত ডাক্তার বাবু ডেডবডি চেক করে পুলিশ কে খবর দিলেন।
আমাকে বললেন ডেড বডির বড়ির লোক আর মর্গ এর লোকটার আসতে দেরী হয়ে যাবে তুমি একটু মর্গ টা খুলে ডেডবডি টা ভেতরে রাখার ব্যবস্থা করো।
আমার ঘাড়ে দায়িত্ব চাপিয়ে নিজের কেবিনে ঢুকে গেলেন । এখন যতক্ষণ পর্যন্ত না পুলিশ আসছে ততক্ষণ ডেডবডি আমার দায়িত্ব।
ডেডবডি এনে মর্গে ঢুকিয়ে দেওয়া হল।বাইরে ঝড় বৃষ্টিটা একটু বেশি বেড়েছে। আমি দরজা জানালা বন্ধ করে ডেডবডির সামনে একটি চেয়ার নিয়ে বসলাম, ততক্ষণে রাত একটা বেজে গেছে, আমার চোখদুটো আমার অজান্তে ডেডবডির ফ্যাকাসে মুখটির দিকে তাকিয়ে ফেলেছি বুঝতে পারিনি ।
খুব কষ্টে হয়ত কাঁচা জীবনটা শরীর ছেড়ে বেড়িয়েছে, একটা নীরব জীর্ণ মুখ প্রাণহীন হয়ে এমন অসহায় দেখতে লাগে এতোটা আগ্রহের সাথে আগে দেখিনি। ভয় ডর আমার খুব একটা নেই, আর ভুত প্রেতে বিশ্বাস ও করিনা তাই অতশত না ভেবে চুপচাপ নিজের মোবাইল ফোনে ভিডিও গেম খেলতে লাগলাম। নাইট শিফটে কাজ করে অভ্ভস্ত আমি। তাই ঘুম আর আসেনা ডিউটিতে।
কখন চল্লিশ মিনিট প্রায় কেটে গেছে বুঝতে পারিনি হঠাত্ এক ঠান্ডা হওয়া এসে আমার শরীরে লাগলো, পুরো শরীর যেন কাপুনি দিয়ে উঠল। আমি ভাবলাম যে মর্গের কোনো জানালা খুলে গেছে হয়ত ঝড়ের কারনে। চেয়ার ছেড়ে উঠে চারিদ
িকটা ভালো করে দেখতে লাগলাম কিন্তু কোনো জানালা খোলা পেলাম না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছি যে হওয়া ভেতরে কিভাবে এলো? সব দরজা জানালাই তো বন্ধ। হঠাত্ লোডশেডিং, চারিদিক ঘুট্ঘুটে অন্ধকার। খুব ভয় পেলাম।
মোবাইল ফোনে টর্চ জালাবো বলে ফোনটা তারাতারি পান্টের পকেট থেকে বের করতে যাবো এমন সময় হঠাত করে খুব জোরে গোঙানি কান্নার শব্দ, আমি খুব ভয়ে নিজেকে সামলাতে না পেরে নিচে মেঝেতে পড়ে গেলাম।
আর তারপর যা দেখলাম জীবন থাকতে সে দৃশ্য আমি ভুলতে
পারবোনা।
বাইরে থেকে আসা মৃদু আলোতে দেখতে পেলাম সদ্দ আসা মৃতদেহ স্টেচার এর উপর উঠে বসেছে চুল গুলো সামনের দিকে এলিয়ে গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদছে। গোটা মর্গটা কান্নার শব্দে ভরে ওঠেছে। যেন কাঁচা জীবন চলে যাওয়ার আর্তনাদ করছে সেই মৃতদেহ।
আমি আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে কোনোরকম উঠে দাঁড়িয়ে গেটটা খোলার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু গেট খুললনা, যেন কেউ বাইরে থেকে গেট লাগিয়ে দিয়েছে।
আমি আবার নিজেকে সামলাতে না পেরে পরে গেলাম। মৃতদেহ একভাবে জোরে গুঙিয়ে কাঁদছে। আমি বাঁচাও বাঁচাও বলে চীত্কার করতে লাগলাম। টানা প্রায় পনেরো মিনিট ধরে চোখের সামনে চলতে থাকে এই দৃশ্য। কখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি বুঝতে পারিনি।
জ্ঞান যখন ফিরল তখন আমি হসপিটালের বেডে শুয়ে আছি আমার সামনে দাঁড়িয়ে মর্গের কর্মী আর ডাক্তারবাবু। বাইরে জানালা দিয়ে সকালের আলো উকি দিচ্ছে। বৃষ্টিও থেমে গেছে আকাশ পরিস্কার।
আমায় ডাক্তারবাবু জিগ্গাসা করলেন কি সুভাষ শরীর কেমন অনুভব করছো। আমি বললাম ভালো।
ডাক্তারবাবু বললেন আচ্ছা এবার বলোতো ভাই কাল রাতে ঠিক কি হয়েছিল? ভোরে চারটার দিকে যখন মর্গের কর্মী দরজায় টোকা দেয় তখন ভেতর থেকে দরজা তুমি খোলনি দেখে ভয় পেয়ে আমায় এসে ও খবর দেয়। আমরা তাড়াতাড়ি গিয়ে জানালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে দেখি তুমি গেটের সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছ। তারপর তোমায় নিয়ে এসে চিকিৎসা শুরু করি। তুমি এভাবে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলে কেন।
আমি শরীর দুর্বল হয়ে পড়ার কারন বলে ডাক্তারবাবুর প্রশ্নটা এড়িয়ে যায়।
ভাবতে থাকি যদি পুরোটাই মনের ভুল মেনেওনি তবে দরজাটা বাইরে থেকে কে বন্ধ করেছিল? মর্গের কর্মী আর ডাক্তারবাবুকে জানালা ভেঙে ভেতরে কেন ঢুকতে হল?
তারপর আর হাসপাতালে কাজে যায়নি। কদিন পর গিয়ে পদত্যাগ পত্র জমা দিয়ে এসেছিলাম।
তারপর বছর পাঁচেক কেটে গিয়েছে, জীবনের ঘড়ি টিক টিক করে যে এতগুলো বছর কখন পেরিয়ে এসেছে বুঝতে পারিনি।
কিন্তু সেই ভয়ঙ্কর আর্তনাদের কান্না যেন আজও ভেসে আসে কানে। চুল এলিয়ে বসে কাঁদা মৃতদেহটা ভাসতে থাকে চোখের সামনে।