Gopa Ghosh

Tragedy

4.7  

Gopa Ghosh

Tragedy

পুজোর জামা

পুজোর জামা

4 mins
960


শাশুড়ি আর স্বামীর কথায় কোন উত্তর না দিয়ে লেখা রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলো!। রমলা ছেলের দিকে তাকিয়ে আর কিছু না বলে ইশারা করলো বটে কিন্তু অজয় সেদিকে না তাকিয়েই বলে উঠলো "তুমি কি ভাবছো, কষ্ট শুধু তোমার একার? একটু থেমে কান্না টা চেপে ধরা গলায় আবার বলল "আমি বুঝি, এই শোক ভোলার নয়, তাই তো চাই আমরা এখান থেকে চিরদিনের মতো অন্য কোথাও চলে যেতে, প্লিজ লেখা আর না কোরো না, পম্পা র কথাও তো ভাবতে হবে আমাদের, একজন কে হারিয়েছি সেটা কপালে ছিল, কিন্তু যে আছে........ আর কথা বলতে পারলো না, কান্নায় গলা বুজে এলো অজয়ের। রমলা মুড়ির বাটি টা কোলে রেখে হাপুস নয়নে কেঁদে চলেছে, লেখা ছোটো মেয়ে শম্পার মৃত্যুর পর হাসি আর কান্না দুটোই যেনো ভুলে গেছে। হাতা টা হাতে নিয়ে হন্যে হয়ে হাতা খুঁজে চলেছে। আসলে শম্পার দেহ টা দাহ করার সাথে সাথে লেখার দেহ টা ছাড়া সব কিছু পুড়ে ছাই হযে গেছে। 


এখন আর ওদের বাড়িতে কেউ খবর দেখে না। খবরে যখন দেশে কতজন কোরোনা আক্রান্ত, বা রাজ্যে কতজন মারা গেছে বলে, ওরা কেউই চোখের জল ধরে রাখতে পারে না। কতবার লেখা খবর দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছিল তাই এখন অজয় কেবিল এর তার টা খুলে দিয়েছে।


আসলে শম্পার অসুখটা যদি প্রথমেই ধরা পড়তো তাহলে হয়তো মেয়েটাকে এই অকালে চলে যেতে হত না। অজয় বছর পাঁচেক ধরে দুর্গাপুরের একটি কোম্পানিতে কাজ করছে। আগে কলকাতাতেই অন্য একটি ছোট ফার্মে হিসাব রক্ষক হিসেবে কাজ করতো। ছোট মেয়ে হওয়ার বছর দুয়েকের মধ্যেই এই কাজটা পাই। লেখা প্রথমে বারণ করলেও অজয় বুঝিয়েছিলো পরিবার বেড়েছে তাই রোজগার বাড়ানো দরকার। অনেক ভেবে লেখা স্বামীর কথায় সায় দিয়েছিল। এখন লেখা ভাবে যদি অজয় কলকাতায় থাকতো হয়তো মেয়েটা কে বাঁচানো সম্ভব হতো। কিন্তু বিধাতার বিধান কে আর খন্ডাতে পারে?


বেশ কিছুদিনের ছুটি নিয়ে অজয় গোটা পরিবারকে সাথে করে ওর কর্মস্থলে নিয়ে যাবে বলে এসেছে। কিন্তু পুজোর আগেই ওর অফিসে জয়েন করার কথা। এখন সমস্যা হল লেখা পুজোর আগে কিছুতেই এই ঘর ছেড়ে যেতে চাইছে না ,আর কারণটাও খুলে বলছে না। রমলা অনেকবার জিজ্ঞেস করেও লেখার থেকে কোন সদুত্তর পায়নি। এটা ভাড়া করা ঘর তাই অজয় চাইছে দুর্গাপুরে একটা বড় ফ্ল্যাট ভাড়া করে সবাই এক সাথে থাকবে আর দ্বিতীয় কথা মায়েরও বয়স হচ্ছে তাই মাকে ওর সাথেই রাখার ইচ্ছা। শুধু লেখার এই পুজোর আগে না যাওয়ার ইচ্ছাটা কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না। 


রমলাও চায় না সদ্য কন্যা হারা মাকে বেশি বিরক্ত করতে, অনেক কিছু জানার ইচ্ছে হলেও বৌমার মুখের দিকে চেয়ে চুপ করে থাকে। সারা দিন বড় নাতনি পম্পার সাথেই একটু আধটু কথা বলে কাটান। মাত্র সাত বছরের আদরের বোন কে হারিয়ে পম্পাও যেনো পাথর হয়ে গেছে। কেউ যেচে কথা না বললে ও এখন চুপ করেই থাকে, সর্বদা শম্পার কচি মুখটা ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে। খুব মনে পড়ে জ্বর হওয়ার আগে মায়ের সাথে দুই বোন পুজোর জামা কিনতে গিয়েছিল। সে কি আনন্দ শম্পার, যেনো সব জামাই কিনে নেবে। তবে একার নয়, প্রিয় বন্ধু সুমি র জন্য কিনবে । মায়ের কথা কিছুতেই শুনবে না। সুমি ওদের পাশের বস্তিতে থাকে। বাবা নেই, মা কয়েক বাড়ি কাজ করে তিন ভাই বোন কে মানুষ করছে। খুবই অভাব কিন্তু সুমি আর শম্পার বন্ধুত্বে ভালোবাসার কোনো অভাব নেই। বাড়িতে ভালো কিছু খাবার হলেই সুমির জন্য রাখা চাই, নাহলে ও নিজেই খাবে না। 


শম্পা জানতো সুমির এবার পুজোয় কোনো নতুন জামা হবে না। বড়ো দাদার অপারেশন করতে গিয়ে মা সর্বস্বান্ত, কি করে জামা কিনবে, যাদের দু বেলা খাওয়া জোটাতে ই হিমশিম , তাদের আবার পুজোর জামা টা বিলাসিতা। 


শম্পা চলে যাওয়ার পর সুমি রোজ সকালে একটা টগর ফুল নিয়ে সম্পার ছোটো টেবিলে রাখা ফোটো তে দিয়ে যায় কিন্তু কারো সাথে কথা বলে না, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেও তার উত্তর করে না। শোক টা সুমির ভেতরের অনেক কিছুই বদলে দিয়েছে। লেখার এখন মনে পড়ে জ্ঞান হারানোর আগে শম্পা মাকে একটা কথাই বলে গিয়েছিল "মা, সুমি কে এবার পুজোয় নতুন জামা তুমি পড়িয়ে দেবে, তোমার সাথে সুমি আর আমি নতুন জামা পড়ে ঠাকুর দেখতে যাবো" ব্যাস এরপর আর কথা বলার মত অবস্থায় ফেরে নি। যেদিন অজয় ফিরলো আর কিছু করার ছিল না, সবাই কে কাঁদিয়ে চলে গেলো শম্পা।


অজয় যখন দেখলো লেখা পুজোর আগে কিছুতেই কলকাতা ছেড়ে যাবে না, কারণ যাই হোক, ও মেনে নিয়ে আরো কিছুদিন থেকে পুজোর পর সবাইকে নিয়ে একেবারে দুর্গাপুরে চলে যাওয়া ই মনস্থির করলো। পুজো এলো বটে কিন্তু সবার মন খারাপ টা যেনো হু হু করে বাড়িয়ে দিলো। এবার তাদের আদরের শম্পা নেই, কিসের জন্য তাদের এত বড়ো ক্ষতি হয়ে গেলো কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছে না হিসাব রক্ষক। এই সব ভাবতে ভাবতে লেখা কে দেখে চমকে ওঠে অজয়। সুমির হাত টা ধরে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলো " যা বাবা কে প্রণাম কর, নতুন জামা প্রথম পড়লে গুরুজন দের প্রণাম করতে হয়" অজয় লক্ষ্য করে শম্পার জন্য কেনা জামাটা সুমি কে পরিয়ে যেনো একটু হলেও শান্তি পেয়েছে লেখা। রমলা হাউ হাউ করে কেঁদে ই যাচ্ছে সুমির কাছে হাঁটু গেঁড়ে বসে। এতক্ষণে অজয় বুঝতে পারলো লেখা কেনো পুজোর আগে কলকাতা ছেড়ে যাবে না বলে ছিল। মেয়ের শখ করে কেনা জামা মেয়ের শেষ ইচ্ছা মত সুমি কে পরাবে বলে। আসলে লেখা ওটা সুমি কে নয় শম্পা কেই পরালো। এখন যেনো লেখা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে শম্পা তার সাধের নতুন জামাটা পড়ে খুব খুব আনন্দ করছে।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy