প্রকৃত সাধনা
প্রকৃত সাধনা
রুমি রাতের খাওয়া সেরে বিছানায় শুতে গেল | কাল ওর জন্মদিন | প্রতিবারের মতো এবারেও ওর দাদু ওকে নিয়ে মন্দিরে যাবেন পুজো দিতে | তাই সকাল সকাল উঠতে হবে | প্রতিবার দাদু মন্দিরে পুজো দিয়ে রুমির পছন্দ মতো কেক কিনে বাড়িতে ফেরেন | রাতের বেলায় সেই কেক রুমির জন্মদিনের পার্টিতে রুমি কাটে |
পরদিন সকাল হতেই দাদুর ডাক পড়ে | " ওঠো দিদিভাই, আমাদের বেরোতে হবে তো " |
রুমি ঘুম থেকে উঠে পড়ে তাড়াতাড়ি স্নান করে দাদুর সাথে বেরিয়ে পড়ে |
" আজ দিদিভাই, তোমার জন্য একটা সারপ্রাইস আছে | "
" কি সারপ্রাইস দাদু?? "
" চলো, গেলেই দেখতে পাবে | "
রুমির মধ্যে একটা উত্তেজনার সৃষ্টি হয় | কি সারপ্রাইস দেবে দাদু??
এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা মন্দিরে চলে আসে | কিন্তু মন্দিরে ঢুকেই রুমি অবাক হয়ে যায় | তার মতনই অনেক ছোট ছোট শিশুর দল তাদের অভিভাবকদের সাথে আসছে, একটা হলের ভিতরে তাদের ঢুকিয়ে দিয়ে বড়োরা বাইরে বেরিয়ে আসছেন |
" এখানে কি হচ্ছে দাদু?? "
" ভেতরে গেলেই সব বুঝতে পারবে | "
ভিতরে ঢুকে রুমির চক্ষু চড়কগাছ | এ কি দেখছে সে !! হলের মঞ্চ আলো করে বসে আছেন সব দেব দেবী | আর তাঁদের সামনে রুমির মতনই সব কচি কাচার দল |
" এখানে কি হবে দাদু?? "
" আলোচনা, কথাবার্তা, গল্প | সামনের মঞ্চে যারা বসে আছেন তারা সত্যিই ভগবান | আজ উনারা সবাই স্বর্গ থেকে নেমে এসেছেন তোমাদের মতো ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের সাথে গল্প করবেন বলে | এখানে বড়োদের থাকার অনুমতি নেই | "
" কেন?? "
" কারণ শিশুরা নিষ্পাপ মনের হয় | বড়োদের মনে ছল থাকে | তারা ঈশ্বরের সাথে খোলা মনে কথাই বলতে পারবে না | ঈশ্বরের কাছে বড়োরা হয় দাবি করে, না হয় ভিক্ষে করে | ভগবানের এসব ভালো লাগে না | তাই তারা আজ তোমাদের সাথে গল্প করবেন | ভয় পেয়োনা যেন দিদিভাই | ঈশ্বরের সাথে মুক্ত মনে কথা বলো, দেখবে, তারাই বলে দেবেন ঈশ্বর কি এবং তাদের কোথায় কি ভাবে পাওয়া যায় |"
এই বলে দাদু তো বেরিয়ে গেলো | কিন্ত রুমির ভীষণ ভয় করছে | তার কোনো ভুল প্রশ্নে যদি ভগবান রেগে জান !! রুমি ঠাম্মির কাছে শুনেছে, ভগবানকে রুষ্ট করতে হয় না, পাপ লাগে |
" কি ভাবছো রুমি সোনা?? "
হঠাৎ সম্বিত ফেরে রুমির | দেখে, বিষ্ণু দেব তার হাতের চক্রটাকে নিয়ে খেলা করতে করতে তার সাথে কথা বলছেন |
রুমি সাহস করে জিজ্ঞেস করে, " আপনারা সবাই রিয়েল ভগবান? "
মঞ্চে বসে থাকা সব ভগবান এক সাথে হেসে ওঠেন | " তোমার কি মনে হয়, আমরা নকল?? "
পাশ থেকে আর একটি বাচ্চা বলে ওঠে, " ঈশ্বরকে এ ভাবে দেখা যায় নাকি !! ঈশ্বর তো মন্দিরে থাকে | এক একজন ভগবানের এক একটা আলাদা আলাদা মন্দির |"
" না সোনা, ঈশ্বর মন্দিরে থাকে না | ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজ করেন | জগতে যা কিছু শুভ, তার সব কিছুর মধ্যেই ঈশ্বরের অবস্থান | "
প্রশ্ন ওঠে, তাহলে মন্দিরগুলিতে কারা প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছেন?? "
" মন্দিরে মানুষের তৈরী বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত | সেখানে বিগ্রহকে সামনে রেখে মানুষ ঈশ্বরের সাধনা করে | "
মঞ্চে উপস্থিত সকল ভগবান বলে ওঠেন, " মানুষ বড়ো বড়ো মন্দির বানায়, আমাদের মূর্তি যেন না ভেজে | অথচ যে অভাবীর মধ্যেই আমার বাস, তারাই ঠান্ডা, বৃষ্টিতে কষ্ট পায় | "
সত্যি তো !! এটা তো কখনো রুমি ভেবে দেখেনি |
সত্যিই তো | এত বড়ো মন্দির খুলে দিতেই পারে গরিব দুঃখীদের জন্য | অন্তত বর্ষাতে, ঠান্ডাতে মানুষগুলিকে একটু মন্দিরে থাকতেই দেওয়া যায় |
" ঈশ্বর মূর্তিতে থাকতেও পারে, নাও পারে | কিন্তু তোমাদের সকল শুভ কাজে আমাদের অবস্থান | তোমাদের ভালো আচরণে আমরা থাকি, তোমাদের দয়াশীল ব্যবহারে আমরা থাকি | তোমরা যখন কোনো আর্তের সেবা করো, যখন তৃষ্ণার্তের তৃষ্ণা মেটাও, যখন প্রয়োজনীর প্রয়োজন মেটাও, আর নিরীহ দুর্বলকে বিপদ থেকে রক্ষা করো, তার সব, সব কিছুর মধ্যেই তোমরা ঈশ্বরকে খুঁজে পাবে | "
হলের মধ্যে একটি বাচ্চা মেয়ে বসেছিল | সে হঠাৎ বলে ওঠে, "এই যে শিবরাত্রির দিন শিব ঠাকুরকে এত দুধ দিয়ে স্নান করানো হয়, কেমন ফিলিংস হয় শিব ঠাকুরের?? "
" তোমরাই বলো কেমন লাগতে পারে?? তোমাদের যদি দুধ দিয়ে স্নান করানো হয়, তোমাদের কেমন লাগবে?? "
p>
" যে দুধ খাওয়ার জন্য, তাকে যদি স্নানের জন্য অপব্যয় করা হয়, সেটা কি ভাবে শুভ কর্ম হয়?? আর শুভ জিনিস যেখানে নেই, সেখানে ঈশ্বর থাকেন কি করে?? "
লাল ফ্রক পরা আর একটি মিষ্টি মেয়ে বলে ওঠে, " এই যে তোমরা এত মিষ্টি খাও, তোমাদের সুগার হয় না?? আমার দিদা তো চায়েও চিনি খেতে পারে না | "
" হতো তো | অবশ্যই সুগার হতো | কিন্তু যদি এত মিষ্টি আমরা খেতাম, তবে হতো | ভেবে দেখতো, তোমাদের মা ঠাকুমারা যে ভোগ দেন আমাদের, আমরা কি সেগুলি খাই?? "
" তোমরা তো তোমাদের দৃষ্টি দিয়ে খাও | ঠাকুমা তো তাই বলে | "
" সত্যি কি দৃষ্টি দিয়ে খাওয়া যায়?? আমরা যদি খেতাম তাহলে আমাদের কেউ আর ভোগ চড়াতো না | "
" তোমরা বাড়িতে পুজো করো, এত এত ভোগের ব্যবস্থা করো | আর কাদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়াও, যারা খেতে পারে, যাদের খাবার জোগাড় করার ক্ষমতা আছে | রাস্তার ভিখারি, গরিব মানুষগুলিকে খাওয়াতে পারলে জানবে ভগবানকে সত্যিই নিবেদন করতে পেরেছো | "
ছোটরা পুতুল নিয়ে খেলা করে, আর বড়োরা ভগবানের মূর্তি নিয়ে |
এর মধ্যেই একজন দাদা জিজ্ঞেস করে, " আচ্ছা, ধর্ম কি?? "
" ধর্ম তোমার নীতি, তোমার রীতি | তুমি যে কাজ করছো, সেটা তোমার কর্ম | আর সেই কর্মকে তুমি যে নিয়মে করছো, সেটাই তোমার ধর্ম |"
" ঠিক বুঝলাম না " |
" তোমরা সবাই এখন কারিগর | নিজেদের জীবন গড়ার কারিগর | নিষ্ঠা সহকারে লেখাপড়া করা, বড়োদের সম্মান দেখানো, ভুল করলে তার সংশোধন করা, এগুলি সব তোমাদের কর্ম | আর যে মানসিকতা নিয়ে, যে আগ্রহ নিয়ে করবে এগুলি সেটাই হবে তোমাদের ধর্ম | নিজেকে জানা, নিজেকে চেনা তোমাদের ধর্ম | "
" তোমার বাড়িতে যে কাজ করে তাকে তোমার জন্মদিনে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হচ্ছে তোমার কর্ম, আর সেই কাজটা ভাবা হচ্ছে তোমার ধর্ম | "
" বাড়িতে যে যাই বলুক, তোমাদের বিবেকেই আমরা আছি | তোমাদের মধ্যেই আমাদের বাস | "
" বিবেক কি?? "
" বিবেক তোমাদের মন, তোমাদের চিন্তাশক্তি | বিবেককে সব সময় আলোর মতো ব্যবহার করো | আত্মবিশ্লেষণের চেয়ে বড়ো কিছু হয় না | কোনো কাজ করার আগে নিজেকে প্রশ্ন করো, যা করছো সেটা ঠিক না ভুল?? "
"আচ্ছা, আমরা মাঝে মধ্যেই শুনি, ভগবানের পুজো না করলে ভগবান পাপ দেয় | তোমরা কি সত্যিই পাপ দাও?? "
" ঈশ্বর পুজোতে তুষ্ট হন না, তুষ্ট হন সাধনাতে | আর সাধনা করতে ভগবানের মূর্তির সামনে বসে পুজো করার দরকার নেই | সে যখন খুশি, যে ভাবে খুশি ভগবানকে ভালোবাসা যায় | "
" মানুষের মনে আঘাত দেওয়া হচ্ছে পাপ, কারোর বিশ্বাসে আঘাত হানা পাপ | তাতে ঈশ্বর রুষ্ট হন | ভগবানের পুজো না করলেও ভগবান রুষ্ট হন না " |
রুমির কেমন ঘোরের মতো লাগছিলো | এত দিন ধরে সে যা জেনেছিল, তার বেশির ভাগটাই তো ভুল !! ভগবানকে আমরা যে ভাবে জেনে এসেছি, তারা আদৌ তা নয় |
রুমি ঠিক করে, এবার থেকে ওর জন্মদিনে ওর সব বন্ধুদের সাথে কাকলি মাসির মেয়ে কবিতাকেও নিমন্ত্রণ করবে | হোক না কবিতা কাজের মাসির মেয়ে, সে মানুষ তো !!!"
এমন সময় দাদু পাশে এসে দাঁড়ায়, বলে, " দিদিভাই, ওঠো এবার | যেতে হবে তো | "
দাদুর ডাকে রুমির ঘোর কাটে | সে তাকিয়ে দেখে বিছানায় মাথার পাশে তার দাদু বসে আছেন |
" ওঠো দিদিভাই | উঠে স্নান করে নাও | মন্দিরে যেতে হবে তো |"
রুমি এত ক্ষণে বুঝতে পারে যে, সে স্বপ্ন দেখছিল | কিন্তু তার এত ভালো লাগলো স্বপ্নের কথা ভেবে | বিছানা থেকে উঠে দৌড়ে মায়ের কাছে গেলো, " মা, আজ সন্ধ্যা বেলায় কাকলি মাসি আর কবিতাকেও বলবে?? আমার খুব ভালো লাগবে |"
" বেশ তো, কাকলি মাসি এলে তুই বলে দিস | "
মায়ের সায় পেয়ে রুমির মনটা আনন্দে ভোরে গেলো |
স্নান সেরে দাদুর সাথে বেরোলো রুমি | দাদুকে বলল, " একটু বেশি মিষ্টি কিনবে দাদু?? "
" কেন দিদিভাই? "
" আজ আমরা মন্দিরে ভিতরে পুজো দেবো না | মন্দিরের বাইরে যে গরিব মানুষগুলি বসে থাকে তাদের মিষ্টি খাওয়াবো | "
দাদু একটু অবাক চোখে তাকাতেই রুমি দাদুকে তার স্বপ্নের কথা বলল | দাদুও আর আপত্তি করলো না |
আজ প্রথম রুমির জন্মদিনে রুমি এত আনন্দ পেলো| সে প্রথম উপলব্ধি করলো প্রকৃত সাধনার সংজ্ঞাকে !!