দ্বিতীয় ভালবাসা
দ্বিতীয় ভালবাসা
অমলেন্দু ভালোবেসেছিল । একবার নয় । পরপর দুবার । মনামী অমলেন্দুকে ডিচ্ করেছিল । অমলেন্দু খুব ভালোবাসতো মনামীকে । মনামীও হয়তো সেই সুযোগটা নিয়েছিল । মনামী যখন , যে সময় , যেখানে , ডেকেছে ছুটে গেছে অমলেন্দু । বেশীরভাগ সময় অফিসে ফেরার পর অমলেন্দুর কপালে জুটেছে চরম ভৎসনা । কিন্তু কোনোদিনও কিছুই টের পেতে দেয়নি মনামীকে । কিন্তু মনামী সব সময় অমলেন্দুর ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছে । পান থেকে চুন খসলে কত কথা শুনিয়েছে অমলেন্দুকে । নিজের দোষ-ত্রুটিগুলো অবলীলাক্রমে চাপিয়ে দিয়েছে অমলেন্দুর ওপর । তবুও এহেন মনামীকে নিজের প্রাণের চেয়ে ভালোবাসতো অমলেন্দু । এতো রাতে কথা কীসের? বা রোজই খোঁজ নিতে হবে খেয়েছি কী না ? - এই ধরণের কথা শুনেও চুপ করে থাকতো অমলেন্দু । প্রতি মুহূর্তে মনে করতো মনা হয়তো চাপের মধ্যে আছে তাই এরকম কথা বলছে । মনামীকে ভালোবেসে মনা বলে ডাকতো অমলেন্দু । তবুও অমলেন্দুর ভালোবাসা ছিল পিকচার পারফেক্ট ।
শনিবার দুপুরে অফিসের সাইট থেকে অসীমের সাথে ফিরছিল অমলেন্দু । বাসে প্রচণ্ড ভিড় । বসার জায়গা পাওয়া যায়নি । গলদঘর্ম অবস্থা । এমন সময় অসীম বলে উঠলো -
- অমলেন্দুদা চলো না সামনের ভিক্টোরিয়া , গিয়ে একটু বসি ।
- কেন রে ? তাড়াতাড়ি চল । নাহলে অফিসে গিয়ে আবার ঝাড় খেতে হবে ।
- তুমি তো রোজই খাচ্ছো । তোমার কাছে এটা আবার নতুন কী ?
বলেই হো হো করে হেসে উঠলো অসীম । অমলেন্দুও যোগ দিল হাসির ডাকে সাড়া দিয়ে । দুজনে বাস থেকে নেমে ভিক্টোরিয়ার টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকলো । - এখানেও গরম কম কোথায় রে অসীম ? এর থেকে ভালো আর একটু কষ্ট করে অফিসে গিয়ে এ.সি তে বসি ।
- ঠিকই বলেছো । আজ এমন ভাগ্য একটা এ.সি বাস পেলাম না ।
- তোকে কতবার বললাম একটা ট্যাক্সি নি । এতো কিপটে দেখিনি মাইরি ।
- অমলেন্দুদা একটু বাদাম খাবে নাকি ?
- চল খাই ।
- ও বাদাম দা । একটু আসবেন এদিকে । দশ টাকার বাদাম দিন
- এখানেও কঞ্জুসি ? আমি আরও দশ টাকা দিচ্ছি ।
বাদামের প্যাকেটগুলো নিয়ে খোলা ছাড়াতে ছাড়াতে টুকটাক করে গল্প করতে লাগলো দুজনে । হঠাৎ অসীমের চোখে পড়ল ব্যাপারটা ।
- অমলেন্দুদা ওটা মনামীদি না ?
অমলেন্দু বাদামের খোলা ছাড়াতে ছাড়াতে উত্তর দিল , কী সব ভুলভাল দেখছিস ? এখন ও তো ফ্রেঞ্চ ক্লাসে ।
- তুমি একবার মুখ তুলে দেখো না ।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না অমলেন্দু । ওটা তো মনামীই । একটা ছেলের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে আছে । কিন্তু একটু আগে মেসেজ করে বলল যে ফ্রেঞ্চ ক্লাসে । কিন্তু ছেলেটাই বা কে ?
- চল তো অসীম ।
- অমলেন্দুদা এখানে একটু ঠাণ্ডা হয়ে বসো আগে । ফোন করো দিদিকে । ওটাতো না ও হতে পারে । একই রকম দেখতে পৃথিবীতে আটটা মানুষ থাকে । তারপর এতটা দূরে বসে আছে । মনে হচ্ছে ভুলভাল হচ্ছে আমাদের ।
অমলেন্দু ফোন করল মনামিকে । কয়েকটা রিং হওয়ার পর আপনা থেকেই কেটে গেল ফোনটা ।
- দেখেছো । আমি বললাম ওটা দিদি না । আমাদেরই দেখার ভুল হয়েছে । দিদি হলে ফোনটা ধরত ।
- তুই যাবি ? নাহলে আমি চললাম ।
- ওটা মনামীদি হলে প্লিস তুমি ওখানে গিয়ে কোনও সিন ক্রিয়েট কোরো না , করুণ মুখে বলল অসীম
অমলেন্দুর চোখ মুখ রাগে লাল হয়ে উঠেছে । সামনে গিয়ে দেখে ওটা মনামী-ই । এই সালোয়ারটা অমলেন্দুই জন্মদিনে গিফট করেছিল মনামীকে । এতদূর থেকে চিনতে কোনও ভুল হওয়ার কথাই নয় । ওদের সামনে বসে পড়ল অসীম আর অমলেন্দু । শুরুটা অসীমই করল ।
- মনামীদি তুমি এখানে ?
- আজ ক্লাস অফ্ ছিলো । বাড়িতেও কেউ নেই । তাই একটু এদিকে এলাম ।
মনামী অমলেন্দুর দিকে ফিরে বলল , তুমি এখানে কী মনে করে ? তোমার তো এই সময় অফিসে কাজ থাকে । কারোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছো বুঝি ?
- অসীমের প্রশ্নের উত্তর তুমি এখনো দাওনি । এ কে তোমার সাথে ? অমলেন্দু রাগত স্বরে মনামীকে বলল ।
- আরে এ তো স্যাম । আমাদের ফ্রেঞ্চ ক্লাসের টিচার । ওর বাড়ি ইউ.এস.এ তে ।
- এখানে কী স্পেশাল ক্লাস করছো ?
What he is saying Manami Darling? Who is he ? , মনামীর দিকে ফিরে স্যাম জিজ্ঞেস করল ।
- I am saying that , please enjoy your special class . দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো বলল অমলেন্দু । আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলনা । বাস ধরে সোজা অফিস । মাথাটা গরম হয়ে আছে । সন্ধ্যায় অফিস থেকে বেরিয়ে একটা পাবে ঢুকলো । মদও এখন বিস্বাদ লাগছে অমলেন্দুর মুখে । চেষ্টা করল খানিক্ষন মদ খাওয়ার । শেষে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা নিজের ফ্ল্যাটে । নিজের মনে শপথ নিল জীবনে আ*******
প্রায় দু বছর নির্ঝঞ্ঝাটে কাটলো অমলেন্দু । ফ্ল্যাট থেকে অফিস আর অফিস থেকে ফ্ল্যাট । কোনও কোনও দিন একটু আধটু পাবে গিয়ে বসা । মনামী আসতে আসতে ধূসর হয়ে যাচ্ছিল অমলেন্দুর জীবন থেকে । এখন জানুয়ারী মাসের মাঝামাঝি । কোলকাতায় জমিয়ে বসেছে বইমেলা । ছোট থেকেই পড়াশোনার বাইরে অন্য কিছু পড়ার তেমন আগ্রহ ছিলনা অমলেন্দুর । তবুও সেদিন কলিগরা চেপে ধরল । একপ্রকার নিমরাজি হয়েই কলিগদের সাথে বইমেলা গেল অমলেন্দু । ভিতরে ঢুকে সকলেই বিক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়ার আগে ঠিক করল ঠিক দুঘণ্টা পরে এই খানেই দেখা করবে । অমলেন্দু বেচারা আর কী করে , সে এ দোকান ও দোকানে ঘুরে বই দেখতে লাগলো । দুঘণ্টা যে কীভাবে কাটবে কে জানে ! এরমধ্যেই কানে এলো এক নারী কণ্ঠ ,
- দাদা একটু সরবেন ?
- হ্যাঁ । মানে এই তো সরছি ।
বলতে না বলতেই বই সমেত অমলেন্দুর ঘাড়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল একটা বইয়ের সুনামী । সুনামীর পিছনে ছিলো এক অনামী । থুড়ি অনামীনী । মানে এক নারী । অমলেন্দু পৃথিবীর ঘাসের উপর বোঝা হয়ে পড়ে আছে । মাঝখানে বইয়ের ঢেউ আর তার ঠিক উপরে আছে সেই অনামীনী ।
- কিছু মনে করবেন না স্যার । আপনি সাবধানে উঠুন ।
- কী আশ্চর্য ! আপনি আমার উপর থেকে না উঠলে আমি উঠি কীভাবে ?
- সরি সরি ।
প্রথমে উঠলো সেই অনামীনী । বইয়ের রাশি সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো অমলেন্দু । দোকান থেকে ছুটে এলো দুজন কর্মচারী ।
- স্যার আপনি দোকানের মধ্যে এসে বসুন প্লিজ । বলে উঠলেন সেই অনামীনী ।
অমলেন্দু তার অফিসের ব্যাগ সামলিয়ে ঢুকলো দোকানের ভিতরে । দোকানের ম্যানেজার সলজ্জ ভঙ্গিতে এগিয়ে এলেন তার দিকে ।
- স্যার আপনার লাগেনি তো ?
- না না । আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না । আমি একদম ঠিক আছে । It’s an accident . Nothing to worry.
- না স্যার আপনার গভীর চোট লাগতে পারতো । আপনি প্লিজ বসুন । এই রামু একটা কফি নিয়ে আয় স্যারের জন্য । তাড়াতাড়ি ।
- আপনাকে ব্যস্ত হতে হবেনা । আমি বেরচ্ছি । আমার কলিগরা অপেক্ষা করবে ।
- না না । এইভাবে আপনাকে যেতে দেওয়া যায়না । আত্রেয়ী এদিকে এসো ।
আত্রেয়ী সলজ্জ ভঙ্গিতে এসে অমলেন্দুর সামনে এসে দাঁড়ালো ।
- স্যারের কাছে ক্ষমা চাও আগে ।
- না না । সিনক্রিয়েট করতে হবেনা । Its okay . আপনি আপনার কাজ করুন ম্যাডাম ।
তবুও আত্রেয়ী মাথা নিচু করে নিজের জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইল ।
- আচ্ছা আপনাকে আমাদের তরফ থেকে একটা বই উপহার হিসাবে নিতে হবে ।
অমলেন্দু বিরক্তি মাখানো স্বরে বলল , আপনাদের যেটা ইচ্ছে হয় সেটা দিয়ে আমাকে বিদেয় করুন এবার ।
- আত্রেয়ী , তুমি স্যারকে আজকের প্রকাশিত বইগুলো একটা সুন্দর করে প্যাকেটে ভরে দাও ।
আরও পাঁচ মিনিট পর বইয়ের প্যাকেট হাতে নিয়ে নিষ্কৃতি পেল অমলেন্দু ।
আচ্ছা আঠালো ম্যানেজার , নিজের মনে মনে বলে উঠলো । ঘড়ির দিকে তাকালো অমলেন্দু । এখনো প্রায় সোয়া একঘণ্টা বাকী আছে বাকিদের আসতে । বইভর্তি প্যাকেটটাকে অফিস ব্যাগে চালান করে দিয়ে সামনের খাবারের দোকানগুলোর দিকে এগিয়ে গেল । বইয়ের দোকানের চেয়ে খাবারের দোকানে সময় কাটানো হাজারগুনে ভালো । খিদেও পেয়েছে বিস্তর । প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট খাবারের দোকানে কাটানোর পর এগোতে লাগলো সেই মিটিং প্লেসের দিকে । ফিরতি পথে নজর আটকিয়ে গেল সেই দোকানের দিকে । আত্রেয়ী এখন বুক শেলফে বই গুছিয়ে রাখতে ব্যস্ত । নির্দিষ্ট সময়ের আগেই নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছিয়ে গেল সে । ঘড়িতে এখন প্রায় আটটা বাজে । একটু বাদে আসতে আসতে সকলে হাতে বইয়ের প্যাকেট নিয়ে ফিরতে লাগলো ।
- অমলেন্দুদা , তুমি কোনও বই কেনোনি ? , প্রশ্নটা করল সেই অসীম ।
- ওই দু একটা ।
- কই দেখাও ।
ব্যাগ থেকে বইয়ের প্যাকেটটা বের করে অসীমের হাতে দিল । ওরা সকলে নিজেদের কেনা বইগুলো দেখতে লাগলো ।
- স্যার ।
মেয়েলি কণ্ঠে পিছন ফিরল অমলেন্দু । দাঁড়িয়ে আছে আত্রেয়ী ।
- আজ স্যার আপনার জন্য কাজটা বেঁচে গেল আমার । অশেষ ধন্যবাদ স্যার ।
- ঠিক আছে ।
- অনেক কষ্ট করে চাকরিটা পেয়েছি স্যার । আপনাকে কী বলে ধন্যবাদ দেব স্যার ।
- ঠিক আছে । আসুন এখন ।
আত্রেয়ী মাথা নিচু করে ওখান থেকে চলে গেল । কলিগদের সাথে কথা বলতে বলতে ওরা একটা ট্যাক্সি ধরে যে যার মতো বাড়ি চলে গেল । রাতে বিছানায় শুয়ে অমলেন্দুর খালি একটা কথা মনে হতে লাগলো , মেয়েটার ওরকম ব্যবহার না করলেই ভালো হত । মেয়েটাতো তাকে ধন্যবাদ জানাতে এসেছিল । ওইরকম তাড়িয়ে না দিলেই ভালো করত । যাকগে , যা হওয়ার হয়ে গেছে । বেকার ভাবনাগুলোকে মাথায় প্রশয় না দিলেই ভালো হয় । তবুও সারারাত একটা অপরাধবোধ মনে কাজ করতে লাগলো ।
পরেরদিন অফিসে গিয়েও কাজে মন বসাতে পারলো না অমলেন্দু । আজও অফিস থেকে গুলতাপ্পি দিয়ে একটু আগেই বেরিয়ে পড়ল । ফোনের অ্যাপে একটা ট্যাক্সি বুক করে সোজা বইমেলা । গিয়েই হাজির হল আগেরদিনের স্টলে ।
- স্যার ভিতরে আসুন । আজনেক নতুন স্টক এসেছে ।
অমলেন্দু ভিতরে গেল ।
- একটু চা আনাই ?
- না না । নতুন বইয়ের স্টক কোথায় আছে ?
- সুশীল । সুশীল । একটু এদিকে এসো । স্যারকে ক্যাটলগটা দাও । আর নতুন যে বইগুলো এসেছে সেগুলো দেখাও ।
সুশীল ক্যাটলগ ধরে নতুন বইগুলো দেখাতে লাগলো ।
- সুশীল , আত্রেয়ী কোথায় ?
- ও কাল এখানে কাকে একটা ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল । আর বলবেননা স্যার , তার মাথা ফাথা ফেটে একাক্কার । তারপর আজ মালিক ওকে এখানে আসতে বারণ করে দিল । তার বদলে আজ আমি এসেছি । ও এখন কলেজ ষ্ট্রীটের দোকানে আছে ।
শুনেই অমলেন্দু উঠতে উদ্যত হল ।
- স্যার , আপনি ওকে চিনলেন কীভাবে ? আপনি কী ওর কেউ হন ?
- আমিই সেই লোকটা , যার সঙ্গে কাল ওর ধাক্কা লেগেছিল । বলেই বেরিয়ে গেল ।
- ট্যাক্সি কলেজ ষ্ট্রীট যাবে ?
- চলুন ।
কলেজ স্ট্রীটে পৌঁছিয়ে অভীষ্ট দোকানের দিকে এগিয়ে চলল অমলেন্দু ।
- দাদা , একটা ডিকশনারি দিন ।
- আমাদের এখানে ডিকশনারি পাওয়া যায় না । পাশে খোঁজ করুন ।
- আত্রেয়ীকে পাওয়া যাবে ।
- কার লেখা ?
- দাদা । আত্রেয়ী মানুষ , বই নয় ।
- আত্রেয়ী , তোমাকে কে খুঁজছেন দেখ ।
আত্রেয়ী অমলেন্দুকে দেখেই চমকে উঠলো ।
- বলুন স্যার ।
- আমি কফি হাউসে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি , চাপা গলায় বলল অমলেন্দু ।
আত্রেয়ীকে হ্যাঁ বা না বলার সুযোগ না দিয়ে দোকান থেকে ছিটকে বেড়িয়ে গেল ।
- উনি কে ?
