Sanghamitra Roychowdhury

Classics

3.1  

Sanghamitra Roychowdhury

Classics

অন্ধ অতীত

অন্ধ অতীত

6 mins
1.2K


স্মৃতিকণা সন্তানসম্ভবা। স্মৃতিকণা নামটা নিয়ে ওর শ্বশুরবাড়ির সবাই প্রথম প্রথম খুব বাঁকা হাসি হাসতো। বড্ড সেকেলে নাম। তবে প্রিয়াংশুর কোনো আফসোস নেই, বরং নামটা ছোট করে নিয়েছে। আদর করে কণি বলে ডাকে। তাই নিয়েও আড়ালে হাসি মস্করা চলে যে, তা প্রিয়াংশু বিলক্ষণ জানে। তবে কণিকে প্রিয়াংশু বাস্তবিকই বড়ো ভালোবাসে। তাই সেদিন অফিস থেকে ফিরে কণির মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া এবং তার কারণটা যখন জানতে পারলো, প্রিয়াংশু সাঙ্ঘাতিক উৎফুল্ল। হাসতে হাসতে হৈহৈ করে উঠলো, "উফ্, আমি বাবা হবো? ভাবতেই কেমন উত্তেজনা হচ্ছে!" প্রিয়াংশু আনন্দে কণিকে জড়িয়ে ধরে বলে, "কী, দারুণ খুশি তো?"


ঠোঁট ফুলিয়ে কণি বলে, "না, একদম না! ধুৎ! ভাল্লাগেনা যাও! বিয়ের পরে সবাই কত্তো ঘোরে, বেড়ায়, আনন্দ করে। আর আমার অবস্থা দেখো!"



প্রিয়াংশু কণিকে বুকের মধ্যেই লেপটে নিয়ে, কণির চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, "সত্যিই তুমি খুশি ন‌ও?"



"না, মানে এতো তাড়াতাড়ি আমি চাইনি। কোথায় একটু ঘুরবো, ফিরবো, আনন্দ করবো! তা না, বড্ড তাড়াতাড়ি আটকা পড়ে যাবো যে...", আদুরে গলায় বলে কণি, মানে স্মৃতিকণা, অর্থাৎ প্রিয়াংশুর বৌ। মাত্র কয়েকমাস আগেই ওদের বিয়ে হয়েছে।



আস্তে আস্তে প্রিয়াংশু বলে, "এই ক'মাসের মধ্যে তো আমরা গেছি হানিমুন ছাড়াও আরো দু-একটা ট্যুরে। আবার যাবো, বাচ্চাটা একটু বড়ো হলেই আবার ওকে নিয়েই দু'জনে মিলে আরো অনেক অনেক ঘুরবো বেড়াবো।"



"হ্যাঁ, ঐ হানিমুন আর দু'দিনের জন্য শান্তিনিকেতন আর পুরী যাওয়া! ওটাকে কি ঘোরা বলে, বলো", গলায় অভিমান আর আফসোস মিলিয়ে মিশিয়ে কণি বলে মিহি সুরে।



"সে কি? হলো না? মানে ওটা বেড়াতে যাওয়া নয়? তারপর বন্ধুরা আর তাদের বৌয়েরা সবাই মিলে যে ফ্রেজারগঞ্জ, বকখালি, রায়চক... এইসব জায়গায় গেলাম, ভুলেই গেছো? কয়েকমাসে আর কত ঘোরা হবে বলো? আর তুমি যে সুযোগ পেলেই খালি বাপেরবাড়িতে গিয়ে বসে থাকো, তার বেলা?" হাসতে হাসতেই বৌয়ের মাথার চুলে ঠোঁট ডুবিয়ে বলে ওঠে প্রিয়াংশু।



মুখে অসন্তোষ প্রকাশ করলেও ক্রমশঃ স্মৃতিকণা পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিলো। দুই পরিবারের উচ্ছ্বাসে ও হাসিখুশিতে, আনন্দে... এখন বরং খানিকটা খুশিই আছে স্মৃতিকণা।



