Sukdeb Chattopadhyay

Abstract

5.0  

Sukdeb Chattopadhyay

Abstract

পরিত্রাণ

পরিত্রাণ

11 mins
699


এমনটা হবার কথা নয়। মানুষের চরিত্র অনেকটাই জেনেটিক ব্যাপার। বাবা-মার তো কথাই নেই, দাদু-ঠাকুমা, পিসি, সকলেই খুব শান্ত  প্রকৃতির। ভাল ব্যবহারের জন্য পাড়ার সবাই তাদের পছন্দ করে। সেই বাড়ীতেই এখন গেল গেল রব। আত্মীয় স্বজনরা আসা কমিয়ে দিয়েছে। প্রতিবেশীরা কোন দরকারে এলেও চট করে বাড়ীতে ঢোকে না । বাইরে থেকেই কাজ সেরে চলে যাবার চেষ্টা করে। “কুকুর হইতে সাবধান” লেখা বাড়ীর মত। বাড়ীর ভেতরটা একেবারেই নিরাপদ নয়। অন্তত কিছু ভুক্তভোগীর তাই অভিজ্ঞতা। ভয়ের কারণটা অবশ্য কুকুর নয়, মানুষ। রঞ্জন আর স্বপ্নার ছয় বছরের ছেলে বিল্টু। এইটুকু বয়সেই সে বহু কীর্তির অধিকারি। বাড়ীতে কাঁচের জিনিস খুব কমই অক্ষত আছে। জানলার কাঁচগুলোও রেহাই পায়নি। বাড়ীর কাজের লোকও এক এক করে বিদায় নিয়েছে। প্রায় দশ বছরের পুরনো কাজের বউ হঠাৎই শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে কাজ ছেড়ে দিল। অথচ অন্য বাড়ীগুলোতে দিব্যি কাজ করছে। পরের জন মাস খানেক টিকেছিল। এক সপ্তাহে দুবার তার একপাটি করে চটি খোয়া গেছে।

মাসের মাইনেটা পাওয়ার পর বলেছিল---বউদি অন্য লোক দ্যাখেন। আমি আর আসছি না। আপনাদের বাড়িতে চোর আছে। কাজের লোককে চোর অপবাদ দিয়ে তাড়ানোর ঘটনা মাঝে সাঝে শোনা যায়, কিন্তু কাজের বউ বাড়ীর লোককে চোর সাব্যস্ত করে কাজ ছেড়েছে এমনটা বোধহয় কেউ শোনেনি। কিছুদিন বাদে বাড়ির পাশের ঝোপ ঝাড় পরিষ্কারের সময় দুপাটি চটির খোঁজ পাওয়া গেল। এরপর অনেক চেষ্টা করেও আর কোন কাজের লোক জোটেনি।

আগে অফিসের সহকর্মীরা ছুটির দিনে মাঝে মাঝে বাড়ীতে আসত । সারাদিন গল্প, আড্ডা, ভালমন্দ খাওয়া দাওয়া করে সুন্দর কাটত। একবার রঞ্জনের শরীরটা একটু খারাপ হওয়ায় অফিস থেকে অরুণ আর অসিত খোঁজ খবর নিতে এসেছে। ব্যাগ গুলো পাশে রেখে ওরা রঞ্জনের সাথে গল্প করছে, এমন সময় বিল্টু গুটি গুটি পায়ে ঘরে ঢুকে অতিথিদের কাছে এসে বসল। অরুণ আদর করে জিজ্ঞেস করল--- বাবু, তোমার নাম কি ?

কোন উত্তর নেই। যে উত্তর দেবে তার নজর তখন অরুণের নীল রং এর সুন্দর ব্যাগটার দিকে পড়েছে। এরপর আস্তে আস্তে ব্যাগটাকে নেড়েচেড়ে দেখতে শুরু করতেই বিপদ বুঝতে পেরে রঞ্জন ছেলেকে ধমক দিয়ে ঘর থেকে চলে যেতে বলল।

---আহা বাচ্চাকে ওভাবে বকছ কেন? ও একটু ব্যাগে হাত দিয়েছে তো কি হয়েছে? অরুণ রঞ্জনকে বাধা দিল।পরের অধ্যায়টা জানে বলেই রঞ্জনের অত আতঙ্ক। বেশি সময় লাগল না। ব্যাগটা খোলবার দু একবার চেষ্টা করেও কায়দা করতে না পেরে পাশ থেকে মারল এক টান। সেলাইটা বোধহয় কমজোরি ছিল। পড়পড় করে ছিঁড়ে গিয়ে ব্যাগের ভেতরের সব জিনিসপত্র মাটিতে ছড়িয়ে পড়ল। বিল্টু তার থেকে একটা পেন আর খাতা হিসেবে চেক বইটা তুলে নিয়ে হিজিবিজি কাটতে কাটতে ঘর ছেড়ে পালাল। পুরো ব্যাপারটা নিমেশের মধ্যে ঘটল। বাচ্চাকে আশকারা দেওয়ার ফল যে এতটা মারাত্মক হবে অরুণ তা ভাবতেও পারেনি। স্বপ্না যখন ছেলেকে দুঘা দিয়ে চেক বই আর পেনটা অরুণকে ফেরত দিল তখন দুটোই ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেছে। খবরটা জানাজানি হওয়ার পর থেকে অফিসের কেউ আর ও মুখো হয় না।

স্বপ্নাই চেষ্টা চরিত্র করে কাছাকাছি একটা ভাল স্কুলে ক'মাস আগে ছেলেকে ভর্তি করেছে। যতক্ষণ স্কুলে থাকে ততক্ষণ শান্তি। তবে এ সুখও বোধহয় বেশিদিন কপালে নেই। এর মধ্যেই বেশ কটা হাতাহাতি আর কামড়ে দেওয়ার চার্জ ঝুলছে। স্কুলের সেক্রেটারি চেনেজানা বলে এখনও সহ্য করছে। তবে এভাবে আর ক'দিন চললে স্কুলে খুব বেশিদিন রাখবে বলে মনে হয় না।


প্রথম দিকে রঞ্জন বা স্বপ্না ছেলেকে দু একঘা দিলে দাদু-ঠাকুমা “আহা ও অবোধ শিশু, ওকে মেরো না” বলে কাছে টেনে নিতেন। দুজনের দুটো চশমা ভাঙার পরও বলতেন—একটু দুরন্ত বাচ্চা, বড় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। দাদু ঠাকুমার কাছে নাতি নাতনী বড়ই আদরের ধন। কিন্তু নাতির ধাক্কায় পড়ে গিয়ে ঠাকুমার মাথায় দুটো সেলাই হওয়ার পর থেকে দুজনেই ওর থেকে একটু দূরে থাকার চেষ্টা করেন। কিন্তু ওনারা সরে থাকলে কি হবে, বিল্টু দাদু ঠাকুমাকে একদম কাছ ছাড়া করে না। দুপুর বেলা একটু ঘুমলেই নাকে বা কানে কিছু ঢুকিয়ে খুঁচিয়ে তুলে দেওয়া থেকে আরম্ভ করে সারাদিন নানাভাবে উত্যক্ত করে। বাবা মাকেও যে জ্বালায় না তা নয়, তবে ওখানে মারের ভয় আছে বলে একটু সমঝে চলে। এসবের প্রতিকারের যা যা টোটকা আছে যেমন, পুলিশের ভয়, ভূতের ভয়, হস্টেলে ভর্তি করে দেওয়ার শাসানি, স্বপ্নারা সবই প্রয়োগ করেছে, কিন্তু সামান্যতম ফলও পায়নি। পুলিশ আর ভূতকে ভয় পাওয়া দূরে থাক, তাদেরকে দেখবে বলে বাবা মাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। সে আর এক যন্ত্রণা। আর হস্টেলে পাঠানোর মধ্যে একটু বিপদের গন্ধ পেয়ে সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে হস্টেলের মাস্টারদের মেরে মাথা ফাটিয়ে দেবে। অসম্ভব নয়। যে ছেলে ঠাকুমার ওই অবস্থা করতে পারে তার পক্ষে ওটাও সম্ভব। অনেক মানত, পাথর, কবচ, শেকড়েও কোন লাভ হয়নি। একমাত্র মারেতেই খানিকটা কাজ হয়, তাও খুব অল্প সময়ের জন্য। বেড়ালের মত, আড়াইপা গেলেই ভুলে যায়।

