জন্মদিন
জন্মদিন
অঞ্জনের বাবাকে অঞ্জন মাঝে মাঝে দেখতে যায় । দোতলার ঘরে অঞ্জনের বাবার একটা ফটো টাঙ্গানো আছে ।সামনে দাঁড়ায় অঞ্জন।অনেকদিন ধরে দেখতে দেখতে অঞ্জন আবিস্কার করেছে ওর বাবাকে অনেকটা পাড়ার মুতোদার মত দেখতে ।কথাটা বলতেই অনিমা ওকে একটা চড় মেরেছে।এতে নাকি বাবাকে অশ্রদ্ধা করা হয়েছে। অঞ্জনের পাড়ার আমবাগানের মোড়ে একটা সিমেন্টের বসার জায়গা যারা করেছিল, তাদের কেউই আর ওখানে বসে না।একসময় ওখানে জমজমাট আড্ডা হত।বসার জায়গার গায়ে একটা পুরুষ্ট হিমসাগর আমগাছ ছিল।সে গাছ এখন আর ওখানে নেই।একটা পাঁচতলা ফ্ল্যাট বাড়ি সেখানে প্রোমোটারদের দক্ষতায় আমগাছটাকে সরিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে।বসার জায়গাটায় এখনও মুতোদা বসে। মুতোদার মুখে দুর্বাক্য বেশ মানায়।অঞ্জন স্কুলে যাবার পথে মুতোদার প্রশিক্ষনে বেশ কয়েকটা নিষিদ্ধ শব্দের মমার্থ বুঝতে পেরেছে ।ওখান দিয়ে গেলেই মুতোদা ওকে বলে , ‘ কিরে ভাইপো ! স্কুলে যাচ্ছিস ?’ অঞ্জন ভয়ে ভয়ে বলে , হ্যা । বলেই দৌড়য় ।লোকটা খুব বাজে বাজে কথা বলে। ওটাই ওর একমাত্র কাজ ।একদিন বলেছিল, ‘তোর মা কেমন আছেরে?তোর বাবাটা বহুত হারামি, হারামির হাতবাক্সো।তোর মা খুব ভালো’। অঞ্জন শোনে না ।মুতোদা জোর করে শোনানোর চেষ্টা করে।অঞ্জন সেদিনই স্কুলের একটা ছেলেকে বলেছে, ‘হারামি মানে জানিস ?’
-কি? ছেলেটা একরাশ বিষ্ময় নিয়ে প্রশ্ন করেছে ।
-বদমাইশ লোক , যারা নিজের বৌকে ছেড়ে চলে যায় তাদের বলে হারামির হাতবাক্সো।
ছেলেটা হাসে । নতুন শব্দঞ্জানে ওরও বেশ তৃপ্তি হয়েছে।
ইদানিং বাবার ফটোটা দেখলেই মুতোদার কথা মনে পড়ে যায় ।আগে কেমন একটা শ্রদ্ধা, বিষ্ময়, রাগ সব মিলিয়ে ও বাবাকে দেখতো। মা বলে , ‘তোর বাবা হারিয়ে গেছে’। রেগে গেলে বলে , ‘একটা বদমাইশ লোক, বউ ছেড়ে পালিয়ে যায়!বৌটা কি করে বাঁচবে একবারও ভেবেছে?’
-বাবা কোথায় গেছে? অঞ্জন যখন আরো ছোটো ছিল তখন মাকে এই প্রশ্নটা করত।অনিমা কথা বলত না,অন্য কেউ প্রশ্ন করলে বলত, ‘কে জানে , সকালে বেরোলো , বলল আজ ফিরতে একটু দেরি হবে – তারপর আর এল না’ । অনিমা বেশি বলতে পারে না , চোখ ভর্ত্তি জল চলে আসে ।সুপ্রভাত সেদিন রাত্রে না ফিরতে সমস্ত আত্মীয়স্বজনের কাছে ও ফোন করেছিল, না কোথাও যায়নি । উদ্বিগ্ন আত্মীয়রা ওর বাড়িতে আসতে শুরু করল।রান্নাঘরে অনিমার বোন রিমা ঢুকে গেল।যত আত্মীয়স্বজন এসেছে তারা চায়ে চুমুক দিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করতে থাকল। কেউ কেউ ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে দুকাপ চা খেল।সুপ্রভাতের অফিসে চলে গেল অনিমার ভাই অনুপ।অফিসের সবাইতো শুনে অবাক। তার থেকেও বেশি অবাক হল অনুপ। অনুপ শুনে এল গত দুমাস আগে সুপ্রভাতের চাকরিটাই চলে গেছে।
-দুমাস? অনুপ স্তম্ভিত।কেন?
কেউ কোনো কথা বলে না । অবশেষে পাশের একজন বলল, Moral turpitude। ও অফিসের একটা মেয়ের সাথে মিসবিহেব করেছিল ।
-মিসবিহেব?অনুপ তাকিয়েছিল বক্তার দিকে।
-মিসবিহেব মানে মেয়েটার শরীরে হাত দিয়েছিল। মেয়েদের টয়লেটে ঢুকে ।আরো শুনবেন? ছেলেটা কথা বলে কঠিন চোখে তাকিয়েছিল অনুপের দিকে যাতে তৃতীয় প্রশ্ন আর উত্থাপিত না হতে পারে।তাছাড়া অনুপ একটা চাকরি খোয়ানো বাজে লোক সুপ্রভাতের শ্যালক ,অতএব তাকে বেশি সম্মান দেখানোর কোনো প্রয়োজনই নেই।বসতেও কেউ বলেনি অনুপকে।অনুপ আর কথা বলেনি।মনে মনে সুপ্রভাতকে চিন্তা করে ভাবছিল, তার দ্বারা এই জঘন্যতম কাজটা করা সম্ভব কিনা? হয়ত মানুষের বেশির ভাগটাই পোশাক,তার তলায় থাকে অনর্থ, আকস্মিকতা, অরোধ্য চাহিদা ।সুপ্রকাশ তো সারাদিন আনন্দে থাকতো- কখনও মনে হয় নি তো ওর ভেতরে কোনো অশাসিত আকাঙ্ক্ষা আছে।অনিমাকে একান্তে সব বলেছিল অনুপ।অনিমা বিশ্বাস করেনি।খবেরর কাগজে দিন পনেরো বাদে অনিমা বিঞ্জাপন দিয়েছিল। সুপ্রকাশের ছবির তলায় লিখেছিল, ‘আমি এখনও তোমার পুত্রসন্তান নিয়ে অপেক্ষা করছি।কোথায় আছো তুমি?ফিরে এসো।ফোন কর’ । ফোন নম্বরে ফোন আসেনি সুপ্রভাতের। সুপ্রভাতের শয়ে শয়ে ছবির মধ্যে থেকে বেছে একটা উজ্জ্বল, দীপ্ত ছবিকে বড় করে ফ্রেমে বাঁধিয়ে দোতলার শোবার ঘরে টাঙিয়েছিল অনিমা।
ছোটো থেকে অঞ্জন দেখতো ওর মা ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে আর চোখ মুছছে। অঞ্জনের ভালো লাগতো না।অঞ্জন যত মার কষ্ট দেখতো , তত ওর বাবার ওপর রাগ হত।ও বুঝতে পেরেছিল বাবা মারা যায় নি,বাবা কোথায় কেউ জানে না, মাকে আর ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছে।এই ধারনা থেকে ও বাবার ওপর রেগে যেত।একদিন ফটোটার সামনে দাঁড়িয়ে ও ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল।অনিমা দেখেছিল ওকে কাঁদতে।
-যে বাবা তোর মাকে ছেড়ে, তোকে ছেড়ে পালিয়ে যায় সে কেমন বাবা রে ? তার জন্যে কাঁদিস না । আয় খেয়ে নে । স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
স্কুলের ভেতরটা বেশ ভালো লাগে অঞ্জনের।একটা উঁচু পাঁচিলের ভেতর অনেকটা জায়গা।ঘাস দিয়ে ঢাকা সবুজ মাঠ।তাকে গোল করে ঘিরে রয়েছে তিনটে বড় বড় বাড়ি। ওর এখন ক্লাস সেভেন। ক্লাস সেভেনের চারখানা সেকশন। ও বি সেকশনে পড়ে।ওদের ক্লাস টিচার প্রসন্ন নস্কর।নাইন টেনের দাদারা প্রসন্ন স্যারকে বলে অপ্রসন্ন, বিষন্ন এমনকি জঘন্যও বলে। প্রসন্ন স্যার ভীষণ গম্ভীর মানুষ। অথচ সবার খোঁজ নেন। একদিন অঞ্জনকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তোমার বাবা স্কুলে একদম আসেন না কেন? বাবা কি দূরে কোথাও চাকরি করেন?
