পূত্রব্য
পূত্রব্য
প্রথম অধ্যায়
নিলাদ্রী বিশাল বোইং ৭০৭ বিমানের পেটের ভেতরে, ইকোনমি ক্লাসের জানালার ধারে বসবার আসন থেকেই স্লাইডিং জানালা দিয়ে অনেক নিচে পড়ে থাকা পৃথিবীটাকে দেখছিলো। ওর মনে তখন রিনির মাকে নিয়ে চিন্তার ঝড় বইছে। ৩৬০০০ এর বেশি ফুট উচ্চতায় বিমানটা তখন উড়ে চলছে হিথরো বিমানবন্দর থেকে কলকাতার নেতাজী সুভাষ বোস বিমানবন্দরের দিকে । তখন সকাল । এতো উচ্চতায় পেজা তুলোর মত জমাটবাঁধা মেঘগুলো নিচে যেনো মনেহচ্ছে আরেকটা দেশ তৈরি করেছে। সেটা মেঘেদের দেশ। তার অনেক অনেক নিচে পৃথিবীর মাটি জল মানুষ । ছোটবেলায় নিলাদ্রী তার মা , ঠাম্মার কাছে গল্পঃ শুনতো মেঘেদের রাজ্যটা নাকি পরীদের রাজত্ব। নানারকম পরীদের বসবাস এই মেঘের রাজ্যে। মেঘগুলো যে কত রকমের আকার ধারণ করে সময় সময়ে। কখনো অবিকল মানুষের মত চোখ মুখ আর শরীর । কখনো বা কোন চেনা জন্তুর বা পাখীর মত দেখতে। কখনো বা একটা বাড়ি বা মন্দির বা একটা দুর্গের মত বা কখনো বা কোনো পাহাড়ের গুহার মত। কখনো টুকরো টুকরো মেঘমালা। আচ্ছা! মানুষ মরে যাবার পরে, সেই মানুষটার আত্মা নাকি স্বর্গে বা নরকে যায়। সেই স্বর্গ বা নরক কি এই মেঘেদের রাজ্যে, না আরো ওপরে ওই অন্তরীক্ষে না অন্য কোনো গ্রহে না অন্য অজানা তারার কোনো গ্রহে? নিলাদ্রী দেখে বাইরে পৃথিবীটাকে এই উচ্চতা থেকে একটা বিশাল বড় গোলাকার বলের মত মহাশূন্যে একেবারে একলা পরে থাকতে লাগছে। সেই একলা পরে থাকা গ্রহের মধ্যে ৭ বিলিয়ন মানুষ কত ট্রিলিয়ন অন্য জীব এর বাস। মাঝে মধ্যে যখন বোইং বিমানটা মেঘের সাদা আস্তরণ পেরিয়ে নীল আকাশের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, ঘন নীল আকাশে, সূর্য্যটাকে আগুনের গোলার মত দেখাচ্ছে। কি ঘন নীল লাগছে এই মহাশূন্য কে। মাত্র ৪৫০ কিলো মিটার উচ্চতায় বিমানটা উড়ছে। কিন্তু স্পেসটাইম যে ঘন অন্ধকার। আর অন্ধকারই নাকি আবার সৃষ্টির আধারও। নীলাদ্রী জানে এটা ঘন নীল আকাশ
" রামন এফেক্ট" এর জন্য । ভারতীয় পদার্থবিদ সি ভি রামন বের করেছিলেন কোলকাতার কলেজস্ট্রিটের একটা ঘরে বসেই। পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার ও পেয়েছেন উনি এই আবিষ্কারের জন্য। নিলাদ্রী দূরে স্পেসটাইম এর হোরিজন এর দিকে তাকালো। সেটা বেকানো । সোজা নয়। নিলাদ্রী সেই কারণটাও জানে। আইনস্টাইনের থিওরি অফ জেনারেল রেলাতিভিটির জন্য স্পেসটাইমটা বেকে গেছে। নিলাদ্রীও একজন পদার্থবিদ। লন্ডনের বিরব্রেক ইউনিভার্সিটিতে সে এখন পার্টিকেল ফিজিক্সের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। তার অধীনে বেশ কয়েকজন ইউরোপিয়ান যুবক গ্রাজুয়েট থিসিস করছে। আগেও করেছে অনেকে। আজ প্রায় ২৭ বছর হয়ে গেলো নিলাদ্রী লন্ডনবাসী। মধ্য লন্ডনের উইমবলপার্কে একটা সুন্দর মাঝারি সাজানো ফ্ল্যাটে তার ২৭ বছরের সংসার। স্ত্রী রিনি, ছেলে স্কট ,আর মেয়ে অলিভাকে নিয়ে। স্কট এখন সদ্য পাশ করা ডাক্তার, আলিভা ইকোনমিক সাইন্স নিয়ে বির্ব্রেক ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে প্রথমবর্ষে । লন্ডনে বসবাস করা মোটামুটি এক সুখী ভারতীয় পরিবার তারা । নীলাদ্রির একসময়ের আন্দোলন করা রাজনীতি চরিত্র আর এখানে চলে না। তার সংসারে তো নয়ই। রিনিও তাকে সম্পূর্ন ভাবেই পাল্টে দিয়েছে এখানে এসে। এখন সে ছাপোষা, সংসারে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে থাকা এক স্বামী, এক বাবা, এক লন্ডনবাসী মাত্র। পদার্থবিদ্যার সহকারী অধ্যাপক। মাস গেলে মাইনে পায় ৬৮০০ পাউন্ড। ভারতীয় মুদ্রায় সেটা মাসে ৭ লাখ টাকার মত হবে। লন্ডনের মধ্যবিত্ত তারা।
১৯৯৭ তে নিলাদ্রী বিয়েকরে লন্ডনে পাড়ি দিয়েছিল মনে আছে। তখন পশ্চিমবঙ্গে জ্যোতি বসুদের বাম ফ্রন্টের রাজত্ব। উপমূখ্যমন্ত্রী পদ থেকে বুদ্ধবাবুকে মূখ্যমন্ত্রীর দাযিত্ব বুঝিয়ে জ্যোতিবসু সবে অবসর নিযেছেন। হায়রে নিলাদ্রী ! প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়বার সময় বিপ্লবকরে পশ্চিমবঙ্গে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করবার সপথ পালনের এর পরিবর্তে, সে এখন বিদেশের মাটিতে লন্ডনের প্রথম সারির এক ইউনিভার্সিটির পার্টিকেল ফিজিক্সের সহ অধ্যাপক এবং এক নিরুদ্রপ, সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন জীবন যাপনে অভ্যস্ত সাদামাটা বাঙ্গালী। ১৯৯৭ এর পরেও নিলাদ্রী বেশ কয়েকবার কলকাতার থেকে রেলপথে ২৫ কিলোমিটার দূরে তাদের সোদপূরের বাড়িতে এসেছে রিনিকে নিয়ে। তাদের ছেলেমেয়েকে নিয়ে। তারা তখন অনেক ছোট। কিন্তু সোদপূরের বাড়ীটার ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু । প্লাস্টার খসে পড়ে ,ইট বার হওয়া চেহারা আর রান্নার হাঁড়ি ভাগ হয়ে যাওয়া যৌথপরিবারের পরিবেশে তাদেরও দম বন্ধ হয়ে আসতো। তাই এখন চার/ পাঁচ বছরে একবার আসে। কখনও বা একা, কখনও বা রিনিকে সঙ্গে নিয়ে।
নিলাদ্রী পাশে রিনির দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। রিনিও চোখ বুজে নিজের আসনে মাথা পিঠ হেলান দিয়ে আধসোয়া অবস্থায় বসে রয়েছে সিটবেল্ট বেধে। নিলাদ্রী বোঝে, রিনির ওপর দিয়ে এখন কি প্রচন্ড মানসিক চাপ ও উৎকণ্ঠা বয়ে যাচ্ছে তার মায়ের জন্য। নীলাদ্রির বাবার সময় নীলাদ্রির ও হয়েছিলো। নিলাদ্রী কিন্তু তার বাবাকে জীবিত অবস্থায় আর দেখতে পায়নি। সেটা অবশ্যি তার ভাগ্য। রিনি সেইসময় কলকাতাগামী ফ্লাইটে বসে তাকে অনেক সান্তনার বাণী শুনিয়েছিলো । নীলাদ্রির বাবা নাকি ঠিক হয়েই যাবেন। নিলাদ্রী আর রিনি যখন সোদপূরের বাড়ি পৌঁছেছিল তখন নীলাদ্রির নিথর বাবাকে একটা বরফের চাই এর ওপরে শোয়ানো ছিলো বাড়ির উঠোনে। ক্ষয়িষ্ণু, রোগাটে, হাড় সর্বস্ব একটা মৃত দেহ তখন নিলাদ্রীর বাবা। সাদা চাদরে পুরো শরীরটা ঢাকা। সদ্য দাড়ি কামানো মুখটাই সুধ খোলা ছিলো। চোখ বোজা। বাড়ির সবাই, নীলাদ্রির একমাত্র বোন, ওদেরই আসবার অপেক্ষায় ছিল। পৌঁছাবার কয়েক ঘন্টার মধ্যে স্মসানের সব কাজ শেষ করে, ধরা চুরো পড়ে বাড়িতে ফিরেছিল নীলাদ্রী আর তার ভাইরা। আবারও একদফা কান্নার রোল উঠেছিল। সেও বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। স্কট আর অলিভা নীলাদ্রির কাছে এসে দুঃখ প্রকাশ করেছিল নিলাদ্রী আর রিনি শ্রাদ্ধ সেরে ফেরবার পরে। কারণ তাদের কাছে ঠাকুরদা মানুষটার অস্তিত্বের মূল্যই যে খুবই কম ছিল।সোদপূরের বাড়ীর লোকজনের সঙ্গে নাড়িরটান তো তাদের নেইই প্রায়।
রিনির মা এখন ভেন্টিলেশনে আছেন গতকাল থেকে সল্টলেকের বাইপাসের এক নামকরা বেসরকারি হাসপাতালে। রিনির ভাই বিশ্ব, প্রথমেই ওনাকে কামারহাটির সাগরদত্ত হাসপাতালে ভর্তি করেছিল তার সাধ্য আর অর্থনৈতিক ক্ষমতা অনুসারে । হঠাৎ করেই নাকি ব্রেইনের ভেতরে হামোরেজ হয় ওনার পরশু দিন সকাল সাড়েনয়টায়। তার আগে উনি ঘুম থেকে উঠে নিজের বিছানা নিজেই পরিস্কার করে, ওনার ঘরের মেঝে ঝার দিয়েই বাথরুমে স্নান করতে গেছিলেন । ওনার নিজের কাজ বরাবর উনি নিজেই করতেন ৭২ বছর বয়েসেও। বিশ্বের বউ অর্পিতার হাতে কখনো ছাড়েননি নিজের কাজ । বাথরুমেই নাকি ওনার স্ট্রোকটা হয়েছিলো। খবরটা বিশ্বই প্রথমে ওদের ফোন করে দেয় ওনাকে সরকারী হাসপাতালে ভর্তি করে। প্রায় রাতেই রিনিই তার নিজের বাড়িতে ( আগরপাড়ার শক্তিনগরে) বিশ্ব বা তার বউ অর্পিতাকে ফোনকরে খবর দেয়ানেওয়া করে। রিনি তার মায়ের সঙ্গেও কথা বলে।