 

কোন কিছুতেই যখন সুরাহা হয়নি তখন স্বপ্না দুঃখ, কষ্টের কথা জানিয়ে পরমানন্দ স্বামীকে চিঠি লিখেছিল। পরমানন্দ স্বপ্নার বাপের বাড়ির গুরু। উত্তরপ্রদেশের লোক। হরিদ্বারে আশ্রম আছে। পশ্চিমবঙ্গে স্বপ্নাদের মত বেশ কিছু শিষ্য আছে, তাই প্রয়োজনের তাগিদেই ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে পারেন। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ির লোকেরা রঞ্জনকে একবার স্বামীজীর কোলকাতার আখড়ায় নিয়ে গিয়েছিল। অস্বস্তিকর বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে এসে স্বপ্নাকে রঞ্জন বলেছিল--- দেখ, তোমার গুরুর কাছে তুমি যতবার খুশি যাও আমার কোন আপত্তি নেই, কিন্তু আমাকে আর এর মধ্যে টেনো না। স্বপ্নাও স্বামীকে এ ব্যাপারে আর কখনো অনুরোধ করেনি। তবে বিভিন্ন পালা পার্বণে রঞ্জনের কাছ থেকে আদায় করে আশ্রমে প্রায় নিয়মিত টাকা পাঠায়। ভাল লাগুক বা না লাগুক রঞ্জন কখনো না করেনি।

শুনছ, গুরুদেবের চিঠি এসেছে। আগামী মাসে কোলকাতায় আসছেন---খুব উৎফুল্ল  হয়ে স্বপ্না জানাল।

---হুঁ ।

---হুঁ কিগো ! আমাদের বাড়িতে এবার পদধূলি দেবেন। এক আধ দিন থাকবেনও । আসলে বিল্টুর কথা লিখেছিলামতো তাই--- ব্যাপারটা রঞ্জনের পছন্দ না হলেও কোনরকম বিরক্তি প্রকাশ করল না।

---ভাবছি মাঝের ঘরটাতেই ওনার থাকার ব্যবস্থা করি। আসলে এখন থেকে গোছগাছ না করলে হবে না। মাঝে তো আর কটা দিন।

রঞ্জন চুপ করে থাকে। স্বপ্না তাতে বিন্দুমাত্র হতোদ্যম না হয়ে বিছানায় গেরুয়া চাদর , জানলায় গেরুয়া পরদা, পাথরের থালা বাটি গ্লাস ইত্যাদিতে ঘর সাজাতে লেগে পড়ল। রঞ্জন শান্তিপ্রিয় মানুষ। একে ছেলেকে নিয়ে অশান্তির শেষ নেই, তার ওপর বউ এর গুরুসেবায় বাধা দিয়ে নতুন করে আর অশান্তি বাড়াতে চায়নি। তাই এসব তার কাছে অপচয় মনে হলেও কোন আপত্তি করেনি।

 

রাতের খাওয়াটা বাড়ির সকলে একসাথেই করে। বাবা মার সাথে ছেলে আর বৌমার সম্পর্ক খুবই ভাল। গল্প গুজব, হাসি মস্করা করে ওই সময়টা সকলের বেশ ভালই কাটে। সেদিন খাওয়ার টেবিলে অমিয় ছেলের উদ্দেশ্যে কথাটা পাড়লেন--- অনেকদিন কোথাও বেরোনো হয়নি বুঝলি। ভাবছি ক'দিন একটু ঘুরে আসি। তোর মায়ের শরীরটাও তেমন ভাল যাচ্ছে না। জলহাওয়া পরিবর্তন হলে একটু উপকার হত।

---কোথায় যাবে কিছু ঠিক করেছ ?