-হ্যা, ইউরোপে চাকরি করেন ।আসলে জাহাজে থাকেন , বাবা জাহাজের ক্যাপ্টেন ।
-বা! কোন জাহাজের ?
-কোন জাহাজের নাম মনে নেই স্যার, দু তিন বছর অন্তর অন্তর বাবা চাকরি পাল্টায়।
-গুড, বাবার মত হও।
-না! হটাৎ বলে ওঠে অঞ্জন।
প্রসন্ন স্যারের ভুঁরু কুঁচকে ওঠে।
-বাবার মত হতে চাও না? জাহাজ ভালো লাগে না বুঝি ?
-না ।পায়ের দিকে মাথা নামিয়ে দেয় অঞ্জন । ক্লাসের ধুলোর ওপর একফোঁটা চোখের জল টপ করে পড়ে। প্রসন্ন স্যার দেখতে পান না।
- কি হতে চাও ? কি করবে বড় হয়ে?
- ঠিক করিনি , কোনক্রমে বলে অঞ্জন।
-ঠিক কর,এখন থেকেই ঠিক করতে হয়, গন্তব্য না জানলে পথ খুঁজে পাওয়া যায় না । প্রসন্ন স্যার অঞ্জনকে ছেড়ে এগিয়ে যান। মিথ্যে কথাগুলো বলে অঞ্জনের খুব তৃপ্তি হয়ে ছিল। অঞ্জনের মেশোমশাই জাহাজে চাকরি করেন।রিমা মাসির অনেক টাকা। গাড়ি করে আসে।যখনই আসে অনেক গল্প নিয়ে আসে। রিমা মাসি বিদেশের চকলেট নিয়ে আসে কখনো কখনো।রিমা মাসি আসলেই তাই অঞ্জনের একটা প্রত্যাশা তৈরি হয়।রিমা বুঝতে পারে।
-নারে, এখোনো তোর মেশো আসেনি।এখন আবার অন্য একটা চাকরি নেবার কথা ভাবছে।সেটা পর্তুগালে,খুব বড় জাহাজ কোম্পানি।ও একেবারে ক্যাপ্টেন হয়ে যাবে। এবার তোর মেশোর সঙ্গে আমরাও ঘুরতে যাবো ভেবেছি।বুঝলি দিদি,চঞ্চল বলেছে সৃজন ছোটো থাকতে থাকতে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে আমাদের।জাহাজে করে অনেক দেশ দেখাবে। যেখানে যেখনে দিয়ে জাহাজ যাবে , যে পোর্টে থামবে সেখনে আমরা নামব। ঘুরব, ফিরব, ভালো হোটেলে থাকব । সৃজন তো এখন কেজি ট্যুতে , তাতেই কি পড়াশুনা। খুব কড়াকড়ি। বাংলা বলতেই দেয় না । বলে বাড়িতে একদম ওর সঙ্গে বাংলায় কথা বলবেন না, বাংলা চ্যানেল খুলে সিরিয়াল দেখবেন না । এরপর যখন আরো ভালো এংলিশ মিডিয়ামে দেব তখন তো ছুটিই দেবেনা। তারপর টিউশন! সাতদিনে ছদিনই তো টিউটরের কাছে যেতে হবে।রিমা যখন বলে তখন বেশ তাড়াতাড়ি বলে, অল্প সময়ের মধ্যে অনেক কথা বলতে হয়তো।
তখন অঞ্জন মনে মনে নিজেকে জাহাজের ওপর বসিয়ে মাকে ডাকে , ‘মা দেখো, দেখো দূরে একটা কি সুন্দর দ্বীপ, দেখো কি সুন্দর সুর্য ডুবছে’ । আজকাল অঞ্জন স্বপ্নগুলোকে সত্যি ভাবতে পারে, আর অবাঞ্ছিত সত্যগুলোকে উপেক্ষা করতে পারে ।আমবাগানের মুখটায় এসেও অপসৃত আমগাছটাকে দেখতে পায়, তখন লম্বা, সরু পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়িটা অপ্রয়োজনীয় বলে নিজেই ওর চোখের সামনে থেকে চলে যায়। পড়ানোর ব্ল্যাকবোর্ডে ও সমুদ্র, জাহাজ, সূর্য সব দেখতে পায়।তখন অঙ্কের যোগ বিয়োগ সংখ্যাগুলো দুলতে থাকে, ঢেউএর মাথায় ওঠে আর নামে । প্রেজেন্ট ইন্ডেফিনাইট টেন্সটা সরে গিয়ে জাহাজের জন্যে জায়গা করে দেয়। জাহাজটা ওকে নিয়ে সুর্য্যাস্তের ঘন আলোর মধ্যে ঢুকে যায়,যেখনে ওর বাবাকে ও দেখতে পায়। সাদা পোশাক সাদা টুপি পরে দারুন লাগছে বাবাকে । যেমন জাহাজের ক্যাপ্টেনরা হয়।
কিন্তু অনিমার বুকের ভেতর ভারি পাথরটা একটুও নড়ে না।সুপ্রভাত তাকে না বলে কোথায় চলে গেল! চাকরিটা হারিয়ে সুপ্রভাত ওকে কেন বলতে পারলো না? চাকরিটা হারানোর পরও দুমাস অপেক্ষা করেছিল, কিসের জন্যে? যে মেয়েটাকে সুপ্রভাত অসম্মান করেছে বলে অফিস বলছে, সে মেয়েটাকে খুঁজতে গিয়েছিল অনিমা ওদের অফিসে। মেয়েটা ওর চোখের ওপর চোখ রেখে একবার বলুক, সুপ্রভাত অসম্মান করেছে। বলুক ওর গায়ে হাত দিয়েছে।অনিমা কিছুতেই মেলাতে পারে না । সুপ্রভাতকে কি ও এতদিন বুঝতে পারেনি।সুপ্রভাতের যৌনতাও ছিল শান্ত।তাড়াহুড়ো করত না। অনিমাকে ফুলের মত স্পর্শ করত । ন্ম্র হাতে , ন্ম্র পেষনে।কোনোদিন অনিমা বলেনি, ‘ছাড়ো , ভালো লাগছে না’ ।সুপ্রভাত ভালো লাগাতে জানতো।তাহলে তার মধ্যে এমন উদগ্র কামনা কি করে এল?সুপ্রভাতের অফিস বলেছিল মেয়েটা ট্রান্সফার নিয়ে মালদা চলে গেছে।
-ঠিকানাটা দিতে পারবেন? মেয়েটার ঠিকানা?
-কেন এইটা চাইছেন? মেয়েটা কমপ্লেন করেছে , অফিস অ্যাকশান নিয়েছে।এর বেশি আমরা আপনাকে কিছু বলব না।আপনি আইনের পথে যান।
অনিমা অফিস ম্যানেজার সুভাষ চৌধুরীর চোখে চোখ রেখে বলেছিল, ‘এই চেম্বারে এখন আমি আর আপনি আছি, আর কেউ নেই। আমায় সত্যিটা বলবেন?শুধু বলুন সুপ্রকাশ’...সুভাষ চৌধুরী থামিয়ে দিয়েছিলেন।
-আমায় আর কিছু প্রশ্ন করবেন না। আপনি আসুন।সুভাষ চৌধুরী দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন চেয়ার থেকে।একটা বেল বাজিয়ে দিয়েছিলেন। একজন সিকিউরিটি ঢুকেছিল।
- ওনাকে বাইরে যাবার রাস্তাটা দেখিয়ে দাও। সিকিউরিটিকে বললেন মিস্টার চৌধুরী।
-আমি উত্তর পেয়েছি । আপনার সঙ্গে আবার দেখা হতে পারে।
অনিমা বেরিয়ে এসেছে।চোখটা জ্বলছিল অনিমার।অনিমা উকিলের দ্বারস্থ হয়েছিল।বারাসাত কোর্টের অ্যাডভোকেট নির্ম্মাল্য সেন খানিকক্ষণ শুনেছিলেন,
-ম্যাডাম, আমার ফিস এক হাজার টাকা।
টাকাটা গুনে নিয়ে অ্যাডভোকেট সেন বলেছিলেন,
-ইন হাউস এনকোয়ারি রির্পোট আপনার কাছে আছে?
-না।
-সুপ্রভাত আপনাকে এই ব্যাপারে কিছু জানায় নি?
-না।
-এখন কি কোনো যোগাযোগ আপনার সঙ্গে আছে , কোনো টেলিফোন, চিঠি ?
-না
-কোথায় গেছে আপনি জানেন না ?
-না
-ওকে ফিরিয়ে আনুন, যেভাবেই হোক। ও যদি এরকম একটা কিছু করেও থাকে , ওর চাকরি ও ফেরত পেতে পারে।মেয়েটা পুলিশে কোনো রিপোর্ট করেছিল কিনা জানেন?
-না।
-তবে পালাল কেন? মেয়েটার ডিটেল দরকার।ওকে ডিসমিস করেছে যে অথরিটি তাকে পার্টি করতে হবে।ওদের সি.এম.ডি কে পার্টি করতে হবে।এঙ্কোয়ারি প্রসিডিংসটা দরকার। ওর অফিসের ওই দিনের অ্যাটেনডেন্স রেজিস্টারের কপি দরকার।ওর ডিপার্টমেন্টের স্টাফেদের নাম ঠিকানা দরকার । অনেক কাজ । কিন্তু যাকে নিয়ে লড়ব তাকেতো দরকার। খরচা হবে ম্যাডাম। কত খরচা তা এখনই বলা যাবে না ।আর এর মধ্যে যার জন্যে লড়ব ভাবছি, সে উধাও। উধাও হবার কারণ অনেক রকম হতে পারে ।এক , ও কিছু একটা করে বসেছে।
-আত্মহত্যা ? অনিমা চমকে ওঠে।বুকের ভেতরটায় হটাত একটা ব্যাথা যেন জেগে ওঠে।
-সম্ভাবনা কম , তবে হতে পারে। দুই, ও অন্য কোনো জায়গায় গিয়ে আর একটা আইডেনটিটি নিয়ে বেঁচে আছে।বিয়ে থা করবে , আপনাদের ভুলে যাবে।
-না, তা বিশ্বাস করি না।
-বিশ্বাস করেন না? না করাই ভালো।তিন, ও খুন হয়ে গেছে , অথবা অ্যাক্সিডেন্টে আনক্লেমড বডি হয়ে...কোথা থেকে শুরু করব বলুন ? অনেক যন্ত্রনা আছে। চিন্তা করে নিয়ে বলুন ।অনিমা তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ অ্যাডভোকেটের দিকে । হতাশায় মাথাটা ভারি হয়ে যায় । পৃথিবীতে কেউ অনুকম্পা নিয়ে কারুর জন্যে বসে নেই।
-না পারবো না। অনিমা উঠে পড়ে । অনেক যন্ত্রনা ছাড়া আর কিছু বাকি নেই।সুপ্রভাত রোদ্দুরে হারিয়ে গেছে । এখন অঞ্জনকে নিয়েই ভাবনা। অঞ্জনকে মানুষ করতে হবে।
