(প্রথম পর্ব)
বাইরে ঝড়-বৃষ্টির তাণ্ডব ক্রমে বেড়েই চলেছে। এই অসময়ে হঠাৎ কেন যে বৃষ্টি আরম্ভ হল কে জানে? ভাগ্য ভাল যে ঠিক টাইমে অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে পেরেছি, নাহলে কাকভেজা হওয়ার থেকে কেউ বাঁচাতে পারত না। মায়া দি রাতের খাবার রান্না করে দিয়ে গেছে, শুধু একটু গরম করে নিলেই হয়ে যাবে। সে পরে হবে'খন, এখন একটু জমিয়ে কফি খাওয়া যাক।
সবেমাত্র গরম কফির পেয়ালাটা হাতে নিয়ে আরাম কেদারায় ক্লান্ত শরীরটা এলিয়েছি, ঠিক তখনই সদর দরজার কলিং বেল 'টুং টাং' শব্দে বেজে উঠল। দেওয়াল-ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত সাড়ে দশটা। যাঃ বাবা! এত রাতে আবার কোন অতিথি আমার দ্বারে এল? দরজা খুলে দেখি প্রণবেশ....আমার বাল্যবন্ধু প্রণবেশ দত্ত।
আমাকে দেখে ও ম্লান হাসল। ভীষণ রোগা লাগছে ছেলেটাকে। হাতে একটা ছাতা। পরনে কালো শার্ট। চোখে চশমা। জামা বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। বুঝলাম যে ওর পুরনো ছাতাটা এমন প্রচণ্ড বৃষ্টির দাপট পুরোপুরি রুখতে পারেনি।
"একি! প্রণবেশ....তুই?"
"হ্যাঁ রে। অনেকদিন তোর সাথে দেখা হয়নি, তাই আজ চলে এলাম।"
"তাই বলে এমন দুর্যোগের মধ্যে আসবি? আস্ত একটা পাগল তুই। আয় আয়, ভিতরে আয়।"
প্রণবেশ কে ঘরে নিয়ে এসে সোফায় বসালাম। ঘরের আলোর মধ্যে ওকে আরেকবার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে নিলাম। এ কী চেহারা হয়েছে ওর? প্রণবেশের সাথে আমার প্রায় তিন-চার মাস পর দেখা হচ্ছে। তাই বলে কি মাত্র এই ক'দিনের মধ্যে কোনও মানুষের ভিতরে এমন ভুতুড়ে পরিবর্তন দেখা যেতে পারে? গাল দুটো বসে গেছে। সারা মুখে বেশ কিছুদিনের না-কামানো দাড়ি। চোখের তলায় পুরু কালি। সারা শরীরে যেন একটা ক্লান্তির ছাপ পড়েছে।
"কেমন আছিস রে অবিনাশ?"
"আমি তো ভালই আছি, কিন্তু তোর অবস্থা যে মোটেই সুবিধার ঠেকছে না হে! দাড়ি কামাসনি, চুল উস্কো খুস্কো। অনেকটা রোগাও হয়ে গেছিস। তোর শরীর ভাল আছে তো?"
"শরীর ভাল আছে কিন্তু মন ভাল নেই।"
"কেন? কী হল আবার?"
"অনেক লম্বা কাহিনী; বলতে সময় লাগবে। তার আগে বল....আজ রাতটা যদি আমি তোর ফ্ল্যাটে থাকি, তাতে কি তোর কোনও আপত্তি আছে?"
"আরে কী যে বলিস! তুই এখানে একশো বার থাকবি। একদম নিজের বাড়ি মনে করেই থাক। এমনিতেও এই ফ্ল্যাটে আমি একা থাকি, নাহয় আজ রাতের জন্য একখানা সঙ্গীই জুটে গেল! রাতের যা খাবার আছে তাতে দুজনের দিব্যি হয়ে যাবে। তার আগে আমি গিয়ে তোর জন্য এক সেট শুকনো জামাকাপড় নিয়ে আসি। এই ভেজা কাপড় পরে থাকলে তোর নির্ঘাত ঠাণ্ডা লেগে যাবে।"
প্রণবেশ নীরবে ঘাড় নাড়ল। আমি নিজের ঘরে গিয়ে আলমারি থেকে আমার এক সেট পায়জামা-পাঞ্জাবি বার করে আনলাম। এসে দেখি, প্রণবেশ সোফায় চুপ করে বসে আছে। মাথাটা এক দিকে কাত করা। যেন খুব গভীর ভাবে কিছু চিন্তাভাবনা করছে। আমার ডাকে ওর চমক ভাঙল।
"এই নে, ভেজা জামা-কাপড়গুলো ছেড়ে এই পায়জামা-পাঞ্জাবিটা পরে নে। আমি রাতের খাবার গরম করছি। তুই চেঞ্জ করে বাথরুম থেকে হাত-মুখ ধুয়ে টেবিলে এসে বোস।"
ডাইনিং টেবিলে বসে প্রণবেশের থালায় মাছের ঝোলের সঙ্গে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত বাড়তে-বাড়তে জিজ্ঞাসা করলাম-
"এবার ধীরে-সুস্থে গুছিয়ে পুরোটা বল তো দেখি, কী এমন কাণ্ড ঘটল যার জন্য তোর মনটা এত খারাপ?"
"বাড়িটা আমার স্যুট করছে না রে।"
"কোন বাড়িটা?"
"আরে আমার ওই নতুন বাড়িটা।"
"বলিস কী?" আমি হতবাক হয়ে বললাম, "এইতো সবে আট-ন'মাস হল বাড়িখানা কিনলি। কত সুন্দর বাড়ি! কাঁড়িখানেক টাকা খসিয়ে কত শখ করে কিনেছিলি; রাতারাতি এমন কী ঘটল যে বাড়িটা তোর 'স্যুট' করল না?"
"হ্যাঁ, তুই ঠিকই বলেছিস," প্রণবেশ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, "আমার বহুদিনের শখ ছিল যে একটা বিশাল বড় রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি কিনব। তাই ওই জমিদার-বাড়িটা কিনতে আমি আমার উপার্জনের প্রায় সব টাকাই ঢেলে দিয়েছিলাম। এতদিন সব ঠিকই ছিল। কিন্তু গত একমাস ধরে সবকিছুই কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে রে।"
"গোলমাল? কীরকম গোলমাল?"
"আমার কথাগুলো তুই বিশ্বাস করবি?"
"অবশ্যই করব।"
প্রণবেশ বার দুয়েক ঢোঁক গিলে বলল-
"ওই বাড়িটা ভাল নয় রে অবিনাশ। বাড়িটার উপর কোনও অতৃপ্ত আত্মার ছায়া জড়িয়ে আছে। রাত আড়াইটা বাজলেই বাড়িটার উপর অন্ধকারের এক অশুভ কালো আবরণ নেমে আসে। ওই অতৃপ্ত আত্মাগুলো আমাকে বাঁচতে দেবে না রে....বাঁচতে দেবে না!"
উত্তেজনার বশে শেষের কথাগুলো বেশ চিৎকার করেই বলল প্রণবেশ। আমি পাথরের মূর্তির মতো বসে রইলাম। এসব কী বলছে ছেলেটা? অতৃপ্ত আত্মা....অশুভ ছায়া....এ সবের মানে কী?
"শোন, তুই আগে একটু শান্ত হয়ে আমাকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বল। ভয়ের কিচ্ছু নেই। রাত আড়াইটার সময় কী এমন হয় ওই বাড়িতে?"
প্রণবেশ টেবিলে রাখা জলের গেলাসটা থেকে ঢকঢক করে অনেকটা জল গলায় ঢেলে নিল। একটু স্বাভাবিক হয়ে আবার বলতে আরম্ভ করল-
"তুই তো জানিস, আমার বেডরুমটা দো'তলায়। ওই ঘরের পাশেই আরেকটা ঘর আছে।"
"হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক তাই। তবে ওই ঘরটা তো তুই তালা বন্ধ করে রাখতিস।"
"এখনও তালা বন্ধ করেই রাখি, কারণ ওই ঘরটার বিশেষ কোনও প্রয়োজন পড়েনি এতদিন। কিন্তু গত একমাস ধরে ওই ঘরটাকে ঘিরেই যত ঝামেলা।"
"কেমন ঝামেলা?"
"রোজ রাত আড়াইটা বাজলেই ওই ঘর থেকে সারেঙ্গির সুর ভেসে আসে রে অবিনাশ," প্রণবেশ চোখ বড়-বড় করে বলল, "তার সাথে ভেসে আসে গানের কলি আর ঘুঙুরের ঝুমঝুম শব্দ। বাতাসে ভুরভুর করে আতরের গন্ধ। আমি প্রাণপণে দু'কানে বালিশ চাপা দিয়ে বিছানায় ছটফট করি, কিন্তু ওই পৈশাচিক উপদ্রব বন্ধ হয়না। এইসব ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানা ভোর পর্যন্ত চলে। তারপর সূর্য্যের প্রথম আলো ফুটতেই সব আওয়াজ আপনা থেকেই থেমে যায়।"
"কী বলছিস রে!" আমি সোজা হয়ে বসলাম, "এসব কী কাণ্ড? আচ্ছা তুই কখনও ওই সময় ঘরের তালাটা খুলে ভিতরে যাসনি?"
"গেছিলাম। এক বার নয়, তিন-তিন বার গেছিলাম। প্রতিবারই এক কাণ্ড। ঘরে ঢুকে দেখি ভিতরে কেউ নেই। একদম ফাঁকা। শুধু গান-বাজনা আর আতরের সুগন্ধটা আরও তীব্র হয়ে উঠত। কিন্তু চারিদিকে চেয়ে দেখতাম....কোত্থাও কেউ নেই।"
আমি খানিকক্ষণ গুম মেরে বসে রইলাম। প্রণবেশের সাথে আমার সেই ছোটবেলার বন্ধুত্ব। ওকে আমি হাড়ে-হাড়ে চিনি। বানিয়ে বানিয়ে ফালতু কথা বলার লোক ও নয়। যথেষ্ট প্র্যাক্টিক্যাল ছেলে। তাই ওর কথাগুলো তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারছিলাম না। আবার পুরোপুরি সবকিছু বিশ্বাস করতেও খটকা লাগছিল। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললাম-
"দেখ ভাই। তুই কী বলছিস তার আগাগোড়া আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি ভাবছি কাল তোর বাড়িতে গিয়ে রাতটা ওখানেই কাটাব। কী হচ্ছে না হচ্ছে, তা আমি একবার স্বচক্ষে দেখতে চাই।"
"পাগল নাকি তুই?" প্রণবেশ আঁতকে উঠল, "ওই ভূতের আড্ডায় তুই স্বেচ্ছায় যেতে চাইছিস? মাথা ঠিক আছে তোর?"
"নিজে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। আর তাছাড়া এতদিন যাই হয়ে থাকুক, তোর কোনও ক্ষতি তো হয়নি....তাহলে ভয় কীসের? যখন তোর কিছু হয়নি, তখন আমারও কিছু হবেনা।"
"ক্ষতি হয়নি তবে হতে কতক্ষণ?"
