হৃদয়ে দেশভাগ (ধারাবাহিক) ৩
হৃদয়ে দেশভাগ (ধারাবাহিক) ৩
হৃদয়ে দেশভাগ (ধারাবাহিক) ৩
৩
কিছুদিন যাবৎ কানে আসছে নানান উড়ো খবর, দেশটা নাকি ভাগ হয়ে যাবে। তবে কর্মব্যস্ত মনার পরিবারের কেউ তেমন কানে তুলছে না, কিন্তু খবরটা উড়ছে, কখনো নদীর ঘাটে, কখনো গঞ্জের হাটে আবার কখনোবা ঘরে আসা গৃহস্থের কুটুম্বদের মুখে মুখে। ইন্দুর জায়েরা, ইন্দু আর পিসিশাশুড়ি নিজেদের মধ্যেই চাপা আলোচনা করে। এতোরকম খবরে বাড়ীর পুরুষেরা আজকাল একটু গম্ভীর। তবু কোনোই স্পষ্ট ধারণা নেই এই দেশভাগের সম্বন্ধে।
এরমধ্যেই মনার বৈমাত্রেয় দাদারা আর নিজের দাদাটিও পৈতৃক ব্যবসার নিজের নিজের অংশ বুঝে নিতে চায়। মনার কেবল কোনো বিষয়ে কোনো তাপ উত্তাপ নেই। উনিশশো সাতচল্লিশের গোড়ায় মনার বড়দাদা ভূপেনের বড়ো দুই ছেলে কোলকাতায় চলে গেলো পড়তে। চিঠি চাপাটির লেনদেন দু-একবার হতে না হতেই মাস দুই-তিনেকের আড়াআড়িতে মনার চার দাদাই নিজের নিজের পরিবার আর পৈতৃক ব্যবসার ভাগস্বরূপ মোটা টাকা বুঝে নিয়ে কোলকাতায় পাড়ি দিলো। "দ্যাশের" বাড়ীতে রয়ে গেলো মনা তার পরিবার নিয়ে, বড়দাদা ভূপেন আর তার স্ত্রী এবং কোলের যমজ ছেলেমেয়ে দু'টি। আর রইলো মনাদের বৃদ্ধা পিসি। অতবড়ো একান্নের সংসারটা কেমন ভেঙে খান খান হয়ে গেলো। সবাই মনমরা। মুখ শুকনো করে দৈনন্দিন কাজকর্মের গতানুগতিক ধারায় সবাই।
মনা ইন্দুর বড়ো মেয়ে রমলা দেখতে দেখতে আটে পা দিয়েছে, ভারী সুন্দর দেখতে, কিন্তু রমলা ভারী ভীতু চুপচাপ গোছের। ছ'বছরের ছোট বোন কমলা তো বটেই, এমনকি সাতবছরের ছোট বোন বিমলাও বড়দিদিকে মোটে মান্য করে না। রমলা মায়ের পায়ে পায়েই ঘোরে সর্বক্ষণ। রমলা বড়ো জ্যাঠামশাইয়ের বড্ড আদরের। কাজে কাজেই জ্যাঠামশাইয়ের আদরে সেও পাঠশালায় যেতে চাইলো না কিছুতেই। এই নিয়ে ইন্দুর মনে চাপা অসন্তোষও ছিলো। অগত্যা বড়ো মেয়েকে হাতের কাজ আর ঘরকন্নার কাজেই ইন্দু তালিম দিতে থাকলো। খুব সকালে ইন্দু পাগের ঘরে (রান্নাঘরে) ব্যস্ত, কাজে ভুল করার জন্য বড়ো মেয়েকে বকাবকি করছে। দু'বছরের মেজো মেয়ে আর একবছরের ছোটো মেয়ে বাবার কাজে যাবার আগে বাবার সাথেই বাবার পাতে বসে ঘিয়ে মেখে গরম গরম সিদ্ধভাত খাচ্ছে। বাড়ীর বাকীরাও যে যার নিত্যকর্মে ব্যস্ত। হন্তদন্ত হয়ে মনাদের বাড়ীতে ঢুকলো রমজান আলি।
বাড়ীর সকলের বিস্ফারিত দৃষ্টির সামনে রমজান আলি বলে চলেছে, "মনারে, দ্যাশডা ভাগ অইয়া যাইতাসে। তরা কইলকাতায় চোইল্যা যাবি নিকি?"