ইতিমধ্যে অঞ্জনের মেশমশাই চঞ্চল এসেছে।অনেকদিন, প্রায় একবছর ন মাস বাদে। চঞ্চল মানেই একটা সাফল্যের বিঞ্জাপন । চঞ্চল আসলেই রিমা একটা সরব উৎসবের আয়োজন করে যাদবপুরের বাড়িতে। চঞ্চলের বাবা , মা , রিমা সবাইকে ফোন করে করে ডেকে আনে ওদের বাড়িতে। খাওয়া দাওয়ার মধ্যে চব্য, চোষ্য তো থাকেই আর থাকে অত্যাকর্ষক পেয়।তখন একটা কারণ অকারণেই তৈরি হয়। এবারে কারণটা ছিল সৃজনের জন্মদিন ।অনিমা বিষ্মিত হয়ে রিমাকে বলেছিল , সৃজনের জন্মদিন তো অক্টোবর মাসে ।এটাতো মে মাস।
-হুঃ জন্মদিনের স্মরণে জন্মোৎসব। এই সময়টা ওর বার্থ সারটিফিকেটের বার্থ ডে। বার্থ সারটিফিকেটটা এইসময় ওর বাবা দেখেছিল।তুই এত ভাবিস কেন বলতো?চঞ্চল ওর বড় শালীকে দেখার জন্যে ছটফট করছে।
অনিমা টেলিফোনে হাসে। একটু শব্দ করে যাতে বোঝা যায় ও হাসছে।ওকে বোঝাতে হয় ও খুব খুশী জন্মদিনের নিমন্ত্রণ পেয়ে। চঞ্চলের প্রভাবে ও একটা ফার্মে টাইপিস্টের কাজ পেয়েছে।সামান্য টাকা মাইনে আর সঙ্গে মার উইডো পেনশন ।ওর মা ওর কাছেই থাকেন। মার উইডো পেনশনটা অনিমাকে অনেকটা রক্ষা করে।মার শরীর খারাপ হলে অনিমা ভয় পেয়ে যায় । ভেতরে একটা নির্ম্মম সত্যি ভয় দেখায় অনিমাকে। মা না থাকলে পেনশনটাও থাকবে না ।
বারাসাত থেকে যাদবপুর কম দূর নয়। কিন্তু যেতেই হবে। চঞ্চল দু-দুবার ফোন করেছে ।সেটা অবশ্য রিমা জানে না।সুপ্রভাত থাকাকালিনও চঞ্চল অনিমার সাথে অনায্য ঘনিষ্ঠতা দেখাতে চাইতো।অকারণেই কানে কানে কথা, কথা শেষ হয়ে গেলে ঠোঁট দুটো অনিমার গাল ছুঁয়ে যেত।অনিমা বুঝতে পারতো চঞ্চল তার দিকে এগোতে চাইছে।এখন চঞ্চল যেন একটু বেশি রকম অধিকার নিয়ে এগিয়ে আসে, হাত ধরে , কোমরে হাত দিয়ে দেয়, কানে কানে বলে,’আমিও একাকি ,তুমিও একাকি...’।
-রিমা থাকতেও একাকি ? অনিমা হাসে । হাসবার চেষ্টা থেকে যতটা হাসি আসে।
-রিমাকে আর কতবার রিপিট করব বল? অনু একটু খারাপ হও না আমার জন্যে । এত কন্সারভেটিভ কেন ?এনজয় কর , একদিন তো সব ফুরিয়ে যাবে। খুব দামি স্কচের বোতলও ফুরিয়ে গেলে বোতলটা আমরা ছুঁড়ে ফেলে দিই কিনা? আমাদের দেহটাও একদিন ইউজলেস হয়ে যাবে।
-হুঃ , অনিমা নিরাবেগে তাকাল চঞ্চলের দিকে।দূর থেকে অঞ্জন একবার ওর মেশোমশাইএর দিকে দেখল। মায়ের দিকেও। অনিমা অঞ্জনের দিকে তাকিয়ে হাসল।
- একদিন এসোনা একটা রিসর্টে নিয়ে যাব,রিমা উইল নট মাইন্ড।
-চাকরির দাম নেবে?অনিমা প্রশ্ন করল চঞ্চলকে।চঞ্চলের সারা শরীরে দামি পারফিউমের গন্ধ, মুখে স্কচের।মেয়েদের জন্যে রেড ওয়াইন আছে । সবাই খাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। চঞ্চল অনিমার হাত ধরল ,টান দিল হাতে।
-কোথায়?
-আরে এসো না । চঞ্চল অনিমাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকল তিনতলায়। একসময় সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পড়ে অনিমার ঠোঁটে ঠোঁট রাখার চেষ্টা করল চঞ্চল ।নিজেকে ছাড়িয়ে নিল অনিমা।
-না। অনিমা বেশ জোরের সাথে কথাটা বলল।তারপর বলল , ‘আমি একজনকেই ভালোবাসতাম। সে সুপ্রভাত। আজোও বাসি।আর মানুষের মত মানুষ করতে চাই আমার ছেলেকে।ও ওর বাবাকে শ্রদ্ধা করতে পারে না, মাকেও যদি না শ্রদ্ধা করতে পারে ,তাহলে ও কি করে বাঁচবে, কি নিয়ে ?
চঞ্চল অনিমার হাতটা ছেড়ে দিল । অনিমা ঘুরলো। ঘুরেই দেখল সিঁড়ির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে অঞ্জন, অবাক হয়ে তাকিয়ে মেশোমশাইএর দিকে।অনিমার দিকে না তাকিয়েই অঞ্জন বলল, ‘মা, বাড়ি চল’ ।
-চল, খাবে না বাবা? অঞ্জনকে অনিমা বলল।
-না মা, চারপাশে গন্ধ , বিচ্ছিরি গন্ধ।
- কিসের গন্ধ? চঞ্চলের অহঙ্কারে লেগেছে।
- মদের। অঞ্জন বলল ।চঞ্চল অবাক হয়ে দেখছে অঞ্জনকে । একেবারে নূতন অঞ্জন।এই অঞ্জনকে ও আগে কখন দেখেনি।
অনিমা অঞ্জনের হাত ধরে হলঘর অতিক্রম করল।
-কি হল ? কোথায় যাচ্ছিস তোরা । রিমা দৌড়ে এল।
-বাড়ি, ওর গা গুলোচ্ছে মদের গন্ধে । ওরতো অভ্যেস নেই!
-দাঁড়া , দাঁড়া একটু দাঁড়া, রিমা দৌড়ে গিয়ে খাবারের দুটো প্যাকেট করে আনলো।
বাইরে দাঁড়িয়ে মোবাইলের অ্যাপ থেকে একটা ট্যাক্সি ডেকে দিল।
-সোজা বারাসাত নিয়ে যাবে , কোথাও দাঁড়াবে না । ট্যাক্সিকে রিমাই টাকা মিটিয়ে দিল। ট্যাক্সিটা ছাড়ার আগে রিমা ট্যাক্সির কাঁচে আঙুল দিয়ে ধাক্কা দিল। অনিমা কাঁচ নামাল। রিমার চোখ ভর্ত্তি জল।ভারি গলায় বলল, ‘সাবধানে যাস’।
রাস্তায় অঞ্জন তাকিয়ে থাকল শুধু মায়ের দিকে। মায়ের দুচোখ দিয়ে জল নামছে।রাস্তার আলোয় চিকচিক করছে চোখের জল।মায়ের হাতটা তুলে মুখের ওপর নিয়ে চুমু খেল অঞ্জন।তারপর মায়ের বুক ঘেঁষে নিজের শরীরটা শুইয়ে দিল।ভেজা গলায় বলল, ‘তুমি খুব ভালো মা, খুব ভালো’ ।ওর মাথায় হাত রেখে ফুঁপিয়ে উঠল অনিমা।