রবির আলোয়
রবির আলোয়
"অন্ধকারের.... উৎস..... হতে.....
উৎসারিত.....আলো..."
কথাটা একদম খাঁটি, কারন নিকষ কালো অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত কেটে গিয়ে শান্ত স্নিগ্ধ ভোরের আলো ফোটে পৃথিবীর বুকে। সমস্ত অন্ধকারের বেড়াজাল ছিন্ন হয়ে আলোয় আলোয় ভরে ওঠে চারিদিক। তেমনি নিরুপমার জীবনের অন্ধকার কেটে গিয়ে আলোর দেখা মিলেছে। তবে এই আলোর দেখা সহজে মেলেনি!!! খুব কষ্ট করে মিলেছে। নিরুপমার বাবা ছিল খুব গরীব, দিন মজুরি করেই দিন চলত ওদের। নিরুপমারা চার বোন এক ভাই। ভাই হতে গিয়ে নিরুপমার মা মারা যায়। নিরুপমা সব থেকে বড় তাই.... ভাই এবং বোনেদের আগলে রাখার দায়িত্ব নিজের কাধে তুলে নেয় নিরুপমা। সংসারের সব কাজ সামলেও নিরুপমা হাতের কাজ করত রাত জেগে, যাতে সংসারে দুটো পয়সা আসে, বাবার পাশে কিছুটা হলেও দাঁড়াতে পারে। এই ভাবেই অভাব অনটনের মধ্যে পরিবারকে নিয়ে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল নিরুপমা।
হঠাৎ একদিন নিরুপমার জন্য বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসল নিরুপমার বাবার দূর সম্পর্কের এক বোন। যদিও নিরুপমা তার এই পিসিকে এর আগে কোনদিনও চোখে দেখেনি। ছেলে নাকি শহরে এক বড় কম্পানিতে চাকরি করে, বাবা,মার একমাত্র সন্তান অবস্থা বেশ ভালো। এত কিছু শুনে নিরুপমার বাবা আর আপত্তি করেনি বিয়েতে। ছেলেও একদিন মা, বাবাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে নিরুপমাকে দেখে বিয়ের দিনক্ষন সব ঠিক করে গেল। নিরুপমার বাবার অবস্থা ভালো নয় তাই মন্দিরে বিয়ের ব্যবস্থা করা হয় । নিরুপমা তার ভাই, বোন, বাবাকে ছেড়ে যেতে চাইনি!! কিন্তু ঐ.... যে..... মেয়ে হয়ে জন্মানো মানেই নাকি পরের ঘরে যেতে হবে!!! আর এই নিয়মের বেড়াজাল থেকে নিরুপমাও বেড়তে পাড়েনি!!!! অসহায় হয়ে মুখবুজে সবকিছু মেনে নিয়ে একটা অচেনা মানুষের সাথে জীবন পথ চলা শুরু করেছিল বাবার আর্শিবাদকে সঙ্গে নিয়ে।
কিন্তু নিরুপমা তখনও জানতে পারেনি তার জীবনে কি... হতে চলেছে!!! প্রথম শহরের বুকে পা.... দিয়েছিল নিরুপমা স্বামীর হাত ধরে। মাথাভর্তি টকটকে লাল সিঁদুর, হাতে শাখা, পলা কপালে চন্দনের টিপ জ্বলজ্বল করছিল। নিরুপমা তার স্বামীর হাত ধরে বাস, ট্রাম, গাড়ির ভীড় ঠেলে এগিয়ে চলেছিল অজানা পথের উদ্দেশ্যে। আস্তে আস্তে বড় রাস্তা ছেড়ে গলির মধ্যে ঢুকেছিল ওরা। চারিদিকে কোলাহলের আওয়াজ কিছুটা হলেও কমতে শুরু করে ছিল । ল্যাম্পপোষ্টের আলো গুলো তার উজ্জ্বলতা দিয়ে অন্ধকারের ঘনত্বকে কাটানোর চেষ্টা করে চলেছিল। কত রকমের খাবারের ঠেলা নিয়ে কত লোক সারি সারি দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তার ধারে ধারে এবং পথ চলতি মানুষদের ডাকছিল।নিরুপমা অবাক চোখ সবকিছু দেখছিল আর মনের মধ্যে সবকিছুকে সাজিয়ে নিচ্ছিল যত্ন করে।
অবশেষে একটা মস্তবড় পুরনো দিনের তিনতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। আশেপাশে কত লোকজন। আর মেয়েরা সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছে এমন ভাবে যেন নিজেদের সৌন্দর্য কে.... মেলে ধরার চেষ্টা করছে সকলের সামনে। নিরুপমার স্বামীকে দেখে মেয়েগুলো কেমন একটা বাঁকা হাসি দিল। নিরুপমা কোনদিকে না তাকিয়ে বাধ্য স্ত্রীর মত স্বামীর হাত ধরে বাড়ির ভীতরে ঢুকল।
ভীতরে ঢুকে নিরুপমা অশ্চর্য হয়ে ছিল কারন এত সুন্দর করে সাজনো এবং এত বড় বাড়িতে এর আগে কোনদিনও নিরুপমা যায় নি!!!!নিরুপমা মনে মনে ভাবতে শুরু করেছিল এটাই হয়তো ওর শ্বশুরবাড়ি। কিন্তু হায়রে..... অবুঝ নারী হৃদয় তোর ভাবনা যে..... কতটা অলীক তা..... তুই বুঝলিনা!!!!