ঝড়ের বেগে রমজান আলি কথাগুলো বলেই চলে গেলো। আর সে ঝড়ের দাপটে মনাদের নিরিবিলি পরিপাটি সংসারের উপরে কয়েক মিনিটের মধ্যে নেমে এলো যেন এক করাল ছায়া, দেখা দিলো অশনি সংকেত।
কী হতে চলেছে তার কোনো সম্যক ধারণা কারুর নেই। তবে খুবই গুরুতর কিছু বিষয় যে, এ ব্যাপারে কারোরই কোনোই সন্দেহ নেই। বাকরূদ্ধ পরিবারের প্রাপ্তবয়স্করা আর শিশুগুলি ভীত সন্ত্রস্ত, কান্নাকাটি ভুলেছে। যা খাবার রান্না হয়ে গিয়েছিলো তাই দিয়েই ইন্দু বাড়ীর সকলকে খাইয়ে দিলো। তারপর গোছাতে বসলো ইন্দু, ইন্দুর বড়োজা আর ওদের পিসিশাশুড়ি। লুকিয়ে পালানো এখন আপাতত কিছুদিনের জন্য, সেরকমই ধারণা মনার বড়দাদা ভূপেনের। পরিস্থিতি অল্প দিনেই স্বাভাবিক হবে, তখন আবার ফিরে আসবে। যৎসামান্য সঙ্গে নিয়েই চলা হোক, ভূপেনের মতে। পরনের কিছু কাপড় চোপড়, গয়নাগাটি আর নগদ টাকাকড়ি শুধু নিলেই হবে। কলকাতায় চার ভাই আগে থেকেই আছে তো, পৌঁছতে পারলে আর কোনো সমস্যাই হবে না। হয়তো কয়েকমাস, ফিরে আসবে তারপর সবাই নিজেদের দেশে আবার।
বড়ো বড়ো ক'টা বোঁচকা, ছোট ছোট ক'টা পোঁটলা আর বুড়ি পিসির পুঁটলিতে ঠাকুরের পট আর মনার মায়ের সোনা-রূপোর গোপাল (ঠাকুর কি অভুক্ত থাকবে?) নিয়ে রওনা হওয়ার জন্য তৈরী হয়েছে সপরিবারে মনা। উঁচু দালানকোঠা ঘরটা থেকে ইন্দু এখনো বেরোয় নি, দেখতে গেলো মনা, রমজান আলি এসে গেছে যে, ফুলবাইড়া (ফুলবাড়িয়া) গ্রাম ততক্ষণে ফাঁকা প্রায়। মনা ঘরে ঢুকে দেখে একটা কাপড়ে নিজের আর মেয়েদের সব গয়নাগাটি আঁটোসাঁটো করে জড়িয়ে ইন্দু নিজের পেটে বেঁধে পেটটা মোটা উঁচু করে ফেলেছে। ঠিক যেন গর্ভবতী। ম্লান হাসি হেসে ইন্দু জানালো যে তিনমাস চলছে, সত্যিই ইন্দু গর্ভবতী আবার, এখনো বলা হয়ে ওঠে নি স্বামীকে। বড়ো জা আর পিসি কেবল জানে।
মনার বড়দাদা ভূপেন গদিঘরের দেরাজ থেকে আর নিজের শোবার ঘরের মেহগনি কাঠের আলমারি থেকে সমস্ত নগদ টাকাকড়ি গুছিয়ে কাপড়ের তবিল থলিতে ভরে বেঁধে নিলো কোমরে, ধূতির তলায়। বৌ মেয়ের গয়নাগাটি সবটাই পরিয়ে দিলো তাদের গায়ে। এরপরে ভূপেন ডাক দিয়ে বললো, "মনা রে, যাত্রা করনের আগে, ন, ঠাকরাইনের দুয়ারে গইড় পাইড়্যা নই।" নীরবে মনা অনুসরণ করলো বড়দাদাকে। তার মায়ের ভারী সাধের আটচালা ঠাকুরঘরের সামনের বাঁধানো চাতাল করা উঠোনে দুইভাই গড়াগড়ি দিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালো। দু'জনের মনের মধ্যেই ওঠা তোলপাড় করা ঝড়ের হদিশ হয়তো দু'জনেই দু'জনের নিশ্চুপ আত্মার অনুভবে পাচ্ছে।
চোখের জলে ভাসতে ভাসতে মনারা চলেছে ধলেশ্বরীর নৌকা ঘাটের..... তাদের নিজস্ব ঘাটের পথে। সব রয়েছে পড়ে, খোলা ঘর-দুয়ার, গোয়াল ভরা গরু, আস্তাবলে ঘোড়া, ঘাটে বাঁধা নৌকার সার, ফলের আর নারকেল-সুপারির বাগান, মিঠা পানের বরজ, কারখানা ঘর, সংসার-গৃহস্থালির সর্বস্ব। মনার মায়ের সাধের আটচালা ঠাকুরদালান, মনার বাবার নিজের হাতে তৈরী গোপালের তিনতলা রথ..... সব রইলো পড়ে পিছনে, খোলামেলা, দোস্তোদের, আর রয়ে যাওয়া প্রতিবেশীদের ভরসায়, পরম বিশ্বস্ততার বন্ধনে। ঘর ছেড়ে বেরোবার সময় ছ্যামায় উষ্টা (চৌকাঠে হোঁচট) খেয়ে মনার মনটা ভারী কু-ডাক দিয়ে দিয়েছিলো। ফিরে ঘরে গিয়ে নিজের একটা ধুতিকাপড় ভাঁজ করে চার কোণায় গিঁট দিয়ে ঝোলা বানিয়ে কে জানে কী ভেবে তার মধ্যে কারখানা থেকে হাতুড়ি, বাটালি, রাঁন্দা আর দু-একটি কাজের যন্ত্রপাতি ভরে মনা নিজের কাঁধেই ঝুলিয়ে নিয়েছিলো। অস্থির মন, চোখ থেকে গরম ভাপ বেরোচ্ছে, কানে তালা।
আবাল্য খেলার সাথী রমজান আলি আর তার বৃদ্ধা আম্মি ফতিমা বেওয়া, আজন্মকালের প্রতিবেশী মনাদের, আত্মীয়ের ঊর্দ্ধে, মনার মায়ের আর পিসির 'আসমানতারা সই'...... ওদের সঙ্গে সঙ্গে পথ হাঁটছে। বৃদ্ধার হাতে একটা বড়সড় পোঁটলা। ইন্দুর আর ইন্দুর বড়োজায়ের থুতনি ছুঁয়ে চুমো খেয়ে, আঁচলের খুঁটে চোখ মুছে বৃদ্ধা ফতিমা খালাম্মা আবার বললো, "মনা রে, এই বোস্কাডা কান্ধে ফালাইয়া থো রে, কয়ডা নাড়ু মোয়া আর সিড়া হুড়ুম গুড় দিসি, খিদা ধরলে অরা.... অই পোলাপাইনেরা খাইবো অনে।" মনার দু'গাল বেয়ে পদ্মা-মেঘনা। কিছু বলতে পারলো না মনা, শুধু জড়িয়ে ধরলো খালাম্মাকে। ডুকরে ডুকরে কাঁদতে কাঁদতেই বৃদ্ধা বললো, "কান্দস ক্যা, বেবাক্তেই আইয়া পড়বো নে, তরাও ফিইরা আইয়া পইড়স বেবাক্তের লগে।" মনা তো ভাষা হারিয়ে বসে আছে, মসৃণ নিস্তরঙ্গ জীবনের এই হঠাৎ ছন্দপতন, আসন্ন ঝঞ্ঝার অনুচ্চারিত আগমন মানতে পারছে না। মনার বড়দাদা ফতিমা বেওয়ার হাতদুটো ধরে বললো, "খালাম্মা, হগ্গলডি রইসে পইড়্যা আপনেগো জিম্মায়, দেইখ্যা হুইন্যা থুইয়েন। কী আর কমু জানা নাই, খালাম্মা। ঘুইরা আইতে আসি।"
তখনও তো মনা বা মনার পরিবারের কেউই জানতেই পারে নি ভিড়ের চাপে তারা সবাই একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। পৌঁছতে পারবে গন্তব্যে। কে কোথায় গিয়ে, কিভাবে কখন কোনখানে পৌঁছবে, তা ওদের কেউই ঘূর্ণাক্ষরেও আন্দাজ করতে পারে।নি। কেন, কোথায়, কখন প্রশ্নগুলো তখন ওদের কাছে হয়তো অবান্তর মনে হয়েছিলো।