প্রেম -বনাব- ভয় {PART TWO}
প্রেম -বনাব- ভয় {PART TWO}


প্রেম -বনাব- ভয়
...CONTINUED FROM PART ONE
(PART TWO)
-----------------------------------------------------
সেই দিনটা মনে পড়ে । দিনটা ছিল বুধবার । একটু একটু বৃষ্টি পড়ছিলো । আমি ফ্যাক্টরি র ইন্সপেকশন করে , কিছু কাজ বুঝিয়ে অফিস এ ফিরে এসেছিলাম লাঞ্চ এর ঘন্টা দেড়েক আগে । এসে দেখলাম ডিপার্টমেন্ট এ আর কেউ নেই , ফ্যাক্টরি থেকে এখনো আসে নি । নিজের টেবিল এ বসে আমি দুপরের কাজের ছক বানাচ্ছিলাম, দেখলাম শম্পা ফিরে এলো । আমাকে দেখে কিছু না বলে নিজের টেবিল এর দিকে চলে গেলো ।
প্রায় আধ ঘন্টা পর , যখন আমিও কাজ শেষ করে এনেছিলাম যখন শম্পা এসে আমার সামনে বসলো । ঘমার্ত চেহারা, চুল উস্কো খুস্ক , মুখে বিষাদে চাপ স্পষ্ট, চোখে মনে হলো জল ।
"কি হলো ? শরীর খারাপ? " আমি জিজ্ঞেস করলাম ।
মাথা নেড়ে অস্বীকার করে , সে চুপ করে রইলো ।
"কিছু তো ব্যাপার আছে , তুমি স্বীকার করছো না । আমাকে বিনা দ্বিধায় বলতে পারো । হয়তো একটু ভালো লাগবে, কিংবা সাহায্য করতে পারি । "
তারপর অনেক্ষণ চুপ থাকার পর মনে হলো শম্পা নিজেকে সামলাচ্ছে , সে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো ।
"সন্তোষ, জানি না আমার দুঃখ তোমার সাথে share করা ঠিক হচ্ছে কিনা , তবে আর কাকে বলবো ? তুমি তো আমার বন্ধু, এতো দিনে তোমাকে চিনেছি । তুমি আমার ভালো চাও । "
"হ্যাঁ, তুমি আমাকে বলো, কি করতে পারি আমি ?"
শম্পার হাত আলতো ভাবে ধরে ওর মনে সাহস দিলাম ।
ও রুমাল বার করে আলতো ভাবে চোখ মুছলো ।
"আজকের দিনে, গত দু বছর আগে, আমার স্বামী , বাদল, আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো!" এরপর আর কি বলার ও শোনার আছে ? তার কণ্ঠস্বর যেন বন্ধ হয়ে গেলো !
আমার মনের মধ্যে তখন একটা ঝড় বইতে শুরু করেছিল; এটা আমি জানতাম না, শম্পা বিধবা ! এতো অল্প বয়েসে বিধবা হওয়া যে কত দূঃখজনক, সেটা হয়তো আন্দাজ করতে পারছিলাম! এর পটভূমি কি ? আমার ভালোবাসার কি আশা আছে? আমি ওর দিকে চেয়ে রইলাম।
শম্পা বলে চলছিল , যেন অনেক দিনের বাঁধ আজ ভেঙে গিয়েছিলো !
"আমি আর বাদল , দুজনেই চাকরি নিয়ে এখানে এসেছিলাম , 2015 , জুন মাসে । আমি ছিলাম ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট এ , আর ও ছিল একাউন্টস এ। এখানে আসবার দেড় মাস আগে আমাদের বিয়ে হয়েছিল, কলকাতায়। সুখের জীবন ছিল আমাদের- প্রথম দশ মাস - তারপর আমাদের বিপদের দিন শুরু হলো ! প্রথমে বাদলের বাবা কলকাতায় একটা মর্মান্তিক রাস্তার দুর্ঘটনার শিকার হলেন ; বাদল ছুটে যায় প্রায় এক বস্ত্রে! শ্রাদ্ধ হবার পর যখন ফিরছিলো, এমনি দুর্ভাগ্য যে চলন্ত ট্রেন থেকে খোলা দরজা দিয়ে পা স্লিপ করে বাইরে পড়ে যায়! মৃত্যু বোধ হয়ে তৎক্ষণাৎ! আমি তখন এখানে! খবর পেয়ে ছুটে যাই , কিন্তু বাদলের ক্ষত বিক্ষত, পচন ধরা, লাশ ছাড়া ওর আর কিছু পেলাম না! "
বলতে বলতে ,শম্পা তখন কান্না সামলাতে পারছিলো না, "আজ আমার বড় বিষাদময় দিন!"
খানিক পরে নিজেকে সামলে সে উঠে গেলো, অফিসে নিজের আবেগ দেখানো উচিত নয় ! আমি কিভাবে সান্তনা দেবো বুঝতে পারলাম না !
------------------------------------------------------------
এরপর কয়েকদিন বেরিয়ে গেছে। শম্পা সাধারণ ভাবে আচরণ করছে সবার সাথে। ওর মনে কত কষ্ট কাউকে জানতে দিতে চায়না !
কিন্তু আমি জানি; সেই জন্য আমার ওর প্রতি মনের ভাব , প্রেম, যেন আরও নরম, আরো প্রীতিপূর্ণ, আরো যত্নশীল, আরো গভীর হচ্ছিলো! যদিও সে আমার থেকে বয়েসে বড় , বিধবা , কিন্তু প্রেম এসব মানে না ! তখন প্রগাঢ়ভাবে মনে হচ্ছিলো, শম্পা কি আমাকে ভালোবাসে ? যদি তাই , তাহলে এর কি পরিণতি হবে? আমার বাবা , ও মা কেমন ভাবে এটা মেনে নেবেন ?
আমার মানসিক উথাল পাথাল এর দিন এসে গিয়েছিলো !
-----------------------------------------------------
সেদিন রাতে আমি বিছানায় শুয়ে ছিলাম , ঘুম আসছে না , মনে নানা রকম চিন্তা। অনেক রাতে কিংবা ভোরের দিকে বোধ হয়ে চোখ লেগে গিয়েছিলো, হটাৎ ঘুম ভেঙে গেলো বিচিত্র ভাবে। এরকম অভিজ্ঞতা কখনো হয়নি !
বুঝতে পারলাম খাটের মাথার দিক যেন কেউ তুলছে , ধীরে ধীরে উঠছে, এবং কয়েক মুহূর্তে এতো বেশি উঠে গেলো - আমি স্লিপ করে খাটের পায়ের দিকটা চলে এলাম ! মাথা ও ঘাড় একসঙ্গে এসে দুটো হাঁটু র কাছে আটকে গেলো! শরীরের হাড় ভেঙে গেলো মনে হলো! গায়ের চাদর খসে মাটিতে পড়ে গেলো , বালিশ উল্টোদিকে গড়িয়ে গেলো; এতো সব যেন সেকেন্ডের মধ্যে হয়ে গেলো ! এর মধ্যে সেই আধা অন্ধকার ঘরে একটা অসহ্য পচা গন্ধ পেলাম ও তার সাথে একটা চাপা গোঙানি শুনলাম ! আমি অস্পষ্ট ভাবে ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম ! আমার চিৎকারে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে খাট প্রচন্ড আওয়াজ ও ঝাকুনি দিয়ে নিজের জায়গায় ফিরে এলো! আমি মাঠিতে গড়িয়ে পড়লাম!
তারপর সব শান্ত ! গন্ধ যেন কর্পূর মতো উবে গেছে ! কিছুই যেন হয়নি ! আমি কোনো প্রকারে উঠে , লাইট জ্বালালাম ! একটু শরীর কাঁপছিলো , কিন্তু বুঝতে পারলাম যে আমি অক্ষত ছিলাম! চারিদিকে তাকালাম, একমাত্র খাট লন্ডভন্ড হওয়া ছাড়া, সবই স্বাভাবিক ছিল ।
তারপর আর ঘুম আসে নি প্রবলভাবে আমার মনে হচ্ছে শম্পার সাথে কথা বলতে হবে ।
-----------------------------------------------------
একটু পরেই ভোরের আলো ফুটলো । আমি শম্পাকে মোবাইলে জানালাম আমার শরীর ভালো নেই - যদি তাড়াতাড়ি আসতে পারে আমার কোয়ার্টারে, তাহলে ভালো হয়ে । Boss-কে ফোন করে ছুটি নিলাম ।
মিনিট কুড়ি পর , শম্পা পৌঁছে গেলো । আমার অবস্থা দেখে, সর্বপ্রথম আমাকে দুধের সাথে একটা painkiller দিলো , তখন আমার মাথায় - গায়ে ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে, আমি রাতের ঘটনা বলতে গেলাম, শুনলো না ; আমি একটু রেস্ট নেবার পর কথা বলতে দিলো ।
আমি , নিজেকে সামলে, সব ভৌতিক ঘটনা বললাম ; আমার গলা মাঝে শুকিয়ে গেলো, শম্পা জল খাওয়ালো , তারপর আমি কথা শেষ করলাম । ততক্ষণে আমার শরীর ঘামে ভিজে গেছে ।
অনেক্ষণ আমরা দুজনে চুপচাপ বসে রইলাম , শম্পার আমার হাত ধরে রইলো একবারও ছাড়লো না !
আমার আর কিছু বলার নেই , ও যদি কিছু বলে, আমি তাকিয়ে ছিলাম ।
শম্পা খুব নিম্ন স্বরে বললো, " সন্তোষ, তোমার এই অবস্থা আমার জন্যে!"
আমি আপত্তি করতে গেলাম কিন্তু সে আমাকে আটকালো ।
"আমার মনে হচ্ছে , কাল রাতের ঘটনা দায়ী হচ্ছে আমার মৃত স্বামী , বাদল ! তোমার এই কোয়ার্টারে আমি ও আমার স্বামী থাকতাম, যখন আমরা এখানে এসেছিলাম। যে খাটে তুমি শুয়ে ছিলে, সেখানে আমরা দুজনে শুতাম । বাদল অপঘাতে মারা যাবার পর, আমি এই বাড়ি ছেড়ে দিলাম । এরপর এ কোয়ার্টারে আরেকজন ছিল, এবং তারও তোমার মতো ভৌতিক অনুভূতি হয়, সে চাকরী ছেড়ে চলে যায়! এটা বোঝা দরকার সে ও আমার সাথে কাজ করতো, যেরকম তুমি করো! পরে এরকম ঘটনা আরেকটা হয়েছে। তোমার এই দুর্দশা পর হয়তো অফিস এই কোয়ার্টার বন্ধ করে দেবে । তোমাকে কোথায় রাখবে, জানি না।"
আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলাম না । এরকম ভূতুড়ে বাড়ি কেন অফিস allot করলো ? হয়তো টাউনশিপ এ বাড়ির shortage ছিল । আর কোনও বাড়ি ছিল না। সেই জন্যে কি, শুরুতে, HR ম্যানেজার আমার অসুবিধের কথা বলছিলেন ? তারপর শম্পা আমাকে কেন সাবধান করে দেয়নি ? ওর কি নিজের মৃত স্বামীর প্রতি এমন দুর্বলতা আছে , তার সম্বন্ধে অপবাদ দেবে না, ভেবেছিলো? হয়তো এটা জানতো যে বাদল কখনো আমার ক্ষতি করবে না !
সবটাই বড় জটিল!
তবে একটা কথা নিশ্চই বুঝতে পারলাম।
"শম্পা, কিছু মনে করো না, এই ঘটনার অর্থ হলো তোমার জীবনে যে পুরুষ এসেছে এবং এখানে থেকেছে , তোমার মৃত স্বামী এভাবে ভয় দেখিয়ে তাকে চাকরি ছাড়া করেছে! ওর পছন্দ নয় তুমি আর কোনও পুরুষের সাথে কিছু সম্পর্ক রাখো !"
শম্পা কোনো উত্তর দিলো না । হটাৎ সে আমাকে গভীর আলিঙ্গনে নিয়ে নিলো, তারপর ওর নরম মিষ্টি ঠোঁট দিয়ে আমার ঠোঁটে চুম্বন দিলো! আমি সপ্তম স্বর্গে ! তবে ও কি জানে না, এই বাড়িতে এরকম করলে ওর স্বামীর প্রচন্ড ক্ষোভ ওর এবং আমার জীবনে বিপদ ডেকে আনবে? আমি কিন্তু জানলাম যে শম্পা আমাকে ভালোবাসে; কোন সন্দেহ নেই!
এবার আমার মনের মধ্যে কিন্তু সাহস উৎপন্ন হচ্ছিলো! আমাদের প্রেম কি ওর স্বামী বুঝবে না ? নিজের বিধবা স্ত্রীর ভালো চাইবে না ? ভবিষ্যৎ দেখবে না ? আমার ক্ষতি কেন চাইবে?
এই ঘটনা আমরা কাউকে বললাম না । এটা একান্তই আমাদের নিজস্ব সম্পর্ক। এটা আমরা সামলাবো । আমি কিন্তু সেই কোয়ার্টার ছাড়ি নি, তবে এটা বলা যায়, তারপর, আর সেরকম ঘটনা হয়নি ।
-----------------------------------------------------
সেই দিন ছিল রবিবার ।
আমি ও শম্পা একটি ট্যাক্সি নিয়ে মুম্বাই যাচ্ছিলাম । সকাল সকাল বেরিয়েছি, দিন পরিষ্কার, রাস্তায় ভিড় কম । আমরা গন্তব্য স্থানে আধ ঘন্টার মধ্যে পৌঁছবো আশা করছি তখন আবার একটা বিপদ ঘটলো ! রাস্তার উল্টো দিক থেকে একটি ট্রাক, ট্রাফিক ভেঙে প্রচন্ড বেগে আমাদের গাড়ির সামনে এসে পড়লো ! ব্যাপারটা এতো তাড়াতাড়ি হলো, আমাদের ড্রাইভার সামলাতে পারলো না এবং ধাক্কায় ট্যাক্সির বাঁ দিকের দুটো দরজা উপড়ে গেলো ও গাড়ি পাশের খাদে গড়িয়ে গেলো ! ড্রাইভার এর বুকে স্টিয়ারিং ঢুকে ওর পাঁজর ভেঙে গেলো এবং সামনের সীটে আঘাত খেয়ে, শম্পা মাথায় ভয়ানক চোট পেলো! আমি কিভাবে অক্ষত রইলাম , ভগবান জানেন, কিন্তু নিজেকে সামলে , সময়ে নষ্ট না করে, কয়েকজন দয়ালু মানুষের সাহায্য নিয়ে শম্পা ও ড্রাইভারকে কাছাকাছি একটা নাসিং হোম এ নিয়ে গেলাম ।
এর পরে দু সপ্তাহ কেমন করে কাটলো, মনে পড়ে না । তবে এটা বলতে পারি, আমার ভালোবাসা ও দেখাশোনা পেয়ে শম্পা এই বিপদ থেকে বেরিয়ে এলো ! ড্রাইভার ও বেঁচে গেলো ।
-----------------------------------------------------
তিন মাস কেটে গেছে । গতানুগতিক জীবন চলছে । আবার আমরা অফিসে যাচ্ছি।
সেদিন রাতে সেই বিছানায় শুয়ে আছি , হটাৎ মনে হলো আধা অন্ধকার ঘরে কেউ এসেছে ! যদিও কাউকেই দেখতে পেলাম না , কিন্তু বুঝতে পারলাম যে শম্পার স্বামীর অশরীরি এসেছে ! এবার কি করবে ? গত বার তো আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিলো ! আমার কিন্তু এখন ভয়ে করছে না! শম্পার জন্য আমি সব সহ্য করতে পারি! আমি নিঃস্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছি , দেখি কি হয় ? হটাৎ নাকে এলো সুমধুর পুরুষালি গন্ধ! গতবার কিন্তু পচা গন্ধ পেয়েছিলাম ! তারপর একটা পুরুষের হাসির মৃদু আওয়াজ ! গতবার পেয়েছিলাম চাপা গোঙানির আওয়াজ !
তার মানে কি শম্পার মৃত স্বামীর আমাদের মিলন এ কোনো আক্রোশ নেই ? সে কি এই চায় ?
শম্পাকে এ সুখবর দিতে হবে !
খোকা মানুষ হয়েছে ! প্রেমে সাফল্য পেয়েছে !
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
END
অমিতাভ গাঙ্গুলী
15TH AUGUST 2019