সেই মেয়েটি
সেই মেয়েটি
সেই মেয়েটি
কোনো কোনো দিন কেমন যেন অন্য রকম হয়ে ওঠে । সেদিন ও এইরকম একটি দিন ছিল । সেটা ছিল ডিসেম্বর মাসের প্রথম, আমি রানিগঞ্জ গিয়েছিলাম অফিস এর একটি কাজ নিয়ে । সারাদিন খুব পরিশ্রম এর পর, সন্ধ্যা বেলা অফিস এর কাজের চাপ থেকে মুক্ত হবার জন্য হোটেল এরই রেস্তোঁরা তে একটি টেবিল খুঁজে বসলাম। আমার খুব ইচ্ছে করছিল কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব করবার । আমার টেবিল টা দুজনের বসার উপযোগী ছিল ।
আমি আনমনে হলের মধ্যে বসে থাকা মানুষ জনের ওপর চোখ বোলাচ্ছিলাম, বেশ বড় হল, এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে বেশ কিছু মানুষ- পুরুষ, মহিলা -তবে পুরুষ ই বেশী, বেশ মার্জিত ভদ্র মানুষ এর উপস্থিতি ।হঠাত আমার দৃষ্টি আটকে গেল অদূরে একটি টেবিল এর দিকে, একজন মহিলা একা বসে সেখানে, আমার কেন জানি মনে হল ইনিও আমার মত কোনো সঙ্গী খুঁজছেন, আলাপচারিতার জন্য । মহিলার উপস্থিতি বেশ মধুর, ছিপছিপে চেহারা, বয়স মনে হল কুড়ির কোঠায়, পরনে হালকা সবুজ রঙের শাড়ি । বাতাসে শীতের আমেজ থাকায় একটি কালো রঙের শাল আলগা ভাবে কাঁধে ছড়ানো। কিন্তু আমার সব ভাবনাই এক লহমায় আমার মনে উঁকি দিয়ে গেল- আমি খুব মন দিয়ে কিছু দেখছিলাম না।
তখনি ওয়েটার এসে আমার রাতের খাবারের অর্ডার নিয়ে গেল । আমার ঘড়িতে তখন সাতটা পনচান্ন । আমার দৃষ্টি ফিরে গেল সেই মহিলার দিকে কিন্তু তাকে আর দেখতে পেলাম না ।
আমার কিছু করার না থাকায় আমি মেনু কারডটা পড়তে লাগলাম ।একটি মিষ্টি কন্ঠ স্বরে, আমি চোখ তুলে চাইলাম ।
"আমি এখানে বসতে পারি?”
প্রশ্ন শুনে আমি দেখলাম সেই মহিলা আমার সামনে দাঁড়িয়ে; মুখে মৃদু হাসি, একটি হালকা সুগন্ধ তাকে ঘিরে রয়েছে; সুন্দর মুখশ্রী ভ্রমর কালো চোখ ওষ্ঠ হালকা রঙে রন্জিত; সব থেকে আকর্ষণীয় তার ঘন কালো কাঁধ অবধি নেমে আসা চুলের গোছা।
তার সৌন্দর্য কয়েক মুহূর্ত আমাকে বিবশ করে দিল, আমার হৃদ্ স্পন্দন দ্রুত হল কিন্তু আমি ওপরে শান্ত ছিলাম ।
সে আবার বলল, "বসতে পারি ?”
"বসুন কিন্তু আমি আপনাকে ঠিক চিনলাম না তো । "
সে আমার সামনে বসল, একটু সময় নিল, শাড়ি, শাল গুছিয়ে নেবার জন্য । তারপর ব্যাগ থেকে ভিজিটিং কারড বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আমি জুলি, BUSINESS DEVELOPMENT MANAGER OF M/S COAL EQUIPMENT । আমি আপনাকে দেখেছি BLACK DIAMOND COALFIELD এর অফিস এ আজ সকালে, আর আমার কানে আপনাদের কথা বার্তা পৌঁছে ছিল, যা থেকে আমি আপনার BUSINESS PROPOSAL সম্বন্ধে জানলাম, যদিও আপনার অগোচরে জানার জন্য দুঃখিত।“
সে আমাকে কারড টি হাতে দিয়ে বলল, " এই প্রস্তাবে আপনার আমার দুজনের ব্যবসাই লাভ দায়ক হবে ।”
তারপর মেয়েটি তার দামি চামড়ার ব্যাগ এর চেন খুলে কিছু কাগজপত্র দেখিয়ে বলল, "আপনি যদি রাজি হন তাহলে আমরা এই ব্যাপারে কিছু আলোচনা করতে পারি ।“
এর মধ্যে ওয়েটার আমার খাবার নিয়ে ফিরে আসতে সে চুপ হয়ে গেল । আমি তাকেও আমন্ত্রণ জানাতে সে রাজী হয়ে গেল ।
আমাদের খাওয়া সারতে সারতে সে তার নিজের সম্বন্ধে আমাকে জানাল যে সে কলকাতা থেকে এসেছে ব্যবসার কাজে । আমি কোথায় উঠেছি জানতে চাইলে আমি জানালাম আমি এই হোটেলে উঠেছি ।
আমাদের ডিনার শেষ হবার পর দেখলাম মেয়েটি আলোচনার জন্য ব্যাস্ত হয়ে উঠেছে, আমি তাকে আমার ঘরে গিয়ে, কফি নিয়ে, আলোচনার কথা বলতে সে রাজী হয়ে গেল ।
আমরা হোটেল এর ঘরে এসে গুছিয়ে বসলাম । সে একটি চেয়ার এ নিজেকে স্বচ্ছন্দ করে নিল, আমি বিছানাতেই বসলাম ।গরম গরম কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে আমাদের আলোচনা শুরু হল । সে একটি কাগজ পত্রের ফাইল আমার হাতে দিয়ে নিজের বক্তব্য আমাকে খুব স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দিল ।
এইভাবে ঘন্টা খানেক কেটে গেছে, আমার জুলির ব্যবসায়ীক প্রস্তাব মনমতো হয়েছে, আমার মনে হল এই প্রস্তাব আমার সিনিয়র দের জানানো যায় । আমি ঘড়িতে দেখলাম রাত দশটা পাঁচ, মনে হল অনেক রাত হয়েছে, আমি কথায় কথায় জানলাম জুলি পাশের হোটেল রুপম এ উঠেছে, আমি তাকে এগিয়ে দিতে চাইলাম, সত্যি বলতে কি আমি ততক্ষণে জুলির সুন্দর ব্যক্তিত্ব, অসম্ভব বুদ্ধিমততা দেখে একেবারে মুগ্ধ ও অভিভূত হয়ে গেছি ।
জুলি মৃদু হেসে আমার থেকে বিদায় চাইল- সে বলল এখান থেকে হাঁটা পথ সে একলাই যেতে পারবে । সে আরো বলল, "আমি কাল অনেক দূরে চলে যাচ্ছি, আপনার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না, আশা করছি আমার কোম্পানি এই কাজটা পাবে । " এরপর সে আমার কাছে অনুমতি চাইল, আমি উঠে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে হ্যান্ড শেক করতে হাত বাড়িয়ে দিলাম; আমার দৃষ্টি তার মুখের ওপর ছিল; আমি কেমন বিবশ হয়ে গেলাম; আমার নিঃশ্বাস যেন আটকে গেল; আমার তার নরম হাত আর একবার ছুঁতে ইচ্ছে করল, তাকে কাছে টানতে ইচ্ছে করল; আমি নিশ্চিত যে আমার মুগ্ধ দৃষ্টি ও শরীরি ভাষা সেও অনুভব করতে পারছিল । সেও কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে চেয়ে রইল, তার দৃষ্টি কেমন সজল হয়ে উঠল, ঠোঁট দুটি অল্প কেঁপে উঠল কিছু বলার জন্য, কিন্ত বলতে পারল না !
জুলি চলে গেল!!
আমার মনে হল আমি যেন একটা মধুর স্বপ্ন দেখছিলাম, আমার মনে হল চারপাশে যেন অপার শূন্যতা, আমি জুলির চলে যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে রইলাম । সে রাতটা আমার ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমের মধ্যে কাটল ।
পরদিন সকালে আমি প্রস্তুত হয়ে প্রাতরাশ করবার জন্য নিচে রেস্তোঁরা তে গেলাম। সেখানে দেখি ছোটো ছোটো ভীড় করে কিছু মানুষ কি যেন আলোচনা করছে। আমি রিশেপসনিস্ট মেয়েটি কে জিজ্ঞেস করতে জানতে পারলাম পাশে রুপম হোটেল এ একটি মহিলার মৃতদেহ পাওয়া গেছে ,পুলিশ বলছে মহিলা কাল বিকেলে মারা গেছেন, আজ সকালে দেহ পাওয়া গিয়েছে ।
আমার হঠাত ভেতরটা কেমন কেঁপে উঠল, গলাটা শুকনো লাগল, আমি প্রশ্ন করলাম, “মেয়েটির নাম কি?” কেউ বলল- জুলি ।আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম । এ যদি জুলি হয় তবে সে কে ছিল, যে কাল সারা সন্ধ্যা আমার সঙ্গে ছিল ?
আমার চারপাশ কেমন শূন্য হয়ে গেল, আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না ।সেই দিনই আমাকে কলকাতা ফিরে যেতে হল ।
আমি কলকাতা ফিরে জুলির কোম্পানি তে দেখা করলাম।কাগজ পত্র সব আমার কাছেই ছিল ।সেখানেও শুনলাম জুলির মৃত দেহ পাওয়া গেছে হোটেল থেকে । পুলিশ এখনও কেস সলভ করতে পারে নি। আমি আরো জানতে পারলাম যে জুলি এই কোম্পানির মালিক এর মেয়ে ।
তারপর থেকে আমার মনে অনেক প্রশ্ন আসছে- জুলি সেদিন কেন আমার কাছে এসেছিল ? তার কাছে তার কাজ এত প্রিয় ছিল ?
আমি এই কাজটা সম্পর্কে বসের সঙ্গে কথা বলি, কিন্তু বেশি দূর এগোতে পারছিলাম না অনেক রকম সমস্যা হচ্ছিল, জুলির কোম্পানি থেকেও বিশেষ সাড়া পাচ্ছিলাম না।
সেদিন রাতে বিছানায় শুয়ে আমি এই সবই চিন্তা করছিলাম, হঠাত আমার মনে হল এই ঘরে কেউ আছে । সেই মৃদু সৌরভে ঘর সুরভিত । আমি ঘরের চারপাশে চেয়ে দেখলাম; ঘরে আলো আঁধারি; রাস্তার এক চিলতে আলো পরদার ফাঁক দিয়ে ঘরে এসে পড়েছে, কিন্তু কাউকে দেখা গেল না; শুধু যেন কারো উপস্থিতি টের পেলাম। হঠাত আমার শরীর টা কেমন ভারি হয়ে গেল, গলা শুকিয়ে গেল, তবে কি জুলি এসেছিল? আমি ঘরের আলো জ্বালাতে আমার শরীর স্বাভাবিক হয়ে গেল । বাকি রাতে আর কোনো ঘটনা ঘটে নি ।
আমি পরদিন আবার জুলির কোম্পানি তে গেলাম, আর আশ্চর্যের বিষয় সব কিছু খুব সহজ হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত জুলির কোম্পানি আমাদের কাজটা পেয়ে গেল ।
জুলির ইচ্ছে সফল হল, কিন্তু আমি কোনোদিন এই ঘটনাটি ভুলতে পারি নি ।
জুলি আমার মন জুড়ে রয়ে গেল । ওকে কখন ও ভুলতে পারবো না ।
------------------(ORINGINAL STORY - "HER SECRETS"- BY AMITAV GANGULY, IN HIS BOOK "TWELVE PARANORMAL TALES.”
BENGALI TRANSLATION BY : INDIRA ROY)------------------------------------