রাতের সহচরী
রাতের সহচরী
আকাশে ঘন কালো হয়ে মেঘ করেছে, সন্ধ্যা নামার আগেই চারিদিক অন্ধকারে ঢেকে গেছে, যখন তখন বড়ো বড়ো বৃষ্টির দানা পড়তে শুরু করবে। থেকে থেকে আকাশের বুক ভেদ করে বিদ্যুতের তীব্র ঝলকানি বেড়িয়ে আসছে। প্রকৃতি তান্ডব শুরু করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এলোমেলো ঝোড়ো হাওয়া বইছে। দিব্যেন্দু যতটা সম্ভব জোড়ে গাড়িটাকে ড্রাইভ করার চেষ্টা করছে, যে..... করেই হোক রাতের মধ্যে ওকে কোলকাতা ফিরতেই হবে। আজ ক্যাম্পে এত মানুষের ভীড় হয়ে ছিল যে.... সবাইকে ভালো করে দেখে বেড়োতে দেরী হয়ে গেল দিব্যেন্দুর।
দিব্যেন্দু কলকাতার বড় নার্সিংহোমে একজন হার্ট স্পেশালিস্ট। কিন্তু দিব্যেন্দুর বাবার বড় শখ ছিল ছেলে মস্ত বড় ডাক্তার হয়ে গ্রামের গরিব মানুষদের পাশে দাাঁড়াবে, বিনা পয়সায় তাদের সেবা করবে। বাবার এই শখ পূরন করার জন্য এবং বাবার ইচ্ছেকে মর্যাদা দেওয়ার জন্য প্রত্যেক সপ্তাহে শনি রবি দিব্যেন্দু বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্প করে। তেমনি আজ ক্যাম্প ছিল বর্ধমানের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। গ্রাম থেকে সবে বড় রাস্তায় গাড়িটা উঠেছে, ব্যাস শুরু হয়ে গেল তুমুল বৃষ্টি তার সাথে দমকা ঝোড়ো হাওয়া ওয়াইপারের সাহায্য নিয়েও ভালো করে রাস্তা দেখা যাচ্ছে না। দিব্যেন্দু বাধ্য হল গাড়ির স্পীড কমাতে।
পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে বাড়িতে ফোন করে বলে দিল যেতে দেরী হবে চিন্তার কিছু নেই। অন্যদিন দিব্যেন্দুর সাথে ড্রাইভার সুরেশ থাকে!কিন্তু এই দুদিন হলো ও দেশের বাড়ি গেছে সদ্য বাবা হয়েছে তাই দিব্যেন্দু ইচ্ছে করেই ওকে ছুটি দিয়েছে। দিব্যেন্দু খুব সাবধানে গাড়ি ড্রাইভ করে এগিয়ে চলেছে। রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা, গাড়ি দুই একটা চলছে।
কিছুটা রাস্তা যাওয়ার পর হঠাৎ দিব্যেন্দু লক্ষ্য করল কেউ একজন হাত দেখাচ্ছে গাড়ি থামানোর জন্য। দিব্যেন্দু ভালো করে লক্ষ্য করে দেখল একটা মেয়ে। একবার ভাবলো দাঁড়াবেনা আবার পরক্ষনেই ভাবল একটা মেয়ে ফাঁকা রাস্তায় এইভাবে দাঁড়িয়ে আছে একা, বিপদ হতে কতক্ষন। এই সব ভাবনা চিন্তা করতে করতে গাড়িটা থামালো মেয়েটার সামনে, গাড়ির কাঁচ হাল্কা একটু নামিয়ে দেখল মেয়েটি কাকভেজা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।
---------- দিব্যেন্দু জিজ্ঞাসা করল কোথায় যাবেন????
----------মেয়েটি বলল কাছেই আমার বাড়ি, যদি একটু লিফ্ট দিয়ে দেন তো ভালো হয়। আর তাছাড়া রাস্তার ওপরে, ভীতরে যেতেও হবেনা!
---------দিব্যেন্দু হাসি মুখে বলল, উঠে আসুন...!!!
----------মেয়েটি সময় নষ্ট না.... করে গাড়িতে উঠে পড়ে, সামনের সিটে দিব্যেন্দুর পাশেই বসে পড়ে।
দিব্যেন্দু এতক্ষনে ভালো করে চেয়ে দেখে মেয়েটার দিকে। সাজগোজে কোন বিলাসিতা নেই অথচ একটা স্নিগ্ধ সুন্দর ভাব আর ঠোঁটের কোনে একটা আলতো হাসি লেগে আছে। এক কথায় প্রকৃত সুন্দরী।
------মেয়েটি হাসি হাসি মুখে বলে উঠল, আপনাকে বিব্রত করার জন্য দুঃখিত আসলে অনেকক্ষন থেকে দাঁড়িয়ে আছি, কিছুই পাচ্ছিনা আর তারপর এই বৃষ্টি তাই বাধ্য হয়ে লিফ্ট চাইলাম। বাই... দ্যা... ওয়ে... আমি সুজাতা সেন।
----------দিব্যেন্দু মিষ্টি হেসে প্রত্যুত্তর দিল, আমি দিব্যেন্দু...
----------সুজাতা হেসে বলল, দিব্যেন্দু বাহ্... খুব সুন্দর নাম, তবে পুরো নামটা বললে বেশি খুশি হব।
-----------দিব্যেন্দু হেসে বলল এই অধমের নাম ডঃ দিব্যেন্দু চ্যাটার্জ্জী, হার্ট স্পেশালিস্ট, নর্থ কলকাতার শ্যামবাজারের বাসিন্দা।
----------দিব্যেন্দুর বলার ধরনে সুজাতা খিলখিল করে হেসে উঠল। সুজাতার হাসিতে দিব্যেন্দুও যোগ দিল।
-----------সুজাতা বলে উঠল তা.... ডাক্তার বাবু এদিকে কোথায় যাওয়া হয়ে ছিল শুনি.?
-----------দিব্যেন্দু বলল মেডিকেল ক্যাম্পে।
-----------সুজাতা বলল বাহ্....., সমাজ সেবা করেন খুব ভালো....।
---------দিব্যেন্দু হেসে বলল ঐ একটু।
বেশ দুইজন কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলল গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। এদিকে আজ বৃষ্টি থামার কোন নাম নেই অবিরাম ধারায় বয়ে চলেছে। সমস্ত গ্রাম থেকে শহর আজ বানভাসি করে তবেই ক্ষ্যান্ত হবে বোধহয়!কথা বলতে বলতে দিব্যেন্দু বুঝতেই পাড়েনি রাতের গভীরতা। রাত যে কখন গভীর হয়ে তার ঘন জাল বিস্তার করে ফেলেছে চারিদিকে তার ঠিকানা দিব্যেন্দুর কাছে নেই।
-----------অনেকটা রাস্তা আসার পর সুজাতা বলে উঠল এইতো... চলে এসেছে আমার বাড়ি।
----------দিব্যেন্দু অবাক বিস্ময়ে চারিদিকে চেয়ে দেখলো ফাঁকা রাস্তা আর কিছু নেই, তাই বলে উঠল কোথায়...??? এখানে তো... কিছু নেই!
----------সুজাতা হাসতে হাসতে বলল, ডাক্তার বাবু একটু ভিতরে যেতে হবে মেন রাস্তা ছেড়ে, তাই দেখতে পাচ্ছেন না....!!! আমি এইখানেই নেমে যাচ্ছি.... আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না।
----------দিব্যেন্দু হাসতে হাসতে বলল, আপনি রাস্তা বলুন.... আমি আপনাকে বাড়ির সামনেই নামিয়ে দিচ্ছে, আর তাছাড়া এই বৃষ্টির মধ্যে একা ছাড়তে পারবোনা...!
-----------সুজাতা বলল, তাহলে কিন্তু বাড়ির ভীতরে যেতে হবে.....!!!
----------দিব্যেন্দু হাত ঘড়িতে টাইম দেখে অবাক হয়ে বলে ওঠে, একি বারোটা বেজে গেছে!!!
---------সুজাতা বলল, তা.... ডাক্তার বাবু আপনি বুঝি ভেবেছিলেন এখন সন্ধ্যে!!!! তা..... বলি আজ রাতটা না.... হয় আমাদের বাড়িতেই থেকে গেলেন কষ্ট করে,সকাল বেলায় বেড়িয়ে পড়বেন নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে!
---------দিব্যেন্দুর মনটা কিন্তু কিন্তু করছে। পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে দেখল, কোন স্যিগনাল নেই দিব্যেন্দুর মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এল ওহ.... শিট.....!
---------সুজাতা বলল আমার প্রস্তাবটা ভেবে দেখতে পারেন ডাক্তার বাবু, মন্দ নয়.....!
----------দিব্যেন্দু বলল হ্যাঁ....., ভাবতেই হচ্ছে তাছাড়া আর কোনো উপায় নেই!!!!
দিব্যেন্দু সুজাতার দেখানো পথ অনুযায়ি এগিয়ে চলল। কিছুটা পথ যাওয়ার পর দিব্যেন্দু সুজাতার কথায় গাড়িটা থামল একটা বাড়ির সামনে। গাড়ি থেকে নামার আগেই একজন বয়স্ক লোক হাতে আলো নিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বলল......
---------কিরে...... সুজা এলি....????
------------সুজাতা হাসিমুখে উত্তর দিল, হ্যাঁ...... দাদু সাথে অতিথিও আছে।
-----------বয়স্ক লোকটি কিছুই বলল না... চুপচাপ ঘরে ঢুকে গেল, দিব্যেন্দুও সুজাতাকে অনুসরন করে ভীতরে ঢুকে গেল। সুজাতা একটা ঘর দেখিয়ে দিল দিব্যেন্দুকে। দিব্যেন্দু কৌতুহলবশত জিজ্ঞাসা করল তোমার বাবা... মা... কোথায়????
----------দিব্যেন্দুর এই প্রশ্নে সুজাতার মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল, সুজাতা মৃদু স্বরে উত্তর দিল নেই....., আমি আর দাদু থাকি, যান ডাক্তারবাবু ফ্রেস হয়ে নিন, আমি কিছু খাবারের ব্যাবস্থা করি।
----------দিব্যেন্দু আর কথা না বাড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল।
--------কিছুক্ষনের মধ্যে সুজাতা কিছু শুকনো খাবার নিয়ে আসল দিব্যেন্দুর ঘরে, এবং হাসি হাসি মুখে বলল, খেয়ে শুয়ে পড়ুন ডাক্তার বাবু আমি এলাম, গুড নাইট অ্যান্ড থ্যাঙ্ক ইউ আমাকে এতটা হেল্প করার জন্য।
----------দিব্যেন্দু হাসি মুখে বলল, ধন্যবাদ তো..... আপনারও প্রাপ্য আমাকে আপনাদের বাড়িতে থাকতে দেওয়ার জন্য।
সুজাতা হাসি মুখে গুড নাইট বলে বেড়িয়ে গেল। দিব্যেন্দু একটু খাবার মুখে দিয়ে সারাদিনের ক্লান্ত শরীর টাকে এলিয়ে দিল বিছানায়।
**************************************
সকালের মিঠে রোদের আলো মুখে পড়তেই দিব্যেন্দুর ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘড়িটা হাতে নিয়ে দেখল আটটা বেজে গেছে, দিব্যেন্দু ঝটফট উঠে রেডি হয়ে ঘরে বাইরে বেড়িয়ে আসে। বাইরে বেড়িয়ে এসে দেখে বয়স্ক লোকটা দরজার কাছে বসে আছে আর শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রাস্তার দিকে।
---------দিব্যেন্দু এগিয়ে গিয়ে বলল, দাদু সুজাতা কোথায়..?
---------বয়স্ক লোকটি গলার আওয়াজে চমকে উঠে বলল, কে....তুমি??? আর সুজাতার ফেরার অপেক্ষাতে তো... আমি দরজা আগলে বসে আছি দুবছর ধরে, কিন্তু মেয়েটা এখনও ফিরলোনা!!!! লোকে বলে সুজাতা রোড... অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে, কি.... জানি???? হবে হয়তো!!! কিন্তু আমার মনে হয় সুজাতা ঠিক ফিরবে।
---------দিব্যেন্দু বলল, দাদু সুজাতা তো... কালকে রাতে আমার সাথেই ফিরেছে,আপনি দেখেননি????
----------বয়স্ক লোকটি আনন্দে উত্তেজিত হয়ে উঠে হাত বাড়িয়ে দিব্যেন্দুকে ছোঁয়ার চেষ্টা করতে লাগল, আর বলতে লাগল, তাই.... তুমি ঠিক বলছো...? সুজাতা ফিরেছে? সুজা.... সুজা.... করে ডাকতে লাগল!!!
----------দিব্যেন্দু বলল, কেন দাদু অপনি কালকে রাতে দেখেন নি....???
--------বয়স্ক লোকটি বলল, কি করে দেখব.. বাবা! আমি যে... চোখে দেখতে পাইনা কতকাল!!!
দিব্যেন্দুর মাথায় কিছুই যেন ঢুকছেনা। সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। সুজাতা বেঁচে নেই মারা গেছে! দিব্যেন্দু আর নিজেকে ঠিক রাখতে পাড়লনা ছুটল ঘরের দিকে, কিন্তু না... ঘরে কেউ নেই, এমনকি কারোর থাকার চিহ্ন পর্যন্ত নেই!!! দিব্যেন্দু ঘরের বাইরে বেড়িয়ে আসল এবং দেখলো দেওয়ালে একটা বড় ফটোফ্রেমে সুজাতার ছবি রাখা, এবং তাতে শুকনো মালা দেওয়া, রাতের অন্ধকারে ভালো করে লক্ষ্য করেনি দিব্যেন্দু!!!! তবে সেই সুন্দর হাসিটা বিদ্যমান, মনে হচ্ছে সত্যি হেসে চলেছে সুজাতা প্রান খুলে।