পরিবারে এই বাঁধভাঙা খুশির সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু নতুন এক সমস্যাও এসে হাজির হলো। প্রিয়াংশুর দাদা-বৌদি বিয়ের দশবছর পরেও নিঃসন্তান। অনেক ডাক্তার, চিকিৎসায় গত কয়েক বছরে জলের মতো টাকা খরচ করেছে দাদা। দুই ভাইয়ের মধ্যে দাদার আয়টা একটু কম। তবুও চেষ্টার ত্রুটি নেই। কণিকে দেখছেন যে গাইনোকোলজিস্ট, প্রিয়াংশু বৌদিকে সেই ডাক্তার দেখানোর পরামর্শ দিলো দাদাকে। ভারী মাসে কণি বাপেরবাড়িতেই রয়েছে। প্রিয়াংশু দাদা-বৌদিকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে গেলো। চিকিৎসাও শুরু হলো।




ডাক্তার সবরকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানালেন, সমস্যাটা প্রিয়াংশুর দাদার। সময়সাপেক্ষ চিকিৎসা। বিরাট খরচবহুলও বটে। শুধুমাত্র ওষুধে নির্ভর করলে কতটা ফল পাওয়া যাবে, সে ব্যাপারে ডাক্তারবাবুর নিজেরই সংশয় রয়েছে। তবে শেষ একটা চেষ্টা করা যেতে পারে, আইইউআই। তাতেও সফলতার গ্যারান্টি খুব বিশেষ নেই। কারণ দাদার স্পার্ম কাউন্টের ভয়ানক সমস্যা। তবুও ঐ একটা চেষ্টামাত্র, IUI অর্থাৎ intra uterine insemination মানে বৌদির জরায়ুতে ভ্রূণ গঠনের চেষ্টা। না হলে স্পার্ম ব্যাঙ্কের ডোনারের সাহায্য নিতে হবে। ছোট্ট একটি অপারেশন হয়ে যায় প্রিয়াংশুর বৌদির। ফলাফল আশানুরূপ হলো না। দাদা-বৌদি এবং পরিবারের সব আশায় জল ঢেলে দিয়ে বৌদির অপারেশনটা সাকসেসফুল হলো না।





নির্ধারিত সময় পার হয়েছে, স্মৃতিকণার অল্প কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। ব্লাড প্রেসার অত্যন্ত বেশী। কোনো লেবার পেইনও ওঠে নি। আর অপেক্ষা করা সমীচীন নয় মনে করেই ডাক্তারবাবু সিজারিয়ান সেকশন করে ডেলিভারি করালেন। স্মৃতিকণার মা বাবা ওকে নিজেদের কাছে নিয়ে গেলেন, হসপিটাল থেকে রিলিজ হবার পরেই। ছেলে ও ছেলের মা দুজনেই সুস্থ আছে। আনন্দে ভরপুর প্রিয়াংশুর মনে ছোট্ট একটা কাঁটা খচখচ করছে দাদা বৌদির‌ জন্য।





বৌদির প্রথম চেষ্টায় আইইউআই সফল হয়নি। দ্বিতীয় একটা চেষ্টা করতেই হবে। ডাক্তারবাবুর তাই মত। এই ভয়টা বাড়ির সকলের ছিল‌ই। ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলে আবার ট্রিটমেন্ট শুরু হলো। এবারে বৌদির আইভিএফ করানো হবে। ভাঙা মনে প্রিয়াংশুই উদ্যোগ নেয় বৌদির পরবর্তী চিকিৎসার জন্য। পরের বারে সফল হলো আইভিএফ এবং বৌদির‌ও ছেলেই হলো। দেখতে দেখতে দাদা- বৌদির ছেলে দু'মাসের হলো। প্রিয়াংশু শিলিগুড়িতে বদলি হলো তখনই। বৌকে আর বছরখানেকের ছেলেকে নিয়ে প্রিয়াংশু নতুন কর্মস্থলে শিফট করেছে। দাদা-বৌদির ছেলের ছ'মাস হতেই অন্নপ্রাশনের দিন ঠিক হতে খবর পাঠালো বাড়ি থেকে প্রিয়াংশুদের। কিন্তু সবে এই ক'মাস শিলিগুড়িতে এসেছে। কাজের চাপে আর এক্ষুণি ছুটি নিয়ে কলকাতায় আসা সম্ভব নয়। আর স্মৃতিকণাও ছোট ছেলেকে নিয়ে একলা যেতে পারবে না। সুতরাং দাদা-বৌদির ছেলের অন্নপ্রাশনে স্মৃতিকণা আর প্রিয়াংশুর আসা হলো না।




সেবারে পুজোর সময় প্রিয়াংশু কণি আর ছেলে ডোডোকে নিয়ে কলকাতায় এলো কয়েকদিনের জন্য। প্রথম দু-চারদিন সব ঠিকঠাকই ছিলো। গোলটা বাধলো তারপরই। কণির ছেলে ডোডো আর বৌদির ছেলে জোজো... খুড়তুতো জ্যেঠতুতো ভাই। প্রায় সমবয়সী। সারাক্ষণ খেলছে দু'জনে। খুব মিল দু'জনের। আর পাড়া প্রতিবেশীর মুখে মুখে ঘুরতে লাগলো, "কে বলবে, খুড়তুতো জ্যেঠতুতো ভাই, দেখে মনে হয় যমজ ভাই। শুধু সাইজে একটু ছোট বড়ো।" প্রথম প্রথম কণি গা করে নি। তারপর কণি একদিন ডোডো আর জোজোকে পাশাপাশি বসিয়ে, থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে ছিলো ওদের সামনে। প্রিয়াংশু, "কী হয়েছে", বলতেই... ফেটে পড়লো কণি। প্রিয়াংশুর শার্ট খামচে ধরে হিস্টিরিয়া রুগীর মতো কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করে উঠলো, "আমি যা ভাবছি, তা কী সত্যি? একদম সত্যি কথা বলবে, একদম সত্যি কথা...", হাউহাউ করে কেঁদে ফেললো।

প্রিয়াংশু আর কণি, কেউই খেয়াল করে নি, কখন এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে বৌদি।




বৌদির ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি। স্বরে বিদ্রুপ আর ব্যঙ্গ মেশামেশি। ঐভাবে হেসেই বৌদি বলে ওঠে, "এতোটা উপকার আমার না করলেও পারতে প্রিয়াংশু। ভাইয়ের জায়গা, বন্ধুর আসন দিয়েছিলাম তোমায়। এই প্রতিদান তার? অনেককাল আগে একটা হিন্দি সিরিয়াল দেখেছিলাম, কালীগঞ্জ কী বহু, কোনো একটা বিখ্যাত উপন্যাসের ভিত্তিতে! আর ঘোর বাস্তবে তোমরা তো তাকেও ছাপিয়ে গেলে! আর তো, কোনো সম্বোধন চলতে পারে না!"

বৌদির দু'চোখ থেকে জ্বলন্ত অঙ্গার ঝরছিলো যেন।

জোজোকে কোলে তুলে বৌদি ধীরপায়ে নিজের ঘরে চলে গেলো বোধহয়। মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে প্রিয়াংশু। বড়ো ভুলই হয়ে গেছে হয়তো! সে কাকা না বাবা?




স্মৃতিকণা ডোডোর আর নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলো। ওরও চোখের জলের জায়গায় আগুনে গরম হলকা। সারারাত ব্যালকনিতে বসেই ছিলো। গোটা বাড়ি জুড়ে শ্মশানের স্তব্ধতা। সকাল হতেই ছেলেকে নিয়ে কণি চলে গেলো বাপের বাড়ি। বৌদিও জোজোকে নিয়ে এককাপড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলো, কণি বেরোনোরও আগে। কারুর সাহসে কুলোয় নি, বৌদি অথবা কণিকে কোনো প্রশ্ন করতে। সেই দিনই ফিরে গিয়েছিলো প্রিয়াংশু আবার শিলিগুড়িতে।




যেকথাটা কেবলমাত্র ডাক্তার আর প্রিয়াংশুর বাবা মা দাদা ছাড়া আর কেউ জানে না, এমনকি বৌদিও জানতো না, সেই কথাটা কণি আন্দাজ করে ফেললো লোকমুখে খালি ডোডো জোজোর কী মিল, এই কথাটা শুনে শুনেই। স্মৃতিকণার সন্দেহ অমূলক নয় একেবারেই। বৌদির সন্তান আসলে বাঁকাপথে প্রিয়াংশুরই। তাই প্রিয়াংশু সামান্য প্রতিবাদও করতে পারে নি। প্রতিবাদ করলে বা কণিকে বোঝানোর চেষ্টা করলে কে জানে কী প্রতিক্রিয়া দিতো কণি। ঝুঁকিটা নেয় নি প্রিয়াংশু কোনো সাফাই দেবার। 





বাবা মায়ের গোঁড়ামি... বড়ো ছেলের বংশরক্ষা হোক বংশের রক্তেই, বংশের পিতৃবীজেই। বড়ো ছেলে পিতৃত্বে অপারগ, তাতে কী? তাই বলে ছোট ছেলে তো আর অপারগ নয়। সুতরাং প্রিয়াংশুর স্পার্ম ডাক্তারবাবুর স্পার্ম ব্যাঙ্ক ঘুরে প্রতিস্থাপিত হলো আইভিএফ করে বৌদির জরায়ুতে। বৌদিকে কিচ্ছু জানানোই হয় নি। বৌদি জানলে রাজী হতো না কিছুতেই। বরং পারিবারিক কেচ্ছা চাপা থাকতো না। প্রিয়াংশুর ভেতরটা জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে অব্যক্ত অন্তর্দহনে, সেই দিন থেকেই, যে সকালে ও গিয়ে স্পার্ম প্রিজার্ভ করিয়ে এসেছিলো স্পার্ম ব্যাঙ্কে। কণির পেটে তখন ডোডো। বাবা মা দাদা প্রায় ঠেলেই পাঠিয়েছিলো প্রিয়াংশুকে ক্লিনিকে। তবে কখনো ও প্রকাশ করতে পারে নি একথা কোথাও, কারুর কাছে। শুধু প্রাথমিক আবেগ কেটে যাবার পরে ও বুঝেছে, বাবা মা দাদা এবং প্রিয়াংশু নিজে সবাই মিলে চূড়ান্ত অনৈতিক কাজ করেছে, অন্ধ এক গোঁড়ামির বশে।




 দুই ভাইয়ের দু'টো সংসারের ভাঙ্গন চুরচুর করে গুঁড়িয়ে দিলো, সব আশা ভরসা বিশ্বাস নির্ভরতা সম্পর্ক, যথাসর্বস্ব। প্রিয়াংশু আর কলকাতার বাড়িতে আসে নি। এমনকি বাবা মা মারা যেতেও। দাদা আজকাল একলা কলকাতার বাড়িটা আগলে নিয়ে ভূতের মতো বসে আছে। চেনা পরিচিত মহলে ঢিঢি পড়ে গিয়েছিলো। তা আর সামলানোর কোনো চেষ্টা করে নি প্রিয়াংশুরা। সব তছনছ। একটি অন্যায় সিদ্ধান্ত, নষ্ট ছ'টা জীবন। দুর্বিষহ জীবন যাপন।



একে একে আঠেরো বছর পার। অফিসের কাজে প্রিয়াংশু কলকাতায় এসেছে। ভাঙাচোরা শরীর। ততোধিক ভাঙাচোরা মন। কাজকর্ম মিটিয়ে একবার দাদার সাথে দেখা করে প্রিয়াংশু ফিরছে ব্যাঙ্গালোর, নিজের কর্মস্থলে। হাওড়া থেকে যশোবন্তপুর দুরন্ত এক্সপ্রেসের কামরায় বসে খবরের কাগজে ডুবে আছে প্রিয়াংশু। সহযাত্রী দুই সদ্য তরুণ। তারাও যাবে ব্যাঙ্গালোরেই। দু'জনকেই ট্রেনে তুলে দিতে এসেছে তাদের মায়েরা। খবরের কাগজে মুখ আড়াল করে কোনোক্রমে প্রিয়াংশু নিজেকে লুকিয়েছে। ‌কণি আর বৌদি। অর্থাৎ ডোডো আর জোজোকে পড়তে পাঠিয়েছে ব্যাঙ্গালোরে। ওদের কথাবার্তায় মালুম হলো কণি আর বৌদি বুটিকের ব্যবসা করছে একসাথে। একই বাড়িতে থাকে। নিজের অজান্তেই অহেতুক প্রতারিত দুই নারী একজোট হতে পেরেছে একই জীবনস্রোতে। শুধু সেই স্রোতে মিশতে পারার জায়গা নেই কোনো প্রিয়াংশুর। ভাগ্যের কী নিষ্ঠুর পরিহাস! 




সিগন্যাল পেয়ে ট্রেন হেলেদুলে চলতে শুরু করলো গন্তব্যের দিকে। আর উল্টোদিকের সিটে বসা প্রিয়াংশুর দুই আত্মজ। অথচ অন্ধ অতীতের কালো করাল ছায়ায় পূর্ণগ্রাস গ্রহণ লেগে আছে প্রিয়াংশুর পিতৃত্বে। রেলের দুই পটরির মতোই কখনো মিলতে পারবে না হতভাগ্য বাবা তার অভাগা ছেলেরা।

অন্ধ অতীতের গাঢ় অন্ধকারে কোনো আলোর প্রকাশ হতে পারবে কি কখনো? ভবিষ্যতের কাছেই সেই উত্তর পোঁতা আছে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics