পরিচয়
পরিচয়


আয়নায় নিজেকে দেখে খুব অবাক হয়ে গেলো অতনু।
রোজদিনের মতো আজও ঠিক সকাল সাতটায় ঘুম ভাঙ্গে তার। শেরউডের এই তিন-কামরার ফ্ল্যাটটিতে আপাততঃ অতনু একাই থাকে। আসবাবপত্র কিছু কিছু কেনা হয়েছে, কিন্তু সব এখনো সাজানো হয়নি। ব্যারাকপুর থেকে এখানে শিফ্ট হবার পর মাসছয়েক হয়েছে সবে। মূলতঃ চাকরির প্রয়োজনেই কলকাতায় চলে আসার দরকার হয়ে পড়েছিলো। মা-বাবা ব্যারাকপুরের বাড়িতে। সোম থেকে শুক্র অফিস করার পর উইকেন্ডটা এখনো তার ব্যারাকপুরেই কাটে। অতএব ফ্ল্যাটের পরিচর্যার দিকে বিন্দুমাত্র সময় দেওয়া হয়ে ওঠে না। পুজোর সময় বাবা-মা এখানে এসে কিছুদিন থাকবে। তার আগে বাদবাকি জিনিষ সব সাজিয়ে ফেলতে হবে, এরকম প্ল্যান আছে তার। কাল রাত্রে পুবদিকের বেডরুমে শুয়েছিলো সে। একটা শার্লক হোমস অমনিবাস পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলো কখন।
সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই প্রথমে সিলিংএর দিকে চোখ গেলো অতনুর। মাথাটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো খুব। তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা তখনও বোধহয় কাটেনি। কিছু মনে করতে পারছিলো না যেন। এই ঘরটাও খুব অচেনা-অচেনা লাগছিলো তার। আস্তে আস্তে এদিক ওদিক মাথা ঘুরিয়ে দেখলো। কোথায় আছে সে ? এটা একটা বাড়ি, একটা ফ্ল্যাট মনে হচ্ছে - কিন্তু এটা কোথায় ? বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো অতনু। কি অদ্ভুত, মাথাটা ভীষণরকম তালগোল পাকিয়ে আছে যেন। কিছুই মনে করতে পারছিলো না সে। এটা কাদের বাড়ি, এখানে সে কীকরে এলো, কিছু মাথায় আসছিলো না তার। একটু ভাবতে গিয়ে অতনু আবিষ্কার করলো যে সে এটাও মনে করতে পারছে না যে সে কে। সে বেশ বুঝতে পারছে যে সে একজন জীবিত মানুষ, একটা ঘরে শুয়ে ছিলো। কিন্তু নিজের নাম বা পুরোনো স্মৃতি কিছুই মাথায় আনতে পারছিলো না।
সজোরে মাথাটা ঝাঁকিয়ে দু'হাত দিয়ে কানের পাশে চেপে ধরলো অতনু। মাথাটা কি হ্যাং হয়ে গেছে ? বার বার মাথা ঝাঁকিয়ে মাথাটা স্বাভাবিক করবার চেষ্টা করলো সে। সে কে ? নিজের নাম, নিজের ব্যাপারে ভাবার আপ্রাণ চেষ্টা করলো অতনু, কিন্তু কীভাবে যেন সব বোধহয় মুছে গেছে। কোনোকিছুই মনে পড়লো না তার। হতভম্ব হয়ে ওখানেই কিছুক্ষণ বসে রইলো সে।
অ্যালঝেইমার্স বলে একটা রোগ আছে, এটাই কি সেটা ? অতনু ভাবলো। সে শুনেছে ওই রোগে নাকি মানুষ তার সব স্মৃতি হারিয়ে ফেলে। নিজের নামধাম, এমনকি কীভাবে কথা বলতে হয়, কীভাবে হাঁটতে হয়, খেতে হয়, সব ভুলে যায় মানুষ। একদম শিশুর মতোই হয়ে যায়। কিন্তু না, তার তো এমনি স্মৃতি সব ঠিক আছে। এই যে অ্যালঝেইমার্স রোগটার কথা সে ভাবছে, এই রোগের কথাটাও তো তার স্মৃতিতেই আছে। স্মৃতি তো ক্ষয় হয়নি। দ্রুত আরো অনেক কিছু ভাবার চেষ্টা করলো অতনু। ভারতের উত্তরদিকে হিমালয় পর্বত, দক্ষিণে ভারত মহাসাগর, আমাদের রাজ্যটা হলো পশ্চিমবঙ্গ, জনগণমন হলো আমাদের জাতীয় সংগীত। এ প্লাস বি হোল স্কোয়ার ইজ ইক্যুয়াল টু এ স্কোয়ার প্লাস টু এবি প্লাস - না, সব ঠিক ঠাক মনে আছে।
তাহলে ? "কে আমি ? কে আমি ?" কয়েকবার জোরে চেচিঁয়ে দেখে নিলো অতনু যে সে কথা বলতে পারছে কিনা। সব ঠিক আছে। তার স্মৃতিবিলোপ ঘটেনি। সে সবকিছুই মনে করতে পারছে, শুধু নিজের ব্যাপারে ছাড়া। এই বাড়িটা কাদের বাড়ি, এই জায়গাটা কোথায়, এখানে সে কীভাবে এলো, কোথায় সে থাকে, কী তার নাম - শুধু এসব তার জানা নেই। ভুলে সে যায়নি। তার জানাই নেই। এই বিশ্বাসই দৃঢ় হলো অতনুর মনে। ভীষণ একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিলো তার। ছোটবেলা থেকে কতকিছু সে শিখেছে, কিন্তু কখনো নিজের ব্যাপারে জানেনি ? আশ্চর্য!
প্রায় মিনিট পনেরো নিজের সাথে নিজেই এভাবে লড়াই করার পর বিছানা থেকে নেমে এলো অতনু। আর তখনই সামনে রাখা লম্বা আয়নাটাতে চোখ গেলো তার। প্রথমে ভুত দেখার মতো চমকে উঠেছিলো সে, ঘরে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি আছে ভেবে। কিন্তু হাত নাড়িয়ে যখন বুঝলো যে আয়নায় তারই প্রতিকৃতি, তখন খুব অবাক হয়ে গেলো অতনু। এরকম দেখতে তাকে ? কোনোদিন কি আয়নায় দেখেনি সে নিজেকে ? উসকোখুসকো অবিন্যস্ত চুল, লম্বা দোহারা চেহারা, গালে হালকা দাড়ি - মধ্যতিরিশের এই মানুষটা সে ? অবাক হয়ে দেখছিলো অতনু। জীবনে প্রথমবার যেন এই চেহারাটিকে সে দেখছে। কোনোদিন কোথাও দেখেছে বলে তো মনে পড়ে না।
পায়ে পায়ে জানলার দিকে এগিয়ে গেলো সে। নীচে কিছু গাছ-গাছালি দেখা যাচ্ছে। বেশ বড়ো একটা অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স এটা। একটু দূরে কমপ্লেক্সের পাঁচিলের বাইরে মেইন রোড দেখা যাচ্ছে, গাড়ি চলছে খুব। পাশাপাশি বেশ কিছু উঁচু উঁচু বিল্ডিং। একটা মাল্টিপ্লেক্স, কোনো একটা হিন্দি সিনেমার হোর্ডিং লাগানো সেখানে। কোন জায়গা এটা ? কিছুই তার জানা নেই।
পুরো ফ্ল্যাটটা একবার ঘুরে দেখে নিলো অতনু। তার স্থির বিশ্বাস তৈরী হলো যে এটা তার সম্পূর্ণ অপরিচিত জায়গা, এখানে সে কখনো আসেনি। তিনটে বেডরুম আছে এখানে, একটা কিচেন, দুটো বাথরুম। হলরুমে ফ্রিজ রাখা আছে, একটা টিভি, অগোছালো হয়ে পড়ে আছে কিছু ফার্নিচার। একটা সোফার পাশে খবরের কাগজও পেলো সে। তারিখ দেখে বুঝলো এটা জুলাই মাস। তার টনটনে জ্ঞান আছে যে জুলাই মাস মানে এখন বর্ষার সিজন। বছরে ছ'টা ঋতু। দুর্গাপুজো হয় সেপ্টেম্বর-অক্টোবর নাগাদ। ২৫শে বৈশাখ কবিগুরুর জন্মদিন, ২২শে শ্রাবন প্রয়াণ দিবস। সব ঠিকমতো মনে আছে। শুধু নিজের ব্যাপারেই...
সোফায় বসে ভাবার চেষ্টা করছিলো অতনু কোনোভাবে যদি নিজের কথা কিছু মনে পড়ে। এমন সময় বেডরুমে রাখা তার মোবাইলটা বেজে উঠলো।
**************************************************
বিছানার পাশে ছোট্ট টেবিলটাতে মোবাইল ফোনটা চার্জে দিয়ে কাল রাত্রে ঘুমিয়েছিলো অতনু। ফোনের শব্দ অনুসরণ করে রুমের ভিতর এখন এগিয়ে এলো সে। আর বিছানার পাশে ফোনটাকে আবিষ্কার করলো। কার ফোন এটা ? চার্জ থেকে খুলে হাতে নিয়ে সে দেখলো একটা কল এসেছে। লেখা দেবাশীষ স্যার। কে এই দেবাশীষ স্যার সেটা অতনুর মনে নেই। মানে জানাই নেই। দেবাশীষ নামটা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই কলটা কেটে গেলো একসময়। অতনু আনলক করলো ফোনটা, কোনো পাসওয়ার্ড নেই। এটা কার ফোন সে জানে না। কন্ট্যাক্ট লিষ্টে গিয়ে দেখলো সে। কোনো নামই চেনা লাগলো না তার। সে যে বিছানায় শুয়েছিলো, ফোনটা তার পাশেই ছিলো। ভাবার চেষ্টা করছিলো অতনু। এটা কি তাহলে তারই ফোন ? কিন্তু তার তো মনে পড়ছে না এরকম কোনো ফোন তার আছে বলে। কন্ট্যাক্ট লিষ্ট বন্ধ করে ফোনের হোমস্ক্রিনে এলো সে। হোয়াটসঅ্যাপের আইকন দেখে সেটা খুললো। বেশ কিছু মেসেজ এসেছে ফোনের হোয়াটসঅ্যাপে। কয়েকটা মেসেজ খুলে সে দেখলো। পুরোনো মেসেজ কিছু পড়লো। খুব কিছু মনে পড়লো না। মেসেজগুলো খুব যে অপরিচিত লাগলো তা নয়। কিন্তু যেন বহুকাল পূর্বের কিছু কথা। সঠিক মনে নেই, ভাসা ভাসা ঠাহর হলো কিছু যেন এমন মেসেজ সে আগে দেখেছে বা লিখেছে। সম্পূর্ণ অচেনা নয়, আবার চেনাও লাগলো না খুব।
ফোনের কল লিষ্টে গেলো অতনু। বেশ কিছু নাম রয়েছে কল লিষ্টে, কিন্তু কোনো নাম সে মনে করতে পারলো না। লাষ্ট কল হয়েছে গতকাল রাত দশটায় - সুবীর দে। তার আগের কল সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায়, নাম বন্দনা। তার আগে সকাল দশটায়, দেবাশীষ স্যার। আচ্ছা, এই লোকটাই তো কল করেছিলো এই একটু আগে। এখন বাজে সাড়ে সাতটা। টাইম দেখলো অতনু। কল লিষ্টে আরো কিছু নাম পেলো সে পর পর। প্রণয় মন্ডল, সৌগত, পার্থ সাহা, কোনো এক রাজু প্লাম্বার, মনোজ এলআইসি ইত্যাদির ভিড়ে দেবাশীষ স্যারের নামটা বেশ কয়েকবার আছে। বন্দনা নামটাও কয়েকবার চোখে পড়লো। এই ফোনটা যদি তার হয়, অতনু যুক্তি দিয়ে ভাবলো, তাহলে এই মানুষগুলো নিশ্চয়ই তাকে চেনে। এদেরকে জিজ্ঞাসা করলেই হয়তো সে নিজের সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবে। করবে ফোন ?
কিন্তু ফোন করে কী বলবে অতনু বুঝে পেলো না। এরা কারা বা এদের সাথে তার কীরকম সম্পর্ক, কিছু না জেনে কীভাবে কথা শুরু করবে সে ? কোনো বিপদআপদও হয়ে যেতে পারে কেউ যদি জানতে পারে যে সে নিজের কথা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছে। না এভাবে কাউকে ফোন করে এসব আলোচনা করা ঠিক হবে না। স্মৃতি ঠিকমতো না থাকলেও বুদ্ধি ঠিকঠাকই কাজ করছিলো অতনুর মাথায়। ফোনের লাইনে না গিয়ে বরং এই ঘরেই খুঁজে দেখা যেতে পারে নিজের সম্বন্ধে আরও কিছু জানা যায় কিনা। সে রাত্রিবেলা এখানে শুয়ে ঘুমিয়েছিলো। এই ফ্ল্যাটে সে ছাড়া আর কেউ এখন নেই। তার মানে এই ফ্ল্যাটের সাথে সে কোনো-না কোনোভাবে নিশ্চয়ই জড়িত।
স্কুল সার্টিফিকেট, বইখাতা ইত্যাদি কাগজপত্র সবই অতনুর ব্যারাকপুরের বাড়িতে রয়েছে। এই বাড়িতে খুব বেশি কিছু এখনো আনাই হয়নি। তবু সমস্ত ঘর হাতড়ে অতনু বেশ কিছু দরকারি জিনিষ পেলো। ব্যাঙ্কের চেকবুক পেলো, যাতে নাম লেখা অতনু ঘোষ। এটা কার নাম অতনু বুঝলো না। কিন্তু বেশ কিছু চিঠিপত্র পেলো, কিছু ইলেক্ট্রিসিটি বিল পেলো - সবেতেই অতনু ঘোষ নামটা লেখা। এটা ভালোই বোঝা গেলো যে এই বাড়িটা যারই হোক, এখানে অতনু ঘোষ থাকে। বা থাকতো। টেবিলের ড্রয়ারে একটা মানিব্যাগ পাওয়া গেলো। হাজার দু'য়েক টাকা আছে তাতে। একটা এটিএম কার্ড, একটা ক্রেডিট কার্ড, বাসের টিকিট আর দু'খানা সিনেমার টিকিটও রয়েছে দেখা গেলো। সিনেমার টিকিটগুলো ভালো করে দেখলো অতনু। গত বুধবারের টিকিট, প্রিয়া সিনেমা হলের। ছেঁড়া, মানে ব্যবহার হয়েছে টিকিটগুলো। এই মানিব্যাগটা কার, সেটা যদিও অতনু বুঝতে পারলো না।
হঠাৎ একটা কথা মাথায় আসতেই অতনু গিয়ে ফোনটা খুলে আবার দেখলো। হোয়াটসঅ্যাপে নিজের নাম দেওয়া থাকে। প্রোফাইল খুলে নামটা চেক করলো অতনু। আর সেই সাথে প্রোফাইলের ছবিটাও। দেখে বেশ অবাক হলো। নাম আছে ~অতনু। প্রোফাইলের ছবিটা অনেকটা যেন ওই আয়নায় দেখা মুখটার মতোই। তার মানে... তার মানে এই অতনু ঘোষই হলো সম্ভবতঃ সে নিজে। বেশ দু'য়ে দু'য়ে চার করে ব্যাপারটা সম্বন্ধে কিছুটা নিশ্চিত হতে পারলো সে। অর্থাৎ অতনু ঘোষ নাম তার। এই ফ্ল্যাটটা তাহলে তারই ফ্ল্যাট, তার নামেই ইলেক্ট্রিসিটি বিল আসছে যখন। বাহ্, এতো বড়ো ফ্ল্যাটটা তার মানে তার ? দারুণ তো।
অতনু ঘোষ। মাথা নীচু করে চোখটা একটু বন্ধ করে অতনু এবার ভাববার চেষ্টা করলো - কিছুও যদি মনে পড়ে তার নিজের সম্বন্ধে। সে কি বিবাহিত ? তার কি বাচ্চা-কাচ্চা আছে ? এখানে কি সে একা থাকে ? এই বাড়ির বাকিরা কোথায় ? তার বাবা-মা কি জীবিত আছেন ? তারাও কি এখানেই থাকেন ?
কোনো প্রশ্নেরই কোনো উত্তর পেলো না অতনু, কিছু মনে পড়লো না তার। চোখ খুলতেই টেবিলের উপর রাখা শার্লক হোমস অমনিবাসটা দেখতে পেলো সে। শার্লক হোমসের প্রচুর গল্পের কথা মুহূর্তেই মনে পড়ে গেলো। আশ্চর্য এক বিস্মৃতির শিকার হয়েছে সে। শুধু নিজের কথা ছাড়া বাকি সবই স্পষ্ট মনে আছে।
কী মনে হতে ফোনটা নিয়ে ফোনের কল লিষ্ট থেকে দ্বিতীয় নামটাতে রিং করলো অতনু। মেয়েদের দিক থেকে বিপদের সম্ভাবনা কম। মেয়েরা একটু সহানুভূতিশীলও হয়। তাই কল করার পক্ষে বন্দনা নামটাই সবচেয়ে উপযুক্ত মনে হলো তার।
**************************************************
- "হ্যালো।" তিন-চারবার রিং হবার পরেই ফোনের ওপাশ থেকে সুরেলা কোনো মেয়ের গলা শোনা গেলো।
অতনু মনে একটু সাহস সঞ্চয় করে বললো, "আমি অতনু ঘোষ বলছি।"
- "মানে ? এইসময় ফোন করেছো কেন ?" ওপাশ থেকে মহিলা কন্ঠ চাপা স্বরে বললো, "ও এখনো অফিসে বেরোয়নি।"
"ও মানে ?" বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো অতনু।
- "কী হয়েছে তোমার বলো তো ?" মেয়েটি মনে হয় বেশ বিরক্তই হলো। বললো, "আরে আমার হাজব্যান্ড। কতবার বলেছি না, সাড়ে ন'টার সময় ও বেরোয়, তার আগে ফোন না করতে।"
অতনু হতভম্ব হয়ে গেলো। কেসটা কী ? এই মহিলা যেই হন, তার সাথে কি অতনুর কোনো অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে নাকি ? যাচ্চলে, এ আবার কোন ঝামেলা! অতনু তাড়াতাড়ি ফোনটা কেটে দিলো।
এভাবে হবে না। কোথায় কোন গেরো বাঁধিয়ে রেখেছে সে, সে নিজেই জানে না। তার চাইতে বরং বাইরে বেরিয়ে একটু দেখা যাক, রাস্তাঘাট দেখে কিছু চিনতে পারে কিনা, কোনো সুরাহা মেলে কিনা। অতনু ভাবলো।
ঘন্টাখানেকের মধ্যে স্নান করে রেডি হয়ে নিলো সে। ফ্রিজ খুলে দেখলো খাবার যথেষ্ট আছে সেখানে। কিচেনটা সম্পূর্ণ অপরিচিত হলেও ব্যবস্থাদি সেখানে মন্দ নয়। নিজের জন্য এক কাপ চা বানাতে গিয়ে দেখলো চা বানানো সে ভালোই জানে। এমনকি চার পিস্ পাউরুটি সেঁকে মাখন লাগিয়ে সুন্দর স্যান্ডউইচও বানিয়ে নিলো। সবকিছু তৈরী করে টেবিলে এনে নিজের ওপর বেশ গর্বই হলো অতনুর। যদিও মনের মধ্যে তখনও তার অদ্ভুত এক শূন্যতা।
শেরউডের গেট থেকে বেরোনোর সময় উর্দি পরা দারোয়ান তাকে দেখে এক গাল হেসে বললো, "গুড মর্নিং স্যার।" অতনুও তাকে দেখে একটু হাসলো। যদিও চিনতে সে পারলো না।
গেটের সামনে ফোর লেন চওড়া রাস্তা। খুব চেনা লাগলো না। কিন্তু বহুকাল আগে যেন সে এখানে এসেছিলো, এরকম মনে হলো তার। জায়গাটা ঠিক কলকাতার ভিতরে নয়, একটু বাইরের দিকে, শহরতলিতে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একটা বাস আসতে দেখলো সে। তাতেই উঠে পড়লো। কোথায় যাওয়া যায় সে জানে না, কিন্তু কোথাও তো যাচ্ছে বাসটা। অতনুর কোনো গন্তব্য নেই এই মুহূর্তে। বা বলা যায়, যেকোনো জায়গাই তার গন্তব্য।
একটু পরে মেসেজ ঢুকলো একটা অতনুর ফোনে। মেসেজটা দেখলো অতনু - ঠিক দশটায় আর্জেন্ট মিটিং, কাম শার্প। দেবাশীষ স্যারের মেসেজ।
কে এই দেবাশীষ স্যার ? ভুরু কুঁচকে ভাবার চেষ্টা করলো অতনু। রোজ নিয়ম করে তাকে ফোন করেন এই ভদ্রলোক, বোঝা যাচ্ছে। নামটা তো চেনা নয়। কিন্তু মেসেজটা দেখে মনে হচ্ছে কোনো অফিসিয়াল মেসেজ। আচ্ছা, সে কি কোথাও কোনো অফিসে চাকরি করে ? আর সেই অফিসের সাথেই কি দেবাশীষ স্যার যুক্ত ? কে জানে, হবে হয়তো। অতনুর কিছুই মনে হলো না এরকম মেসেজ পেয়ে। যদিও মেসেজটিতে জরুরি তলব আছে, কিন্তু তাতে অতনুর কী ? যিনি মেসেজটি পাঠিয়েছেন, তার তাড়া থাকতে পারে। অতনুর কোনো তাড়া নেই। অতনুর কোনো জরুরি কাজ নেই।
বাসটা হেলতে দুলতে গড়িয়ার কাছাকাছি আসতেই অতনু চিনতে পারলো। এই রাস্তা তো সে চেনে। সামনেই এন্ড্রুজ কলেজ। তারপরে ভাসমান বলে একটা সুইমিং পুল আছে। তারপরে পদ্মশ্রী সিনেমা হল। সব তার জানা। ওইখানেই একটা জায়গায় বাস থেকে নেমে পড়লো সে।
**************************************************
রাস্তাটা পার হয়ে একটা ছোট্ট শিবমন্দিরের সামনে দাঁড়ালো অতনু। সে কি হিন্দু ? জানা নেই তার। নাম যখন অতনু ঘোষ, হয়তো হিন্দুই হবে। কিন্তু মুসলিম হলেই বা ক্ষতি কি। অথবা নাস্তিক। কিংবা আর কিছু। সত্যি, নিজের গোত্র ভুলে গেলে মানুষ কত উদার হয়ে যায়। ভেবে দেখলো অতনু। নিজেকে কেমন মুক্তপুরুষ মনে হলো তার। কোনো কিছুর প্রতি তার বন্ধন নেই, মায়া নেই, আকাঙ্খা নেই, মোহ নেই। অদ্ভুত। শিব মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে সে মাথা তুলে আকাশ দেখলো। কালো মেঘ ছেয়ে আছে। বৃষ্টি আসবে হয়তো।
বন্দনার ফোন এলো এই সময়। মোবাইলটা পকেট থেকে বার করলো অতনু। এই মোবাইলটাতেই তার সমস্ত পরিচয় বন্দি হয়ে আছে। ফোনটা আনলক করে বন্দনার কলটা রিসিভ করলো সে।
- "আরে বলো, কী ব্যাপার বলো। তখন ফোন করেছিলে কেন বললে না তো ? শরীর-টরীর ঠিক আছে তো ?" কলকলিয়ে জিজ্ঞাসা করলো ফোনের ওপাশের মেয়েটি। একটু আগের সেই চাপা স্বর এখন আর নেই।
"হ্যাঁ", কোনোরকমে জবাব দিলো অতনু। "ঠিক আছে।"
- "সাত সকালেই তোমার ফোন দেখে আমি কোথায় লুকাবো বুঝতে পারছিলাম না। ভাগ্যিস ও তখন বাথরুমে ছিলো। আচ্ছা শোনো, আজ তাহলে সিটি সেন্টারে দেখা হচ্ছে কিন্তু। দেরী করবে না একদম।"
"সিটি সেন্টারে ?" অতনু ভাবার চেষ্টা করলো।
- "হ্যাঁ, তাই তো বললে। না তো কোথায়, বলো -"
"না মানে... আপনি... তুমি - ক্ষমা করো, আমার পক্ষে দেখা করা সম্ভব নয়। সরি।"
- "মানে ? ইয়ার্কি হচ্ছে নাকি ?"
"না, আমি সিরিয়াসলিই বলছি। দেখা করা সম্ভব হবে না।" অতনু কাটাতে চাইলো।
- "এই দ্যাখো, জোক করবে না একদম। ভালো লাগে না। আচ্ছা, তুমি কি রেগে গেছো ? আমি সকালে ভালো করে কথা বলিনি বলে ? এই দ্যাখো প্লিজ -"
কলটা কেটে দিলো অতনু। তারপর নাম্বারটা ব্লক করলো।
সামনেই একটা ছোট্ট লেক আছে। সেখানে গিয়ে দাঁড়ালো সে। লেকের পাশে দাঁড়িয়ে লেকের জলে নিজের ছায়া দেখলো কিছুক্ষণ। তারপর ফোনটা তুললো হাতে। কন্ট্যাক্ট লিষ্টে গিয়ে টাইপ করলো - মা। একটা নম্বর পেলো। ভালো করে নম্বরটা দেখলো সে। এই পৃথিবীতে তাহলে কোথাও তার মা আছে। বাবা শব্দটা লিখে দেখলো সেটাও আছে কন্ট্যাক্ট লিষ্টে। ভালো। তারা যেখানেই থাক, ভালো থাক। ব্যক্তিগত স্মৃতিই যখন নেই, তখন সেই বাবা-মায়ের প্রতি কোনো টানও অনুভব করলো না অতনু। শুধু বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পারা কিছুটা কৃতজ্ঞতাবোধ রয়েছে হয়তো। কিন্তু সেও কয়েক মুহূর্তের জন্য।
ফোনটা আবার আনলক করে দেবাশীষ স্যারের মেসেজটা খুললো। ইনি কে, অতনু জানে না। যদি অফিসেরই কোনো সহকর্মী বা অফিসের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ কেউ হন, সেই ভেবেই অতনু একটা রিপ্লাই দিলো - "আই রিজাইন ।" ব্যাস, এইটুকুই। বুঝে নিতে পারবে তারা বাকিটা। পাওয়ার বাটনে গিয়ে ফোনটা স্যুইচ অফ করে দিলো সে।
মাঝে মাঝে জীবনকে কেঁচে গণ্ডুষ করতে ইচ্ছা হয় তো আমাদের। মনে হয় আবার নতুন করে শুরু করা যেত যদি, একদম শুরু থেকে শুরু। যদি করা যেত। মনে হয়, কিন্তু আমরা পারি না। আমাদের স্মৃতি, আর সেই স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ভালো-লাগা, মন্দ-লাগা, আবেগ, সংস্কার - আমাদের আটকে রাখে। আমাদের আশৈশব তৈরী হওয়া কোনো এক নির্দিষ্ট পরিচয়ের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ রাখে।
বুক ভরে একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে একসময় ফোনটা লেকের জলে ছুঁড়ে ফেলে দিলো অতনু। ওই ফোনের সাথে সাথেই তার পুরোনো পরিচয় চিরকালের মতো হারিয়ে যাক। তার কোনো সংস্রব নেই সেই পরিচয়ের সাথে। পুরোনো শহরতলীর ওই ফ্ল্যাটেও আর সে ফিরে যাবে না। নতুন এক জীবনকে তৈরী করবে সে এই শহরের বুকে। আজ থেকে সে নতুন মানুষ। নতুন পরিচয়।
~ সমাপ্ত