মাঝেমধ্যে নিলাদ্রীদের সোদপূরের বাড়িতেও ফোনে কথাবলে সে, সেখানকার হাঁড়ি আলাদা হওয়া, যৌথ পরিবারের ভেতরের পলিটিকসগুলো জানতে আর নিলাদ্রী যে এখনো তার রোজগারের থেকে কিছু পাউন্ড ( ২৫০ পাউন্ড)সোদপূরের বাড়িতে পাঠায় প্রতিমাসেই নিয়ম করে, তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশুনো করতে, রাজামশাই ও রানামশাইকে, রাজার বউয়ের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সেটাকেও বারবার তাদেরকে মনে করিয়ে দিতে। কিম্বা নিলাদ্রীকে তার বাবার মৃত্যুর পরও, তার ভাইদের পরিবারকে যে টানতে হয় , সেই নিয়ে খোঁচা মেরে কথা বলতে, ছেলেমেয়ের সামনে। নিলাদ্রী এক কানে এইসব মেয়েলী কথা শোনে আর অন্য কানে বেরও করে দেয় সেইসব। মনে রাখে না কিছুই। মনেও করে না। সেদিন রাতে কিন্তু আচমকাই বিশ্ব ফোন করেছিল। সাধারণত ,বিশ্ব কিন্ত নিজের থেকে ফোন খুব একটা করেনা। রিনি তখন কিচেনে ছিলো। প্রথমে রিনি এবং পরে নিলাদ্রীও ফোনটা ধরেছিল। ওদের কথামতই বিশ্ব বাইপাসের ধারের হাসপাতালে ভর্তি করে রিনির মাকে সরকারী হাসপাতাল থেকে রিস্কবন্ড দিয়ে বের করে নিয়ে এসে । নিলাদ্রী নিজেই চিকিৎসার সমস্ত খরচের ভার তুলে নিয়েছে পারমিতাদেবীর। বাইপাসের সেই হাসপাতালের নিউরোসার্জনের সাথেও কথা বলেছে ওরা। নিউরোসার্জন কিন্তু তেমন একটা ভরসা দেননি তাদের। ওনার মাথার সি টি স্ক্যান করা হয়েছে। এম আর আই এনজীও করেছে ওই হাসপাতাল। রিনির মায়ের টেম্পোরাল লোবের কাছে একটা সামান্য বড় ধরনের রক্তেরদলা নাকি জমাট বেঁধে আছে। অল্প অল্প জ্ঞান থাকলেও ভেন্টিলেশনে রেখেছে ওনাকে প্রথম থেকেই। কথা বলতে পারছেন না। এখনো নানা রকম ওষুধেই রাখা হয়েছে ওনাকে এনসিইউতে। আগামী কাল হয়তো বা অপারেশন করবেন নিউরোসার্জন। ব্রেনের মধ্যে রক্ত ক্ষরণ এর ৩৬ ঘণ্টার মধ্যেই অপারেশন করলে বাঁচবার চান্স নাকি বেড়ে যায়। নীলাদ্রির বাবার সময় রিনি কিন্ত অনেক করেছিল। রিনি তার মাকে শেষ দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল সেই রাতেই। হয়তো বা রিনির মা আর বাঁচবেন না। হয়তো বা অপারেশনের পরে বেচেঁ থাকলেও পরবর্তী বাকী জীবনটা প্যারালাইসিস অবস্থায় বিছানায় শয্যাশায়ী বা হুইল চেয়ারে কাটাবেন। আর বিশ্বের স্ত্রী অর্পিতা যে কি জিনিস দিয়ে তৈরি এবং সেটা ওনার পক্ষে কতটা সুখদায়ক হবে ভাবলেই নিলাদ্রী ভয় পায়।
নিলাদ্রী রিনির হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলে " তোমার মা ঠিক হয়ে যাবেন, আশা করছি অপেরেশন এর পরে "
রিনি ওর দিকে জলভরা চোখে তাকায় অস্ফুষ্টে বলে " কি জানি । আমার মন যে কু গাইছে। মা কিন্তু খুব কমই অসুস্থ হয়েছে এ যাবৎ! পুরো সংসারটা একার হাতেই সামলেছে বরাবর। কোনো রোগভোগ ছিলো না তার। না ডায়াবেটিস না প্রেসার! তবুও হলো! কেনো হোল! বাবার দায়িত্ব এখন কে সামলাবে? এতোদিন তো তবুও মা ছিল"
" হ্যা তা ৭২ বছর বয়েসও তো হলো ওনার সেটাও তো ভাবো!" নিলাদ্রী উত্তর দিলো। "ভেবো না! ঠিক হয়ে যাবেন উনি। অপারেশন এর পরে ক্রিটিক্যাল স্টেজটা কাটলে নাহয় ওনাকে লন্ডনের হাম্যারস্মিথ হাসপাতালে নিয়েগিয়ে ভর্তি করে দেবো। ভগবানের ওপরে ভরসা রাখো। " রিনির মায়ের স্বাস্থ্য যে কতো ভালো ছিলো সেটা যে নীলাদ্রীও ভালো জানে। নিলাদ্রী একবার হাতের ঘড়ি দেখে। এখনো চারঘণ্টার মত সময় লাগবে দমদম এয়ারপোর্ট পৌঁছতে। সমর মনে হয় আসবে তাদেরকে রিসিভ করতে দমদম বিমানবন্দরে। সমর বছর চারেক আগে একটা টাটা সুমো গাড়ি কিনেছে। নিজেই ও ড্রাইভ করে। ওরা বাগুইআটির সমরদের ওখানেই প্রথমে উঠবে । তারপর রিনির মায়ের অবস্থা বুঝে সোদপূরের বাড়িতে যাবে। সেই রকমই কথা হয়েছে । নিলাদ্রী সিটবেল্ট খুলে উঠতে চাইলে, রিনি চোখ মেলে একবার জিজ্ঞাসার চোখে তাকালো। নিলাদ্রী উত্তর দিলো " বাথরুম যাব" এই একটা বাজে সমস্যা নতুন করে হয়েছে নীলাদ্রির। বছর দুয়েক। বেশিক্ষণ বাথরুম সে চেপে রাখতেই পারেনা। নীলাদ্রির প্রোস্টেট গ্রন্থিটা বেশ কিছুটা বড় হয়েছে। ৫০ গ্রামের কাছাকাছি এখন।রিনি ও জানে সেটা। দুই রকমের ওষুধ খাচ্ছে সে এখন প্রোস্টেট বড় হবার জন্য । ওষুধ দুটো নাকি প্রোস্টেটের মিডিয়ন লবকে মূত্র থলি থেকে মুত্রপথের যাতায়াতে বাধা দূর করে এবং প্রোস্টেটের আয়তনও কমিয়ে আনে। তাই আপাতত অপারেশন না করলেও চলবে। মধ্য লন্ডনের এন. আই. এচ এর ক্লিনিকের ইউরো সার্জনের সেই মত। ইউ কে তে স্পেশালিস্ট এর কনসালটেশন আর কোনো অপারেশন এর তারিখ পেতে যে কত সময় আর কত বছর নেয় তা ইউ কে এর দেশগুলিতে যারা বসবাস করেন তারাই একমাত্র ভুক্তভোগী ও সেটা জানেন। আর প্রাইভেটে চিকিৎসার যা খরচ সেখানে, সাধারণ চাকরিজবীদের পক্ষে সেই খরচ ব্যয়করাও সম্ভপর নয়। তাই তো ভারতবর্ষের মেট্রোসিটি গুলোতে, কলকাতাতে, হেলথ টুরিসম ও বেড়ে উঠছে দিনেদিনে। কোলকাতার বাইপাশের ধারে নতুন নতুন বেশ কিছু ঝা চকচকে প্রাইভেটে হাসপাতালও গজিয়ে উঠেছে গত কুড়ি বছরে সরকারের মদতে, ব্যবসা করবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে। লন্ডনের প্রাইভেটে হাসপাতাল থেকে কিছুতো কম খরচে, তাড়াতাড়ি অপারেশন করিয়ে নেওয়া যায়। নিলাদ্রীর আজকাল ঘন্টায় ঘন্টায় বাথরুম পায়। রিনি নিলাদ্রীকে যাবার জন্য দুই পা গুটিয়ে বসলে নিলাদ্রী উঠে গেলো। এখনো ঘন্টা সাড়ে তিনেক লাগবে ল্যান্ড করতে ।
নিলাদ্রী বাথরুম থেকে ফিরে এসে নিজের আসনে সিটবেল্ট ঠিকমত বেধে, রিনির মত করেই নিজের মাথা আর ঘাড় ব্যাকসিট এ এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলো। হাত বাড়িয়ে পাশের ভিউ জানালাটাও বন্ধ করে দিল। মাথার ওপরে নব ঘুরিয়ে ফ্যানের স্পীড আর বাতাসের গতি বাড়িয়ে দিলো। রিনির মায়ের অবস্থা এখন কেমন কে জানে? মহিলা আদৌ বাঁচবেন কিনা সেটাও সন্দেহ আছে নীলাদ্রির। নীলাদ্রির আজকাল আর কোলকাতা বিশেষ আসাও হয় না। সেই পাঁচ ছয় বছর আগে তারা দুজনেই এসেছিল। দিন পনেরোর জন্য। তখনই সোদপূরের বাড়িটার যা অবস্থা ছিলো! এই পাঁচ ছয় বছরে যে আরো খারাপ হয়েছে সেটাও নিলাদ্রী আন্দাজ করতে পারে। নিলাদ্রীর বাবা গত হবার পরে বাড়ির ভাগ নিয়ে, ভাই ভাইতে , জায়ে জায়ে সম্পর্ক যে কোন তলানিতে পৌঁছেছে এখন, তাতে নীলাদ্রির বাড়িটাতে দমবন্ধই লাগে এখন। রিনিতো তাদের বাড়িতে থাকতেই চায় না বেশিদিন। যতই নীলাদ্রির বড়দা, ভাইরা আর ভাইয়ের বউরা তাদের এইসব সাংসারিক পলিটিকস আর কুচকচালি গুলোতে মিষ্টি ব্যবহারের প্রলেপ লাগিয়ে, হাসিমুখে তাদেরকে কুটুমের মত আতিথেয়তা আর যত্ন আত্তি করুক না কেনো বাড়ীটার যে হাভাতে শোচনীয় অবস্থা সেটা নিলাদ্রীর চোখ কিন্ত এড়ায় না। নিলাদ্রী আর রিনি কার কার জন্য কি কি উপহার আনল লন্ডন থেকে, ফিরে যাবার আগে নিলাদ্রী কোন ভাইকে বা কোন বউকে বা কোন ভাইপো ভাইঝিকে কতো পাউন্ড নগদ উপহার দিলো এবং সেটা সে কেনো দিলো, সেটা নিয়েও চলে আলোচনা, অভিমান, কুটকচলী বাড়ির বউদের আর ছেলে মেয়েগুলোর মধ্যে সেটাও নিলাদ্রী জানে। একমাত্র নিলাদ্রীর নিজের মায়ের পেটের দুই জমজ দুইভাই , রাজামশাই আর রানামশাই ( রিনি তাদের এই ভাষায় সম্ভোদন করতেই অভ্যস্ত লন্ডনের বাড়ীতে বসে স্কট আর অলিভার সামনেও এবং তারাও তাদের একই ভাবে সম্বোধন করে নিলাদ্রীর কাছে । ) এই নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না। ওদের নিয়েও বোধকরি সংসারে কেউ ভাবেও না। ২০১৭ সালে স্টার্টআপ বিজনেস করবার নামে রাজা আর তার অল্পশিক্ষিত বউ স্বপ্না ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া কোম্পানিগুলোর (এম আই এফ সি এবং এন বি এফ্ সি কোম্পানিগুলোর ) কাছে দুজনে বর্তমানে প্রায় ১০লাখ টাকা আর ১৪ লাখ টাকা ( দুজনে মিলে মোট ২৪ লাখ টাকার) ঋণের বিশাল ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছে, কভিড- ১৯ এর আগের সময় থেকেই অনেক সুদে লোন নিয়ে। তারা কিন্তু এখনও নিজেরাও জানেনা কিভাবে তারা তাদের এই ঋণ শোধ করবে। এর জন্য একমাত্র দায়ী রাজার ( স্কুল মাধ্যমিক পাশ করতে না পারা) বস্তিবাড়ি থেকে প্রেমকরে আনা বউ স্বপ্না। সত্যিকরেই নিলাদ্রীর ছোট ভাই রাজার সাথে বিয়েরআগে স্স্বপ্নাদের বাড়ীটা সোদপুরের পানিহাটি হাসপাতালের কাছে এক বস্তিতেই ছিলো। স্বপ্নার মা শান্তিদেবী বিধবা ছিলেন আর বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে আয়ার কাজ করতেন। তিন বোন স্বপ্নারা। বড় দিদি সবিতা, মেজো বন্দনা । স্বপ্না নাকি বন্ধন ব্যাংক মাইক্রোফাইন্যান্স, নিগম সুধা মাইক্রোফাইন্যান্স, প্রগতি মাইক্রোফাইন্যান্স আর চেন্নাইয়ের আশীর্বাদ মাইক্রোফাইন্যান্স দ্বারা পরিচালিত পাড়ায় মহিলাদের এক স্ব নির্ভর হওয়ার সব বিবাহিত এক মহিলা গোষ্ঠীর লিডার। আর সেটা সে ২০১৭ সাল থেকেই। রাজামশাইও তার অশিক্ষিত বউয়ের কথায় নেচে, সোদপুরের বাড়িতেই (২০১১ সালে তারই অনেক কষ্টে তৈরি করা ) ছোট একটা স্ট্রাটআপ entrepreneurship বিজনেসকে বড় করে তোলার আর নাকি রাতারাতি বড়োলোক হবার স্বপ্নে এবং বাড়ির এবং তার কারখানার কিছুটা অংশ মেরামত করবার জন্য, ও নতুন যন্ত্রপাতি কেনার জন্য লোন করেছিল (৫ লাখ টাকা ) বাড়ির সকলের অজ্ঞাতেই ২০১৭ সালে, সেটা নিলাদ্রী জানে। ইউনিভার্সিটিতে নিজের ঘরে বসেই নিলাদ্রী ২০১৯ এ প্রথম সেটা জানতে পারে, যেদিন তার মামাতো উকিল ভাই শ্রীজিত তাকে টেলিফোন করে এটা জানায় এবং রাজাকে সাবধান করতে বলে এইভাবে ঋণের জালে না ফাঁসতে স্বপ্নার পাল্লায় পড়ে। নিলাদ্রীও প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই রাজামশাইকে টেলিফোনে লোন করবার জন্য অনেকরকম গালাগাল দেবার পরে, ২০১৯ সালেই রাজামশাই বন্ধ করে দেয় তার বিজনেসের জন্য নতুন ভাবে লোন করা এবং লোনের গোটা পাঁচ/ ছয় কিস্তি দেবার পরে রাজামশাই বন্ধও করে দেয় তার লোনশোধ করার বাকি কিস্তিগুলো । কভিড- ১৯ এর জন্য সারা ভারতবর্ষ জুড়ে যখন বারে বারে সম্পূর্ন ভাবে বা আংশিক ভাবে লকডাউন এর ফলে সব দোকান বাজার বন্ধ থাকায় তার নতুন ব্যবসাও মার খেতে থাকে। অথচ কারখানায় আগের কেনা কাঁচামাল পরে থাকায় প্রোডাকশন হতে থাকে, গোটা চারেক লেবারকে মাইনে, পুজোর বোনাস দিতে হয় তাকে। দোকান বাজার বন্ধ থাকায় তৈরি করা মাল বিক্রি করতেও পারে না। বাড়িতেই জমতে থাকে ও নষ্ট হতে থাকে। ফলে রাজামশাই তার করা লোন এর কিস্তির টাকা শোধ করতেও অক্ষম হয়। এর জন্যই আজকে রাজামশাই এর লোনের পরিমাণ দাড়িয়েছে ১০ লাখ। কোর্টের সমন আসে বাড়িতে । কোর্টেও হাজির হতে হয় তাকে। উকিলের টাকাদেবার ক্ষমতাও নেই।
কিন্ত রাজার অশিক্ষিত বউয়ের গত দুই বছরে ১৪ লাখ টাকার লোনের পেছনে সত্যিকারের ইতিহাস যে কি, স্বপ্না কিন্ত কখনোই খোলসা করে বলছে না এই বাড়ির কাউকেই । তাকে সত্যিটা বলবার জন্য যথেষ্ট চাপ দেবার সত্বেও । বিশেষ করে গত ছয়মাসে ৫ লাখ টাকার লোন কেনো সে করেছে কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে এবং টাকাটা সে কোথায় ব্যয় করেছে। নিলাদ্রী এবং বাড়ীর প্রায় সকলেই কিন্ত একশ ভাগই নিশ্চিত, যে সেই টাকাটা সে তার ৮৫ বছরের কাজ করতে অক্ষম বিধবা মা শান্তিদেবী , তার এক সদ্য বিধবা হওয়া বড়বোন সবিতা ( ,২০২১ কভিড এ মারা যায় তার জামাই বাবু) আর তার মেজদিদি বন্দনার আগরপড়াতে বস্তিবাড়ির থাকা প্রচণ্ড অভাবের সংসারের খাই মেটাবার জন্যই করা, সবাইকে লুকিয়ে চুরিয়ে। বাড়িতে স্বপ্নার লোনের কিস্তির টাকা দেবার জন্য মাইক্রোফাইন্যান্স কোম্পানীর এন. বি. এফ্. সি কোম্পানির এবং প্রাইভেটে লোন এর লোকগুলো প্রায়ই আসে, হুমকি দেয় রাজামশাই আর তার কুড়ি বছরের মেয়েকে। স্বপ্নাকেও তাই বাধ্য হয়েই এখন অন্যের বাড়িতে তার মায়ের মতই দুবেলা আয়ার কাজ করতে হয়। এই ছাড়াও স্বপ্না, নিলাদ্রী (তার ছোট জমজ দুই ভাই আর ভাইজির কলেজে পড়াশুনোর জন্য) যে টাকা এতদিন ধরে স্বপ্নার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠাতো, ২০১৭ সাল থকেই, প্রতিমাসে সেখান থেকে একসাথে ১০০০০/ টাকা স্বপ্না কাউকে না জানিয়ে, গোপনে চুরি করে, হয় তার নিজের করা লোনের কিস্তি শোধ করেছে বা তার দুই দিদিদের পরিবার ও বৃধ্যা অক্ষম মায়ের দেখভাল করার জন্য খরচ করেছে। দ্বিতীয়টাই বেশী হওয়ায় স্বাভাবিক। এই ভাবে সে নীলাদ্রিদের বাড়ীটার যতটুক মানসম্মান বেচেঁ ছিলো সেটাও পাড়াতে ধূলিসাৎ করে দেয়। এবং পাড়াটাকে বন্ধন বা আশীর্বাদ মাইক্রোফাইন্যান্স এর কাছে এক ঋণগ্রস্ত পাড়াতে পরিণত করে তোলে। অথচ তার ভেতরে কিন্তু নীলাদ্রির এতোগুলো টাকা নষ্ট করবার জন্য বাড়ীটার সুনাম নষ্ট করবার জন্য সামান্যতম অনুতাপ, বা কষ্ট নেই। বরঞ্চ আছে তার অসুখ নিয়ে নানা রকম নাটক করবার প্রবণতা, আছে নাকি তার বুকভর্তি অভিমান এই বাড়ির প্রায় সকলের প্রতি, কেনোই বা তার কাজকে এই বাড়িতে সাপোর্ট করেছে না কেউ। কেনো সবাই তাকে এই লোন করার জন্য দোষারূপ করছে। সেতো নিলাদ্রীর পাঠানো টাকায় বা তারই করা লোনের টাকায় তারই ৮৫ বছরের বৃধ্যা মাকে আর তার সদ্য বিধবা হওয়া বড়দিদি আর গরীব বস্তিবাসি মেজোদিদিদের সাহায্য করেছিল বড় জামাইবাবুর মৃত্যুর পরে আর লকডাউন এর সময়। না হয় তার মেজোদিদি একটা ছোট ইট বালি সিমেন্টের পাকা বাড়িই তুলে নিয়েছে ,লন্ডন থেকে নিলাদ্রীর পাঠানো টাকায় তার ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে। হোক না সেটা চুরি করেই বা হোক না সেটা লোন করে। তাই নিলাদ্রীর বাড়িতে স্বপ্না রাজামশাইকে ঘিরে ফ্যামিলি পলিটিক্স এখন তুঙ্গে।
সব কিছু ভাবনা চিন্তা করেই রিনিই ঠিক করেছে এবারে প্রথমে তারা সমরের ফ্ল্যাটে উঠবে তারপরে রিনির মায়ের অপারেশনের পরে শারীরিক অবস্থা গতিবুঝে সোদপুরের বাড়িতে যাবে দিন দুয়েকের জন্য। আর এবার তাড়াহুড়ো করে আসবার জন্য নিলাদ্রীর বাড়ি বা বিশ্বদের বাড়ির জন্য কোনো গিফট আনাও হয়নি । সময়ই পায় নি তার।
নিলাদ্রীরও তন্দ্রার মত এসেছে। এই চার ঘণ্টা একভাবে বসে থাকা যে কি বিরক্তিকর সেটা প্রতিবার যখন কোলকাতা আসে নিলাদ্রী টের পায়।
নিলাদ্রীর কাছে কিন্তু রিনির মা, পারমিতাদেবী কেবলই তার শ্বাশুড়িমা ছিলেননা ,তার চেয়েও যে বেশী কিছু, সেটা এই ত্রীভুবনের আর কেউই না জানলেও নিলাদ্রী, পারমিতাদেবী আর পারমিতারই এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী বিভাদেবী জানেন। বিভা মাসিমা তখন তো ভাটপাড়া হাসপাতালের স্টাফনার্স ছিলেন। সন্তানহীনা ও ডিভোর্সি মহিলা ছিলেন উনি। পারমিতাদেবীর স্কুলের বান্ধবী এই বিভাদেবী । পারমিতাই নিলাদ্রীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন বিভার সাথে সেদিন বিকেলে একটা রেস্তোরাঁতে। নিলাদ্রী তার কয়েকদিন আগেই কোলকাতার কলেজস্ট্রিট প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে বি এস সি তে , কোলকাতা ইউনিভার্সিটিতে, পদার্থ বিদ্যায়, প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছে সেই খবর পেয়ে তাকে কিছু উপহারও দিয়েছিলেন সেদিন পারমিতা। পারমিতাদেবীর সাথে নিলাদ্রীও এরপরে বারকয়েক বিভাদেবীর শ্যামনগরের ছোট দুই কামরার সরকারী ফ্ল্যাটে গেছিলো। পারমিতাকে ফ্ল্যাটের চাবি দিয়েই দিতেন। বিভাও বিশ্বাস করতেন যে খুব পারমিতাকে। রিনিকে নিলাদ্রী বিয়ে করেছিল ১৯৯৬ সালে । পারমিতাকে নিলাদ্রী কথা দিয়েছিল একসময় বলেই। রিনিও তখন কলেজের অন্য একজনের সঙ্গে প্রেম করত। নিলাদ্রীকে তাকে বিয়ে করতে হবে জানতে পেরে কম অশান্তি করেনি রিনি তার মা, বাবা, বোনের আর নিকট আত্মীয়দের সঙ্গে। কিন্ত পারমিতাদেবীর ব্যাক্তিত্বের কাছে রিনিকে একসময় বশ্যতাও স্বীকার করতে হয়েছিল এবং বিয়ের পিঁড়িতেও বসতে হয়েছিল তার মায়ের কথা মেনেই নিলাদ্রীর সাথে। অসম্ভব ব্যাক্তিত্বপূর্ণ মহিলা ছিলেন একসময় রিনির মা পারমিতা। বিয়ের পর, অনেকগুলো বছর রিনি কিন্তু নিলাদ্রীর সোদপুরের বাড়ির লোকজনকে নিজের লোক বলেই ভাবতেই পারতো না, এমন কি উইম্বাল পার্কের ফ্ল্যাটে বসেও না । এই নিয়ে নিলাদ্রী অবশ্য কখনো কিছুই মনে করেনি। রিনির জন্য যে এটাই স্বাভাবিক ছিল। প্রথমেই অবশ্য নিলাদ্রীরা উইমবল পার্কের ফ্ল্যাটে থাকতো না । থাকত বাক্সলেতে একটা ঘিঞ্চি রাস্তার ওপরে ঘর ভাড়া করেই । সেখানেই রিনিকে বিয়ে করে নিয়ে উঠেছিল নিলাদ্রী। তাদের সংসার পেতেছিল। বাক্সলেতে বার তিনেক বাড়ীও চেঞ্জ করেছ ওরা। আসলে তখনতো নিলাদ্রীর মাইনেও কম ছিল বিরব্রেক ইউনিভার্সিটিতে।সোদপুরের বাড়িতেও তাকে বাবার অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে হতো। সেটা রিনি কিন্তু একদমই সহ্য করতেই পারতো না। এই নিয়েও অনেক অশান্তি হয়েছে তাদের মধ্যে। পারমিতাদেবী কিন্ত নিলাদ্রীর সোদপুরের বাড়িতে টাকা পাঠানোটাকে সাপোর্ট করতো। নীলাদ্রির পক্ষেই থাকতেন। বড় মেয়েকে বোঝাতেন টেলিফোনে। এরপরে স্কট আর তার তিন বছর পরে আলিভা পৃথিবীর আলো দেখে। স্কটের জন্ম কলকাতার নার্সিং হোম এ। নিলাদ্রী কিন্তু রিনির প্রাক্তন প্রেমিককে নিয়ে কোনোদিনও একটা কথাও বলেনি রিনির সাথে । রিনি বলতে চাইলেও না। তার মধ্যে সেই ব্যক্তিকে নিয়ে আগ্রহ ও ছিলো না কিছুই জানবার। নিলাদ্রীতো জানতো, সে পারমিতাদেবীর তাকে করা একটা অনুরোধ বা আদেশ পালন করেছে আর রিনির প্রতি তার স্বামী হিসাবে তার দায়িত্বও পালন করেছে তার সাধ্য অনুসারে। রিনির মা সেটা বুঝতেন বলেই, রিনি যাতে নিলাদ্রী থেকে কোনদিনও স্ত্রী হিসেবে অবহেলা না পায়, কষ্ট না পায়,সেটা প্রায়ই অনুরোধ করতেন যখন উনি আর নিলাদ্রী শক্তিনগেরের বাড়িতে একটা ঘরে নিভৃতে কিছু কথা বলবার সুযোগ পেতেন । এক অদ্ভূত ব্যাক্তিত্বের অধিকারিণী ছিলেন রিনির মা পারমিতা দেবী। অথচ নিলাদ্রীর ওনাকে নিয়ে করা জেদ বা পাগলামীগুলো মেনেও নিতেন কোনো কোনো সময়ে। আসলে বিয়েরপর থেকেই যে উনি স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রী হিসাবে তেমনভাবে শ্রধ্যা, মর্যাদা, আদর, বিশ্বাস, ভালোবাসা, সুখ এগুলো থেকে প্রায় একরকম বঞ্চিতই ছিলেন। প্রেমের স্বাদও পাননি কখনও।
নিলাদ্রী কিন্তু এখনো জানেনা, রিনি তার প্রাক্তন প্রেমিকের সঙ্গে আদৌ এখনো যোগাযোগ রাখে কিনা। অবশ্য দরকার ও বোধ করে না নিলাদ্রী।
রিনি তার তৈরী নিজস্ব একটা জগতে বাস করে আর নিলাদ্রী ও তার নিজের জগতে। এতেই তো অভ্যস্ত ওরা। কেউ কারো জগতে ভুলেও উকি মারতেও যায় না। এই ভাবেই দাম্পত্য জীবনে তারা অভ্যস্ত হয়ে গেছে তাদের ২৭ বছরে বিবাহিত জীবনে। তাই তারাও সুখী দম্পতি মধ্য লন্ডনের উইমবল পার্কের ফ্লাটে। দুই ছেলমেয়ে নিয়ে সুখী পরিবার। বড় ছেলে স্কটতো সদ্য ডাক্তারি পাশ করে এখন ইন্টার্ন। দেখলে আর কথাবার্তাতে মনেই হবেনা স্কটের আসল শেকড় যে সোদপুরের এই প্রায় ভেঙেপড়া বাড়িতে, এক দরিদ্র যৌথ পরিবারে। আর মেয়ে অলিভা তাদের ইউনিভার্সিটিতেই ইকোনমিকস নিয়ে পড়ছে। ভারতবর্ষকে নিয়ে, কোলকাতাকে নিয়ে ,সোদপুরের বা শক্তিনগরের বাড়ি নিয়ে তাদের মাথাব্যাথা বিন্দুমাত্র নেই। সেখানে কি ভাবে যে লোকজন প্রবল দারিদ্র্যতার মধ্যেও জীবিকা নির্বাহ করে,সেখানকার পলিটিক্স নিয়ে, ইকোনমিকস নিয়ে কোনো বিষয়েই জানবার আগ্রহই নেই তাদের মধ্যে। আগ্রহ নেই তাদের কাকা, জ্যাঠা কাকী, জ্যাঠি, মামী ,খুড়তুতো , মামাতো ভাইবোনদের নিয়েও। নামগুলো সকলের ঠিকঠাকমতো বলতে পারবে কিনা তারা সন্দেহ হয় মাঝেমধ্যে। তবে রাজামশাই আর রানামশায় এই দুটো নাম বোধ করি ওদের কন্টোস্থ হয়েগেছে রিনির দৌলতেই, যদিও মুখোমুখী হলে কেউই কাউকে চিনতে পারবে না, সে ব্যাপারে নিলাদ্রী ৯০ ভাগ নিশ্চিত। ওরা শুধু এইটুকুই জানে তাদের বাবা একসময় কলেজস্ট্রিটের প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএসসি তে ফিজিক্স হনোর্স নিয়ে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিল কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে আর এরপরে যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স এও প্রথম স্থান অধিকার করেছিল কোনো এক বছরে। Doctorate ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সে। কিন্তু কোথায় বা কলেজ স্ট্রিট বা কোথায় প্রেসিডেন্সি কলেজ বা কলকাতা ইউনিভার্সিটি বা যাদবপুর ইউনিভার্সিটি সে সব জানাবার ইচ্ছেও নেই। শিকড়ের টানটা রিনিই রাখতেই দেয়নি তাদের দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে। এই নিয়ে নিলাদ্রীর মধ্যে অবশ্য কোনো ক্ষোভ নেই। কেননা স্কট বা অলিভা কখনোই সোদপুরের বা শক্তিনগরের কোনো বাড়িতেই এসে থাকবে না, যদিও সোদপুরের বাড়িতে নীলাদ্রির জন্য একটা সাজানো বড় ঘর (এটাচড বাথ ও এ সি লাগানো )তালাবন্ধ করে রাখা রয়েছে। বাড়িতে গেলে সেই ঘরেই নিলাদ্রী আর রিনি ওঠে। এটার দখলদারি নিয়েও বাড়ীতে নানা রকম পলিটিক্স হয় সেটা তারা দুজনেই সেটা জানে।
অধ্যায় দুই
একটা মৃত্যু এবং পশ্চিমবঙ্গের প্রাইভেট স্বাস্থ্য ব্যবস্থা।
সমরের বাগুইআটির কিছুটা ভেতরে, তিনতলায় তাদের, দুই বেডরুম বিশিষ্ট ফ্ল্যাটের একটাতে সমর আর মিমি ওদের জন্য আগের থেকেই সাধ্যমত তৈরি করে রেখেছিল, যাতে নিলাদ্রীদের এখানে উঠে কোনোভাবেই অসুবিধে না হয়। এই প্রথম তারা সমরের ফ্লাটে থাকবে বেশ কিছুদিন অতিথি হিসাবে। মিমি আর সমর দুজনেই তাদের দমদম বিমান বন্দরে তুলতে আসার আগে, তারা দুজনেই একবার হাসপাতাল থেকে ঘুরেই এসেছে। হাসপতালের ভিজিটিং নিউরোসার্জন এর সাথে টেলিফোন করে কথাও বলেছে ওরা। উনি নাকি তখন ও পি ডি তে রোগী দেখতে ব্যস্ত ছিলেন। পারমিতার শারীরিক অবস্থা নাকি একইরকম ভাবে এখনও ( নিউরো আই সি ইউ র জুনিওর রেসিডেন্ট ডাক্তারদের বক্তব্য ) স্থিতিশীলই আছে। বড় ডাক্তারও নাকি সকালেই রাউন্ড দিয়ে গেছেন । যার অধীনে পারমিতা বর্তমানে ভর্তি আছেন এই বেসরকারি হাসপাতালে । আগামীকাল সকালে নিউরোসার্জন হয়তোবা অপারেশনটা করলেও করতে পারেন ব্রেনে জমাট বাঁধা রক্তেরদলাটা বেরকরে দিতে। একটু যদির খিচ আছে। যদি অবশ্যি সবকিছুই ঠিক থাকে তবেই হবে অপারেশনটা। পারমিতা গতকাল বিকেলেও যেমন ঘোলাটে চোখ মেলে কাউকে কাউকে তার বেডের কাছে খোঁজার চেষ্টা করছিলেন, আজকে ভোর থেকে নাকি দুই চোখই আর একদমই খুলছেন না। গভীর ভাবে অরবিটাল প্রেসার দিলে উ উ শব্দ করবার বৃথা চেষ্টা করছেন দাতমুখ বেকিয়ে। কিন্তু ওর মুখ দিয়ে কোন শব্দই বেরহচ্ছে না। হবার কথাও নয়। ডান দিকটাও পড়ে গেছে একদম। এটাই শুধু গতকাল সকাল থেকে আজকে সকালের ওনার অবস্থার পার্থক্য। এছাড়াও আজকে ব্রেইনস্টেম ও সেরিব্রাল কর্টিকাল লেভেলে বেসাল ইলেকট্রোইভক পোটেনশিয়াল ( BEP) , electroencephalogram, আবারও নতুন করে ব্রেইনের সিটি স্ক্যান, এম আর আই, বুকের x ray ,হার্টএর আবারও ইসিজি, যাবতীয় বায়োকেমিক্যাল প্যারামিটার সবই টেস্ট করানো হয়েছে ,হচ্ছে, ও হবে । সবই নাকি এখনও পর্যন্ত মোটামুটি ডাক্তারদের কন্ট্রোলের মধ্যেই আছে। এটা জুনিওর এক রেসিডেন্ট ডাক্তারের কথা । ওই রেসিডেন্ট ডাক্তারদের একটাই আওড়ানোবুলি " ৭২ ঘণ্টার আগে কিছুই বলা যাবে না! ওনার অবস্থা এখনও বেশ ক্রিটিক্যাল" । অথচ অবস্থা কেনো ক্রিটিক্যাল, কখনকার থেকেই বা ক্রিটিক্যাল, কোন কোন বেসিক প্যারামিটারটারের ওপরে ভিত্তি করে রোগীর অবস্থা ক্রিটিক্যাল বলা হচ্ছে , ক্রিটিকাল অবস্থা সামলানোর কী ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে, সেটা কিন্তু কেউই এখানে বলে না পার্টিকে বা জবাবও দেয় না ।" প্রায় সকলের ক্ষেত্রেই একইরকম একটা তোতা পাখির মত শেখানো একটা বুলি উগরে দেয় তারা চোখে মুখে সিরিয়াস আর সবজান্তার ভাব নিয়ে। রোগীর কাছেও সকাল ১১টার পরে আর সন্ধ্যার ৫ টায় ভিজিটিং সময়ে একজন ছাড়া আর কাউকেই আই সি ইউ র ভেতরে যেতে দেওয়া হয় না রোগীর কাছে কয়েক মিনিটের জন্য, তাও প্রপার ভাবে ড্রেস করেই ঢুকতে হবে। রোগির গলা থেকে পা পর্যন্ত সাদা বেড কভারে ঢাকা থাকে একটু মুমূর্ষ রোগী হলে। কী কী ইনভেস্টিগেশন বা কী কী ধরনের ইন্টারভেনশন বা কী কী ওষুধ রোগীকে দেওয়া হবে বা দেওয়া হচ্ছে বা কেনোই দেওয়া হবে তার ব্যাখ্যা বা রোগীর অবস্থার কোনো আপডেটও অপেক্ষারত পার্টিকে দেওয়া হয় না"! কোনো চিকিৎসায় বা কোনো পরীক্ষা করার দরকার হলে তার জন্য রোগীর বা তার আত্মী়স্বজনের কাছ থেকে লিখিত ভাবে জানানো বা কোনো অনুমতিও নেওয়া হয় না। পারমিতাকেও ভেন্টিলেশনে দেবার আগে বিশ্বের কাছে একবারও অনুমতি নেয় নি হাস্পাতাল ,যে বিশ্ব তার মাকে ভেন্টিলেশনে দিতে আদৌ ইচ্ছুক কিনা বা তার আই সি ইউর বিল মেটাবার ক্ষমতা আছে কিনা । ভর্তির সাথে সাথেই ভেন্টিলেশনে ঢুকিয়ে দিয়ে তবেই এরা বিশ্বকে জানিয়েছে, যে পারমিতা নিউরো আই সি ইউর ভেন্টিলেশনে। অথচ সরকারী সাগরদত্ত হাসপতালে সকাল সাড়ে দশটা থেকে অ্যাম্বুলেন্স করে নিয়ে আসা এই হাসপতালের ইমার্জেন্সীতে বেলা তিনটে পর্যন্ত কিন্তু ভেন্টিলেশন ছাড়াই ছিলো পারমিতা। মাঝে মধ্যে অবশ্য তার খুব বমির ভাব হচ্ছিলো। বমি কিন্ত হচ্চিল না। শরীরের ডান দিকটা অসাড় হয়ে পড়ে গেছিলো। এখানে রোগীর বেডহেডড টিকেট দেখানো হয় না, দেখানো হয় না ভিজিটিং ডাক্তারের লিখিত নোট সেখানে। রোগীর আপডেটও থাকে না বেড হেড টিকিট। ওষুধের বা ইনজেকশন বা ড্রেসিং মেটেরিয়াল, স্যালাইন বা ডেক্সট্রোজ বা ringer lactate বা কোনও ইমপ্ল্যান্ট এর স্লিপ রোগির কাছের অ্যাটেনডেন্টকে দিয়ে অপেক্ষমান পার্টিকে ধরিয়ে, এই হাসপতালেরই নিচের ফার্মেসি থেকেই সেগুলো কিনে আনতে বলা হয়, প্রয়োজনের অতিরিক্ত পরিমান। ঘুরপথে ফেরৎ যায় আবার সেই উদবৃত্ত ওষুধগুলো সেই ফার্মেসীতেই রোগির ডিসচার্জ বা মৃত্যুর পরে । কিন্তু রোগীর বিলে তাদের দাম যুক্ত হয়ে যায়। বড় ডাক্তারের সাথে সেখানেই দুই মিনিট কথা বলা মানে যেনো কোনও ভগবানের সাথে কথা বলা। দেখাই পাওয়া যায় না তাদের রাউন্ডের সময়টুকু ছাড়া। প্যাথলজিক্যাল , মাইক্রোবায়োলজি, বায়োকেমিস্ট্রি রাদিওলজি ইনভেস্টিগেশন একমাত্র তাদের ল্যাব থেকেই টেস্ট করলেই সেই রিপোর্ট নাকি গ্রহণযোগ্য হয় এবং চিকিৎসার জন্য সঠিক রিপোর্ট ধরা হয়। অন্য ল্যাব থেকে রিপোর্ট করে আনলে সেটা গ্রাহ্য করা হয় না। আদৌ ঠিকঠাকমতো চিকিৎসা হচ্ছে কিনা এই হাসপাতালগুলোতে কে বলবে সেখানে? শুধু সমর যেহেতু খোদ নবান্নতেই চাকরী করে, সে জেনেছে এক অনডিউটি জুনিয়র রেসিডেন্ট ডাক্তারের কাছ থেকে যে পারমিতার রক্তের চাপ কমানোর দামী ওষুধ, নাকের টিউব দিয়ে গ্লিসারিন, হরলিক্স খাবার , ইন্ত্রাভেনাস ম্যানিটোল, lorazepam , ringer lactate, PEP, হার্টের এর মনিটরিং সবই চলছে এই নিউরো আই সি ইউ তে। সাথে বিদেশ থেকে অনানো দামী কিছু ওষুধ । কিন্তু কিযে সেই ওষুধ( মনে হয় rTPA) , কখনই বা আনা হলো, আর কেনোই বা সেটা দেওয়া হচ্ছে সেটাও বলবার কেউই নেই। বড় ডাক্তারবাবু নাকি নির্দেশ দিয়ে গেছেন । পারমিতার তাই পোর্টেবল ইকোকারডিওগ্রফি , বুকের x Ray, প্রায় প্রতি দিনে, প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় রক্তের গ্লুকোজ, ইউরিয়া , ক্রিয়টিনিন, EGFR, ACR, লিপিড প্রোফাইল , প্রো থ্রোম্বিন টাইম fibrinogen level, আই এন আর, সি আর পি, প্রো ক্যালসিটোনিন, ইলেক্ট্রোলাইটস লেভেল, সোডিয়াম, পটশিয়াম, ক্যালসি়াইয়াম, ক্লোরাইড, ফেরেটিন লেভেলে, কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস , অক্সিজেন গ্যাস লেভেল , রক্তের পি এইচ, বাইকার্বনেট লেভেল, হাইড্রোজেন লেভেল সবই মাপাও হচ্ছে। ক্যাথেটার দিয়ে আসা পেচ্ছাব ও পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে ইনফেকশন কিছু হয়েছে কিনা জানতে । প্রতিদিনে, ঘন্টায় ঘণ্টায় বুঝি এইসব বায়োকেমিক্যাল প্যারামিটার শরীরে মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে যায় ? গত পরশুদিন বিকেলথেকে গতকাল রাত পর্যন্ত এই হাসপতালের বিল উঠে নাকি দাড়িয়েছে আড়াই লাখ টাকা। নিউরোসারজারি করতে নাকি ১০ লাখ টাকা আগেই জমা করতেই হবে কালকে সকালের মধ্যে । তবেই হবে অপারেশন। অপারেশন এর পরে আরো কত লাগবে সেটা হাসপাতাল থেকে বলেনি এখনও। সমর বা বিশ্ব কারুর পক্ষেই সম্ভব নয় এতোগুলো টাকা একবারে দেওয়া। কোনও মধ্যবিত্তের পক্ষেই সেটা সম্ভব নয়। তাই সবাই এখানে নিলাদ্রী আর রিনির জন্য অপেক্ষায় ছিলো। যখন তাদের নির্দেশে বিশ্ব পারমিতকে এই বেসরকারী হাসপতালে এনেছে। ওরা পৌঁছতে, সমর মিমি দুজনেই হাফ ছেড়ে যেনো বেচেঁছে । বিশ্ব বিকেলে যাবে হাসপতালে। কাল সারা রাত হাসপতালে কাটিয়েছে সে পার্টি ওয়েটিং রুমে। হাসপতালেই দেখা হবে সবার সাথে।
রিনি আর মিমির দুজনের কারুর মনই ভালো নেই। সেটাইতো স্বাভাবিক। রিনিতো ঘরে প্রবেশ করার পরে নিশব্দে ফুফিয়ে ফুফিয়ে বেশ কিছুক্ষন ধরে কেদেই চলেছে। মিমি ও তাই। দুই বোন মিলে জলভরা চোখে মিমির ফ্লাটে তাদের মায়ের সাথে পুরনো অ্যালবাম খুলে তাদের নানা রকম স্মৃতি নিয়ে নানা রকম কথাবার্তাও বলছে মিমির ঘরে বিছানায় শুয়ে। মিমির চেহারা অনেকটা তাদের মায়ের মতো হচ্ছে দিন দিন । নীলাদ্রিও ততক্ষণে বাথরুম থেকে প্রাতকৃত আর স্নানটা সেরে নেয়। সুটকেস থেকে বেরকরে পায়জামা, গেঞ্জী, তার ওপরে পাঞ্জাবি পরে ফ্রেশ হয়ে সোফাতে বসে সোদপুরের বাড়িতে টেলিফোন করলো। নীলাদ্রির বড়দাই ফোন ধরতে নিলাদ্রী প্রথমে তাদের ঠিকঠাকমতো পৌঁছ সংবাদটা দিলো। সমর্ আর মিমি যে তাদের রিসিভ করতে বিমান বন্দরে গেছিলো সেটাও বললো। নীলাদ্রির বড়দার বয়সও ৬৩ হলো। ডায়াবেটিক আর প্রেশার এর রোগী উনি। রোজ সরকারী হাসপতালের ফ্রিতে পাওয়া ইনসুলিন নেন দুই বেলা করে । বড়দা রিনির মা কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতে, নীলাদ্রি যতটুক গাড়িতে আসতে আসতে শুনেছিল সেটাই বললো। এরপরে রাজামশাই এর লোনশোধ, রাজার বউয়ের লোনশোধ নিয়েও কিছুক্ষণ কথা হলো বড়দার সাথে। স্বপ্নার রক্তের সুগার নাকি ফাস্টিং লেভেল অনেক বেশি। ৩০০ এর মত বড়দা জানালো। ঠিকঠাকমতো সে হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তারও দেখায় না , ডায়াবেটিসের ওষুধও খায়না রেগুলার, গত ৭ মাস ধরে, ইচ্ছাকৃত ভাবে, বারেবারে সবাই বলা সত্ত্বেও । নিজের করা লোন শোধ করতে নাকি এখন সে দুবেলা দুই বাড়িতে তার মায়ের পুরনো পেশা, আয়ার কাজ করে, তাই হাসপতালে নিজেকে দেখাতে যাবার তার সময়ও নেই। এটাই হল নাকি তার দিক থেকে অজুহাত। নীলাদ্রিরা এবারে আদৌ সোদপুরের বাড়িতে আসতে পারবে কিনা সেটাও জিজ্ঞেস করলেন উনি। নিলাদ্রী বললো পরিস্থিতি বুঝে তবেই তারা যাবে। নিলাদ্রীর ইচ্ছে ছিলো তার দুই জমজভাই রাজামশাই আর রানামশাইয়ের সাথেও কিছু কথা বলার। তারা এখন বাড়ির বাইরে। যে যার নিজের নিজের কাজে গেছে। রাজাতো এখন ডেইলি লেবার হিসাবে সোদপুরে পাড়ার লোকের বাড়িতে ওয়েল্ডিং / গ্রিল এর কাজ করে। কলকাতা ইউনিভার্সিটির হিনোরস কমার্স গ্রাজুয়েট এখন ডেইলি লেবার। অদৃষ্ট কাকে বলে! ওর ব্যবসাপত্র সবই বন্ধ হয়ে গেছে। বাড়িতে সাধের কারখানাও বন্ধ। কারখানার ইলেকট্রিক লাইন কেটে দিয়েছে। অনেক যন্ত্রপাতিও সে বেঁচে দিয়েছে তার বৌয়ের লোন কিছুটা শোধ করতে। দিনে তার এখন ২০০ থেকে ৪০০ টাকার মত রোজগার রোদে তাপে পুড়ে। তাও বা যদি মাসের রোজদিন কাজ পায় সে। দিন আনে দিন খায় অবস্থা ওদের। ছোট এক ব্যাবসায়ী থেকে বর্তমানে সে ভিকারি, মাইক্রোফাইন্যান্স/ এন. বি. এফ্. সি কোম্পানিগুলোর ঋণের জালের খপ্পরে পড়ে, এবং নিজের প্রেমকরা ,বস্তিবাড়ি থেকে উঠে আসা ,অল্পশিক্ষিত, বউএর কথায় নেচে, ২০১৭ সাল থেকে। অথচ এই ঋণ করবার কিন্তু বিন্দুমাত্র প্রয়োজনই ছিলো না তার। স্বপ্নার ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে ,নীলাদ্রির পাঠানো প্রতি মাসের ২৩,০০০ টাকায় রানামসাই এর কন্ট্রিবিউশন আর তার পুরানো ব্যাবসা থেকে আয়ের টাকায় তাদের চার জনের সংসার কিন্তু ভালোভাবেই চলে যেত। যদি না স্বপ্না ২০১৭ সাল থেকেই নিলাদ্রীর পাঠানো টাকা থেকে, সবার অজ্ঞাতে চুরি করে নিয়ে , তার ৮৫ বছরের অক্ষম মা আর বড় ও মেজো দিদিদের সংসারে প্রতি মাসে ১০,০০০ টাকা করে দিত। কিংবা স্বপ্নার নিজের করা মাইক্রোফাইন্যান্স লোনের কিস্তির টাকা মেটাতো। এর পরেও নাকি স্বপ্নার আশা,সোদপুরের বাড়িতে তাকে সকলেই বাড়ির ছোট বউ / ছোট কাকী/ ছোট মামী/ ছোট ভাইয়ের বউ হিসেবেই আগেরমতই আদর, শ্রদ্ধা ও সম্মান দেবে। আগের মতোই খাতিরও করবে তাকে। কেউই দোষারূপ করবে না। নীলাদ্রির সোদপুরের সংসারে পাঠানো টাকায় , বড়দা তার ১৪ লাখ টাকার লোনের কিস্তিও শোধ করবে। মামার বাড়ির আবদার তার! তবুও যদি সে বাড়ির কারুর জন্য বা ক্রমশ ভেঙেপড়া বাড়িটাকে মেরামত করবার জন্য বা নিজের স্বামী রাজার করা লোনের বাকি কিস্তির টাকা মেটাতে এই লোন করত বা বাড়ীর কাউকে জানিয়ে, সম্মতি নিয়ে, লোনগুলো করতো বা বাড়ির বয়স্ক কারুর অনুমতি নিয়ে মাইক্রোফাইন্যান্স কোম্পানী লিঃ ললিপপগুলোর বিবাহিতা মহিলাদের গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত হতো এবং তার লিডার হতো। সেতো লোন করেছে কেবলই তার মা আর দিদিদের ওয়েলফেয়ার এর জন্য, যাদের সাথে নীলাদ্রির কিন্তু বিন্দুমাত্র পরিচয়টুকুও নেই। তবুও বড়দা, নিলাদ্রীর পাঠানো টাকা থেকেই স্বপ্নার করা পাড়াতে খুচরো লোন প্রায় ১,১০,০০০ টাকা শোধ করেছে ,এই শর্তে, যে স্বপ্না দুবেলা চাকরী করে ,প্রতি মাসে তার নিজের সংসারেই ৭০০০ টাকা করে দেবে। রাজামশাই ও দেবে ৭৫০০ টাকা আর রানা দেবে ৪০০০ টাকা চার জনের সংসারে। সেটাও স্বপ্না ঠিক মত না দেওয়াতে নিলাদ্রী বড়দাকে বলে দিয়েছে কঠিন ভাবেই, যে তার পাঠানো টাকা থেকে স্বপ্নার ( তার মা বা দিদিদের জন্য করা ) লোনের একপয়সাও আর শোধ করা যাবে না। যতটুক করা হয়েছে সেটাই যথেষ্ট। স্বপ্নার করা লোনের দায় ও দায়িত্ব স্বপ্নকেই নিতে হবে আর তাকেই সেটা শোধ করতে হবে। এতেই স্বপ্না বুঝেছে যে দুবেলা লোকের বাড়ি আয়ার কাজ করে সংসারে ৭০০০ টাকা দিয়ে তার স্বামীর রোজগারের টাকা আর নীলাদ্রির পাঠানো টাকা থেকে ২০,০০০ টাকা না পেলে অসম্ভব এই লোনের কিস্তির টাকা শোধ করা তার একার পক্ষে। তাই স্বপ্নার মনের মধ্যে রাগ নীলাদ্রির আর রিনির ওপরে। তার বাড়া ভাতে ছাই ঢেলে দিলো নিলাদ্রী এইভাবে ? সোদপুরের বাড়িতে নিলাদ্রী আর রিনা গেলে স্বপ্না এতোদিন দেখভাল করতো তাদের। সংসারের কর্তৃত্বপেয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করেছিল গত ১৪বছরে, নীলাদ্রির বাবার মৃত্যুর পরে। নিলাদ্রীর বাবা নাকি তাকেই সংসারের দায়িত্ব দিয়ে গেছিলেন হাসপাতালে যাবার আগে।
নিলাদ্রী, রিনা, মিমি আর সমর বিকেল পাঁচটার কিছু আগেই বাইপাশের বেসরকারী হাসপাতালে পৌঁছেছিল। সমরই ড্রাইভ করে নিয়ে গেছিলো তাদের। বিশ্ব আর তার বউ অর্পিতা আগরপাড়ার শক্তিনগর থেকে ওদের আগেই এসেছিল। পারমিতাদেবী চারতলায় নিউরো আই সি ইউতে ২৮ নম্বর বেড এ ভর্তি। সমর মিমি সকালে এসেছিল তাই ওরা চিনত জায়গাটা। ওরা লিফট করে আই সি ইউ র কাছেই নামল। পারমিতার খবর পেয়ে আরো কয়েকজন আত্মীয় তাকে দেখতে এসেছেন। তাদের মুখগুলি চেনা হলেও, কারুর বা নাম জানলেও নীলাদ্রির সাথে তারা তেমন ঘনিষ্ঠ নয় । নিলাদ্রীও অনেকের নাম ঠিকানা মনেই করতে পারলো না। তবে নিলাদ্রী আর রিনি যে লন্ডনবাসি এবং পারমিতার অসুস্থ হবার আর হাসপাতালে ভর্তি হবার খবর পেয়েই আজকেই এসেছে সেটা কিন্তু সকলেই জানে। আর তাদের চেনেও সকলে। তাই তাদের প্রতি সমীহ সমীহ ভাব একটা সবার মধ্যেই রয়েছে। বিশ্ব আর অর্পিতা দুজনেই পরপর নীলাদ্রির পা ছুঁয়েই প্রণাম করলো। অর্পিতা দেখতে আরো ভারী আর ভরাট হয়েছে নিলাদ্রী সেটাও দেখলো। অর্পিতার গায়ের রং বেশ ফর্সা। কতো বয়েস হলো অর্পিতার? ৩৩-৩৪ বছর হবে। বছর ছয়েক আগে দেখেছিল নিলাদ্রী অর্পিতাকে শক্তিনাগারের বাড়িতে । অর্পিতার বড় ছেলে তখন বছর চারেক হবে। এরপরেও আরএকটা ছেলের মা হয়েছে অর্পিতা। বিশ্বরও মাথার চুলে আর দুদিনের না শেভ করা দাড়িতে সোনালী সাদা চুল উকি মারছে সেটাও নজরে পরলো নীলাদ্রির। আরো দুই চারজন কারা যেনো এসে রিনি আর নিলাদ্রী কে প্রণাম করলো পা ছুঁয়ে। হাসপাতালের নিউরো আই সি ইউর সামনে দাড়িয়ে এদের প্রণাম নিতে নীলাদ্রির কেমন যেনো অস্বস্তি বোধ হচ্ছিলো। রিনি আর মিমির সাথে কয়েকজন কথা বলছিলো খুবই নীচু স্বরে। বিশ্ব নিলাদ্রী আর সমারকে বললো আই সি ইউ র জুনিওর এক ডাক্তারের সাথে ঘণ্টাখানেক আগেই তার কথা হয়েছে। কিছু নতুন ওসুধ, স্যালাইন ড্রিপ সেট এগুলো সে কিনে দিয়েছে এসেই, অ্যাটেনডেন্ট স্লিপ ধরাতে। পারমিতার শারিরীক অবস্থা একই রকম আছে নাকি। খুবযে একটা রেসপন্স করছেন চিকিৎসাতে সেটাও নয়। তবে অ্যাটেনডেন্ট বলেছে রোগিণীর পেচ্ছাব নাকি ঠিকঠাকভাবেই হচ্ছে, পরিমাণে। জ্বর আসেনি কিছু এখনও ( ভালো সাইন) । Ryles টিউব দিয়ে হরলিকস আর দূধ খাইয়েছে দুপুরে। বুকের ভেতর থেকে ঘড়ঘড় শব্দটাও কিছুটা কমেছে । পালস আর রক্তের প্রেসার স্ট্যাবল এখনও। চোখ খুলে আজকে সকাল থেকে অবশ্য উনি আর তাকান নি। হাত বা পায়ের আঙুলও নাড়াচ্ছেন না একদম। অ্যাটেনডেন্ট মাঝে মধ্যে পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে দিচ্ছে। বড় ডাক্তার সকালের পরে আর রাউন্ডে আসেননি। সন্ধ্যার রাউন্ডে আসবেন হয়তো। নিউরোসার্জনকে রেফার করা হয়েছে। একজন জুনিওর নিউরোসার্জন দুপুরে এসে দেখে এডভাইস লিখেও গেছে। আগামীকাল বিকেল দুটোর পরে অপারেশন হবে ব্রেইনের ভেতরে জমাট বেঁধে থাকা রক্ত বার করে দিতে এবং টেম্পোরারি শুন্ট করতে।
এতোজনকেতো আর ভেতরে যেতে দেবে না পারমিতার কাছে। তবে একজন একজন করে ভেতরে গিয়ে দেখে আসতেই পারে। নিলাদ্রী দরজার কাঁচ এর ভেতর দিয়ে একবার দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করলো। কোনটা যে রিনির মা সেটা বুঝতেও পারলো না। সব বেডের গায়েই ভারী নীল/ সবুজ পর্দা ঝুলছে। ধারে কাছে কোনো নার্স বা ডাক্তার বা অ্যাটেনডেন্ট কাউকেই দেখা গেল না।
রিনিই তার মাকে প্রথমে ভেতরে দেখতে গেলো। ভেতরে যেতে গেলে হাসপাতালের নিয়ম মেনে ধরাচুরো পরে ,মাথায় টুপি, নাকে মুখে মাস্ক, এপ্রন পরে ঢুকতে হবে। রিনি প্রথমে উঠে গেলো। বাইরের চেয়ারে অনেক রোগীর পার্টি বসে আছে। রোগীর সাথে ভিজিটিং সময় এখন। তাদের রোগীরাও এই নিউরো আই সি ইউ তে ভর্তি রয়েছে। কেউ বা সদ্য কেউ বা একসপ্তাহের ওপরে ভর্তি রয়েছে। কেউ ভেন্টিলেশনে , এক দুজন সদ্য ভেন্টিলেশনে থেকে বাইরে এসেছেন। মিমি ,সমর ,অর্পিতা ওরা অন্যদের সাথে পারমিতাকে নিয়েই কথা বলছে। অন্য রোগীর আত্মীয়রা হয় চুপ করে বসে আছেন নাহয় নীচু স্বরে নিজেদের মধ্যেই কথা বলছেন। এই হাসপাতালের চিকিত্সা নিয়ে। পার্টির কাছে গলাকাটা বিল চার্জ করা নিয়ে । এখানে কোন ডাক্তারবাবু কেমন চিকিৎসা করেন, বাইরে কেমন ওনাদের পসার বা নাম সেটা নিয়ে। কত রোগী এখানে ভালো হয়েছে সেটা নিয়ে। এখানে রোগীর অবাঞ্চিত পরীক্ষা নিরীক্ষা করা নিয়ে। নিলাদ্রী এখানকার কোনো ডাক্তারকেই বা আদমিনিকেই চেনেনা বা তাদের নাম ও জানেনা শোনে নি। তাই এইসব আলোচনাও একেবারই অর্থহিন তার কাছে। তাই এক কান দিয়ে শুনছিল আর অন্য কান দিয়ে বার করে দিচ্ছিল সে। বিশ্ব একসময় ইতঃস্তত করে কানের সামনে তার মুখ এনে বললো " মাকে এখানে না এনে সাগরদত্ত হাসপাতালে বা আর জি কর বা PG বা বি আই এনতে নিয়ে গেলেই ভালো হতো হয়তো। এতো টাকা খরচ লাগতো না। নিলাদ্রী উত্তরে বললো "টাকা পয়সা নিয়ে তুমি বেশি চিন্তা করোনা বিশু। মাকে সুস্থ করে বাড়ি নিয়ে যাওয়াটা এখন আমাদের মুখ্য কাজ। আচ্ছা বাবা কেমন আছেন? ঠিক আছেন তো? " বিশ্ব তার গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললো " আর বাবার কথা বলো না নিলাদ্রীদা। তবুও মা অ্যাক্টিভ ছিলো বলেই বাবা বেচেঁ আছে। বোঝোতো আলঝাইমারের রোগী। ৭৮ বয়েস। মার যে পরশুস্ট্রোক হয়েছে, পরশু থেকে হাসপাতালে যে ভর্তি হয়েছে সেটা বোমালুম ভুলেই গেছে। মনে করিয়ে দিলেও মনে রাখতে পারে না। মাঝে মাঝেই মাকে ডাকছে পারো, পারো করে"। "আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো তোমাকে?"
-"কী কথা?" বলেই ফেলো "
-"মা নিশ্চয় তেমন ভাবে খুব একটা যন্ত্রণা অনুভব করছে না এখন "
-"বলতে পারবো না । আমি তো আর ডাক্তার নই। তবে শুনেছি, মানুষ একবার কোমাতে চলে গেলে, সেখানে কোন যন্ত্রণা অনুভব করা যায় না , এমন কি মৃত্যুর যন্ত্রণাও অনুভব করতে পারেনা"
-"জানো তো মা কিন্তু একদম পেইন সহ্য করতে পারেনা। "সেটা অবশ্য নীলাদ্রির থেকে আর ভালো কেই বা জানে ? নিলাদ্রী মুখে শুধু বললো " হুম"
রিনি অনেকক্ষণ লাগাচ্ছে ভেতরে। এতক্ষন যে কী করছে সে ভেতরে? এরপরে হয়তো মিমি যাবে, অর্পিতা যাবে ,সমর যাবে তারপর সময় পেলে সে যাবে দেখতে রিনির মাকে।
-"আজকে রাতেও কি তুমি থাকবে হাসপাতালে?"
-"আর কেই বা থাকবে বলো? একজন কে তো থাকতেই হবে এখানে, কখন কি দরকার হয়! ওষুধ কিনতে হয়! "
-"সে রকম হলে রাজা আর রানাকে বলতে পারি আমি, রাতের ডিউটিটা ওদের এখানে দিতে"
-"খুবই ভালো হয় গো নিলাদ্রীদা সেটা হলে"। বিশুর গলায় কাতর আবেদন।
-"তাহলে না হয় কাল থেকেই ওরা রাতে থাকবে দুই ভাই পালা করে। বড়দাকে আর ওদের দুজনকে আজকে ফোনে বলে দেবো। তুমিও একবার আমাদের বাড়িতে কাল সকালে একবার গিয়ে ওদের বলো কেমন!" এই সময় লোকবল আর অর্থবল দুটোই কিন্তু ভীষণ দরকার ।
"কালকে সকালে দশ লাখ টাকা জমা করতে বলেছে রিসেপশনে তারপরেই নাকি অপারেশন হবে"
-" হুমম! জানি! সমর বলেছে আমাকে। চিন্তা করোনা সব ঠিক হয়ে যাবে। স্কট কালকে সকালের মধ্যেই সমরের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে দেবে টাকাটা আমার থেকে "
-"আমিও আমার অফিসে লাখ দুয়েক টাকা জি পি এফ্ থেকেই লোনের অ্যাপ্লাই করেছি। সানকশন হতে দিন সাত লাগবে। তারপরে পেয়ে যাবো "
-"আচ্ছা ! এখন রেখেই দাও তোমার কাছেই টাকাটা। মাকে বাড়ি নিয়ে যাবার পরও অনেক খরচ আছে তাইনা। "
বিশ্ব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। "কার যে কখন কি হয় নীলুদা। দিব্যি কিন্তু হেঁটে চলেই বেড়াচ্ছিল মা। নিজের সব কাজও নিজেই করতো। এমন কি নিজেদের রান্নাও। কারোর সাহায্য নিতে হতো না। বাবার দেখভালের কাজও মা করতো । পরশু সকালেও ঘুম থেকে উঠে সব কাজই করেছেন।স্বাস্থ্য ও ভালো অনেকের চাইতে বরাবরই। কোনো অসুখও ছিলো না মায়ের। তারই কিনা স্ট্রোক হলো। "
-" হলে আর কি করা যাবে বল! যা ঘটবে সেটাতো মেনে নিতেই হবে। মনকেও তৈরি রাখো! ওনার বয়েসও তো ৭২ হয়েছে। তাই না " "আমার বাবাও তো ৭০ বছরে হঠাৎ করেই চলে গেলো। কী করতে পারলাম বলো আমরা? তবুও তো মার জন্য চেষ্টার কোনো ত্রুটি করা হচ্ছে না। আমার বাবাতো সরকারী পানিহাটির ঘোলা হাসপাতালের ফ্রি বেড এই শেষ হয়ে গেলেন। আমি তো ওনার ডেড বডিটাই দেখেছি। তাই না ? তাও তো বছর ছয় হয়ে গেলো। আমার মা তো তারও তিন বছর আগেই চলে গেছিলো। "
রিনি রুমালে চোখের জল মুছতে মুছতেই বেরিয়ে এলো তার মাকে চোখের দেখা দেখে, ওয়ার্ডে ঢোকার প্রায় কুড়ি বাইশ মিনিট পরে। এরপরে পরপর মিমি গেলো, তারপরে সমর ,তারপরে অর্পিতা ভেতরে গেলো। এরই মধ্যে নিউরো আই. সি . ইউর ভেতরে ভর্তি থাকা কোনো এক পুরুষরোগীর নাম ধরে অ্যাড্রেস সিস্টেমে বাইরে বসে থাকা তার ভিজিটিং ঘন্টায় দেখতেআসা পার্টি বা আত্মীয়দের ডাকা হলো ভেতরে। তাদের দু তিনজন মহিলা আর একজন পুরুষ মানুষ প্রায় ছুটেই দরজা খুলে ভেতরে গেলেন । নিলাদ্রীও বুঝলো যে কোনো ইমারজেন্সি খবর বা কোনো দু:সংবাদ দেবার জনই ডাকা হয়েছে তাদের। অর্পিতা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বেরিয়ে এলো। নিলাদ্রী সমরকে বলল " আমি একবার দেখেই আসি মাকে "
ধড়াচূড়া পড়ে নীলাদ্রি নিউরো আই. সি .ইউর মধ্যে ঢুকলো।আই সি ইউর বেডগুলো সব ভারীভারী নীল পর্দা দিয়ে ঘিরে রাখা চারিদিকেই। সবার বেডের সামনে অ্যাটেনডেন্ট আছে। ওয়ার্ডের ভেতরটা বেশ ঠান্ডা। বেশিক্ষণ থাকলে শীতে কাপুনি হবে যে কারোরই। কোনো অনডিউটি স্টাফনার্স বা ডাক্তারকে ধারেকাছে দেখতে পেলোনা সে। হয়তো নির্দিষ্ট কোনো ঘরেই আছেন তাঁরা। কোন বিছনায় যে রিনির মা, পারমিতাদেবী ভর্তি আছেন নীলাদ্রী বুঝতেই পারছিলো না। একজন অ্যাটেনডেন্ট হঠাৎ পর্দার বাইরে বের হতেই নিলাদ্রী জিজ্ঞেস করলো" বেড নম্বর ২৮ কোনটা একটু বলবেন ? রোগিণীর নাম পারমিতা ব্যানার্জী? " অ্যাটেনডেন্ট মেয়েটা সম্পূর্ণ উল্টো দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিতে নীলাদ্রি তাকে মৃদু ধন্যবাদ জানিয়ে সেই দিকে এগিয়ে গেলো। প্রায় ছয় বছর পরে নিলাদ্রী তার শ্বাশুড়ীমা, নাকি একসময়ের তার "পারমিতাকে " চর্মচোখে দেখলো। এই ছয় বছরে অবশ্য অনেকসময়ই হোয়াটস অ্যাপ ভিডিও চ্যাট বা স্কাইপিতে কথা হতো, ছবিও দেখত রিনি ওকে ডেকে কথা বলাতে চাইলে " মা তোমার সাথে কি কথা বলবে"। তবে বেশির ভাগ সময়ই উনি নিজের মেয়ে আর নাতি নাতনিদের সাথেই কথা বলতেন। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমেই জামাইসস্থি ও দিতেন বা পুজোর আশীর্বাদ নিলাদ্রীকে । নিজের থেকে সে বা পারমিতা কখনও কথা বলতেন না। এই ব্যাপারে ভীষণ সজাগ ছিলেন পারমিতাদেবী। পারমিতা তাকে কি যেনো বলতো " সেই নাকি পারমিতার গত জন্মের সোলমেট! " পারমিতা বেশ কয়েকবারই তাকে ফিস ফিস করে তার কানে মুখ রেখে , তার গালে জোরে চিমিটি কেটে ধরে পরমতৃপ্তির গলায় বলতেন " সে নাকি তারই পারমিতা"। " …তার গত জন্মের সোলমেট। … " হতেই পারে এই জন্মে সে অন্যের তিন ছেলেমেয়ের মা, । হতেই পারে সে এই জন্মে অন্যকারুর বিবাহিতা স্ত্রী হয়েছে। , হতেই পারে সে এখন অন্য কারোর ঘরণী। , হতেই পারে সে নিলাদ্রীর থেকে ১৫ বছর আগেই এই পৃথিবীতে এসেছে।, কিন্তু পারমিতা নিশ্চিত ভাবেই উপলদ্ধি করেছেন যে গতজন্মে সে নীলাদ্রির সোলমেট ছিলেন নিশ্চয় "... না হলে তাদের দুজনেরই বা এমনভাবেই পরিচয় হবেকেনো আর দুজনেই বা দুজনের কাছে আসবেন কেনো ….প্রেমে পড়বেন কেনো….." laws of moon এ বিশ্বাসী ছিলেন উনি।
সেও যেনো কত যুগ আর কত বছর আগের কথা। এরপরেতো গঙ্গা দিয়ে যে কত জল বয়ে গেছে…..সময়ও তাদের অনেক কিছুর যে সাক্ষী থেকেছে।
নীলাদ্রী তখন একুশের যুবক । সবে তার বি এস সি হনোর্সের পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে আর কলেজ স্ট্রিটের প্রেসিডেন্সিতে থেকে কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে, পদার্থ বিজ্ঞানে ,সেই প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকারী। পারমিতার তখন ৩৫ বা ৩৬! নীলাদ্রীর চেয়ে বয়সে ১৪-১৫ বছরের বড় পারমিতা। তবুও কিন্ত তাদের মধ্যে একটা অসম বয়সের অদ্ভুত প্রায় বাৎসল্য রসেই মিশ্রিত একটা প্রেম হয়েছিলো। পারমিতার মধ্যে ঔই রকম এক নারী ব্যাক্তিত্ব থাকা সত্বেও। নীলাদ্রী নিজেও কিন্তু প্রথম দিকে বেশ ভয়ই পেত আর সমীহ করেই চলতো পারমিতাদেবীকে। সমীহও করতো আবার ওনার প্রতি একটা অদ্ভুত রকমের মনের আর দৈহিক আকর্ষণ অনুভব করতো, নিজের ভেতরে যার কোনো ব্যাখ্যা তার কাছে ছিলো না। সমবয়সী অন্য অনেক সুন্দরী, ডানা কাটা পরী , বড় লোকের, উচ্চ মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েরা তো প্রেসিডেন্সিতে পড়ত। স্টুডেন্টস ইউনিয়নে বাম রাজনীতিতে বেশ কিছু মেয়েও ছিল। নীলাদ্রী তো অ্যাক্টিভলি বামপন্থী রাজনীতিতে জড়িয়েও পড়েছিল কলেজ। কিন্তু সেই মেয়েদের প্রতি বিন্দুমাত্র কোনোই ফিলিং ছিলো না তার। পারমিতাও এটা নিয়ে তাকে অনেক বারই টিস করেছেন পরে। কেনো যে প্রেমে পড়েছিল নীলাদ্রি পারমিতার কে জানে। কোন আকর্ষণে? এই ধাধার উত্তর খোঁজার অনেক চেষ্টা করেছে সে নিজের মধ্যেই । কিন্ত পায়নি তার কোনো সঠিক উত্তর। এটাকি তার অউডুপাস কমপ্লেক্স ছিলো? না: সেটাও নয়। সেটা হলে তো অন্য মায়ের মতো মহিলার প্রেমেও পড়তে পারতো সে।
তখনতো নিলাদ্রী প্রেসিডেন্সিতে তার প্দিত্বিয় বর্ষে। বছরখানেক সময় নিয়েছিল সে মুখ ফুটে পারমিতাকে তার প্রবলেমটা বলতে। কী ভাবে নেবেন উনি? যদি রেগে যান? তাকে রিফিউজ করেন? নীলাদ্রী ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছিলো। একরকম মরিয়া হয়েই একদিন বিকেলে পারমিতাকে শক্তিনগরের বাড়িতে একলা পেয়ে বলেফেলেছিল। পারমিতাও ওইসব শুনে প্রচণ্ড রকমের আশ্চর্য হয়েছিলেন। একেবারেই ভাবতেই পারেনি ১৯-২০ বছরের একটা রোগা ছেলে তার প্রেমে পড়বে। কিন্তু একেবারেই হেসে ফু দিয়ে উড়িয়েও দেননি নীলাদ্রীকে। বরঞ্চ তাদের ডাইনিং টেবিলের এক চেয়ারে বসে মনোযোগ সহকারেই শুনেছিলেন নিলাদ্রীর উগরে দেওয়া কথাগুলো। পরে একদিন হাসতে হাসতেই নীলাদ্রির গালে খুব জোরে চিমিটি দিয়ে বলেছিলেন " আমি কিন্তু অনেক আগেই বুঝতে পারছিলাম তুমি আমার প্রেমে পড়েছ"। পারমিতার এই একটা স্বভাব ছিলো। ওর গালে বা নাকে দুই আঙ্গুলে খুব জোরেই চিমটিকেটে ধরা ,ওনার মধ্যে উত্তেজনা হলেই। এটাই ওনার ভেতরের উত্তেজনার প্রাথমিক প্রকাশ ছিলো। পারমিতা কিন্তু প্রথমদিন সব শুনে আর নীলাদ্রীর প্রস্তাবে সত্যিই আকাশ থেকেই পড়েছিলেন । নিলাদ্রীকে কী যে বলবেন, কী যে বলা উচিত, বুঝেই উঠতে পারছিলেন না। এটাযে কখনো হতে পারে তার চিন্তা ভাবনায় ছিলোই না। তার তো ভরা সংসার। তার ওপরে বয়েসে কত বড় সে। ভাগ্যিস বাড়িতে সেদিন কেউই ছিলো না । পারমিতা আর তার শ্বাশুড়ি। শ্বাশুড়িকে কেমন যেনো ভয়ও পেতেন পারমিতা, ঐরকম একটা ব্যাক্তিত্ব থাকা সত্বেও। পারমিতা নিজের বুকের মাঝখানে আঙুল রেখে বলেছিলেন "আ আ আ..আমাকে ভালোবাসো তুমি? তুমি ? সত্যি ? এ হয় নাকি আবার? কেনো ভালোবাস? কী আছে আমার মধ্যে এখন এই বয়েসে ? কী পাবে তুমি আমার কাছ থেকে ? শরীর চাই? দুই বড় মেয়ে আর এক ছেলের মা আমি । তুমি জানো কি আমার বয়েস কতো এখন ? তুমি যে বাবা আমার সন্তানের বয়সী নিলু! আমার যে ভরা সংসার আছে, বাড়ি আছে স্বামী আছে, ছেলে মেয়ে আছে। তাদের প্রতি দায়িত্ব আছে। আমার স্বামী দেবতার মত স্বামী। আসলে পারমিতা লজ্জা আর খুব ভয় পেয়েছিলেন নিলাদ্রীর প্রপোজে। সমাজের লজ্জা। লোক লজ্জা। ছিলো দ্বিধা । আবার কেনো যেনো নীলাদ্রিকে একবারে ইগনোর ও করতে পারছিলেন না । মন থেকেও ঝেড়ে ফেলতে পারেননি। পারমিতা তাকে বোঝাবার খুব চেষ্টাও করেছিলেন " এই সম্পর্কটা ঠিক নয় নিলু। …. এটা নিলাদ্রীর মনের একটা বিকৃত মনোভাব। নীলাদ্রির কোনো মানসিক ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত । নিলাদ্রী কিন্তু তখন পারমিতাকে পেতে মরীয়া। তবে যাতে উনি কখনো অপমানিত মনে না করেন সেটা নিলাদ্রী কথা দিয়েছিল আর বলেছিল সে তাকে একটুকুও জোর করবে না তার সম্মতির জন্য। পারমিতা কিছুটা সময় চেয়ে নিয়েছিলেন নীলাদ্রির কাছে তার উত্তর জানাতে এই ব্যাপারে। নীলাদ্রী কিন্তু খুবই ভয়েভয়েই থাকত সেইসময়। এই বুঝি পারমিতাদেবী তাকে আর এই বাড়িতেই আর না আসতে বলে দেন। না সেটা বলেন নি কোনোদিনও পারমিতা।
নীলাদ্রির নিবেদিত প্রেম আশ্চর্য ভাবে মেনেও নিয়েছিলেন উনি একসময়। নীলাদ্রি ওনাকে একা পেলে গোপনে তার হাতে প্রেমের চিঠি দিতো। পারমিতাও দ্রুত নিয়ে নিতেন। একান্তে পড়তেন। একদিন পারমিতাও তাকে চিঠি লিখে ছিলেন। নীলাদ্রির হাতেই তুলে দিয়েছিলেন। বাড়িতে এসে নিলাদ্রী পড়েছিলো। সেই চিঠিতেই পারমিতার সম্মতি লেখা ছিল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কায়দা করে। তবে তাতে অনেক রকম উপদেশ আর সর্তও ছিলো। পারমিতা তাদের প্রেম ও গোপন রেখেছিলেন সবার খোলা পঞ্চন্দ্রিয় থেকে। পরিবারের থেকে , আত্মিয় স্বজন থেকে, সমাজের থেকে । না গোটা ত্রিভুবনের কেউই আজ পর্যন্ত জানেনা তাদের এই সম্পর্কের কথা। এইমাত্র বিভাদেবী ছাড়া। ত্রিভূবনের কিন্তু কেউই জানেনা আজ পর্যন্ত তাদের এই অসম প্রেমের কাহিনী, একমাত্র বিভাদেবী ছাড়া। আর বিভাদেবীরও সম্পূর্ণ সায় ছিলো তাদের প্রেমের। পারমিতা তাকে নিজেই বলেছিলেন তাদের প্রেমের পড়বার গল্পঃ।
নীলাদ্রিরতো এখন ৫৬ পেরিয়ে ৫৭ চলছে। আর পারমিতার ৭২ হবে। ২৫ -২৬ বছর হয়ে গেল সেই সব দিনগুলো তারা পেড়িয়ে এসেছে। নিজের বড় মেয়ে রিনির সাথে তার বিয়েও পারমিতাই দিয়েছিলেন অনুষ্ঠান করেই। বিয়ের দিন বরণডালা দিয়ে প্রথমে তিনিই বরণ করেছিলেন নিলাদ্রীকে। রিনি তখন প্রেম করতো পাড়ার এক উঠতি স্টেজ গায়কের সাথে । সেটা নিলাদ্রী শুনেছিল রিনির মূখে বিয়ের আগেই। পারমিতাও জানত। আর পারমিতার কথার অবাধ্য হবার ক্ষমতা তো নীলাদ্রির কখনোই ছিলো না। নিলাদ্রী তখন পার্টিকেল ফিজিক্সের ডক্টরেট ডিগ্রি শেষ করে পোস্ট ডক্টরেটফেলো হিসাবে লন্ডনের ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি তে ডাক পেয়েছে । যাবার প্রস্তুতি করছে।নি
লাদ্রী পর্দা সরিয়ে বেডের কাছে গেলে মহিলা অ্যাটেনডেন্ট বললো "আপনি কে?"
"আমি ওনার বড় জামাই"
"ওঃ আপনিই বুঝি লন্ডনে থাকেন। "অ্যাটেনডেন্ট একজন বিবাহিত মাঝ বয়সী মহিলা। বোধ হয় কেরালিয়ান হবেন। বাংলাটা ভালো শিখে নিয়েছেন।নার্সের মতই ড্রেস ওনার গায়ে।মাথায় নার্সের মতোই টুপি
নিলাদ্রী সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়ল।- "কেমন আছেন উনি? এখন" পারমিতার দিকে দেখিয়ে বললো।
"একই রকম তো । সাড়া কিন্ত তেমন দিচ্ছেন না ডাকলে, চোখ ও খুলছেন না" তবে স্ট্যাবল আছেন এখনও। ভাইটাল গুলোও নরমাল প্রায়। সেই রকমই ডাক্তার বলছে" আপনি না হয় ওনার কাছে একটু থাকুন আমি চা খেয়ে ওনার দুধটাও গরম করে নিয়ে আসি। সময় হয়ে গেছে ওনাকে খাওয়ানোর"
অ্যাটেনডেন্ট বেড়িয়ে গেলে নিলাদ্রী পারমিতার দিকে ভালো করে তাকালো। পারমিতাদেবীর সমস্ত শরীরটাই পা থেকে বুক পর্যন্ত ধবধবে সাদা একটা চাদরে ঢাকা। চাদরের নিচে মনে হচ্ছে একটা কম্বলও আছে। ওনার মুখে মেকানিকাল ভেন্টিলেশনে এর টিউব আর নল পড়ানো আর প্লাস্টিকের অক্সিজেন মাস্ক কাপ। বা দিকে কাত করে রাখা মুখটা " খুব ফর্সা বা হাতের শিরাতে স্যালাইনের নল লাগানো। লম্বা নিডল দিয়ে ইনট্রাভেনাস চ্যানেল করা। বেডের পাশে স্যালাইন স্ট্যান্ডে তিনটে স্যালাইনের প্লাস্টিক বোতল ঝুলছে। সেখান থেকে কি সব ফ্লুইড ঢুকে যাচ্ছে ওনার শরীরের মধ্যে। ওর হাতপা bed এর রেলিং এ শক্ত করেই বাঁধা গজ দিয়ে। নাকে ryles টিউব পড়ানো । চাদরের নিচ থেকে একটা ক্যাথেটার বিছানার ওপর দিয়ে গেছে , তাতে ইউরিন যাচ্ছে আর নিচে ঝোলানো একটা ইউরোব্যাগ জমা হচ্ছে। ইউরোব্যাগটা অর্ধেকের বেশি ভর্তি। পারমিতার এই ৭২ বছর বয়সেও ওনার শরীর এখনো পেটানো স্বাস্থ্য। দেখে মনে হয় ৬০-৬১ বছর বয়েস ওনার। দুই চোখই বোজা। চোখে গ্লিসারিন দেওয়া আর কি যেনো অ্যান্টিবায়োটিক মলম দেওয়া । ওর চাদরে ঢাকা বুক দুটো ভেন্টিলেশনে ওঠা নামা করছে(?) মৃদু মৃদু। ভেন্টিলেটরের মনিটরে অনেক রকমের ডাটা ওঠা নামা করছে। হাতের তর্জনীতে পালস অক্সিমিটার লাগানো। ব্লাড প্রেসার, পালস রেট , রেসপিরেটরি রেট, অক্সিজেন এর মাত্রা ,কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা , ইসিজির লিড প্রতি মুহূর্তেই মনিটরিং হচ্ছে। মাঝে মধ্যে অদ্ভুত বিপ বিপ করে শব্দও হচ্ছে মনিটরে। নীলাদ্রীর খুব ইচ্ছে করছিল একবার অন্তত সে ছুয়ে দেখে পারমিতাকে। হোকনা সে এখন ৭২ বছরের বুড়ি। আর এই মুহূর্তে তো সে আর পারমিতা একা। তাদের চারধারে ভারী নীল পর্দা। নীলাদ্রীর মনে পড়লো রিনির সাথে বিয়ের পরেও রিনিদের আগরপাড়ার শক্তিনগরের বাড়িতেই কিছু সময়ের জন্য একা পেলে রিনি বা মিমি বা রিনির বাবা, বা বিশ্ব কেউইনা থাকলে , রিনির মাকে হঠাৎ করে জড়িয়ে ধরলেই, পারমিতাও কপট রাগ দেখিয়ে নীলাদ্রির কান ধরেই বলতেন " কি হচ্ছে শুনি? বয়েস তোমার বাড়ছে, না দিনদিন কমছে নীলু? এখন না আমি তোমার শ্বাশুড়ি ? একটু স্রধ্যা ভক্তিতো দেখাও এখন। আর রিনির ঠাম কিন্ত ঘরেই আছে। বুড়ির চোখ কান যে খুব শার্প তুমি তো জানোই সেটা । হঠাৎ করে চলে আসলে কি ভ্য়নকর যে কেলেঙ্কারি হবে সেটা তো অন্তত খেয়াল রাখো। " তারপরে ওর গালে দুই আঙ্গুলে জোরে চিমটি দিয়ে মৃদু হাসতে হাসতে গলা একেবারে খাদে নামিয়ে বলতেন " অসভ্য । ইতরকোথাকার! জীবনে যে একটা প্রেম করলে তাও কিনা এই বুড়িটার সাথেই করতে হলো তোমাকে? আর মেয়ে জুটলো না তোমার কপালে? " সবইতো দিয়ে দিয়েছি । আরো কি বাকি আছে কিছু পেতে ? আমার সংসারে অন্তত আমার মান ইজ্জৎটা নষ্ট করোনা আর দয়া করে। আর এখন না বিয়ে হয়েছে তোমার। আমি না তোমার শ্বাশুড়ী? আমার মেয়েকেও কিন্ত কষ্ট দিও না। " সে এইসব জানতে পারলে খুব কষ্ট পাবে। " আর একটু পাগলামী করে জোর করলে প্রথমে " ভালো হবে না কিন্তু নিলু ! ভালো হবে না বলছি কিন্তু।" কয়েক বার উচ্চারণ করলেও , কয়েকটা মুহূর্তের জন্য হলেও চোখ বুজে নিয়ে, ওনার ঠোঁটে নীলাদ্রির ঠোঁট রাখতে দিতেন । স্ট্যাচু হয়ে যেতেন কয়েক মিনিট নীলাদ্রির আলিঙ্গনে। তারপরই জোরে ঠেলা দিয়ে সরিয়ে দিতেন বা নিজেই দ্রুত সরে যেতেন অনত্র ,নীলাদ্রির সামনে থেকে"
নীলাদ্রী ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে এলে সমর , বিশ্ব আর সে রিসেপশনে গিয়ে বকেয়া তিন লাখ টাকার বিলটা প্রথমেই মেটাল। বিলের পাকা রশিদ নিলো। আগামী কাল দুপুরে সার্জারি করার ১০ লাখ জমা করে দেবে প্রতিশ্রুতি দিলো নিলাদ্রী। নিউরোসার্জন আজকে রাতে পারমিতাকে আর দেখবে কিনা জিজ্ঞেস করলে, রিসেপশনিস্ট বললো উনি তার ইনস্ট্রাকশনস দিয়েই গেছেন ওনার জুনিয়রকে। আনস্থেস্টিস্ট চেক আপ পরে ,রোগীর ফিটনেস সার্টফিকেট দিলে কালকে বেলা দুটোর পরেই অপারেশন হবে। OT তে অর্ডার দেওয়া হয়ে আছে।
পরদিন সকালে ঠিকসময়েই ওরা সকলেই হাসপাতালে পৌঁছেছিল। বড় নিউরোসার্জনের সাথে সেই প্রথম দেখা হল। ভদ্রলোকের বয়েস নিলাদ্রীদের মতই হবে হয়তো। আয়ারল্যান্ডের FRCS উনি। উনি বললেন রিস্কি অপারেশন এটা। clot টা বেশ বড় । মিড ব্রেইন এর ওপরে চাপ দিচ্ছে। ইন্ত্রাক্রানিয়াল প্রেসার টাও বেশি। ওপেন craniotomy করে, ব্রেইন খুলে রক্তের জমাট বাঁধা ক্লোটটা বার করে দিতে হবে। STICH ট্রায়াল এর উদাহরণ দিয়ে বললেন সংক্রমণ আর অপারেশনের পরেও আবার রক্ত ক্ষরণের চান্স থেকেই যায় কিন্ত। সেই ক্ষেত্রে বাঁচানো ভগবানের ওপরে। তবে উনি আপ্রাণ চেষ্টা করে দেখবেন যাতে সুস্থ হয়ে যায় পারমিতা। মিষ্টি হাসিতে মিষ্টি কথায় অপারেশনের ব্যাপারটা অল্প কথায় কিছুটা বুঝিয়ে উপস্থিত সকলের মনে আশা আর ওনার প্রতি একটা গুডফিল কনফিডেন্স তৈরি করে উনি চলে গেলেন। বেলা দেড়টা নাগাদ প্রায় কোমাতে থাকা পারমিতাকে তাদের সামনে দিয়েই OTতে নিয়ে গেল। রিনি মিমি অর্পিতা ওনার মাথায় পুজোদেওয়া ফুল ছুঁইয়ে দিলেন। ভগবানই ভরসা এখন।
ক্রমশ চলবে