---না, এখনও সেরকম ভাবে কিছু ভাবিনি। প্রথমে কদিন পাটনায় থাকব। মঞ্জু, বিকাশরা ( রঞ্জনের দিদি আর জামাইবাবু ) বারে বারে বলে, যাওয়া হয়ে ওঠে না। তারপর ওখানে গিয়ে ঠিক করব দু পাঁচদিন কাছাকাছি কোথায় যাওয়া যায়।

---খুব বেশিদিন যেন বাইরে থাকবেন না বাবা। আমাদের ভাল লাগবে না। আর বাবা গুরুদেব আসার আগে কিন্তু ফিরে আসবেন।

---বৌমা, বড়জোর দিন পনের। স্বপ্নাই সব গোছগাছ করে দিল। কিন্তু পনের দিনের জন্য বেরিয়ে প্রায় একমাস হল তাঁদের ফেরার নামটি নেই। ফোনে কুশল বিনিময় হয় কিন্তু ফেরার কথা উঠলেই অমিয় কায়দা করে এড়িয়ে যান। মুখে বেড়ানোর কথা বললেও এখন স্বপ্নারা বুঝতে পারে যে আসলে তাদের ছেলের জ্বালাতেই বাবা মা বাড়ি ছেড়েছেন। লজ্জায় লোকের কাছে মুখ দেখান দায়। বদ ছেলে বা দজ্জাল বৌমার জন্য অনেকে বাড়িছাড়া হয় বা বৃদ্ধাশ্রমে যায়, কিন্তু আদরের নাতির দৌরাত্মে দাদু ঠাকুমাকে ঘর ছাড়তে হয়েছে এ ভাবাও যায় না।

 

যথাসময়ে পরমানন্দ স্বামী এলেন। স্বপ্নাই গিয়ে গাড়ি করে আখড়া থেকে তাঁকে বাড়িতে নিয়ে এসছে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করলেন---রঞ্জন বাবাজী কুথায়?

---বাবা সে তো অফিস গেছে।

---আর তুহার বেটা ?

---এই যে বাবা।

ঘর থেকে নড়া ধরে টানতে টানতে নিয়ে এসে স্বপ্না ছেলেকে গুরুর সামনে হাজির করল। বিল্টুর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে পরমানন্দ বললেন- এতোটুকু বচ্চার জোন্যো এতো পরেশান হোচ্ছিস কেনো ? ধিরজ সে কাম লে বেটি। হামি এসে গেছি সোব ঠিক কোরে দিবো ।

“তাই যেন হয় বাবা” বলে স্বপ্না গুরুর পায়ে নিজেও মাথা ঠেকাল আর ঘেঁটি ধরে বিল্টুকেও শুইয়ে দিল। হাত মুখ ধুয়ে পরমানন্দ ঘরে চৌকিতে গিয়ে বসলেন। খবর পেয়ে বাইরের কিছু লোকও সাধু দর্শনে এসেছেন।

ছেলেকে গুরুর পাশে বসিয়ে স্বপ্না অনুরোধ করল--- বাবা, গায়ে মাথায় একটু জপ করে দিন যাতে ছেলেটা মানুষ হয়। তারপর গুরুর সন্ধ্যা পূজার ব্যবস্থা করতে লাগল।

---বেটি তু বহুত ভাগ্যাবতি আছিস।

এই দুঃসময়ে সৌভাগ্যের কথা শুনে পূজোর যোগাড় করতে করতেই ভক্তি গদগদ চোখে স্বপ্না গুরুর দিকে চাইল।

---ই তো তুহার কিষণ বেটা আছে। কিষণ ভগবান ভি ছুটো বেলায় বহুত্ নট্ খট্ ছিলো। মাকে তংগ কোরতো। তু তো বেটি যশোদা মইয়া আছিস। বোড়ো হোয়ে তুহার ইয়ে বেটা পুরো দুনিয়াকা দেখভাল কোরবে।

যাকে নিয়ে এত ভাল ভাল কথা হচ্ছে সে তখন প্রবল অনিচ্ছায় ভাল মানুষের মত বসে আছে। একে বাইরের লোকজন দেখে একটু ঘাবড়ে গেছে তার ওপর স্বাস্থবান পরমানন্দ তার একটা হাত শক্ত করে ধরে আছেন। কিছুটা সময় ওই ভাবে বসে থাকার পর বিল্টু একটা ঝটকা মেরে হাতটা ছাড়িয়ে পালাবার চেষ্টা করতেই গুরুদেব ওকে আরো কাছে টেনে নিয়ে বললেন---কিষণ বেটা, এখোন তো যাওয়া হোবে না। এখোন পূজো হোবে, আরতি হোবে, পরসাদ খাবে, তারপোরে যাবে।

কিছুক্ষণ পরেই ঘটে গেল ভয়ানক কাণ্ড। গুরুদেবের গেরুয়া লুঙ্গি খুলে মাটিতে পড়ে আছে। পরনে শুধু কৌপীন। আর কবজি দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। বিল্টু হাওয়া। চকিতের মধ্যে ঘটনাটা ঘটে গেছে।

আর্তনাদের মত স্বামীজীর গলা পাওয়া গেল--- তুমাদের মোতো ভালোমানুষের ঘোরে এরোকোম জানবর (কিছুক্ষণ আগের কিষণ বেটা) পয়দা হোলো কি কোরে?

পরের দিন কাকভোরেই পরমানন্দ স্বপ্নাদের বাড়ি থেকে পাততাড়ি গোটালেন।

স্বপ্নার শেষ ভরসাও শেষ। ছেলেকে শুধরোবার আর কোন উপায় তাদের জানা নেই। নিজেদের বড় অসহায় লাগে। একমাত্র সন্তান, দূর করেও তো দিতে পারে না। সবই কপাল। এর মধ্যে আবার অশোকরা কয়েকদিন এসে থাকবে। অশোক রঞ্জনের বহুদিনের বন্ধু। চাকরি সূত্রে নিউজিল্যান্ডে থাকে। মাস খানেকের জন্য কোলকাতায় এসেছে। তারই মধ্যে সময় বার করে বউ আর ছেলেকে নিয়ে দেখা করতে আসবে। অশোকের ছেলে বিল্টুর থেকে বছর খানেকের বড়। এমনিতে খুবই আনন্দের কথা, কিন্তু এখন যা বাড়ির অবস্থা তাতে স্বপ্নাদের চিন্তা আরো বাড়ল। যে এক আধ জনের সাথে এখনও সম্পর্ক টিকে আছে সেটাও বোধহয় আর থাকবে না। আসতে মানাও করা যায় না। বিল্টু বড়দেরই নাকানি চোবানি খাওয়াচ্ছে আর অশোকের বাচ্চাটার যে কি হাল করবে ভাবলেই আতঙ্ক হচ্ছে। দুজনেই বাবা বাছা করে ছেলেকে অনেক বোঝাল। বিল্টু মন দিয়ে সব শুনল। কম কথার মানুষ। কাজে বিশ্বাসী। হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না। 


পরেরদিন সকালে কলিং বেল বাজতে স্বপ্না দরজা খুলে দেখে অশোক, রূপা আর তাদের ফুটফুটে ছেলে রাজা। রাজা বাবার হাত ধরে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখলেও ভাল লাগে। সবই কপাল---আরে অশোকদা, আসুন আসুন। রূপা এস, আমার রাজা সোনা এস।

ডাকতেই রাজা বাধ্য ছেলের মত স্বপ্নার কাছে চলে এল। ফর্সা রং, সুন্দর স্বাস্থ, দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। ভেতর থেকে দুটো চোখ পুরো ব্যাপারটার ওপর নজর রাখছিল। রূপা বিল্টুকে কাছে ডাকতেই ও কোন উত্তর না দিয়ে ওখান থেকে চলে গেল। স্বপ্না বকা দিতেই রূপা বাধা দিয়ে বলল---আহা ছেলেমানুষ, ওকে বকছ কেন ? নতুন লোক দেখে লজ্জা পেয়ে চলে গেছে।

অনেকটা রেখেঢেকেই স্বপ্না বলল- যা দুরন্ত হয়েছে বলার নয়।

--ও একটু বড় হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

-- হলেই বাঁচি।

অপ্রীতিকর পরিস্থিতি থেকে বাঁচার জন্য রঞ্জন অশোককে আগেই জানিয়েছিল যে মা-বাবা বেড়াতে গেছেন। কবে গেছেন আর কবে ফিরবেন তার কোন উল্লেখ অবশ্য করেনি। বড়রা যখন গল্পে মত্ত রাজা তখন নতুন বাড়ির এধার ওধার ঘুরতে ঘুরতে একটা ছোট ঘরে ঢুকে পড়েছে। বিভিন্ন আকৃতির গাড়ি, বল, আঁকার সরঞ্জামের মত নানা লোভনীয় জিনিসে ঘর ভর্তি। এতো রত্নভাণ্ডার। রাজা ছোট হলে কি হবে খুব সহজেই সকলকে আপন করে নেয়। আর মানুষ আপন হলে স্বাভাবিক ভাবেই তার জিনিসপত্রও আপন হয়ে যায়। ঘরের সবকটা জিনিসই একবার করে পরখ করতে শুরু করল।


অতিথিদের আসাটা বিল্টুর একেবারেই পছন্দ হয়নি। তাই সে ছাদে চলে গিয়েছিল। কিছুটা পরে নিচে নেমে নিজের ঘরে ঢুকতেই দেখে তার সাম্রাজ্য আক্রান্ত। তার মহামূল্যবান সম্পত্তিগুলো নিয়ে রাজা নাড়াচাড়া করছে। এর পর মাথা ঠিক রাখা সম্ভব নয়। নালিশ টালিশ সে খুব একটা করে না। তার ধরণ অনেকটা অমিতাভ বচ্চনের শাহেনশার মত। নিজেই শাস্তি দেওয়ার পক্ষপাতী।

চেঁচিয়ে রাজার উদ্দেশ্যে বলল-- বেরো এখান থেকে।

রাজা তাতে কান না দিয়ে জিজ্ঞেস করল--এগুলো সব তোর?

--- বেরোলি ?

রাজা আপন মনে দম দেওয়া দুটো গাড়ি চালাতে শুরু করল। ধমকে কোন কাজ না হওয়ায় বিল্টু রাজার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। রাজার স্বাস্থ্য অনেক ভাল। এক ঝটকায় বিল্টু মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। স্বপ্না রূপাকে বাড়ির ঘরদোর সব দেখাচ্ছিল। দ্বিতীয় রাউন্ড শুরু হওয়ার ঠিক আগে মায়েরা ঘরে ঢোকায় যুদ্ধ থেমে যায়। 


-- ছিঃ বিল্টু, রাজা দুদিনের জন্য এসেছে আর তুমি ওর সাথে মারপিট করছ। লজ্জা করে না !

ওইটুকু সময়ের মধ্যে ঘটনাকে নিজের মত করে সাজিয়ে বিল্টু জানাল--ও আমার দুটো গাড়ি নষ্ট করে দিয়েছে।

এবার রূপার পালা-- ছি ছি তুমি ভাইয়ের খেলনা নষ্ট করেছ?

সুবোধ বালকের মত রাজা বলল--- না গো মা। খেলনাতে হাতই দিইনি। ঘরে ঢুকতেই তো ও আমাকে মারতে শুরু করল।

বিল্টু বুঝল যে শুধু গায়ের জোরেই নয় মিথ্যে বলাতেও রাজা ওর থেকে অনেক এগিয়ে।

গম্ভীর হয়ে বলল-- মা ও মিথ্যে কথা বলছে।

--- হ্যাঁ ও মিথ্যে বলছে আর তুমি সব সত্যি কথা বলছ। চলে আয় রে রাজা, ওর সাথে থাকিস না।

মিটিমিটি হাসতে হাসতে রাজা বাধ্য ছেলের মত স্বপ্নাদের সাথে চলে গেল। খেলনাগুলো বিল্টুর জান। ওগুলোতে রাজার নজর পড়ার পর থেকে পাহারা দেওয়ার জন্য সারাদিন ঘরেই কাটাল। কিন্তু কতক্ষণ। একবার না একবার তো বেরোবে। রাজা তক্কে তক্কে ছিল। তালবুঝে একফাঁকে বিল্টুর ঘরে ঢুকে একটা বড় গাড়ি হাতে নিয়ে চুপ করে বিল্টুর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল। বিল্টু ঘরে ঢুকতেই জানলা দিয়ে ওটা বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ছুটে স্বপ্নার কাছে গিয়ে বলল--- কাকিমা, বিল্টু এইমাত্র একটা ভাল গাড়ি জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে আমায় বলল “দেখ এবার তোকে কেমন পিটুনি খাওয়াই”। সাথে সাথে স্বপ্নাকে নিচে নিয়ে গিয়ে পড়ে থাকা খেলনাটাও দেখিয়ে দিল। গাড়িটা যথেষ্ট দামী। এবার জন্মদিনে ওর বাবা কিনে দিয়েছে। স্বপ্না ভাবল এইটাই বাকি ছিল। অন্যের জিনিস ফেলা,লুকোনো এসব তো করতই এবার নিজেরটাও শুরু করেছে। জানলা দিয়ে সাধের গাড়িটার পরিণতি দেখতে গিয়ে মার কাছে আসতে বিল্টুর একটু দেরী হয়ে গেল। যেই “মা রাজা আমার গাড়িটা” বলতে শুরু করেছে সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্না ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল--- রাজা আমায় সব বলেছে। নিজে ফেলে দিয়ে বকা খাওয়ানোর জন্য রাজার নামে নালিশ করছ। অত ভাল গাড়িটা ফেলার আগে একবার হাত কাঁপল না।

এতদিন বাড়িতে একা রাজত্ব করেছে। মাঝে মাঝে মার কাছে অল্প স্বল্প চড় চাপাটি খেলেও তা বিল্টুকে বিশেষ দমাতে পারেনি। কিন্তু নতুন এই আপদের সাথে কোন দিক থেকে এঁটে উঠতে না পেরে যা সে সচরাচর করে না তাই করল। সিঁড়িতে বসে অঝোরে কাঁদতে থাকল। ছেলেকে কাঁদতে দেখে স্বপ্নার মনটাও খারাপ হয়ে গেল। তার ছেলে যেমনই হোক নিজের জিনিসগুলো খুবই যত্ন করে আগলে রাখে। তাই নিজের অমন ভাল গাড়িটা ফেলে দেবে এটা বোধহয় সত্যি নয়। রাজার কথায় বিশ্বাস করে না বকলেই হত। ছেলেকে কাছে টেনে অনেক আদর করল।

ফোঁপাতে ফোঁপাতে বিল্টু বলল--- মা, সত্যিই আমি খেলনাটা ফেলিনি।

--- ঠিক আছে, কেঁদ না। আবার কিনে দেব।

--- মা ওরা কবে যাবে ?

স্বপ্না জানত যে রূপারা পরের দিনই চলে যাবে। কিন্তু এই প্রথম কারো কাছে তার দামাল ছেলে শায়েস্তা হয়েছে দেখে দুর্লভ সুযোগটা হাতছাড়া করল না।

--- তুমি ভাল হয়ে থাকলেই ওরা চলে যাবে।

--- ওদের চলে যেতে বল। আমি আর কক্ষনো দুষ্টুমি করব না।

পরের দিন সকালে রূপারা চলে গেল। স্বপ্না অনেকবার দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে যেতে বলেছিল কিন্তু আরো কয়েকজনের সাথে দেখা করা বাকি আছে এই অজুহাতে ওরা আর থাকেনি। যাবার সময় অবশ্য রাজা সবার অলক্ষ্যে বিল্টুকে একটা মোক্ষম চাঁটা মেরে বাড়ি ছেড়েছিল। 

এরপর আর কক্ষনো বিল্টুকে নিয়ে স্বপ্নাদের দুশ্চিন্তা করতে হয়নি। আশ্বাস পেয়ে ঘরছাড়া দাদু দিদাও তীর্থ সেরে বাড়ি ফিরে এসেছে। কাজের লোকও এক আধটা করে আসছে। ধীরে ধীরে সংসারে স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে এসেছে। কখনো সখনো বিল্টু একটু বেতাল হলে কেবল শোলের  “গব্বর সিং” আসছের মত রাজারা আবার আসছে বললেই ম্যাজিকের মত কাজ হত। আজ স্বপ্নারা প্রকৃতই এক সুখী পরিবার।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract