STORYMIRROR

Agniswar Sarkar

Abstract Horror

4  

Agniswar Sarkar

Abstract Horror

প্রতিশোধ

প্রতিশোধ

9 mins
437

‘আচ্ছা মাঝরাতে কি কাক ডাকে?’ , প্রশ্নটা নিজের মনেই করল অভীক। হয়তো ডাকে ! এসব নিয়ে এই মাঝরাতে ভাবার কোনও কারণ নেই। কাকগুলোর খিদেও পেয়ে থাকতে পারে। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ঘুমের চেষ্টা শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়েও পড়ল।দিন সাতেক হল শিলিগুড়ির চারতলা ‘অদ্বিতীয়া’ এপার্টমেন্টের দোতলায় এসেছে অভীক। এটা অবশ্য ব্যাঙ্কের দারোয়ানের ঠিক করে দেওয়া। অভীকের বাড়ি কন্টাইয়ে। একটা প্রাইভেট ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের পোস্টে জয়েন করেই প্রথম পোস্টিং এই শিলিগুড়িতে। বাড়িতে মা অবশ্য ঘোরতর আপত্তি করলেও অভীক মা-কে বুঝিয়েছে,কয়েকটা মাসের তো ব্যাপার। কয়েকমাস পরে নতুন পোস্টিং নিয়ে এদিকে চলে আসবে। আসলে অভীকের ছোটবেলা থেকেই পাহাড়ের প্রতি একটা অমোঘ আকর্ষণ আছে। প্রথম পোস্টিং-এ আকর্ষণের দোরগোরায় পৌঁছিয়ে সেটা মাটি করার ইচ্ছেটাকে একদমই প্রশ্রয় দেয়নি অভীক।একটা টাটকা নতুন সকালে ঘুম ভাঙল অভীকের। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি। বাতাসে কাঞ্চনজঙ্ঘার বরফের একটা ছোঁয়া আছে। আকাশের অবস্থা খুব একটা সুবিধার নয়। ঘড়িতে ৯টা ১৫। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে অফিসের দিকে বেড়িয়ে পড়তে হবে। আজকের ব্রেকফাস্টটা অফিসে করা ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই।আজ বেলা এগারোটা থেকে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে, ব্যাঙ্কের দৈনিক কাজও খুব তাড়াতাড়ি মিটে গেছে। অফিসের দারোয়ানকে দিয়ে একটা টোটো ডেকে এপার্টমেন্টের দিকে এগোল অভীক। আজ আর রান্না করার ঝঞ্ঝাট না করাই ভালো, অনলাইন থেকে চাইনিজ কিছু একটা অর্ডার করে দিলেই হবে। এই দিকে চাইনিজ প্রিপারেসানগুলো ভালোই করে। বৃষ্টি হওয়াতে ঠাণ্ডার প্রকোপটা একটু বেড়েছে।রাতে একটু তাড়াতাড়িই খাওয়া শেষ করে ফেলল অভীক। ঘরে নাইট ল্যাম্পটা জ্বালাতেই নীল রঙের একটা মিষ্টি আলোতে ঘরটা ভরে উঠলো। বাইরে বৃষ্টির বেগটা অনেকটা বেড়েছে। কানে হেডফোনটা গুঁজে মোবাইলে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত চালিয়ে চোখটা বন্ধ করে বাড়ির কথা ভাবতে শুরু করল অভীক। মা হয়তো এখন রুটি করছে। বাবা টিভির খবরে ডুবে আছে। ভাবতে ভাবতে চোখটা কখন লেগে এসেছে কে জানে, ঘুমটা ভাঙল সেই কাকের ডাকে। কানের হেডফোনগুলো খুলে গেছে। বাইরের বৃষ্টির বেগ একটুও কমেনি। কিন্তু এই বৃষ্টির মধ্যেও কাকের ডাক? আশ্চর্য হয়ে গেল অভীক। বিছানার ওপর উঠে বাইরের দিকের জানালাটা খুলে দিল, কাকটা ওই দিক থেকেই ডাকছে।কাকটা সামনের ইলেকট্রিকের তারে বসে আছে। বৃষ্টির জলে বাস্তবিকই কাকভেজা। কী আশ্চর্য! কাকটা নিজের জায়গায় স্থির। অদ্ভুত!জানলাটা বন্ধ করে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল অভীক। কাকের ডাকটা কেমন অকোয়ার্ড লাগছে। বিছানাতে শুয়েও অস্বস্তিটা পিছু ছাড়ছে না। হেডফোনটা আবার কানে গুঁজে দিয়ে মোবাইলের ভলিউমটা বাড়িয়ে দিল। মাথাটা ঝমঝম করলেও কাকের ডাকটা চাপা পড়ে গেছে তীব্র গানের আওয়াজে। কিছুক্ষণ বাদে কানের ব্যাথায় হেডফোনটা খুলে ফেলল অভীক। এখনও কাকটা অবিশ্রান্তভাবে ডেকে যাচ্ছে।এইভাবে ঘুমানো সম্ভব না, একদমই না। সেই রাতের প্রায় পুরোটাই জেগে কাটালো অভীক। ভোরের দিকে একটু ঘুম হলেও ফোনের অ্যালার্মের কাছে সেটা চিরস্থায়ী হল না। এরপর থেকে রাত হলেই কাকের ডাক আর অভীকের জেগে থাকা পরস্পরের পরিপূরক হতে শুরু করল। চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ, চোখের কোলে ডার্ক স্পট আর চিরতার মতো মেজাজ নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে গেল অভীকের। এই তো সেদিন, জলের বোতলে জল না থাকার জন্য পিওনের ওপর যা-তা রকমের চিৎকার করল। আজও দুপুরে নিজের কেবিনে লোক ঢুকে যাওয়ার জন্য দারোয়ানকে বাজে ভাবে ভৎসনা করল। বিকেলে কাচুমাচু করে অভীকের কেবিনের কাঁচের দরজায় টোকা দিল দারোয়ান অনিল শেরপা। ‘আসবো স্যার।’মুখটা তেতো করে অভীক বলল, ‘কাম ইন।’

‘স্যার, গুস্তাখি মাফ। কেয়া হুয়া হ্যায় আপকো?’     

‘কী আবার হবে? তুমি যাও তো এখান থেকে। কিছু কাজ বাকি আছে সেরে নিই।’

‘স্যার, আপ মুঝে বোল সাকতা হ্যায়।’, বলেই কেবিনের একপাশে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল অনিল।

অভীকের মনে কিছু একটা হল। এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে একজন কেউ তো তার এই অসহনীয় অবস্থা দেখে কেউ সহমর্মিতা দেখাতে এসেছে।

‘বসো।’

‘কেয়া হুয়া স্যার। আপ বোলিয়ে। ম্যায় কুছ জুগার লাগাতা হু।’

ধীরে ধীরে পুরো কাক বৃত্তান্ত অনিলের সামনে তুলে ধরল অভীক। একটু হালকা লাগছে। কোথাও যেন দুপুরের অপরাধবোধটা থেকে একটু রেহাই পাওয়া গেল।

‘স্যার, আপ আজ হি মেরে সাথ চলিয়ে। ইধার এক গুম্ফা মে লামাজি হ্যায়। উও আপকা প্রবলেম জরুর সল্ভ কর দেগা। ইধার সব উনকো মানতা হ্যা।’, বলেই কোনও এক অজানা মানুষের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাবনত হল অনিল শেরপা।

অভীকও যেন একটা নতুন লাইফ লাইন পেল। অচেনা জায়গায় পেল বিশ্বাসের এক চিলতে রোদ। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজনে একটা টোটো ধরে শিলিগুড়ি শহরের একটু বাইরে থাকা পুরানো এক বৌদ্ধ মঠে হাজির হল। অনিলের পিছু পিছু মঠের মূল উপাসনা গৃহে প্রবেশ করল অভীক। চারদিকে একটা স্বর্গীয় শান্তি বিরাজমান। কয়েকজন বৌদ্ধভিক্ষুর মন্ত্রোচ্চারণের সাথে ধূপের গন্ধ মিশে গিয়ে একটা চিরশান্তির পরিবেশ তৈরি হয়েছে চারদিকে। জমে থাকা ক্লান্তির কাছে নতি স্বীকার করে ঘরের এক পাশে বসে পড়ল অভীক। পাশেই বসল অনিল। চোখটা বুজে গেল ধীরে ধীরে।

অনিলের ধাক্কায় চটকাটা ভেঙ্গে গেল। চোখ খুলতেই দেখল সামনে এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বসে আছেন। মুণ্ডিত মস্তক, সৌম্য চেহারার অধিকারী। শ্রদ্ধায় মাথাটা নিচু হয়ে গেল অভীকের।

বিশুদ্ধ বাংলায় সেই সন্ন্যাসী অভীককে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে আপনার? শরীরের উপর এত ধকল কীসের?’

অভীক শিলিগুড়িতে আসার দিন থেকে সব গড়গড় সব বলল সন্ন্যাসীকে। সব শুনে উনি চোখবন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। চারদিকে একটা নিশ্ছিদ্র নীরবতা বিরাজ করছে। বেশ কিচ্ছুক্ষণ পর চোখ খুলে সন্ন্যাসী বলতে শুরু করলেন-

‘কাক এক অশুভ শক্তির প্রতীক। কাকটা নিশ্চিত কালো। সে যখন আপনার ঘরের দিকেই তাকিয়ে আছে তখন সম্ভবত সমস্যা ওই ঘরের মধ্যেই আছে। আপনি বরং একটা কাজ করুন।’ , বলেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি। শান্তভাবে এগোতে শুরু করলেন বাইরের দিকে। বাকি দু-জনও তাঁকে অনুসরণ করল। প্রার্থনাগৃহের সামনের চাতালে এসে হাতের ইশারায় দাঁড়াতে বলে পাশের একটা ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলেন সেই সৌম্যকান্তি সন্ন্যাসী। ফিরে এলেন হাতে একটা তিব্বতি ঘণ্টা নিয়ে। 

‘এই ঘণ্টাটা আপনার বিছানার পাশের একটা কিছুর উপর রেখে দেবেন। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

আরও কিচ্ছুক্ষণ কথা বলে সন্ন্যাসীর কাছে আশীর্বাদ নিয়ে অভীক আর অনিল ঘণ্টা নিয়ে শিলিগুড়ি শহরের দিকে ফিরে চলল। বুকের ভিতরটা অনেক হালকা লাগছে অভীকের। রাতের শহর মোহময়ী লাগছে। উত্তরদিক থেকে আসা হিমেল বাতাস হাড়ের ভিতরে একটা শিরশিরানির অনুভূতি জাগিয়ে তুলছে। এপার্টমেন্টে ঢোকার আগে দুজনে একটা নামী হোটেলে ডিনার সেরে নিল। অনিল ফিরে গেল নিজের বাসার উদ্দেশ্যে। ঘরে ঢুকে একটা চেয়ার খাটের পাশে নিয়ে এসে ঘণ্টাটা রেখে দিল অভীক। মনের ভিতরে একটা প্রশস্তি অনুভূত হল। বিছানায় শুতেই আচ্ছন্ন হয়ে গেল গভীর ঘুমে।

***

‘স্যার কাল কুছ হুয়া থা ক্যায়া?’ , ব্যাঙ্কে ঢোকার সময় অভীককে প্রশ্নটা করল অনিল শেরপা।

নিস্তেজ, মরা মাছের মতো একটা শীতল চাউনি দিয়ে দারোয়ান অনিল শেরপার দিকে তাকালো ব্যাঙ্ক ম্যানেজার অভীক চৌধুরী। কোনও উত্তর না দিয়ে নিজের কেবিনের দিকে এগিয়ে গেল।

‘স্যারের চুলগুলো উসকো-খুসকো, জামা-প্যান্টও অবিন্যস্ত। হয়তো আজ অনেকদিন পর নিশ্চিন্তে ঘুমনোর কারণে। কিন্তু যে মানুষটা কাল অতো কথা বলল, আজ কেমন যেন ব্যবহার করল। উনি বড়া আদমি। নাকি..?? ’ , এইসব ভাবতে ভাবতে দিনের ব্যাস্ত শিডিউলের মধ্যে হারিয়ে গেল দারোয়ান অনিল শেরপা।

দিন দিন অভীকের স্বভাবের মধ্যে পরিবর্তন শুরু হল। সময়ের সাথে সাথে প্রাণোচ্ছল মানুষটা রুক্ষতার কাঠিন্য পেরিয়ে কেমন যেন নিশ্চল হয়ে যাচ্ছে। দু-সপ্তাহে সম্পূর্ণভাবে পাল্টে গেল অভীক। নোংরা হতে শুরু করল বেশভূষা। একে প্রাইভেট ব্যাঙ্ক তার ওপর কাজের চাপ, অভীকের পরিবর্তন কারোর চোখে দেখার সময় নেই। কিন্তু অনিলের মধ্যে সেই অবকাশ নেই। পাহাড়ি মানুষ, সারল্যে ভরা মনে প্রভাব পড়তে শুরু করল। একদিন আর সহ্য করতে না পেরে বিকেলে হাজির হল ম্যানেজারের কেবিনে।

‘স্যার, আপ ঠিক নেহি হো? ফিরসে কুছ হুয়া হ্যায়?’ , ইতস্তত হয়ে কথাগুলো বলল অনিল।

চেয়ারে বসে সেই অদ্ভুত চাহনি দিয়ে আনিলকে বিদ্ধ করতে লাগলো অভীক।

‘স্যার, আজ লামাজিকে পাস জায়েঙ্গে?’ , মরিয়া হয়ে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল অভীকের দিকে।

এবারের অভীকের দৃষ্টিটা আরও ক্ষুরধার। শীতল চাহনি এতটা ভয়ঙ্কর হয় সেটা জানা ছিল না অনিলের। দ্রুতপায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের জায়গায় ফিরে গেল। ব্যাঙ্ক বন্ধ করে অনিল বাড়ি ফিরল। মুখে ভেসে উঠল অদ্ভুত এক হাসি। বাড়ি ফিরে আলনা থেকে একটা চাদর নিয়ে মাথা পর্যন্ত জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল।

পরদিন সকালে শিলিগুড়ি হুলুস্থুল। ‘অদ্বিতীয়া’ এপার্টমেন্টের প্রমোটার বিমল দাস অদ্ভুতভাবে মারা গেছে। হয়তো খুন। রক্তশূন্য। চোখজোড়া বিস্ফারিত। পুলিশ নিজেদের কাজ শুরু করে দিয়েছে। শহরের হাওয়ায় একটা চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে গেছে। এমন বিস্ময়কর ঘটনা স্থানীয় মানুষও আগে দেখেনি। প্রমোটারেরে বাড়ির চারপাশে ঘিরে থাকা মানুষের মধ্যে একটা চাপা ফিসফিসানি ভেসে বেড়াচ্ছে। কেউ বলছে, ‘যেমন মানুষ ছিল, বেশ হয়েছে।’ কেউবা বলছে, ‘এ পুরীর সাজা এ পুরীতেই পেল।’ পাড়ার ক্লাবের ছেলেদের কাছে এ যেন বিপুল ক্ষতি। সব পুজোতেই দরাজ হাত ছিল বিমলকাকুর। পুলিশ বেলা এগারোটা নাগাদ বডি নিয়ে মর্গে চলে গেল। পড়ে রইল অত্যুতসাহী কিছু লোক, পুলিশ কুকুর আর কয়েকজন পুলিশকর্মী। মর্গের গাড়ির পিছু পিছু আরও একটা লোক মুখে পৈশাচিক আনন্দমেখে ফেরার পথ ধরল।

ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল অনিল শেরপা। ঘরে ঢুকতেই একটা চেনা স্পর্শ, একটা চেনা গন্ধ পেল। ছোটবেলা থেকেই এই গন্ধটা খুবই পরিচিত। গোটা ঘরটা নোংরায় ঢেকে আছে। খাবারের টুকরো, চিকেনের হাড়ে ঘরটা একটা জলজ্যান্ত নরক। ঘরের মধ্যে একটা শক্তির অস্তিত্ব পদে পদে টের পাওয়া যাচ্ছে, সেটা শুভ না অশুভ? বিছানায় গিয়ে ধপ করে বসে পড়ল অনিল। দু দুটো কষ্ট বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করছে। বিছানার পাশে রাখা ঘণ্টাটা তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করল।

ঘটনার শুরু মাস ছয়েক আগে। পৈতৃক বাড়িটা নিয়ে দড়ি টানাটানি শুরু হয়েছিল অনিল শেরপার বাবা আর প্রমোটার বিমলের মধ্যে। হঠাৎ একদিক সকালে ঠিক এমনভাবেই হুলুস্থুল পড়ে শিলিগুড়িতে। অনিলের বাবার নিথর দেহ পাওয়া যায় বাড়ির উঠোন থেকে, গোটা গায়ে ইলেকট্রিকের তার জড়ানো অবস্থায়। অনিলের দেহেও তার জড়ানো ছিল, কিন্তু ভোরে লোডশেডিং হওয়ায় হয়তো প্রাণে বেঁচে যায় অনিল। গায়ে ছিল প্রচুর আঘাতের দাগ। সেদিন গোটা শিলিগুড়ির চোখ বেয়ে জল গড়িয়েছিল। সবাই সব জানতো, কিন্তু পরিণতির ভয়ে চুপ করে গিয়েছিল। অনিলের বাবা ছিলেন শিলিগুড়ির এক প্রাচীন বৌদ্ধ গুম্ফার সদস্য। শিলিগুড়ি বিপদে পড়লেই মুখে স্মিত হাসি নিয়ে সমাধান বাতলে দিতেন তিনি। কিন্তু তার এই পরিনতিতে সেই সাহসটা আর কেউ দেখাতে পারেনি। অনিলের পাশে সেদিন সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ওই গুম্ফার-ই লামা। তৈরি হয়েছিল প্রতিশোধ নেওয়ার স্বপ্ন। তখনই আদ্যন্ত নতুন শহরে আসে অভীক। রচনা করার হয় নাটকের শেষ অঙ্ক। প্রাচীন তিব্বতি মন্ত্রে আহ্বান করা হয় অন্য জগতের বাসিন্দা অনিলের বাবার। বাবার খুব প্রিয় ঘণ্টাটা অনিল তুলে দেয় বৌদ্ধ লামার হাতে। ঘণ্টাটাকে করা হয় মিডিয়াম। ওই ঘণ্টার মাধ্যমেই অভীকের শরীরে বসত শুরু করে সেই শক্তির, না কি অনিলের বাবা? ঘরে বাসা বাঁধে এক অশুভ শক্তির আরেক অশুভের বিনাশের হেতু। গতকাল রাতে এক প্রাচীন তন্ত্র সাধনার সাক্ষী ছিল অনিল। এই ঘণ্টাই হয়ে উঠেছিল অসুর বিনাশের মাধ্যম। এই শুভ ঘণ্টাধ্বনি গতকাল রাতে কাল-ঘণ্টায় পরিবর্তিত হয়েছিল বিমলের কাছে। অভীক হয়ে উঠেছিল খেলার পুতুল, অসুরদমনকারী রূপে। অভীককে মাধ্যম করেই চোখের সামনে দেখা ছেলের ওপর অত্যাচারের বদলা নিয়েছিল অনিলের বাবা, না অনিল ও বৌদ্ধ লামা নিয়েছিল অনিলের বাবাকে অত্যাচার করে মৃত্যু মুখে ঠেলে দেওয়ার প্রতিশোধ? সেদিন অভীকের চোখের চাউনি খুব চেনা লেগেছিল অনিলের। এতো তার জন্ম-জন্মান্তরের চেনা চাহনি।

নিজেকে সামলে নিতে কিছুক্ষণ সময় লাগলো অনিলের। বেশ কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো। নিজের হাতে যত্ন করে গোটা ঘরটা পরিষ্কার করল। ঘড়িতে দুপুর তিনটে বাজে। ঘণ্টাটা বুকে জড়িয়ে ধরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাইরের রাস্তায় দাঁড়ালো। হাত নেড়ে একটা গাড়ি দাঁড় করিয়ে, তাতে চেপে রওনা দিল তিস্তার উদ্দেশ্যে। প্রায় একঘণ্টা বাদে অনিলকে তিস্তার ধারে নামিয়ে গাড়িটা এগিয়ে চলল তার নিজের গন্তব্যে। অনিল ধীর পদক্ষেপে নেমে গেল তিস্তার মধ্যে। শীতল স্রোতস্বিনী ধারার মধ্যে দাঁড়িয়ে ঘণ্টা ধরা হাত দুটো আকাশের দিকে প্রসারিত করে কিছু লামার শেখানো মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করল পিতৃহীন অনিল। শেষে ঘণ্টাটা নিষ্ঠা সহকারে বিসর্জন করল তিস্তার বুকে। বাবার স্নেহের পরশের শেষ ছোঁয়াচটা এক ঝটকায় তলিয়ে গেল প্রবাহমান তিস্তার গর্ভে। অনিলের চোখের উষ্ণ স্রোত তিস্তার ওপর পড়ে শীতল হয়ে যাচ্ছে। বৌদ্ধ লামার দেওয়া মন্ত্রপূত তাবিজটা অভীকের ঘরের ভেন্টিলেটারের মধ্যে লুকিয়ে এসেছে। আজই শাপমুক্তি ঘটবে নিষ্পাপ অভীকের । হয়ে উঠবে সেই পুরানো প্রাণোচ্ছল অভীক। অনিল আজ সকালেই ফোন করে আসতে বলেছে অভীকের বাবা-মাকে। আস্তে আস্তে ওপরে উঠে এলো অনিল। একটা লাইনের গাড়িতে চেপে ফিরে যাবে নিজের পুরানো জীবনে। যে জীবনে আছে প্রাণপ্রিয় বাবাকে নিজের চোখের সামনে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা। প্রাণের মানুষটার ফেলে যাওয়া ফাঁকা জায়গাটাকে আঁকড়ে ধরে জীবনযুদ্ধে নতুন করে ঝাঁপিয়ে পড়া। কিছুদিন বাদেই হয়তো অভীক বদলি হয়ে চলে যাবে এখান থেকে। রেখে যাবে কিছু বোবা স্মৃতি। অনিল কি পারবে তার পরিবারে সদ্য যুক্ত হওয়া নতুন মানুষটাকে অজানার হাতে একা ছেড়ে দিতে?

না কি দারোয়ানের মতো সারা জীবন আগলিয়ে রাখতে মিশে যাবে অভীকের জীবনের মধ্যে?     


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract