STORYMIRROR

Aparna Chaudhuri

Inspirational Classics

4  

Aparna Chaudhuri

Inspirational Classics

উস্মান ভাই

উস্মান ভাই

6 mins
1.3K


অমৃতা একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ করে। অফিসের কাজে মাঝে মাঝেই তাকে বাসস্থান মুম্বাই থেকে দেশের অন্যান্য জায়গায় যেতে হয়। প্রথম প্রথম ছেলে আর মেয়েটাকে স্বামী অরুণের কাছে রেখে আসতে কেমন একটা অপরাধ-বোধ কাজ করতো ওর। মনে হত কি জানি যদি বাচ্চাগুলোর মনে হয় যে ওরা মায়ের কেয়ার পাচ্ছে না! এখন অবশ্য ব্যাপারটা বেশ গা সওয়া হয়ে গেছে। সত্যি কথা বলতে কি মাঝে মাঝে এরকম একটা সলিটারই ব্রেক, খারাপ লাগেনা অমৃত- র...... ‘মি টাইম’...... যদিও কখনও সে কথা অরুণের কাছে স্বীকার করতে পারেনি ও। 

কাজে পুণে যাচ্ছে অমৃতা । ট্যাক্সি নিয়েছে সে। ক্লায়েন্ট বলেছে চলে আসতে, ভাড়া রি-ইম্বার্স করে দেবে।

অফিস থেকেই ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। কিন্তু ট্যাক্সির ড্রাইভারটিকে দেখে একটু দমে গেলো অমৃতা।চোখে সুরমা আঁকা, দাঁড়িতে মেহেন্দি করা , প্রায় ছফুট লম্বা, এক পাঞ্জাবী মুসলমান। বয়স পঞ্চান্ন ষাট হবে, কিন্তু মুখের কয়েকটি বলিরেখা ছাড়া, সেটা শরীরের আর কোথাও থেকে বোঝা মুশকিল। সোজা সুঠাম শরীর। ওর সুটকেসটাকে একটা খেলনা বাগের মত তুলে গাড়ীর ডিকিতে ভরে, হেসে বলল,” ম্যাডাম, ম্যায় আপকা ডেরাইভার। মেরা নাম হ্যায় উস্মান শেখ। আপ মুঝে উস্মান ভাই বুলা সাক্তে হো। “

খুব শঙ্কিত ভাবে গাড়ীর পিছনের সিটে বসে অমৃতা একবার ভাবল অরুণকে গাড়ীর নম্বরটা মেসেজ করবে কিনা। তারপর নিজেকে শক্ত করলো ও, এখন ঝক ঝকে দিন অমৃতা , আর এটা রেজিস্টার্ড কোম্পানির ট্যাক্সি। আর তা ছাড়া, পেশাগত ব্যাপারে ওরা সাধারণত কেউ কাউকে বিরক্ত করে না। যখন ওরা ওদের কোর্ট শিপের পর, বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়, ওরা দুজনেই নিজের নিজের পেশায় সুপ্রতিষ্ঠিত। এটা ওরা দুজনেই জানত, যে, ওরা কেউই নিজেদের কেরিয়ার ছাড়বে না পরিবারের জন্য। এই নিয়ে কোন ভুল বোঝাবুঝি নেই ওদের মধ্যে। যখন অরুণ ট্যুরে যায় অমৃতা দায়িত্ব নেয়, আর যখন অমৃতা যায় তখন অরুণ।

এসব ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল অমৃতা । হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেলো উস্মান ভাই-এর গলার স্বরে,” আপ কামসে যা রাহে হো ক্যা?”

“ হাঁ কিউ?” হাল্কা বিরক্তির সঙ্গে উত্তর দেয় অমৃতা ।

“ নাহি, আকেলি যা রাহি হো ইসি লিয়ে পুছা। বুরা মত মাননা। “ উস্মান ভাই এর লজ্জিত স্বর শোনা গেলো।

“ কিউ লড়কিয়া আকেলি নহি যা সাক্তি কেয়া?” বেশ মজা পেলো অমৃতা ।

“ নহি নহি , অ্যাইসি বাত নহি , আজকাল লড়কা লড়কি বরাবর। আপ বাঙালি হো? “

উস্মান ভাই মানুষটা একটু বেশী বকে, বুঝলো অমৃতা । নিজের ব্যাগ থেকে ল্যাপটপটা বার করতে করতে অন্যমনস্ক ভাবে উত্তর দিল,” হুম।“

“ ম্যায় ভি বহত দিন কলকত্তে মে থা। হামি ভি থোড়া থোড়া বাঙালি জানে। ফির দিল্লী মে থা কুছ সাল।“ হেসে বলল উস্মান ভাই।

ওর কথায় স্মিত হেসে অমৃতা ল্যাপটপটা কোলের উপর খুলে বসলো । ক্লায়েন্ট এর সাথে যা-যা আলোচনা করতে হবে তার পয়েন্ট গুলো একবার ঝালিয়ে নেবে সে। আগেও অনেকবার একা ট্যাক্সি নিয়ে হাইওয়েতে যাতায়াত করেছে সে, কিন্তু সাধারণত ড্রাইভাররা কথা বলে না। রেডিও চালু করে দেয়। কিন্তু এ একটু আলাদা।