- আমাদের বাড়ির পাশে থাকে ।
কিছুক্ষন বাদে আত্রেয়ী কফি হাউসের দোতলায় উঠলো । ওই তো বসে আছেন উনি ।
- এসো । বসো ।
- বলুন স্যার ।
- আগে কী খাবে বলো । দুটো কফি বলি ? ওয়েটার । দুটো কফি আর সঙ্গে একটা স্ন্যাক্স ।
- বলুন স্যার । আমাকে কী জন্য ডাকলেন ?
- কাল আমার ওইরকম ব্যবহার করা উচিত হয়নি তোমার সঙ্গে । আমি খুব লজ্জিত ।
- না স্যার । অমন ভাবে বলবেন না । আমার অভ্যাস আছে ।
- মানে তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছ ?
- ওই ভাবে বলবেন না স্যার ।
- এই যে কফি আর স্ন্যাক্স ।
কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে সামান্য কিছু কথা হল ।
- এবার উঠি স্যার । গিয়ে আবার হিসাবটা নিয়ে বসতে হবে । আপনি খুব ভালো মানুষ । ভালো থাকবেন ।
*********
বাড়ি ফিরলেও মন পরে রইল কফি হাউসে । আজ মনটা একটু হাল্কা লাগছে । আত্মগ্লানি কিছুটা কমেছে । মনের ঘরে কি বাসা বেঁধেছে আত্রেয়ী ? না , না , আর ওই রাস্তায় পা বাড়ানো যাবে না । অনেক বিনিদ্র রজনী আর কয়েক হাজার টাকার মদ লেগেছে মনামীকে ভুলতে ।
মাথা আর মনের লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত মনই জিতে গেল । মাঝে অবশ্য তিন দিন কেটে গেল । তিন দিন বাদে এক মুখ দাড়ি-গোঁফ নিয়ে অফিসে গেল অমলেন্দু ।
- অমলেন্দুদা , শরীর ঠিক আছে তো ? ফোন তুলছিলে না কেন ? , অসীম জিগেস করল ।
- না রে , শরীরটা একটু খারাপ ছিল ।
- ডাক্তার দেখিয়েছো ? আর কয়েকদিন রেস্ট নিতে পারতে তো ।
- এখন একটু ঠিক আছি । চল চল । অনেক কাজ জমা হয়ে আছে ।
বিকেলে একটু আগেই ঢপ দিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল অমলেন্দু । ট্যাক্সি ধরে সোজা কলেজ স্ট্রীটে ।
- দাদা , একটা রবীন্দ্র রচনাবলী হবে ?
- কোন খণ্ড ?
- সব কটাই ।
- এই ননী । রবীন্দ্র সেটটা নিয়ে আয় ।
- বাইশো টাকা দিন । কী নামে বিল করব ?
- অমলেন্দু সাহা ।
- দাদা , আগের দিন যে মেয়েটি বই দিচ্ছিল সে কোথায় ? তার বইয়ের নলেজ বেশ ভালো । একটু ডেকে দেবেন ?
- সে আজ আসেনি । ননী , একটু এদিকে আয় । ইনি কী বলছেন একটু দ্যাখ ।
ননী এসে অমলেন্দুকে জিগেস করল ,
- স্যার বলুন ।
- আত্রেয়ী কোথায় ? আজ আসেনি ?
- না স্যার । আজ ওর বাড়িতে কিছু কাজ আছে । ছুটি নিয়েছে । আপনি কী বই নেবেন ?
- বেয়ার গ্রিলস এর কোনো বই আছে ?
- না স্যার । আপনি পরশু আসুন । প্রকাশনী বলতে পারবেন ?
- না । আত্রেয়ীর বাড়ির ঠিকানা বা ফোন নম্বর পাওয়া যাবে ? ও জানতে পারে ।
- দাঁড়ান স্যার । আমি ফোন করে দিচ্ছি ।
ফোনে কিছুক্ষন কথা বলার পর ...
- স্যার । এই নিন ।
- আত্রেয়ী তুমি কোথায় ?
- আপনি ?
- আমার সঙ্গে ধাক্কা লেগেছিল বইমেলায় ।
- স্যার আমার বাড়িতে একটু কাজ আছে । পরশু দোকানে যাব ।
- কিন্তু আজ যে তোমার সঙ্গে দরকার ছিল । দেখা করা যাবে না ?
- না স্যার ।
- আমার যে একটা বই লাগতো ।
- আপনি ননীকে বলুন । ও দিয়ে দেবে ।
- কিন্তু আমার যে তোমাকে দরকার । কথাটা বলল অমেলেন্দু । কিন্তু তার আগেই ফোনের লাইন কেটে দিয়েছে আত্রেয়ী ।
আপাততঃ পরশু অব্ধি অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও দ্বিতীয় রাস্তা খোলা নেই । উদাস মনে ট্যাক্সি ধরে বাড়ি ফিরল উন্মাদচিত্ত অমলেন্দু । হঠাৎ করে কী এমন হল ? বেশ তো আকাশের মুক্ত বিহঙ্গ ছিল । আজ আবার খাঁচায় আবদ্ধ হওয়ার জন্য কেন এতো আনচান ? আত্রেয়ীর আগুনে আবার নতুন করে পোড়ার হাতছানির উপেক্ষা কেন করতে পারছে না ? মনে ওঠা প্রশ্ন ।
************
তিনদিন বাদে অফিস ফেরত অমলেন্দু হাজির হল বইয়ের দোকানে । আজ নিজেকে অনেক বেশী অকুতোভয় মনে হচ্ছে । সোজা দোকানের মালিকের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল নির্ভীক অমলেন্দু ।
- আত্রেয়ী আছে ?
- কে মশাই আপনি ? প্রায় রোজই আপনি আত্রেয়ীর খোঁজ করছেন ।
- ওর সঙ্গে আমার একটু বিশেষ দরকার আছে ।
- আপনাকে একটা কথা বলছি , আজকের মতো দেকে দিচ্ছি । রোজ রোজ দোকানে এসে এসব চলবে না । দরকার হলে ওর বাড়ি যান ।
- হ্যাঁ । দরকার হলে তাই যাব । আপনার অতো কৈফিয়ত নেওয়ার দরকার নেই । আপনি কি মশাই ওর গার্জেন ।
ভরসন্ধ্যের চেঁচামেচিতে কিছু উৎসুক পথচারী দোকানের দিকে একটা বাঁকা চাউনি দিয়ে চেয়ে আছে । দোকানের ভিতর থেকে ননীর সঙ্গে বেড়িয়ে এলো আত্রেয়ী ।
- কী দরকার আছে স্যার ?
- তুমি একটু বাইরে এসো । তোমার সঙ্গে আমার কিছু দরকার আছে ।
- সেটা সম্ভব নয় স্যার । আপনি এখানেই বলুন ।
- এখানে সম্ভব নয় ।
আত্রেয়ী চুপ । ওদিকে দোকানের মালিকের চাহনিতে এবার দুজনেই ভস্ম হয়ে যাবে বোধহয় । নিজেকে যতটা সম্ভব সংযত করে ঠাণ্ডা গলায় অমলেন্দু আত্রেয়ীকে অনুনয়ের সুরে বলল – আমি দোকান বন্ধ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছি । দোকান বন্ধের পর না হয় দরকারটা মেটাব । আত্রেয়ী দোকানের ভিতরে ঢুকে গেল ।
- বলুন স্যার । কী এতো দরকার আমার সাথে ?
- প্রথম দিন তোমাকে দেখে আমার তোমাকে ভালো লেগে গেছে । অনেক চেষ্টা করেছি তোমাকে ভুলে থাকার । কিন্তু বিশ্বাস করো , সব সময় তোমার মুখটাই চোখের সামনে ভাসছে । জানি এটা শুনতে অড লাগছে । তুমি আমাকে চেনোনা আমিও তাই । শুনতে ছেলেমানুষের মতো লাগছে । কিন্তু এটা তোমাকে না বললে আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না । আমরা ভালো বন্ধু হতে পারি না ?
মাথাটা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল আত্রেয়ী ।
- প্লিজ আত্রেয়ী । কিছু বলো ।
- কী বলব স্যার । আসলে আমি আপনাকে চিনি না । জানি না । এইভাবে স্যার বন্ধুত্বও হয় না । স্যার প্লিজ । এই ব্যাপারটা এই পর্যন্তই থাক । বলেই আত্রেয়ী হাঁটা শুরু করল ।
- আত্রেয়ী ।
আশেপাশের লোক মজা দেখছে । কেউ কেউ জামার হাতা গোটানোর চেষ্টা করছে । একবার মেয়েটা চিৎকার করুক , মেরে লোকটাকে পাট পাট করে দেবে ।
অমলেন্দু এবার এগিয়ে গিয়ে সোজা আত্রেয়ীর হাতটা চেপে ধরতেই আশেপাশের লোক হইহই করে তেড়ে এলো । আত্রেয়ী কোনওরকমে তাদের থামিয়ে পিছু হটতে বাধ্য করল ।
- স্যার এমন করবেন না প্লিজ । আচ্ছা আমাকে একটু ভেবে দেখতে সময় দিন ।
- তুমি প্লিজ আমার বন্ধুত্বকে ভেঙে দিও না । কাতর আর্তি জানলো অমলেন্দু ।
*********
সেদিন সারারাত কলকাতার দু প্রান্তে দুটো মানুষ একে অপরের জন্য ভেবে সারারাত ঘুমোতে পারলো না । ঘুম আসে ক্লান্তি থেকে । আসলে সামনে অনেকটা বড় পথ । শুরুতেই ক্লান্ত হলে চলে ? মাঝখানের দুটো দিন অপেক্ষাতেই কেটে গেল । অফিসের কাজে দুটো দিন কলকাতার বাইরে যেতে হয়েছিল অমলেন্দুকে । আর ওদিকে আত্রেয়ীর আর কিছুতেই মন বসে না । সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ হাওড়া স্টেশনে নেমেই একটা ওলা বুক করে সোজা কলেজ স্ট্রীটে চলে এল অমলেন্দু । দোকানে জিজ্ঞেস করলে এবার মালিক সোজা অপমান করে দিতে পারে । আবার আত্রেয়ীর চাকরীটাও চলে যেতে পারে । এর থেকে ভালো উল্টো দিকে একটু অপেক্ষা করা । সময় নিজের ছন্দে এগিয়ে চলল । দোকানগুলো এক এক করে বন্ধ হতে শুরু হল । এবার নিশ্চয় আত্রেয়ী বেরোবে । এই যাহ্ ! আত্রেয়ীদের দোকানও বন্ধ হয়ে গেল । এতো দেরি তো হয়না ! ওই তো ননী আসছে ।
- ননী । একটু আসবে ?
- ও স্যার । যাই । বলুন ।
- আত্রেয়ী ?
- আজ আত্রেয়ী আসেনি স্যার । মালিককে ফোন করেছিল । শুনলাম ওর জ্বর । আপনি কোথায় ছিলেন এই দুদিন ? আপনার জন্য অপেক্ষা করে কাল সবার শেষে বাড়ি গেছে ।
- ওহ মাই গড ! তুমি ওর বাড়ি চেনো ?
- না স্যার । তবে শ্যামল চেনে । দাঁড়ান , শ্যামলকে ফোন করে জেনে নিই ।
ফোনে কথা হল । স্যার ও মেসেজ পাঠাচ্ছে ।
- লিখে নিন স্যার ।
- লিখে নিন মানে ? তুমিও যাবে আমার সাথে ।
ননীর আপত্তি সত্বেও অমলেন্দু জোর করে নিয়ে গেল । একতলা বাড়ি । বাড়ির কলিং বেল বাজাতে এক বৃদ্ধা দরজা খুলে দিলেন ।
- কাকে চাই ?
পিছন থেকে ননী এগিয়ে এসে বলল , মাসীমা চিনতে পারছেন না ? আত্রেয়ীকে দেখতে এসেছি ।
- চোখের জোর কমে গেছে বাবা । চিনতে পারিনি । কালই তো এসেছিলে তুমি । যাও ভিতরের ঘরে আছে আত্রেয়ী । সঙ্গের এই বাবাটিকে চিনতে পারলাম না । দোকানে তোমাদের সঙ্গে কাজ করে ?
- হ্যাঁ ।
ঘরের বাইরে এসে ননীই ডাকলো , আত্রেয়ী ।
- কে ? ননী ? ভিতরে এসো ।
- সঙ্গে আরও একজন আছে ।
- শ্যামলদা ? এসো এসো ।
অমলেন্দুকে দেখেই আত্রেয়ীর চোখে মুখে বিস্ময় ।
- স্যার । আপনি ? এখানে কীভাবে ?
উত্তরটা ননীই দিয়ে দিল ।
- কাল তোর মতো স্যার আজ পথ চেয়ে বসে ছিলেন । আমি জানি না তোদের মধ্যে কী ব্যাপার । মিটিয়ে নে ।
আত্রেয়ী শুরু করল , আমার আগে আমার এক দিদি আছে । বিয়ে হয়েছিল বছর দুয়েক আগে । লাভ ম্যারেজ । বেশ কয়েক বছরের প্রেম । বছর ঘুরতে না ঘুরতেই জানা গেল জামাইবাবুর অফিসের এক কলিগের সাথে ঘনিষ্ঠতা হয়েছে । বাড়িতে ঝামেলা । তারপর দিদি এখানেই চলে এলো । বাড়িতে একটা গুমোট আবহাওয়া রয়েছে সবসময় । এরপর আমার পক্ষে সম্ভব নয় স্যার । আমাকে ক্ষমা করে দিন । বলেই চুপ করে গেল । চোখের দুপাশ দিয়ে জলের স্রোত বইতে লাগলো ।
ঘরের মধ্যে এক আশ্চর্য নীরবতা নেমে এসেছে । তিনটি প্রাণীর শ্বাস-প্রশ্বাস ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না । ঘরটা যেন এক অন্য কোন গ্রহে অবস্থিত । নীরবতা ভেঙে অমলেন্দু বলল , আমার উত্তর আমি পেয়ে গেছি । তোমার চোখের জল বোলে দিচ্ছে তুমি কী চাও । আমি তোমাকে সেদিনও জোর করিনি , আজও করছি না । তবে তোমাকে এটা বলতেই পারি আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না । কারণতা খুব সিম্পল । তোমাকে ছাড়া এই দুটো দিন কীভাবে কাটিয়েছি সেটা আমি ছাড়া কেউ জানে না । আর তোমার অবস্থাটা আমি দেখতেই পাচ্ছি । হয়তো আমি খুব তাড়াতাড়ি তোমার কাছে মনের ভাব প্রকাশ করে দিলাম । তোমার সন্দেহ হতে পারে আমাকে নিয়ে । তবে আমি বলছি আমাকে প্লিজ ছেড়ে যেও না ।
আজ অমলেন্দুর কথাগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে । একদিন এই অমলেন্দু সব কিছু মানিয়ে চলার চেষ্টা করে বঞ্চনা , প্রতারণা ছাড়া কিছুই পায় নি । আজ পেয়েছে সত্যিকারের ভালোবাসা । নির্ভেজাল ভালোবাসা । কৃত্তিম নয় । প্রায় এরকম অবস্থা আত্রেয়ীরও । যদিও তার জীবনে প্রথমবার ভালোবাসার ছোঁয়া লেগেছে । মানুষটাও নির্ভরতা দিতে পারবে বলে মনে হচ্ছে । পাশে থাকতে পারবে । ঘরের নীরবতা ভেঙে ননী বোলে উঠলো ,
- আমি দুজনকেই বলছি , আমি বর আর কনেযাত্রী দুটোতেই যেন নেমন্তন্ন পাই । আত্রেয়ী নিশ্চিত কাল থেকেই কাজে যাচ্ছে । সুতরাং কালই আমার দুজনের কাছ থেকে ট্রিট চাই । আর আমি আপনাকে আর স্যার বলে ডাকতে পারবো না । অমলেন্দুদা বলব । আশা করছি আপনার আপত্তি নেই ।
আত্রেয়ী অমলেন্দুর মুখের দিকে তাকিয়ে একটা মিষ্টি হাসির ছোঁয়া দিল । ঘরের গুমোট ভাবটা এখন আর নেই । এর পরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত । অমলেন্দু মনামীর কথা আত্রেয়ীকে বলে দিয়েছিল । সম্পর্কের মধ্যে কোনও লুকোছাপা রাখতে চায়নি অমলেন্দু । আত্রেয়ীও বুঝেছিল । আত্রেয়ীর জামাইবাবুর সঙ্গে দেখা করেছিল অমলেন্দু । বুঝেয়েছিল । এখন দিদিও তার শ্বশুরবাড়িতে ফিরে গেছে । বিয়েতে ননীর দুপক্ষ থেকেই নেমন্তন্ন হয়েছিল । আজ শ্রীময়ীর মুখেভাত । শ্রীময়ী অমলেন্দু আর আত্রেয়ীর একমাত্র মেয়ে। ভাত খাওয়াবে একমাত্র মামা ননী। আপনাদেরও নেমন্তন্ন। আসবেন কিন্তু।