রাজনন্দিনী
রাজনন্দিনী
কোজাগরী পূর্ণিমার আলোয় বিশ্ব চরাচর ধুইয়া যাইতেছে। বিজয়নগর দুর্গের চারিধারে বিস্তৃত পরিখার জলে পূর্ণচন্দ্র প্রতিবিম্বিত। মৃদুমন্দ বাতাসে তরঙ্গায়িত পরিখার জলে চন্দ্রমা শতখন্ডে বিভাজিত। দুর্গের আভ্যন্তরীণ পথে দ্বারপাল প্রহরারত। নিশ্ছিদ্র প্রহরা। দুর্গের প্রত্যেক প্রান্তে এবং বিজয়নগর রাজ্যের রাজপ্রাসাদ ঘিরিয়া।
রাত্রির তৃতীয় প্রহর প্রায় অতিক্রান্ত। বৈতনিক বৈতালিকদল দৈনন্দিন প্রাতঃকর্মের প্রস্তুতিতেও কিঞ্চিত উত্তেজিত। উপলক্ষ্য রাজা বিজয়প্রতাপের পুত্রী রাজনন্দিনীর আবক্ষ মর্মরমূর্তি উন্মোচন। রাজনন্দিনী স্বয়ং যারপরনাই উত্তেজিত। রাত্রি অতিক্রান্ত প্রায়, রাজনন্দিনী দুর্গপ্রাসাদের প্রশস্ত ছাতে অস্থির পদচারণারত।
চন্দ্রালোক স্তিমিত। প্রত্যূষকাল উপস্থিত প্রায়। রাজা রাজমহিষীকে জিজ্ঞাসা করিলেন রাজনন্দিনীর নিদ্রাভঙ্গ হইয়াছে কিনা। রাজমহিষীর আদেশে দাসী পর্যবেক্ষন করিয়া আসিয়া বলিলো যে রাজনন্দিনীর গৃহ অর্গলাবদ্ধ। বৈতালিকের অতীব শ্রুতিমধুর রাগালাপ অণুরণিত সমগ্র দুর্গের অলিন্দে অলিন্দে। দিনমণি দিবালোকের ঔজ্জ্বল্য ক্রমশঃ বৃদ্ধি করিতেছেন। দাসী সংবাদ আনিলো রাজনন্দিনী আপন গৃহে নাই।
বিজয়নগর দুর্গের ও রাজপ্রাসাদের প্রতিটি প্রকোষ্ঠ-অলিন্দ-চবুতরা নির্মম সত্য প্রকাশ করিলো, রাজনন্দিনী নিরুদ্দেশ। রাজা ও রাজমহিষী গৃহদ্বার রুদ্ধ করিলেন। দিবাকর অস্তাচলগামী, ধেনুপালকেরা গোষ্ঠ হইতে গৃহাভিমুখী।
সহসা দেখিলো ধেনুপালকের দল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। থমকাইয়া গিয়া তাহারা দেখিলো, যে অদূরে বিজয়নগরের রাজা বিজয়প্রতাপের পুত্রী রাজনন্দিনী। ঘর্মসিক্ত বদনে তৃণাঙ্কুরে ক্ষতবিক্ষত চরণে দ্রুত পদক্ষেপে চলিয়াছে সম্মুখের তেপান্তরের প্রান্তর পার হইয়া। প্রান্তর পার হইলেই ঘন জঙ্গল। রাজনন্দিনীর পেলব কোমল হাতটি মূর্তিকার শ্রীমন্তের মুষ্টিবদ্ধ। মূর্তিকার শ্রীমন্ত রাজনন্দিনীর মূর্তি নির্মাণ করিতে বিজয়নগরে আসিয়াছিলো দেশান্তর হইতে। চলিয়াছে পুনরায় প্রান্তর জঙ্গল পার হইয়া দেশান্তরে। রাজনন্দিনী ও শ্রীমন্ত, দুইজনে দূরদিগন্তে বিলীন হইয়া গেলো।
ধেনুপালকেরা শুনিলো তেপান্তরের মাঠের ধারের বৃহৎ ও বৃদ্ধ অশ্বত্থ বৃক্ষের কোটরে বসিয়া আলাপ করিতেছে ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী, "আহা হা, জয় হোক রাজনন্দিনীর, জয় হোক প্রেমের।" তাহারা ফের বলিলো, "চুপ চুপ, রাজপ্রহরীরা আসিতেছে।" ধেনুপালকেরা লুকাইয়া পড়িলো চকিতে। আর ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী গান ধরিলো মহানন্দে, "যতই আসুক ভীতি ভয়, অন্ত্যমিলে হইবে প্রেমের জয়।"
(বিষয়: রূপকথা)