---------কিছুক্ষনের মধ্যেই একজন মধ্যবয়সি পুরুষ এবং মহিলা এসে দাঁড়াল ওদের মুখোমুখি। এবং মহিলাটি হাসতে হাসতে বলল, এই বুঝি তোর নতুন বউ!!!! বাহ্.... বেশ দেখতে!!!!!
-----------নিরুপমার স্বামী একমুখ হেসে মাথা নেড়ে উত্তর দিয়ে ছিল হ্যাঁ.....।
নিরুপমা আর কিছু না ভেবে ওনাদের প্রনাম করলেন পায়ে হাত দিয়ে। এই দৃশ্য দেখে আশেপাশে সবাই হেসে উঠে ছিল। নিরুপমা কিছুই বোঝেনি ব্যাপারটা!!!! শুধু চারিদিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে দেখেছিল, আর মনে মনে ভেবে ছিল কিছু ভুল করে ফেললাম নাকি????এইসব ভাবনার মাঝেই নিরুপমা দেখল ঐ..... মধ্যবয়সি লোকটা ওর স্বামীর হাতে একটা টাকার বান্ডিল ধরিয়ে দিল। এবং ওর স্বামী টাকাটা পকেটে পুরে হাসি হাসি মুখে চলে যেতে লাগল।
নিরুপমাও চুপচাপ ওর স্বামীর পথ অনুসরন করতে লাগল ঠিক দরজার কাছে আসা মাত্র পিছন থেকে একটা টান অনুভব করল নিরুপমা, পিছন ফিরে দেখল দুটো মেয়ে দুইদিক থেকে ওকে ধরে রেখেছে আর ওর স্বামী হাসতে হাসতে ওকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে।
নিরুপমা অসহায়ের মত বলে উঠেছিল সেইদিন আমাকে ছেড়ে দাও!!! আমার স্বামী চলে যাচ্ছে
-----------মেয়ে দুটি হেসে বলেছিল চলে তো.... যাবেই!!! মোটা টাকা পেয়ে গেছে, আর তোকে প্রয়োজন নেই!!! এবার আবার অন্য কাউকে বউ করে নিয়ে আসবে, সত্যি পারেও বটে এই নিয়ে একশোটা বিয়ে করল শালা! মেয়েদুটোর চোখ মুখ ঘৃনায় ভরে উঠেছিল। নিরুপমার কাছে সবটা পরিস্কার হল জলের মত। নিরুপমার আর বুঝতে বাকি রইলনা যে.... যাকে বিশ্বাস করে এবং যার..... হাত ধরে ও.... এই শহরে এলো সে....আসলে একটা ঠগ, প্রতারক!!! এবং ওকে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়ে গেল এদের কাছে।
শুরু হল নিরুপমার এক অন্য জীবন!!! যে.... জীবনের সাথে এত দিনের জীবনের কোনো মিল নেই!!! নিরুপমা কোন রকমের প্রতিবাদ করেনি!!! কারন প্রতিবাদ করার মত সাহস নিরুপমার মধ্যে ছিলনা!!! তাছাড়া প্রতিবাদ করে হবেই বা কি???? ওর যে... যাওয়ার কোনো জায়গা নেই!!!আর বাবার কাছে ফিরে যেতে এরা দেবেনা কোনমতেই!!! এই ভাবেই চলছিল নিরুপমার জীবন রাতের অতিথিদের মনোরঞ্জন করে।
এই রকমই একদিন নিরুপমার কাছে রাতের অতিথি হয়ে এসেছিল রবি। সত্যি মানুষটা যেন রবির মত। কারন তার উজ্জল আলোর কিরনে নিরুপমার অন্ধকার জীবন থেকে মুক্তি ঘটেছে। মানুষটি অনেক লড়াই করেছে নিরুপমার জন্য। সমাজের বিরুদ্ধে গিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত নিরুপমাকে অন্ধকার জীবন থেকে বার করে এনে নিজের জীবনে জায়গা দিয়েছে, যোগ্য সম্মান দিয়েছে। নিরুপমার জীবনটাকে আলোয় ভরে দিয়েছে। সূর্যের আলো যেমন চাঁদকে আলোকিত করে যতই তার কলঙ্ক থাক তেমনি রবির ভালোবাসার আলোয় নিরুপমা আলোকিত হয়েছে এবং নিরুপমার অন্ধকার জীবন আলোয় ভরে উঠেছে। নিরুপমা কোনদিনও স্বপ্ন দেখেনি সংসারের কারন তার জীবনে যে.... এই সব অলীক কল্পনা! কিন্তু ঐ মানুষটা নিরুপমার জীবনকে সমস্ত কিছু দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে। রাত কেটে গিয়ে যেমন নতুন দিনের নতুন সূর্যোদয় হয় তেমনি রবির আলোয় নিরুপমার জীবনের সমস্ত অন্ধকার কেটে গিয়ে ঝলমলে ভোরের দেখা মিলেছিল।