ট্যাক্সি ততক্ষণে শহর ছেড়ে হাইওয়ে ধরেছে। দুদিকে শুধু সবুজ, আর ঝাঁ চকচকে হাইওয়ের উপর দিয়ে গাড়ী পক্ষীরাজের মত ছুটে চলেছে। ল্যাপটপ থেকে মুখ সরিয়ে অমৃতা জানালার বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে প্রকৃতির মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল।

“ আমি আগে ট্যাক্সি চালাতাম না, হামার নিজের গাড়ী ছিল, তিনটে। তাদের ভাড়া খাটাতাম। “ ও কাজ করছে না দেখে, বলে উঠলো উস্মান ভাই।

হঠাৎ অমৃতা-র আর কাজ করতে ইচ্ছা করলো না, “ সেগুলোর কি হল?” ল্যাপটপ বন্ধ করতে করতে জিজ্ঞাসা করলো অমৃতা ।

“ বেচে দিয়েছি। ওই লাইনে অনেক কামাই। আমরা টুরিস্টদের নিয়ে দিল্লী সে রাজস্থান, সিমলা- কুলু- মানালি, চার ধাম, এসব যায়গায় নিয়ে যেতাম। যাওয়া আসার জন্য ভাড়া পেতাম, তার উপর যে হোটেলে থাকবে, যেখানে খাবে, যেখানে কেনাকাটা করবে সবার থেকে আমাদের কমিশন থাকতো। তার ওপর থাকতো বকশিস।“ হাসল উস্মান ভাই।

“তাহলে বেচলে কেন?”

“ কি করবো? মায়ের ক্যানসার হল। আমার বিবি পড়াশোনা জানেনা। হাসপাতাল যানা, ডাক্তারদের সাথে বাত করনা, এসব ও পারে না। তাই আমি ছিলাম মায়ের সাথে। ও ঘর দেখত, বাচ্চাদের দেখত ...... আমি পুরো কোশিশ করেছিলাম, কিন্তু তবু মাকে বাঁচাতে পারলাম না। মা ভি গেলো , সাথে গাড়ীগুলো ভি গেলো ...... মরার আগের দিন যখন মা হোশ মে এসেছিল, আমার মাথায় হাত রেখে বলেছিল, উস্মান মেরা রাজা বনেগা।“ গলাটা ধরা ধরা শোনালো উস্মান ভাই-এর।

টিং করে একটা মেসেজ আসার শব্দ হতে হাতের মোবাইলটা ঘুরিয়ে দেখল অমৃতা , মায়ের

অ্যাকাউন্টে এমাসের টাকাটা ট্রান্সফার হয়ে গেছে। হঠাৎ মায়ের মুখটা মনে পড়ে গেলো। বাবা মারা যাবার পর কোলকাতায় ওদের বাড়ীতে মা একাই থাকে। প্রত্যেকবার এই মেসেজটা দেখে একটা অদ্ভুত আত্মপ্রসাদ অনুভব করে অমৃতা। কিন্তু আজ কেন জানিনা ওর মনটা হঠাৎ উদাস হয়ে গেলো। মা কে এবার কিছুদিন নিজের কাছে নিয়ে এসে রাখবে। ছেলে মেয়ে দুটোর ও তো দিদার আদর পাওয়ার অধিকার আছে, ভাবল সে।

“ ভালো চা খাওয়াবো আপনাকে। ইয়ে রাস্তা একদম উজড়া চমন ।“ নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠলো উস্মান ভাই।

“মানে?”

“ মানে রাস্তেমে কোন দুকান নাই। সামনে একটাই জায়গা আছে যেখানে চা, খাবার সব পাওয়া যায়। আপনি ওখানে ফ্রেশ হয়ে নেবেন , আমি আপনার জন্য চায় নিয়ে আসবো।“

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ওরা পৌঁছে গেলো সেই জায়গাটায়। উস্মান ভাই গাড়ীটা পার্ক করতেই অমৃতা লেডিস ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে গেলো। বেরিয়ে ওয়াশরুমের বাইরে উস্মান ভাইকে দেখে একটু অবাক হল ও।

ওকে দেখে উস্মান ভাই বলে উঠল ,” আপ গাড়ী মে হি বাইঠো। বাইরে সব ছেলেরা রয়েছে। কোন আউরাত নেই। আমি চা গাড়িতে এনে দিচ্ছি।“

ওকে গাড়িতে বসিয়ে, এসি চালিয়ে, দরজা সেন্ট্রাল লক করে দিয়ে চলে গেলো উস্মান ভাই। একটু বাদে ফিরে এলো দুকাপ চা নিয়ে। ওকে গাড়ীর ভিতরে চা দিয়ে নিজে বাইরে দাঁড়িয়ে চা শেষ করলো। তারপর ওর খালি কাপটা নিতে নিতে জিজ্ঞাসা করলো,” অউর কুছ চাহিয়ে আপকো। আগে কুছ নাহি মিলে গা।“

অমৃতা মাথা নেড়ে ‘না’ বলাতে গাড়ীতে স্টার্ট দিলো উস্মান ভাই। নিজেকে হঠাৎ খুব প্যামপার্ড লাগে অমৃতার । নিজের ছোটবেলায়, বাবা মার সাথে বেড়াতে যাওয়ার কথা মনে পড়ে যায় ওর । মানুষের বয়স যত বাড়ে , আবদার করার লোক ততই কমে যায়।

“ ওখানে একদল লরি ড্রাইভার আর কিছু বদমাশ ছেলে বসে দিনেরবেলা মদ খাচ্ছিল। তাই আপনাকে নামতে মানা করলাম। এই লোকগুলোকে আমি চিনি এরা ট্রাকে করে গলত সামান নিয়ে যায়।“

“ গলত মানে?”

“ আলু পিঁয়াজের মধ্যে সোনা, দারু, ড্রাগস সব নিয়ে যায়।“

“ পুলিশে ধরে না এদের?

“সব সেটিং থাকে। সবচেয়ে বেশি ড্রাগস তো পেট্রোল ট্যাঙ্কেতে যায়। প্যাকেটে পাত্থর বেঁধে সুতো দিয়ে ডুবিয়ে দেয়। তারপর ট্যাঙ্কি খালি হলে সুতো টেনে প্যাকেট বার করে নেয়। পুলিশ সব জানে, কিন্তু ধরেনা। ধরে আমাদের মত চুনোপুঁটিদের । “ গলার স্বরটা বেশ কঠিন শোনালো উস্মান ভাই এর।

অমৃতা খেয়াল করলো একটা পুলিশের গাড়ী ওদের পিছু নিয়েছে। “ উস্মান ভাই ওই পুলিশের গাড়ীটা কি...।“

“হ্যাঁ আমাদেরই পিছে আসছে । আমি গল্প করতে করতে খেয়াল করিনি , স্পিড থোড়া জাদা হয়ে গিয়েছিল।“ বলতে বলতে গাড়ী সাইডে করলো উস্মান ভাই।

পুলিশের গাড়ীটা এসে ওদের গাড়ীটার সামনে তেরছা করে দাঁড়ালো। সার্জেন্ট নেমে এলো, “ পেপার দিখাইয়ে।“

উস্মান ভাই গাড়ীর কাগজপত্র সব দেখাল।

সব দেখে সার্জেন্ট বলল,” লাইসেন্স ওয়াপিস চাহিয়ে তো তিনশো দো।“

“ রিসিট দো।“

“ ফির পানশো লাগেগা।“

“ ঠিক হ্যায় “ বলে, উস্মান ভাই একটা পাঁচশো টাকার নোট বার করলো......

“ ও তো বলছে তিনশ টাকায় হয়ে যাবে। তাহলে আপনি পাঁচশো কেন দিচ্ছেন?” ককিয়ে উঠলো অমৃতা ।

“ফির রিসিট নেহি মিলেগি।”

“রিসিট নেহি মিলা তো কেয়া। এই পয়সাটা তো তোমার পকেট থেকে যাবে।“

মুচকি হেসে পাঁচশো টাকা দিয়ে, নিঃশব্দে পাঁচশো টাকার রিসিটটা পকেটে ভরে গাড়িতে স্টার্ট দিলো উস্মান ভাই। তারপর ধীরে ধীরে বলল,” যদি আমি তিনশো দিতাম, তাহলে ওই টাকাটা সার্জেন্টের পকেটে যেত। আর এখন এই টাকাটা গভর্নমেন্ট এর কাছে গেল। দেশের কাজে লাগবে। আমি ছোটা আদমি, দেশকে লিয়ে কুছ নহি কর পাতা। এই টুকুই করি...”

অমৃতার মনে পড়ে যায় আগের সপ্তাহেই একটা মাইক্রো ওয়েভ আভেন কিনেছে, কাঁচা রসিদ নিয়ে। দোকানদার বলল বেকার জি এস টির অতগুলো টাকা এক্সট্রা কেন দেবেন? কেনার পর, বেশ জয়ের আনন্দ হয়েছিল, অনেকগুলো টাকা বেঁচে গেলো। আজ হঠাৎ নিজেকে খুব ছোট মনে হল। ক-টাকাই বা রোজগার করে লোকটা...

গন্তব্যে পৌঁছে ভাড়ার উপর হাজার টাকা বকশিস দিলো অমৃতা ।

উস্মান ভাবাঁচানো জিএসটির কিছুটা, দেশের একজন অনামী সিপাইকে দিতে পেরে বেশ হাল্কা লাগছিল অমৃতার।,” রাখ লিজিয়ে।“

এক গাল হেসে টাকাটা মাথায় ঠেকিয়ে, গাড়ী ঘুরিয়ে উস্মান ভাই চলে গেলো। 

বাঁচানো জিএসটির কিছুটা দেশের একজন অনামি সিপাইকে দিতে পেরে বেশ হাল্কা লাগছিল অমৃতার। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational