প্রেমের কেমন পরীক্ষা
প্রেমের কেমন পরীক্ষা
সেদিন সকালে গীতিকা বড়াল তার রান্নাঘরে ছিল যখন মোবাইল ফোন বেজে উঠল। অনিচ্ছায় সে মোবাইলটি তুলল, কারণ মারাত্মক মাথাব্যথা, কাল রাত থেকে।
"ম্যাডাম গীতিকা?" একটা ভারী কন্ঠস্বর শোনা গেলো।
কোনও অজানা কারণে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়টি বলছিল কিছু গণ্ডগোল হবে; হৃদয় ধড়ফড় করা শুরু করল, ঠোঁট শুকিয়ে গেল। তার সুন্দর চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
সে ক্ষীণভাবে জবাব দিল, "কে বলছেন?"
"ম্যাডাম, আমি ইন্সপেক্টর ভাস্কর বলছি; গতরাতে আমরা স্থানীয় পুকুর থেকে একজনের মৃতদেহটি বের করে এনেছি, মুখটা বিকৃত ... চেনা যাচ্ছে না..."
গীতিকা মোবাইলটিকে এত শক্ত করে ধরল যে আঙ্গুলগুলি সাদা হয়ে গেল। নিশ্বাস মনে হচ্ছে আটকে যাবে। একটা আর্তনাদ যেন বেরিয়ে আসবে।
কিন্তু সে নিঃশব্দে ইন্সপেক্টর এর কথা শুনছিল, "... আমরা সেই দেহ থেকে একটি মানিব্যাগ উদ্ধার করতে পারি, তার মধ্যে অস্পষ্ট ও গলিত একটা চিরকুট ছিল, যার থেকে আপনার নাম, ফোন নম্বর এবং ঠিকানা অতি কষ্টে উদ্ধার করতে পেরেছি।" ইন্সপেক্টর একটু থেমে বললো, "আপনি দয়া করে এখনি থানায় আসবেন? আমি আপনাকে আনবার জন্যে আমার মহিলা কনস্টেবলকে পাঠাচ্ছি।"
এর পরে অন্য দিকে একটু নীরবতা, ইন্সপেক্টর স্পষ্টতই তার জবাবের জন্য অপেক্ষা করছিল।
গীতিকা, ইতিমধ্যে এসে ড্রইং রুম এর সোফায় বসে পড়েছে, পা দুর্বল, শরীর একটু কাঁপছে, মনে একমাত্র প্রশ্ন ... তার প্রত্যাশিত ভয় কি সত্য হয়ে উঠছে?
কারণ বোঝা শক্ত নয়ে। গত সন্ধ্যায়, স্বামী, বর্ধনের সাথে দৈনন্দিন এর মত গৃহ যুদ্ধ হয়েছিল; তাদের দেড় বছরের বিবাহিত জীবনে এটি সবচেয়ে গুরুতর; চরম রাগে স্বামী বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিলো এই বলে সে কখনও ফিরে আসবে না ... অথবা গীতিকা তার মরা মুখ দেখবে ...!
গীতিকা আটকাবার প্রচুর চেষ্টা করেছিল কিন্তু পারেনি।
এরপর সারা রাত বর্ধন বাড়ি ফিরে আসেনি এবং কোনও খবর দিল না। তার আগে গীতিকা খোঁজ নেবার অনেক চেষ্টা করেছে; চেনা, অচেনার বাড়িতে ফোন করেছে, নিজে গেছে, কিন্তু পদে পদে বিফলতা পেয়েছে; তাছাড়া ওর স্বামীকে কতবার মোবাইল কল করেছে তার কোনও হিসেব নেই। প্রতি বারে মোবাইল switched off পেয়েছে। এটা খুব অস্বাভাবিক, বর্ধন কখনই মোবাইল বন্ধ করে না।
রাত ভোর সে ভাবছিল পুলিশকে এই ঘটনা জানাবে, কিন্তু নিজেদের স্বামী-স্ত্রীর ঝামেলা বাইরে অভিযোগ করতে লজ্জা পাচ্ছিল। এছাড়া দুজনের পুলিশের কারো সাথে জানাশোনা ছিল না। আর আশা ছিল সব ঠীক হয়ে যাবে।
কিন্তু সকালে, এই সময়ে, ফোন পেয়ে পৃথিবী যেন স্থির হয়ে গেল। গীতিকা কথা বলতে পারছিল না, তবে বুঝছিল ইন্সপেক্টর তখনও অপেক্ষা করছে, লাইন এর উল্টো দিকে।
নিজেকে সামলে নিয়ে গীতিকা সম্মতি দিল এবং আধঘন্টার মধ্যে কনস্টেবলকে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইন্সপেক্টর ভাস্কর ফোন কাটলো।
সেকেন্ডের মধ্যে গীতিকার মনে হল পৃথিবী আর স্থির নেই, আরো বিপদ, চারপাশে ভেঙে পড়ছে। সে চোখের জল আটকাতে পারছিল না, কিন্তু মন শক্ত করতে হবে, নিজেকে সামলাতে হবে, থানা এ যেতে হবে। অবশ্য বেশি সময় পেল না। ড্রইং রুম এর দরজার ঘণ্টা যখন বেজে উঠল তার মন ও শরীর, শক ও হতাশায় নিস্তেজ হয়ে ছিল, ওকে উঠতে দিচ্ছিল না ।
তারপর যখন আবার ঘণ্টা বেজে উঠল তখন আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে দরজা খুলল। সেখানে একজন মহিলা কনস্টেবল দাঁড়িয়ে।
-----------------
গীতিকা যখন থানায় পৌঁছেছে তখন মনে হচ্ছে সে একটি বিধ্বস্ত মহিলা। সবাই সেটা লক্ষ করছে, তবে শেষ পর্যন্ত তাকে মৃতদেহ সনাক্ত করতে হবে। পুলিশ পদ্ধতি।
মৃতদেহ কি তার স্বামীর?
ইন্সপেক্টর ভাস্কর তাকে মর্গের ভেতর নিয়ে গিয়ে নীরবে একপাশে সরে গেল।
যখন গীতিকা ঘর থেকে বেরিয়ে এল তার মুখ ফ্যাকাশে, পাশের বেঞ্চিতে বসে এক গ্লাস জল চাইলো।
তারপর একটু সামলে নিয়ে সে মানিব্যাগ ও অন্য বস্তু সনাক্ত করতে আরেকটা ঘরে গেল। মোবাইলটি সনাক্তযোগ্য ছিল, তবে এটি বন্ধ ছিল, জলে নিশ্চয় নষ্ট হয়ে গেছে। চিরকুটের হাথে লেখা কার ?
যখন ফিরে এসে বেঞ্চে আবার বসল, কেবল একটি সত্য নির্দয়ভাবে এগিয়ে আসছিল। মৃতুদেহের মুখ নষ্ট হয়ে গেছে, তবে শরীরের গড়ন তো স্বামীর! এমনকি গায়ে কাপড়- শার্ট ও ট্রাউজার- তার ; চশমার সাথে মানিব্যাগ, মোবাইল ও পেন, সে সব তো স্বামীর জিনিস! হাতের লেখা বর্ধনের!
এই মৃত লোকটা তার স্বামী, সন্দেহ নেই!
গীতিকার উপর রাগ করে কাল রাতে আত্মহত্যা করেছে!
গীতিকার অশ্রু থামছে না। সহানুভূতি সবার মনে, ওর মনের যন্ত্রণা বোঝা শক্ত নয়ে।
বাইরে যাওয়ার সময় ইন্সপেকটর ভাস্কর এগিয়ে এসে বলল, "ম্যাডাম, আপনার কষ্ট বুঝতে পারি... কিন্তু ভেঙে পড়লে চলবে না .... নিজেকে সামলান।"
"আমার সব শেষ হয়ে গেল, ইনপ্সেকটর! কী করে বাঁচবো?" অস্পষ্ট ভাবে সে উত্তর দিল।
মনে ভাবছে, "হে ভগবান, তিনি যেন আমাকে রক্ষা করেন! এই দুঃস্বপ্ন কি কখনও শেষ হবে না?"
-----------------------
গীতিকা সেই রাতে খুব তাড়াতাড়ি বিছানায় অবসর নিয়েছিল, দুঃখে তার মন ভারী। ঘুম আসছে না।
থানা থেকে ফিরে আসার পরে সে একা থাকতে চেয়েছে, কিন্তু খবরটি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। শুভাকাঙ্ক্ষী, বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনদের একটি অবিচ্ছিন্ন ধারা ছিল। বর্ধনের বিধবা মা পরদিন সকালে 'মুম্বই' থেকে পৌঁছে যাবেন। তার ভাই ইতিমধ্যে 'লস অ্যাঞ্জেলেস' থেকে যাত্রা আরম্ভ করেছে।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছে, " ঠাকুর, কী হয়ে গেল আমার। আমার স্বামী, আমার প্রাণ, এরকম ভাবে তাকে হারালাম? আমি জানি আমরা অনেক ঝগড়া করেছি - কেন বর্ধন আমার কলেজের বন্ধু, পূনীতকে সহ্য করতে পারতো না – তার এত সন্দেহ প্রবণ মন কেন? সে কি বুঝতো না আমার জীবনে পুণিতের কোনও স্থান নেই? অবিশ্বাস এর পুরো কারণ অমূলক, অন্যায়, তা বলে এই পরিণাম? ওকে আমি এত ভালবাসলাম কিন্ত ওর ভালোবাসা কখনো পেলাম কী ?"
রাত এগিয়ে যাচ্ছে, মাঝরাতে গীতিকার মোবাইলে একটা beep হোলো, SMS এসেছে। সারা দিন গীতিকা শোকের বার্তায় প্লাবিত হয়ে পড়েছিল – সবগুলো পড়তে পারেনি তবুও কেন জানি এই SMS দেখার সিদ্ধান্ত নিলো।
একটি অজানা নম্বর থেকে SMS এসেছে, "কাল সন্ধ্যার ঝগড়ার জন্য খুব দুঃখিত।"
এটা কী ? আধ ঘুমন্ত ও অবসন্ন মনে গীতিকা আর কিছূ ভাবতে পারলো না।
বেশ কিছুক্ষণ পরে, মোবাইলে আরও একটা beep শোনা গেল, সময় 3.15 am , এই বার্তাটি শুনতে পেয়ে গীতিকা আবার মোবাইল ওঠাল।
বার্তাটিতে লেখা ছিল, "কোন উত্তর নেই, কেন? আমাকে ক্ষমা করবে না? খূব ভুল করেছি!" এটি একই মোবাইল নম্বর থেকে এসে ছিল।
গীতিকা তখন প্রশস্ত জাগ্রত, উঠে এক মুহুর্তের জন্য ভাবল। ব্যাপারটা দেখতে হবে, অন্যথায় ভবিষ্যতে আরও ঝামেলা হতে পারে। সে বুঝছিল কেউ বা কারা তাকে হেনস্থা করবার চেষ্টা করছে।
ইন্সপেক্টর ভাস্কর নিজের পার্সোনাল মোবাইল নাম্বার দিয়েছিল। ডায়াল করার সাথে সাথেই সে তার মোবাইলটি তুলে নিল। "হ্যাঁ ম্যাডাম, আপনি ঠিক আছেন তো? রাতের এই সময়ে ফোন করছেন কেন?"
"ইন্সপেক্টরকে, দয়া করে আমাকে সাহায্য করুন ... গত কয়েক ঘন্টার মধ্যে আমি অজানা নম্বর থেকে দুটো SMS পেয়েছি ... দ্বিতীয়টা কয়েক মিনিট আগে ... দেখে মনে হচ্ছে কেউ আমার মৃত স্বামীকে নকল করার চেষ্টা করছে," গীতিকার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে উঠল।
ইন্সপেক্টর ভাস্কর কিছু মুহুর্তের জন্য চুপ করে থাকবার পর বলল, "ম্যাডাম চিন্তা করবেন না, আমরা নাম্বারটা সনাক্ত করতে পারি এবং আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারি, আশ্বাস দিচ্ছি, আপনি নিরাপদে আছেন। নাম্বারটা আমাকে পাঠান।" তারপর একটু থেমে, "সম্ভবত আপনার স্বামী এই বার্তা পাঠাচ্ছেন ..." লাইন কেটে গেল।
গীতিকা হতবাক হয়ে গেল, ইন্সপেক্টর এর এই প্রতিক্রিয়াটি ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত! এর অর্থ হল স্বামী বেঁচে আছে? কী করে সম্ভব ? সে তো কাল রাতে মারা গিয়েছে, গীতিকা সকালে তার মরদেহ দেখেছে এবং তাকে সনাক্ত করেছে। সে কি ভুল করতে পারে? এটা সত্য স্বামীর মুখটা সনাক্তযোগ্য ছিল না ... কিন্তু আরো সব সনাক্তকরণ... সে সব ভূল?
গীতিকার ঘূম উড়ে গেল, খুব ভয় হচ্ছিল অদ্ভুত কারণে, শরীর ঘামতে শুরু করল, একটু হাঁফ ধরছে, সেই অবস্থায়ে সে পাশের টেবিল থেকে গ্লাস তুলে প্রচুর পরিম
াণে জল পান করল।
আবার বিছানায় শুয়ে পড়বার পর তার মনের মধ্যে তখনও ঘূর্ণিঝড় চলছে, কিন্তু একটু পরে গীতিকা ন্যায়সঙ্গত ভাবে চিন্তা শুরু করল, "এটা খুব গোলমেলে পরিস্থিতি। সকালে আমি ইন্সপেক্টরের সাথে আবার কথা বলব। সে যা বলেছে আরও ভাল করে বুঝতে হবে। কিছু সন্দেহ আছে কি? আমার কি আবার মৃতদেহটা দেখা উচিত? পোস্টমর্টেম কী হয়েছে? তার শবদাহ কী আজ হবে?"
গীতিকা যখন বিছানা থেকে উঠে পড়ল, তখনও ভাবছে, "যদি মৃতদেহটি বস্তুত ওর স্বামীর হয় তবে তার ভাই, আমেরিকা থেকে না আসার আগে পুলিস কীভাবে তাকে শ্মশানে নিয়ে যেতে পারে? আরো আইনগত কার্যপ্রণালী নিশ্চয় আছে।"
হটাত্ মনে হল দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, জানলার কাছে গিয়ে গীতিকা পর্দা খুলল, খোলা বাতাস দরকার; পরিষ্কার ঠান্ডা রাত এবং ঝলমলে তারা শুভেচ্ছা জানায়। যেন সব ঠীক আছে!
গীতিকার চিন্তাভাবনা কিন্ত অব্যাহত ছিল, "যদি কোনও অলৌকিক ঘটনা ঘটে থাকে, ঈশ্বর যদি দয়াবান হন, তবে আমি কী আশা করতে পারি বর্ধন এখনও বেঁচে আছে ... আমি কি বিশ্বাস করতে পারি মৃতদেহ অন্য কারও ছিল, তবে ... কেমন ভাবে?" গীতিকা বিহ্বল হয়ে মাথা নাড়ল।
এরপর তার ক্লান্ত মন আর ভাবতে পারলো না, ধীরে ধীরে চোখে ঘুম নেমে এল।
রাতের বাকি সময় আর কোনো SMS আসেনি।
--------------------
পরের দিন সকালে ইন্সপেকটর ভাস্কর আসবার পর, ধৈর্য ধরে গীতিকার কথা শুনল, তারপরে উঠে ক্যাপটি তুলে বলল, "ম্যাডাম, আপনার স্বামীর মৃতদেহর ব্যপারে পুরোপুরি নিশ্চিত নই; যদি অন্য মানুষের দেহ হয়ে, তবে স্বামী হয়েত বেঁচে আছেন, তাহলে তিনি আপনাকে এই জাতীয় ব্যক্তিগত SMS পাঠাতে পারেন। আমাকে তাঁর ওয়ালেট, জামাকাপড়ের ও পুরো ব্যাপারের রহস্যটি আবার তদন্ত করতে হবে। আমি SMS এর নম্বর যাচাই করছি, দয়া করে এই সব ঘটনা কারও কাছে প্রকাশ করবেন না।"
--------------
সারা দিন গীতিকা ব্যস্ত ছিল, বর্ধনের মা এবং অন্য আত্মীয় এসে গেলেন, অন্যরাও পাশে ছিলেন। কিন্তু যেহেতু ইন্সপেক্টর তাকে নিষেধ করেছিল, সে কারও সাথে নিজের সন্দেহ এবং ভয় নিয়ে আলোচনা করতে পারে নি।
পূনীত কে দিনের বেলা ফোন করেছিল, কিন্তু উত্তর পায়েনি। ট্র্যাজেডির সময়ে যদি সে এগিয়ে না আসে তাহলে কী রকম বন্ধু? এই লোকটার জন্যে বর্ধন এর সঙ্গে এত ঝগড়া? এই বিপদ? পূনীত না থাকলে ... সম্ভবত তার বিবাহ জীবন অন্যরকম হত। গীতিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঠিক করেছিল এরপর আর পূনীত এর সাথে কোনও সম্পর্ক রাখা চলবে না ।
সেই দিনটা কেটে গেল এবং পরের দিন। ইন্সপেক্টর ফিরে আসেনি। গীতিকা র ফোন পেয়ে তার জবাব ছিল, তদন্ত চলছে এবং কোনও তথ্য পেলে তাড়াতাড়ি কাছে আসবে।
------------------
সেদিন সন্ধ্যা হয়ে গেছে, অন্ধকার প্রায়ে নেমে এসেছিল, বাড়ি খালি, যখন সামনের ড্রইং রুম এর দরজার ঘণ্টা বেজে উঠল।
গীতিকা দরজা খুলে দেখল ইন্সপেক্টর ভাস্কর দাঁড়িয়ে আছে। সে তার ক্যাপটি তুলে তাকে সম্বর্ধনা করল, "ম্যাডাম, আমি কি ভিতরে আসতে পারি?"
বেরিয়ে এসে গাড়ী বারান্দার আলো জালবার জন্যে পাশের দেত্তয়াল এর দিকে ঘুরেছে যখন হঠাৎ গীতিকার মনে হল আরেকটা লোক ছায়ার মত দরজা দিয়ে ঢুকে গেল।
গীতিকা শঙ্কিত মনে ইন্সপেকটর এর দিকে তাকাল, কোনও প্রতিক্রিয়া না পেয়ে দ্রুতগতিতে ঘরে ঢুকল, সঙ্গে সঙ্গে থমকে গেল, বিস্ময়ে হৃদয় স্পন্দন বেড়ে গেল।
এ কী ? ঈশ্বর তাকে সাহায্য করছেন কী? তার স্বামী, বর্ধন, দুটি বাহু প্রসারিত করে ওর সামনে দাড়িয়ে আছে! একেবারে সুস্থ দেখাচ্ছে, হাসিখুশি। কিছু বলার আগে, বর্ধন, গীতিকা কে পরিচিত আলিঙ্গনে মধ্যে নিয়ে নিলো । ঠোঁট স্পর্শ হল।
সব ভুলে গিয়ে গীতিকা তখন সুখের আনন্দে ভেসে গেছে।
একটু পরে, ব্যাপারটা একটু সামলাবার পর, গীতিকা এবং বর্ধন যখন সোফায় একসাথে বসে, ইন্সপেক্টর ভাস্কর সামনে সোফাতে বসে হাস্যোজ্জ্বল মুখে তাদের পর্যবেক্ষণ করছে।
গীতিকা কিন্তু স্বামীর দিকে তাকিয়ে, মুখে হাসি, চোখের হালকা অশ্রু বোঝা যাচ্ছে। "বর্ধন তুমি ভাল আছো বুঝতে পারছি। কিন্তু এটা কিরকম রসিকতা ? দয়া করে বল আমি এখনো স্বপ্ন দেখছি না! সব বুঝিয়ে বল। প্লীজ!"
ইন্সপেক্টর ভাস্কর একটু এগিয়ে বসল, বলল, "অনুমতি দিন, আমি বলছি। আপনার স্বামী একটি প্রচণ্ড সন্দেহবাতিক লোক ... সে নিশ্চিত ছিল আপনি তাকে ভালোবাসেন না এবং আপনার বন্ধু পূনীত কে ভালোবাসেন; আপনাদের সব ঝগড়ার কারণ ছিল সেই সন্দেহ। এটা আপনি বোঝেন। "
একটু থেমে ইন্সপেক্টর ভাস্কর আবার শুরু করল, "বর্ধন, আমার বন্ধু, সেটা আপনি জানতেন না, যাইহোক সে আমাকে বিশ্বাস করত এবং সব মনের কথা বলতো। আমি সবসময় বোঝাতাম, তার এই ভাবনা একদম ভূল ও পাগলামির লক্ষণ। তবে সে আমাকে মানতে পারেনি। এটা তো চলতে দেওয়া যায় না, তাই আমি এই অদ্ভুত পরিকল্পনা করেছিলাম যেটা বর্ধন করতে রাজি হল।
"আপনি যে মৃতদেহটি দেখেছেন - অন্য পুরুষের। অচেনা ও দাবীবিহীন। এই লোকটার আপনার স্বামীর মতোই আকৃতি, কোনো কারণে তার মুখটা নষ্ট হয়েছিল। একে আমরা পুকুর থেকে তুলি নি । থানার মর্গে পড়ে ছিল । তারপর আমি বর্ধনকে তার নিজের কাপড় ও অন্য নিশানদিহি দিতে বলেছিলাম। আমরা সেই দেহটি কে ভিজিয়ে, এবং নানান ভাবে আপনার স্বামীর পরিচয় দিতে চেষ্টা করলাম, যদিও কাপড়, পার্স, ইত্যাদি জলে তেমন ভাবে নষ্ট দেখাতে পারিনি ... তবে সেটা বোঝার মানসিক অবস্থা আপনার ছিল না ও আপনি সত্যই বিশ্বাস করেছিলেন আপনার স্বামীর মৃতু হয়েছে।
"এর প্রতিফল ভালোই হলো, এই সামান্য সময়ের মধ্যে আপনার দুঃখ এবং ভালবাসা, বর্ধন প্রগাঢ় ভাবে বুঝতে পারলো, এখন সে নিশ্চিত হয়েছে আপনি তাকে ভালবাসেন এবং চান, আপনার জীবনে পূনীত এর কোনও জায়েগা নেই।"
"আর সেই SMS?" গীতিকা জিজ্ঞাসা করল। ওর মনে তখন অনেক আবেগ চলছে।
বর্ধন উত্তর দিল, "আমি এটা পাঠিয়েছি, অজানা নম্বর থেকে; আমি তোমার ভালবাসা বুঝতে পেরেছিলাম, আমি তোমাকে miss করছিলাম, আমি তোমার সাথে যোগাযোগ রাখতে চাইছিলাম ... চেয়েছিলাম তুমি আমাকে ক্ষমা কর .. আমি নিজেকে থামাতে পারিনি। তোমাকে আর বেশি ক্ষন কষ্ট দিতে চাইনি।"
তারপর, বর্ধন সোফা থেকে নেমে এসে গীতিকা র সামনে নতজানু হয়ে বসে বললে, "দয়া করে এবার আমাকে সমস্ত কিছুর জন্য ক্ষমা কর, প্লীজ ....!"
গীতিকা উঠে বর্ধন কে আবার সোফায় বসিয়ে দিল। নিজের ঊষ্ম নরম হাত রাখল, স্বামীর হাথে, স্পর্শ সব বলছে।
ইন্সপেক্টর ভাস্কর ইতিমধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে এল, থানা এ যেতে হবে। তার সিনিয়রকে কিছু জবাবদিহি দিতে হবে । এরকম করা অন্যায়, ভুল। হয়েত বেআইনী।
-------------------
এদিকে গীতিকা বলছিল, "তোমার বিপদের খবর পেয়ে আমি পূনীত কে ফোন করেছিলাম ... কিন্তু সে আমার ফোন নিল না .... ঠিক করেছিলাম এরপর আর পূনীত এর সাথে কোনও সম্পর্ক রাখা চলবে না। "
বর্ধন একটু হাসল, "কী করে ফোন নেবে? পূনীত একটা ভীতু! আমার কথামত ইন্সপেক্টর ভাস্কর ওকে থানা এ ডেকেছিল, আমার মৃতুর কারণ নিয়ে তদন্ত করবে বলে .... সে সাফ বলে দিল সে কিছু জানে না ও কয়েক ঘন্টার মধ্যে শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে, কাজের সুত্রে । ওর মানসিকতা একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেছে ... এত মাস আমি কত ভূল করেছিলাম ওকে তোমার প্রেমিক মনে করে .....!"
গীতিকা একটু ভাবল, "কিছু মনে করবে না, বর্ধন , আমার ভালোবাসার পরীক্ষা তো নিলে, কিন্তূ সবসময়ে আমি কী করে তোমার প্রেম কে বিশ্বাস করব? সর্বদা আমি চিন্তা করবো, তুমি আমাকে সন্দেহ করতে পারো।"
"তুমি যখন চাও আমার প্রেমের পরীক্ষা নিতে পারো।"
গীতিকা একটু হাসল, "সে দেখা যাবে …."
--------------------------
কয়েক মাস পরে, এক বিকেলে, গীতিকা ও বর্ধন ড্রইং রুম এ বসে চা পান করছিল যখন সামনের দরজার ঘণ্টা বেজে উঠল।
গীতিকা দরজা খুলল, সামনে পূনীত দাঁড়িয়ে ।
"আসতে পারি? sorry, এর আগে আসতে পারিনি, কাজের ব্যপারে বিদেশে temporary পোস্টিং হয়েছিল।"
গীতিকা, কিছু না বলে, দরজা থেকে সরে এল...ভেতর থেকে বর্ধন ডাক দিল, "আরে পূনীত ... what a surprise? এস ... ভেতরে এস ! "
এরপরে সে যথারীতি আসতে শুরু করল, সম্পর্ক স্বাভাবিক ছিল।
সেদিন থেকে পূনীত ওদের মাঝে কোনও মনোমালিন্য এর কারণ হল না ।
প্রধানত বর্ধন পূনীত কে নিঃশর্তভাবে স্বীকার করেছে; গীতিকা ও ক্ষমা করেছে; এবার স্পষ্ট ছিল স্বামী-স্ত্রীর ভুল বোঝা বুঝির পর্ব শেষ ও ভালবাসা জয়লাভ করতে পেরেছে ।