"আমি অত জানিনা ভাই। যখন একবার ঠিক করেছি যে ওই বাড়িতে যাব, তখন আমি যাবই।"
বেগতিক দেখে প্রণবেশ চুপ করে গেল। দুজনেই ক্লান্ত ছিলাম, তাই রাতের খাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। এই বিষয়টা নিয়ে আমাদের মধ্যে আর কোনও আলোচনা হল না। পরের দিন ঘুম ভাঙতে বেশ বেলা হল। স্নান আর প্রাতঃরাশের পাট চুকিয়ে, সবকিছু গোছগাছ করে বেরোতে-বেরোতে আমাদের প্রায় সাড়ে এগারোটা হয়ে গেল। এখান থেকে ওর বাড়িটা বেশ দূর; ট্যাক্সিতে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক লেগে যায়।
ট্যাক্সিতে বসে প্রণবেশ একটা কথাও বলল না। মুখ গোমড়া করে চুপচাপ বসে রইল। বুঝলাম, ছেলেটা মনে-মনে ভীষণ ভয় পেয়েছে। এমন প্রাণোচ্ছল একজন মানুষের মধ্যে এই ধরণের পরিবর্তন দেখে বড্ড মায়া হল। নাহ্....ব্যাপারটা খুঁটিয়ে দেখতেই হচ্ছে। কী এমন ভৌতিক চক্রান্ত চলছে ওই বাড়িতে, যা ওকে মানসিক ভাবে এতটা ভেঙে দিয়েছে?
আমাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর কথা দুপুর দুটোর আগেই। কিন্তু যানজটের কল্যাণে আমরা যখন বাড়ির দোরগোড়ায় এসে পৌঁছালাম, তখন ঘড়ির কাঁটা ঝাড়া সাড়ে তিনটে পার। ট্যাক্সি থেকে নেমে অল্প কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে যেতে হয়। দূর থেকেই বাড়িটা চোখে পড়ে। বিশাল অট্টালিকার সমান বাড়ি। প্রণবেশের মুখেই শুনেছিলাম, এইটা ছিল এই অঞ্চলের জমিদারদের বাসভবন। তারপর অনেক হাত ঘুরে শেষমেশ এখন এর মালিকানা ওর হাতে। এর আগে একবার এসেছিলাম এইখানে, যখন বাড়ির গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠান হয়েছিল। সত্যি বলতে তখন বাড়িটাকে একদম পোড়ো হানাবাড়ির মতোই লেগেছিল। দীর্ঘদিনের অযত্নের ফলে সামনের বাগানটাও একটা আস্ত জঙ্গলে পরিণত হয়েছিল। তবে প্রণবেশ লোক-লস্কর লাগিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই বাড়িটার ভোল পাল্টে ফেলেছে। বাড়ি পরিষ্কার আর রং করানো তো বটেই, ও বাগানটাকেও একদম তৈরি করে ফেলেছে নিজের হাতে। এমনিতেই গার্ডেনিং করার প্রতি বরাবরই ওর ঝোঁক ছিল। কিন্তু আজ বাড়িটার অবস্থা স্বচক্ষে দেখে বুঝলাম, প্রণবেশের নান্দনিক বোধটাও অতি প্রখর। বাগানের মাঝে একটা সুন্দর ফোয়ারা লাগিয়েছে। সব মিলিয়ে বলতে গেলে, বাড়িটা আবার ফিরে পেয়েছে নিজের পুরাতন স্বরূপ।
প্রণবেশ আমারই মতো ব্যাচেলার মানুষ, বিয়ে-থা করেনি। বাড়িতে ওকে ছাড়া আরও তিনজন জীবিত প্রাণী থাকে:- ওদের পরিবারের বহুকালের পুরনো কাজের লোক শুভ্রা দি, বাগানের পরিচর্যার জন্য সনাতন দা....আর তৃতীয় জন হল প্রণবেশের পোষা হাউন্ড বক্সার। এই বক্সারই হল ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী।
"এই বাড়িতে শিফ্ট করার পর থেকেই বক্সার কেমন যেন অদ্ভুত আচরণ করতে শুরু করেছে," প্রণবেশ চাবি ঘুরিয়ে বাড়ির সদর দরজার তালাটা খুলে ফেলল, "কিছু খেতে চায়না, সারাদিন শুধু ওই তালাবন্ধ ঘরটার সামনে বসে গজরাতে থাকে। আগে ও আমাকে চোখে হারাত, কিন্তু এখন আমার কাছেও খুব একটা আসতে চায়না।"
বাড়ির ভিতরটাও বেশ ভাল সাজিয়েছে প্রণবেশ। ছেলেটার টেস্ট আছে বলতে হবে! বেশ মনে হচ্ছিল যেন আজ থেকে প্রায় দু'শো বছর আগেকার কোনও বনেদি বাড়িতে এসে দাঁড়িয়েছি।
সারাটা দিন গল্পগুজব আর খাওয়া-দাওয়া করেই কাটিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নামল, আরও খানিকক্ষণ পরে গুটিগুটি পায়ে নামল রাতের আঁধার। আমরা দুজনেই উদগ্রীব হয়ে বসে ছিলাম। দশটার মধ্যে নৈশভোজ সেরে আমরা শোওয়ার ঘরে ঢুকলাম। সব ব্যবস্থা করেই রেখেছি আমি। সঙ্গে আছে চার-ব্যাটারির বড় টর্চ। লোডশেডিং হলে তার জন্য মোমবাতি আর দেশলাই। কোনও অস্বাভাবিক গতিবিধি লক্ষ্য করলে সেটাকে ফ্রেমবন্দী করার উদ্দেশ্যে ক্যামেরাটাও এনেছি। আর সঙ্গে নিয়েছি একখানা অসমাপ্ত উপন্যাস, কারণ রাত আড়াইটা পর্যন্ত আমরা কেউ ঘুমাব না।
ধীরে-ধীরে রাত আরও গভীর হল। দুজনে খাটে শুয়ে আছি ঠিকই, তবে কারও চোখে একফোঁটা ঘুম নেই। প্রণবেশ একটার পর একটা সিগারেট ধরিয়ে যাচ্ছে, আর আমি ডুবে আছি উপন্যাসের পাতায়। ঘরের মধ্যে এক অস্বস্তিকর নীরবতা বিরাজ করছে। ঘরের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিশালকায় গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটা থেকে-থেকে সময়ের জানান দিয়ে যাচ্ছে গুরুগম্ভীর শব্দে। রাত এগারোটা বাজল। তারপর বারোটা। একটা, দেড়টা....
আমি প্রমাদ গুনলাম। আর মাত্র এক ঘণ্টার অপেক্ষা। আচ্ছা....যদি এমন হয় যে আজ রাতে কিছুই হল না, তখন কী হবে? সবই যদি আজ স্বাভাবিক থাকে? আমার তো এখানে আসাটাই মাটি হবে তাহলে। সে যাই হোক, দেখা যাক কী হয়।
ঢং ঢং করে ঘড়িটা দু'বার বেজে আবার নিশ্চুপ হয়ে গেল। রাত দুটো। আড়চোখে প্রণবেশের দিকে তাকালাম। দেখলাম ও খাটের এক কোণে জড়সড় হয়ে বসে আছে; চোখেমুখে ভয়ের ছাপ সুস্পষ্ট। আমি বেশি পাত্তা না দিয়ে আবার বইয়ের পাতায় মনোনিবেশ করলাম।
"অবিনাশ....শোন না!"
"হুম, বল।"
"আর তো আধঘণ্টা বাকি। কী হবে বল তো? শেষমেশ নিজের ঝামেলায় তোকে জড়িয়ে কোনও ব্লান্ডার করে ফেললাম না তো? যদি তোর কোনও চরম ক্ষতি হয়ে যায়?"
"দেখ ভাই, চরম ক্ষতি বলতে তো মৃত্যু, তাই তো? মরতে তো আমাদের সবাই কে হবে। কিন্তু ভয়ে-ভয়ে প্রতিনিয়ত মরার চাইতে ভয়ের কারণটা জানতে গিয়ে প্রাণ হারানো আমার কাছে অনেক শ্রেয়।"
প্রণবেশ চুপ করে গেল। আমিও আবার উপন্যাসে মন দিলাম। কতক্ষণ ওইভাবে কেটেছে জানিনা। শেষের দিকে হয়তো চোখদুটো একটু লেগে এসেছিল। ঘড়ির আওয়াজে আচমকা ঘোরটা ভেঙে গেল।
ঢং........
একবার বেজেই ঘড়িটা শান্ত হয়ে গেল। রাত আড়াইটা। প্রণবেশের প্রবল ঝাঁকুনিতে আমি ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। একটা মিষ্টি আতরের গন্ধে গোটা ঘরটা ভরে উঠেছে।
"ওই যে....ওই যে সেই গানের আওয়াজ!" প্রণবেশ আমার হাতটা খামচে ধরল, "শুনতে পাচ্ছিস ঘুঙুরের শব্দ? শুনতে পাচ্ছিস না?"
আমি কান পেতে শুনলাম। হ্যাঁ, ঠিক তো! ক্ষীণ অথচ স্পষ্ট। তালা বন্ধ ঘরটার ভিতর থেকে মধুর কণ্ঠে ঠুমরী গানের সুর ভেসে আসছে। তার সাথে সঙ্গত করছে তবলা আর সারেঙ্গি। ঘুঙুরের মৃদু কিন্তু ছন্দবদ্ধ 'ঝুম ঝুম' শব্দ কানে যেন মধু ঢালছে। ঘরের বাতাসটা ক্রমেই ভারী হয়ে উঠেছে সুরা আর আতরের মিশ্রিত মাদক গন্ধে।
"ঘরের চাবিটা কোথায় রেখেছিস?"
"এই তো, আমার সঙ্গেই আছে," পকেট থেকে চাবিটা বার করল প্রণবেশ।
"আয় আমার সঙ্গে," আমি ওকে নিয়ে ঘরটার দিকে এগোলাম।
তালা খুলে অল্প ধাক্কা দিতেই দরজাটা বিকট শব্দে খুলে গেল। ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। টর্চটা সাথেই ছিল, ওটা জ্বালাতেই ভিতরটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। নিরেট ফাঁকা একটি হলঘর। একটা আসবাব পর্যন্ত নেই। শুধু প্রকাণ্ড একখানা ঝাড়বাতি সিলিং থেকে ঝুলছে। দেখেই বুঝতে পারলাম, জমিদারি আমলে এটাই ছিল এই বাড়ির নাচঘর। ঘরে কেউ ছিল না, তবুও যেন ঘরটা খোলামাত্র নাচ-গানের আওয়াজ আর আতরের গন্ধটা আরও বেশি তীব্র হয়ে উঠল। ঠিক যেন এক অদৃশ্য জলসাঘরে এসে পড়েছি আমরা দুজন। এখানে সবই আছে, শুধু আমরা চোখে দেখতে পাচ্ছি না। এখানে আমাদের উপস্থিতি যেন একান্ত অপ্রয়োজনীয়।
"ভিতরে আয় তো," আমি প্রণবেশ কে ডাকলাম, "একটু খুঁজে দেখি আওয়াজটা কোত্থেকে আসছে।"
প্রকাণ্ড হলঘর। ঘুঙুরের শব্দটা যেন প্রতিটা দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে বার-বার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আমি দেওয়ালে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম। শব্দ থাকলে তার উৎস তো থাকবেই। ওইভাবে দেওয়ালে আড়ি পেতে আমি ঘরটা প্রদক্ষিণ করতে লাগলাম। একটা জায়গায় এসে হঠাৎ যেন আওয়াজটা অনেক বেশি জোরালো হয়ে উঠল। দেওয়ালের ওই অংশে টর্চের আলো ফেললাম। ভাল করে খুঁটিয়ে দেখে বুঝলাম, দেওয়ালের এই স্থানটি বাকি জায়গার তুলনায় অনেক বেশি মসৃণ। দু'বার ঠকঠক করে ওই জায়গায় আঘাত করতেই একটা ফাঁপা শব্দ হল। আরে! এইটা তো সিমেন্ট নয়, এ যে....কাঠ! হ্যাঁ, প্লাইউড বা ওই জাতীয় কোনও কাঠ দিয়ে দেওয়ালের এই অংশটা নির্মিত।
"প্রণবেশ, তোর কাছে কি কাঠ ভাঙার মতো কোনও কুড়ুল-টুড়ুল আছে?"
"হ্যাঁ, সনাতন দা তো বাগানের কাজকর্ম করে। তার কাছে থাকতে পারে। কিন্তু তোর হঠাৎ কুড়ুলের কী দরকার?"
"আহ্! বাজে প্রশ্ন করিস না। তাড়াতাড়ি কুড়ুলটা নিয়ে আয়। আর পারলে সনাতন দা কেও ধরে আনবি।"
প্রণবেশ আর বাক্যব্যয় না করে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ফিরে এল, ওর সঙ্গে হাতে কুড়ুল নিয়ে হাজির হল সনাতন দা।
বলিষ্ঠ হাতের শক্তিশালী প্রহার পড়তে লাগল দেওয়ালের গায়ে। কুড়ুলের সাত-আটটা কোপেই পাতলা কাঠের চাদর ভেঙে ফেললেন সনাতন দা। তারপর আরও কিছুটা কসরৎ করে কাঠের তৈরি পুরো অংশটাকেই চড়মড় শব্দে উপড়ে ফেললেন। এখন দেওয়ালের ওই জায়গাতে এক বিরাট গহ্বর সৃষ্টি হয়েছে। টর্চের আলো ফেললাম সেই হাঁ-মুখের ভিতরে। দেখতে পেলাম, প্রায় বারো-তেরো ধাপ নড়বড়ে লোহার সিঁড়ি পাতালে নেমে গেছে। নিচে একটা ছোট তলঘর মতো চোখে পড়ল....যেন আমাকেই বার-বার হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
(দ্বিতীয় পর্ব)
প্রণবেশের দিকে ফিরে বললাম-
"শোন, আমাদের নিচে নামতে হবে। খুঁজে দেখতে হবে কী আছে ওখানে।"
"কোনও প্রশ্নই ওঠে না," প্রণবেশ আমার হাতটা চেপে ধরল, "ঢের হয়েছে, আর নয়। তোকে আমি কিছুতেই নিচে নামতে দেব না।"
"পাগলামি করিস না," আমি এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম, "নিচে না নামলে বুঝব কীভাবে যে ওই ঘরে কী আছে? বেশ। তাহলে তোরা দুজন এখন উপরেই থাক, আমি একা নামছি।"
সনাতন দা আর প্রণবেশের অসংখ্য অনুরোধ ও সাবধানবাণী কে অগ্রাহ্য করে পা বাড়ালাম সিঁড়িটার দিকে। মাকড়সার ঝুল আর ধুলোয় ভরে আছে জায়গাটা। দু'হাত দিয়ে ঝুল সরাতে-সরাতে এগোলাম। কে জানে কতদিন পরে খোলা হয়েছে এই রাস্তাটা! বহুদিন বন্ধ থাকার ফলে ভিতর থেকে একটা গুমোট ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা দিচ্ছিল। টর্চের আলোয় ধূলিকণাগুলো আরম্ভ করেছিল উত্তাল নাচন। অতি কষ্টে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে, এক পা-এক পা করে সাবধানে নামতে লাগলাম লোহার জরাজীর্ণ সিঁড়ি বেয়ে। এতক্ষণ লক্ষ্য করিনি তবে এবার খেয়াল হল, নাচ-গানের শব্দ আর ঘুঙুরের ধ্বনি এখন একদম থেমে গেছে। এমনকি সেই আতরের গন্ধটাও আর পাচ্ছি না।
নিচে নেমে দেখলাম, যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। একটা খুপরি মতো তলঘর। আয়তনে খুবই ছোট। টর্চের আলোয় জায়গাটা খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। ঘরের পাথুরে দেওয়ালে শ্যাওলার মোটা আস্তরণ জমেছে। এখানকার মাটিটাও বেশ নরম। ঘরে জিনিস বলতে কিছুই তেমন চোখে পড়ল না, শুধু মাকড়সার জাল আর ধুলোবালি ছাড়া। আপনমনে সারা ঘর জুড়ে টর্চের আলো বোলাচ্ছি, এমন সময় মনে হল যে ঘরের কোণে কিছু একটা জিনিস পড়ে আছে। সেই দিকে টর্চের আলো ফেলতেই যে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলাম, তা দেখে আমার সর্বাঙ্গে একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল।
কোণার দেওয়ালে ঠেস দিয়ে শায়িত রয়েছে একটি নরকঙ্কাল। অতি প্রাচীন হাড়গুলি কালের কবলে পড়ে একদম খটখটে সাদা হয়ে গেছে। চক্ষুহীন শূন্য দুই কোটরে জমেছে মাকড়সার জাল। কাঠামো আর হাড়ের গড়ন দেখে মনে হচ্ছে যে এই কঙ্কালটা কোনও স্ত্রীলোকের। কঙ্কালের পাশেই পড়ে আছে কাঠের একখানা বড় বাক্স। তার ডালাটা খোলা, ভিতরে কিচ্ছু নেই। বুকটা এখনও ধড়ফড় করছিল। বায়োলজির স্টুডেন্ট ছিলাম, তাই ছাত্রজীবনে অসংখ্য কঙ্কাল দেখেছি। কিন্তু এখানে এমন আকস্মিক ভাবে একটা আস্ত নরকঙ্কাল চোখের সামনে এসে পড়বে, এই দৃশ্যটা দেখার জন্য মোটেই মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলাম না।
ঘরের অন্য কোণাগুলোর উপর আলো ফেলতে যাচ্ছিলাম, তখনই হঠাৎ আমার হাত থেকে টর্চটা ছিটকে মাটিতে পড়ে নিভে গেল। ঠিক হাত থেকে পিছলে পড়েনি; যেন কেউ জোর করে আমার হাতে ধাক্কা মেরে ওটা ফেলে দিল। চারিদিক আবার ডুবে গেল ঘুটঘুটে অন্ধকারে। কোনওমতে মাটিতে উবু হয়ে বসে হাতড়ে-হাতড়ে টর্চটার নাগাল পেলাম। ভাগ্যিস নরম মাটিতে পড়েছে, তাই ভাঙেনি। কিন্তু অনেক ঝাঁকাঝাঁকি করা সত্ত্বেও আমি ওটাকে আবার জ্বালাতে পারলাম না।
এ তো আচ্ছা মুশকিলে পড়া গেল! কী করি এখন? আর তো কিছু নেই এই ঘরে। ফিরে যাওয়াই তাহলে বুদ্ধিমানের কাজ। আলকাতরা মাখানো অন্ধকারে সিঁড়ির দিশা অনুমান করে পা বাড়ালাম। তবে কিছুটা দূর এগোতেই বুঝলাম যে আমি দিক ভুল করেছি। সঙ্গে ফোনটাও আনা হয়নি যে তার ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে সিঁড়িটা খুঁজব। বেশ কয়েকবার চিৎকার করে প্রণবেশ আর সনাতন দা'র নাম ধরে ডাকলাম। আমার গলার স্বর ঘরের দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে আমাকেই যেন উপহাস করে গেল। কিন্তু উপর থেকে দুজনের মধ্যে কারও সাড়া পাওয়া গেল না। একি! ওরা কি যে যার ঘরে গিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ল নাকি?
অবশ্য এইটুকু ছোট জায়গার মধ্যে দিক-নির্ধারণ করাটা মোটেই শক্ত কাজ নয়। দেওয়াল ধরে হাঁটলেই সিঁড়িটার সন্ধান পাওয়া যাবে। একটু এগোতেই দেওয়ালের নাগাল পেয়ে গেলাম। দু'হাত দিয়ে দেওয়াল হাতড়ে-হাতড়ে সিঁড়িটা খুঁজতে আরম্ভ করলাম। এক পা-এক পা করে দেওয়াল ধরে হাঁটছি। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে আমার যেন একটা খটকা লাগল। টর্চের আলোয় ঘরটার যা আয়তন দেখেছিলাম, সেই অনুসারে ঘরের এক কোণা থেকে আরেক কোণা বড়জোর দশ-বারো পায়ের বেশি নয়। কিন্তু আমি গুনে-গুনে প্রায় পঁচিশ পা মতো হেঁটে নিয়েছি। কই....এখনও তো ঘরের অপর প্রান্তে পৌঁছতে পারলাম না? ঘরটা বুঝি এতটাই বড়, নাকি আমিই কোনাকুনি হাঁটছি? সেটাও বা কী করে সম্ভব, আমি তো দেওয়াল আঁকড়ে ধরেই এগোচ্ছি। সুতরাং কোনাকুনি বা আঁকাবাঁকা পথে চলার প্রশ্নই ওঠে না। তবে? নিজের মন কে শক্ত করে আর পা'দুটো কে যথাসম্ভব সোজা পথে রেখে একটা নির্দিষ্ট দিশা ধরে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। কিন্তু আবার সেই একই কাণ্ড। হাঁটছি তো হাঁটছি....সিঁড়ি আর মেলে না। যেন ঘোর তমসার মধ্যে কোনও মাঠের মাঝখান দিয়ে চলেছি। কোনওমতেই দিক-নির্ণয় করতে পারছি না।
এতক্ষণ ধরে যেটার ভয় মনে আসেনি, এখন চকিতে যেন সেই ভাবনাটাই মনে আঘাত হানল। তার মানে আমি কি সত্যিই কোনও প্রেতপুরীতে এসে পড়েছি? এখানকার বিদেহী আত্মারা কি আমাকে নিয়ে খেলা করছে? এভাবে এই অন্ধকারের গোলকধাঁধায় ঘুরতে-ঘুরতেই কি আমার মৃত্যু ঘটবে? কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। হৃৎপিণ্ডটা চাবুক খাওয়া ঘোড়ার মতো ছুটছে।
এবার আমি দিক-বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়াতে আরম্ভ করলাম। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি....কিছুই জানিনা। শুধু উন্মাদের ন্যায় ছুটে চলেছি। হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ছি, উঠে দাঁড়াচ্ছি, আবার ছুটছি। একসময় ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে ধপ্ করে মাটিতে বসে পড়লাম। আর পারছি না। হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে মনে হচ্ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। বুকটা প্রচণ্ড ভাবে ধড়ফড় করছে। চিবুক বেয়ে দরদর করে নামছে ঘামের লবণাক্ত ধারা।
কতক্ষণ এভাবে বসে ছিলাম জানি না। হঠাৎ মনে হল যেন দূর থেকে সারেঙ্গির ক্ষীণ সুর ভেসে আসছে। আতরের গন্ধ আর ঘুঙুরের ধ্বনিও এক-এক করে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। চারিদিক ভরে উঠেছে এক অপার্থিব স্নিগ্ধ নীল আলোয়। সেই আলোর মধ্যে কিছু ছায়ামূর্তি ফুটে উঠেছে। ঠিক যেন পূর্ণচন্দ্রের হালকা কুয়াশামাখা জোছনা এক জায়গায় জমাট বেঁধে আমার চোখের সামনে একটা মায়াবী দৃশ্যপট তৈরি করেছে। দেখলাম এক বিশাল জলসাঘর। ছাদ থেকে মস্ত একখানা ঝাড়বাতি ঝুলছে। আরে! এইটা প্রণবেশের বাড়ির সেই ভুতুড়ে হলঘরটা না? হ্যাঁ, ওটাই তো।
কিন্তু এখন দেখছি ঘরটা খালি নয়। পুরনো দিনের সব আসবাবপত্র আর লোকজনের ভীড়ে গমগম করছে। সবাই গোল হয়ে বসে আছে। সামনে জমিদার মশাই গদিতে হেলান দিয়ে গড়গড়ার নলে টান দিচ্ছেন। মাঝে-মাঝে একটা বড় পাত্র ঠোঁটে লাগিয়ে গলায় এক ঢোঁক করে সুরা ঢালছেন। পুরো ঘরটা ভুরভুর করছে বসরাই গোলাপের সুবাসে। ওস্তাদ গাইয়ে টপ্পা আর ঠুমরী গানের নেশায় আসরে সুরের আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আর জলসাঘরের ঠিক মাঝখানে চলছে বাঈজির নাচ। বাঈজির সে কী অপরূপ আর নিখুঁত নৃত্য! কী অপূর্ব তার নাচের প্রত্যেকটা মুদ্রা....কী মধুর তার চোখের এক-একটা ভঙ্গি! এমন নাচ আমি জীবনে কখনও প্রত্যক্ষ করিনি। কতক্ষণ যে কাঠের পুতুলের মতো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে নাচ দেখলাম; সময়ের খেয়ালই রইল না। কিছুক্ষণ পর সে দৃশ্য ক্রমেই ছায়ার ন্যায় মিলিয়ে গেল।
এবার আমার চোখের সামনে এক ভিন্ন দৃশ্য এসে উপস্থিত হয়েছে। একটা ঘরে একজন নারী ও পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। ঘরটা দেখে অনুমান করলাম, এইটা প্রণবেশের শয়নকক্ষ। তবে এই ঘরের আন্তরিক সজ্জা একদম আলাদা। মহিলাটির হাতে মাহোগনি কাঠের একটা বড় বাক্স।
"এ বাক্স আমি তোমাকে কিছুতেই দেব না!" বাক্সটা প্রাণপণে বুকে আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে উঠল সেই মহিলা, "এক-এক করে তুমি আমার সবকিছু কেড়ে নিয়েছ। কিন্তু আমার এই গয়নার বাক্সটা আমি কিছুতেই তোমাকে আত্মসাৎ করতে দেব না।"
"দিবি না মানে?" পুরুষটা চাপা রাগে হিসহিস করে উঠল, "তোকে দিতেই হবে! এই গয়না বেচে যা টাকা আসবে, তা দিয়ে আমি বাড়িতে হীরাবাঈয়ের নাচের আসর বসাব। দামি বিলেতি মদ আনাব। এই চৌধুরী বাড়িতে আজ জলসা বসবে....জলসা!"
"কিছুতেই না। বাপের বাড়ির দেওয়া এই গয়নাগুলো আমার শেষ সম্বল। আমি বেঁচে থাকতে কোনও অবস্থাতেই তোমাকে এগুলো ছুঁতে দেব না।"
"ও আচ্ছা, তাই নাকি?" লোকটার ঠোঁটের কোণে খেলে গেল একচিলতে নিষ্ঠুর হাসি, "বেঁচে থাকতে এ বাক্স ছুঁতে দিবি না? কিন্তু মরে গেলে তো দিবি? এটাই যখন তোর ইচ্ছে, তবে তাই হোক!"
লোকটা তেড়ে গিয়ে মহিলার টুঁটি চেপে ধরল। মহিলাটি নিজেকে ছাড়ানোর জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করছে। কিন্তু একজন পুরুষমানুষের সাথে একজন স্ত্রীলোক ধস্তাধস্তি করে কতক্ষণ এঁটে উঠতে পারবে? কিছুক্ষণের মধ্যেই মহিলার দেহ শিথিল হয়ে গেল। নিষ্প্রাণ হাত থেকে সশব্দে খসে পড়ল মাহোগনি কাঠের ভারী বাক্সটা। লোকটা পাগলের মতো বাক্সের ভিতরকার সব গয়নাগাটি বার করে একটা পুঁটলির মধ্যে ভরতে লেগেছে। তারপর আস্তে-আস্তে এই দৃশ্যটাও মিলিয়ে গেল।
এরপর আমার চোখের সামনে ফুটে উঠল এই তলঘর। দুজন লোক একটি নারীর মৃতদেহ বয়ে আনছে। সেই মহিলার'ই মড়া, যাকে কিছুক্ষণ আগে নিজের চোখের সামনে মরতে দেখলাম। ওরা অবজ্ঞার সাথে মৃতদেহটা ঘরের মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলল। গয়নার খালি বাক্সটাও পাশেই ফেলে দিল। তারপর কাঠের বড়-বড় পাটাতন দিয়ে বুজিয়ে ফেলল তলঘরে নামার গুপ্ত রাস্তাটা। আবার চারিদিক ঘোর অন্ধকারে ডুবে গেল। হঠাৎ অন্ধকারের বুক চিরে উঠে এল এক গগনবিদারী আর্তচিৎকার........
"মুক্তি! আমাকে মুক্তি দাও। আর কতদিন এভাবে আমাকে এই ঘরে বন্দী করে রাখবে? আমার বাঁধন খোলো। কী কষ্ট, কী নরক-যন্ত্রণা! মুক্ত করো আমাকে!!"
আমি দু'কান চেপে ধরে ছটফট করতে লাগলাম। বড় তীব্র সেই আর্তনাদ; মনে হচ্ছে যেন আমার কানের পর্দা ফেটে যাবে সেই অমানুষিক চিৎকারে। কিছুক্ষণ পর আস্তে-আস্তে সব নিশ্চুপ হয়ে গেল। শ্মশানের নীরবতা গিলে ফেলল বিদেহী আত্মার করুণ আর্তি। আমার যেন হঠাৎ সম্বিৎ ফিরল। এলোপাথাড়ি টিপতে লাগলাম টর্চের সুইচ। এইবার আশ্চর্যজনক ভাবে একবার টিপতেই জ্বলে উঠল টর্চটা। আমি এখনও সেই ঘরের মেঝেতেই পড়ে আছি। সবকিছু স্বাভাবিক....সামনে সিঁড়িটাও দেখতে পাচ্ছি। কোণায় শোয়ানো কঙ্কালটা আগের মতোই নিথর ভাবে পড়ে রয়েছে। পাশে বাক্সটাও অক্ষত আছে। আমি পাগলের মতো এক দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে হাজির হলাম হলঘরের দোরগোড়ায়। দেখি প্রণবেশ আর সনাতন দা উদ্বিগ্ন ভাবে ঘরে পায়চারি করছে। আমাকে ওইভাবে এলোপাথাড়ি ছুটে আসতে দেখে ওরা তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে এল।
"কী রে অবিনাশ? কী দেখলি নিচে? আর এত হাঁপাচ্ছিস কেন?"
"তোরা কোথায় গেছিলি? এত ডাকাডাকি করলাম তবু তোরা কেউ সাড়া দিলি না।"
প্রণবেশ আর সনাতন দা হতভম্ব হয়ে একে-অপরের মুখের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সনাতন দা'ই বলল-
"তুমি কখন ডেকেছিলে দাদাবাবু? আমি আর সাহেব তো এতক্ষণ ধরে এখানেই আছি। এক পাও নড়িনিকো। কই, আমরা তো তোমার কোনও ডাক শুনতে পাইনি।"
"হ্যাঁ রে," সায় দিল প্রণবেশ, "আর তাছাড়া তুই তো গেলি আর এলি। এইটুকু সময়ের মধ্যে তুই এমন কী দেখলি, যা দেখে তোর এই অবস্থা হল?"
"গেলাম আর এলাম মানে?" আমি বিস্ফারিত চোখে তাকালাম, "আমি তো প্রায় ঘণ্টা দুয়েক ধরে ভিতরে আছি....অথবা তারও বেশি।"
"কী উল্টোপাল্টা বকছিস!" প্রণবেশ নিজের হাতঘড়ির ডায়ালটা আমার চোখের সামনে মেলে ধরল, "এই দেখ, তুই ভিতরে ঢুকেছিলি প্রায় তিনটে নাগাদ, আর এখন বাজে তিনটে দশ।"
আমার আর কিছু শোনার বা বোঝার মতো ক্ষমতা ছিল না। সব চিন্তাভাবনা কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। অতিকষ্টে বললাম-
"নিচে তলঘরে একটা মহিলার কঙ্কাল পড়ে আছে। আর তার পাশে পড়ে আছে কাঠের একটা বড় বাক্স। ওই দুটো উদ্ধার করে আন। শ্মশানে নিয়ে গিয়ে কঙ্কালটার শেষকৃত্য সম্পন্ন করার ব্যবস্থা কর। অতৃপ্ত আত্মা কে মুক্তি দে, আর বাক্সটা পুড়িয়ে ফেলিস। ওই কঙ্কালটার সদ্গতি না করলে ও তোদের কাউকে রেহাই দেবে না রে....রেহাই দেবে না!"
আর নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। হাঁটুদুটো থরথর করে কাঁপছে। যন্ত্রণায় মাথাটা ফেটে যাচ্ছে। চোখের সামনে একটু-একটু করে অন্ধকার ঘনীভূত হয়ে আসছে। প্রণবেশের কোলে মাথা রেখেই আমি জ্ঞান হারালাম।
এরপর বেশ কিছুদিনের জন্য হাসপাতালে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে ছিলাম। বাড়িতে এসে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে আমার প্রায় সপ্তাহখানেক মতো সময় লেগেছিল। প্রণবেশের কাছে পরে শুনেছিলাম যে আমি নাকি টানা দুই দিন অজ্ঞান অবস্থায় ছিলাম। আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করে ও আর সনাতন দা মিলে আমার নির্দেশ অনুযায়ী কঙ্কালটা কে তলঘর থেকে উদ্ধার করে এনেছিল। তারপর বিধিসম্মত ভাবে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে দাহকার্য সমাধা করে এসেছে। বাক্সটাও পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যে ও গয়ায় গিয়ে মৃত আত্মার শান্তিকামনা করে পিণ্ডদানও করে আসবে। কঙ্কালটা দাহ করে আসার পর থেকে বাড়িতে আর কোনও উৎপাত ঘটেনি। বহুদিনের প্রতীক্ষার পর মুক্তি পাওয়া আত্মার আশীর্বাদে প্রণবেশের শখের বাড়িটা কালক্রমে আবার আগের মতোই শান্তিনিকেতন হয়ে উঠেছিল।
**** সমাপ্ত ****