পর্দার আড়ালে
পর্দার আড়ালে
এক
বর্ষণ মুখর রাত্রি। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। ব্যাঙ্গালোরের ইউ বি সিটির কাছে একটি মাল্টিস্টোরেইড বিল্ডিং নাম গোল্ডেন চ্যারিওট। বিল্ডিং ক্যাম্পাস তে গোল্ডেন কালার এর মহাভারতের যুদ্ধে কৃষ্ণ সারথি ও অর্জুন এর গীতার উপদেশ দেবার একটি প্রতিমূর্তি আছে তার সাথে জলের ফোয়ারা . সাত তলার চারটি ২ বি এইচ কে ফ্ল্যাটের একটিতে তৃনা একা মনে মনে তার পছন্দের একটা গানের কলি গুন্ গুন্ করছিলো। একটু আগেই সে বাইরে থেকে ফিরেছে। বৃষ্টি টা তখন এতো জোরে পড়ছিলো না। ব্লুউ কালারের আই টোয়েন্টি গাড়িটা কে পার্কিং লট এ ছেড়ে সে সবে মাত্র ফ্ল্যাটে এসেছে। এবার সে বাথ রুম এ যাবে ফ্রেশ হবার জন্য।
রাত তখন প্রায় সাড়ে আট টা। হঠাৎ দরজার বেল বেজে উঠলো। কে এলো এই সময় ? কারুর সাথে তো আজ দেখা করার কথা নেই। তৃনা এগিয়ে গিয়ে দরজার আই হোলে চোখ রাখলো। কৈ কাউকে তো বাইরে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। ফিরে যাচ্ছিলো ডাইনিং হল এর দিকে। কিন্তু আবার কলিং বেল বেজে উঠলো। কিছুটা বিরক্ত মুখে দরজার দিকে এগিয়ে যায় তৃনা, ভাবে নিশ্চই পাশের ফ্ল্যাটের খুদে বিট্টুটা। দরজা খুলে ভালো করে বকে দিতে হবে , যাতে এই বাঁদরামি না করে।
দরজা খুলতেই সাইলেন্সার লাগানো বন্দুকের দুটো গুলি তার হৃৎপিণ্ড কে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়। মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরোনোর সময় পেলো না। মেঝেতে বডিটা পরে গেল। আক্রমণকারী দরজা বন্ধ করে দিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।
এরপর দুই দিন পরের ঘটনা। গোল্ডেন চ্যারিওট এর সাত তলার বাকি বাসিন্দারা এক উৎকট গন্ধের জন্য বিল্ডিং সেক্রেটারি কে কল করে এবং তিনি ব্যাপারটা পরীক্ষা করতে আসেন। সাত তলার করিডোর এ যেন গন্ধটা ঘোরাফেরা করছে। সেক্রেটারি সব ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেন শুধুমাত্র তৃনার ফ্ল্যাট ছাড়া। ডোর বেল বাজানো সত্ত্বেও যখন দরজা খুলেনি তখন তৃনার মোবাইল তে ফোন করেন। নো রেসপন্স আসছে দেখে সেক্রেটারি বলেন যে মনে হয় অফিস এর কাজে বাইরে গেছে , পরে কথা বলে নিলে হবে। চারিদিক পরীক্ষা করেও কোনো কিছু পাওয়া গেলো না। সব দিক পরিষ্কার , আর এই কোবিদ সিচুয়েশন তো আরো বেশি করে সাফাই ও স্যানিটেশন চলছে। ড্রেনেজ ও পরিষ্কার করা হচ্ছে নিয়মিত ভাবে।
অবশেষে দিন চারেক পর সাত তলার ফ্ল্যাট বাসিন্দা রা নিশ্চিত হলো যে পচা গন্ধটা তৃনার ফ্ল্যাট থেকে আসছে। কিন্তু মোবাইল ফোন এ তৃনাকে পাওয়া যাচ্ছে না। সুইচ অফ বলছে । তাছাড়া গত তিন চার দিন থেকে তৃনার কোনো খবর নেই। তাকে দেখা যাই নি। সাধারণত পাশের ফ্ল্যাটের ছোট্ট বিট্টু তৃনার ঘরে হানা দিতো গিফট এর উদেশ্যে , তৃনার সঙ্গে তার খুব ভাব। বিল্ডিং সেক্রেটারি অতঃপর কোনো গতি না দেখে তৃনার ফ্ল্যাট খোলার ব্যবস্থা করে। দরজা খোলা হোলে সবাই নাক চাপা দেয়। ভয়ানক দৃশ্য । তৃনার প্রায় পচা মৃতদেহ পড়ে আছে মেঝেতে। গুলি বিদ্ধ হয়ে মারা গেছে । চারিদিক রক্ত শুকিয়ে আছে।
দুই
অশ্বিনী দিবাকর , বয়স প্রায় ২৮ বছর । বছর দুয়েক হলো সিনিয়র ইন্সপেক্টর পদে উন্নীত হয়েছে। কারণ অতি অল্প সময় এর মধ্যে সে অনেক জটিল কেসের সমাধান করেছে। তাতে সুনাম এর সঙ্গে সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে প্যাঁচালো কেসের সমাধান করার জন্য তার সঙ্গে পরামর্শ করেন ডেপুটি কমিশনার।
অশ্বিনী তার নিজের চেম্বারে চেয়ার এ বসে মোবাইল ফোন থেকে কিছু নিউস পড়ে নিচ্ছিলো সকালবেলা। এটা তার রোজকারের অভ্যাস। ছোট খাটো নিউস গুলো অনলাইন নিউজ থেকে পড়ে নেয়। ফ্যাশন থেকে ফিনানস সবেতেই তার সমান ইন্টারেস্ট। প্রায় এগারোটা বাজে। মোবাইল ফোন টা বেজে উঠলো। মোবাইল স্ক্রিন তে ডি জি পুলিশ কমিশনার , মিস্টার ভেঙ্কটারমান এর নম্বর ভেসে উঠলো। অশ্বিনী বলে উঠলো হাল্লো স্যার কেমন আছেন ?? উত্তরে বলেন তিনি ভালো আছেন। এরপর বলেন "ম্যাডাম আপনাকে একটু কষ্ট দিচ্ছি। একটা নতুন কেসের ব্যাপারে আপনার সাহায্য চাই। ইউ বি সিটির পুলিশ ইনচার্জের কোবিদ ইনফেকশন হয়েছে। আর তাছাড়া কেসটা একটু কমপ্লিকেটেড আছে।
অশ্বিনী চন্দ্রশেখর ওরফে চন্দ্রু কে ডেকে পাঠায়। চন্দ্রু সবে পুলিশ এর চাকরি তে ঢুকেছে বছর খানেক আগে। চট পটে, উদ্যমে ভরা। অশ্বিনী এর সাথে তার কমিউনিকেশন খুব পরিষ্কার। ম্যাডামের উপর তার অগাধ আস্থা আর খুব গৌরব অনুভব করে।
অশ্বিনী পৌছে যায় তার অ্যাসিস্ট্যান্ট চন্দ্রু এবং ফরেনসিক টীম এর সঙ্গে। ফ্ল্যাট টা সীল করে দেওয়া হয়েছে। মৃতদেহকে পোস্টমর্টেম এর জন্য পাঠানো হচ্ছে। প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে তিন থেকে চার দিনের আগে এই ঘটনা ঘটেছে। কোনো স্ট্রাগলে এর চিহ্ন নেই।
ইন্সপেক্টর অশ্বিনী ঘরের মধ্যে সমস্ত জিনিস পত্র ভালো ভাবে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। তার মনে হলো যে তৃনা দরজা খোলার সাথে সাথে তার উপর হামলা হয় এবং নিমেষে খুন করে আততায়ী সরে পড়ে। খুব ঠান্ডা মাথায় খুন।
ঘরের মধ্যে সব কিছু পরিপাটি করে সাজানো। । মডার্ন লিভিং এর নিত্য প্রয়োজনীয় সব রকম উপকরণ মজুত রয়েছে। স্মল জিম একুইপেমেন্ট , ভ্যাকুয়াম ক্লিনার থেকে মাইক্রোওভেন। ফ্ল্যাটের ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন ও মনোহর। দেওয়ালে কিছু পেইন্টিং এবং তৃনার একটি পোর্ট্রেট লাগানো রয়েছে। পোর্ট্রেট টি দেখে তৃনার চরিত্র সম্বন্ধে কিছুটা আইডিয়া করা যেতে পারে। চিবুক উন্নত দৃঢ় ব্যাক্তিত্বএর ছাপ , ডিম্বাকৃতি মুখ , বয়স বোঝা যাচ্ছে না , তবে তিরিশের মধ্যেই হবে।
ফরেনসিক টীম ঘরের মধ্যে ফিঙ্গার প্রিন্ট, ফুট প্রিন্ট্স্ , ব্লাড এর স্যাম্পল সংগ্রহ করছে। মোবাইল ফোন , ল্যাপটপ সবেরই ব্যাটারি ডিসচার্জ হয়ে গেছে। সেগুলো ও সাথে নেওয়া হলো পরীক্ষা করার জন্য।
সিসিটিভি এর মনিটর এবং তার রেকর্ডিং মেশিন সহ পুরো সিস্টেমটা বিল্ডিং এর অফিস রুম এ একটা টেবিলের উপর রাখা আছে। সবসময় অনলাইন সিস্টেম। বিল্ডিং সেক্রেটারি ছাড়াও আর এক জন অল্প বয়সী ছেলে কাজ করে। বিল্ডিং মেইনটেন্যান্স এর একাউন্টস এর কাজ ছাড়াও নানা আনুসাঙ্গিক কাজ করে।
বিল্ডিং সিকিউরিটি ক্যামেরা এর রেকর্ডিং ব্যাক আপ সি ডি নেওয়া হচ্ছে। যতক্ষণ না পোস্টমোর্টেম রিপোর্ট আসছে , মৃত্যুর সঠিক দিন বলা শক্ত। তাই প্রায় ১৫ দিনের রেকর্ডিং এর ব্যাকআপ নিতে নির্দেশ দিলো।
বিল্ডিং সেক্রেটারির সাথে কথা বলে জানা গেল যে তৃনা এম জি রোড এ একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি এর এক্সকিউটিভে পদে কাজ করতো এবং ভালোই স্যালারি পেতো। কারন ফ্ল্যাট এর রেন্ট ছিল প্রায় তিরিশ হাজার টাকা।
তৃনার পার্সোনাল লাইফ বলতে বা ফ্যামিলি সম্বন্ধে কিছুই বিশেষ জানা যাই নি এখনো। বাবা মা বা ভাই বোন কারুর কথাই বিশেষ জানা যাচ্ছে না।
এম জি রোড এর ঝাঁ চক চকে অফিস। নাম Anapolish , এডভার্টাইসিং এজেন্সী। তৃনার মৃত্যুর খবরটা নিউজ চ্যানেল কভার করেছিল। বেশির ভাগ অফিস কোলিগস ব্যাপারটা সেখান থেকেই জানতে পারে। ইন্সপেক্টর অশ্বিনী প্রথমে অফিস তে এইচ আর ডিপার্টমেন্ট এর সঙ্গে কথা বলার জন্য পা বাড়ায়। এইচ আর ডিপার্টমেন্ট এর হেড মিসেস সুকন্যা। অনেকদিন এই কোম্পানি তে আছেন। তৃনার সম্পৰ্কে জিজ্ঞাসা করায় সুকন্যা বললেন যে তিনি ভালোই চিনতেন তৃনা কে। তৃনা বছর তিরিশের সুন্দরী অবিবাহিত মহিলা। অফিস তে নানা সেলিব্রেশনস এর সময় তার সাথে কথা হতো। বুদ্ধিদিপ্ত , হাসি খুশি , শান্ত প্রকৃতির আর এট্রাক্টিভ ছিল। এমপ্লয়ী ডাটাবেস থেকে তৃনার বায়োডাটা , বাড়ির এড্রেস এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় ডিটেলস গুলো ইমেইল করে দিতে বললো অশ্বিনী।
সুকন্যা এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অশ্বিনী এবার মিস্টার প্রকাশ , জেনারেল ম্যানেজার সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং এর সঙ্গে কথা বলতে তার চেম্বার এর দিকে চললো। প্রায় পঞ্চাশ বছরের মিস্টার প্রকাশ , নিজের চেয়ার এ বসে ছিলেন। নমস্কার বিনিময়ের পর কথা শুরু হলো।
ইন্সপেক্টর অশ্বিনী জিজ্ঞাসা করে যে তৃনার মা বাবা , ফ্রেন্ডস ও রিলেটিভস সম্পর্কে কিছু জানা আছে কিনা। মিস্টার প্রকাশ বললেন যে তিনি তৃনাএর সঙ্গে গত তিন বছর ধরে কাজ করছেন। তার মতে তৃনা একজন স্বাবলম্বী বুদ্ধিদীপ্ত , চট পটে মেয়ে ছিল আর কাজের ব্যাপারে সে ছিল খুবই পারদর্শী। নেচারের দিক থেকে সে ইন্ট্রোভার্ট ছিল। কাজের বাইরে তাকে লুজ টক্ করতে কখনো দেখা যায়নি। বাবা মা বা বন্ধু বান্ধব সম্পর্কে কোনো কথা কোনো দিন বলেনি বা পার্সোনাল রিজন এর জন্য কোনো দিন ছুটি নেয়নি। একটু অদ্ভুত লাগলেও যখন কাজের ক্ষেত্রে কোনো কমপ্লেইন নেই তো বাকি জিনিস গুলো সাইডে হয়ে যায়।
অশ্বিনী আরো জিজ্ঞাসা করে , ইদানিং কি কিছু অস্বাভাবিক লক্ষ করেছিলেন। বা কোনো ব্যাপারে আপসেট ছিল। সব দিন তো সমান যায় না তাই। মিস্টার প্রকাশ বললেন , না সেরকম কিছু তো মনে পড়ছে না। তৃনা সবসময় খুব চটপটে আর পরিপাটি ছিল।
হ্যাঁ , মনে পড়েছে , লাস্ট ক্লায়েন্ট মিটিং তে তৃনা একটু অমনোযোগী হয়ে যাওয়ায় প্রেজেনটেশন তে একটু ভুল হয়ে গেছিলো। কিন্তু সে সঙ্গে সঙ্গে সামলে নেয়। খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও সেটা চোখে পড়েছিল কারণ তৃনাকে সেদিন খুব আপসেট লাগছিলো মিটিং এর পরে। সে আসে আমার কাছে সরি ও বলে। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে তার শরীর ঠিক আছে কিনা বা অন্য কিছু অসুবিধা হয়েছে নাকি ?? সে বলেছিলো , আমি একদম ঠিক আছি। একটু অমনোযোগী হয়ে গিয়ে ছিলাম। অশ্বিনী বললো এটা কবেকার ঘটনা ?? মিস্টার প্রকাশ চিন্তা করে বললো লাস্ট বুধবার হবে , মানে আজকে থেকে এক হপ্তা আগে।
এরপর অশ্বিনী উঠে পরে চেয়ার থেকে , বলে , মিস্টার প্রকাশ , যদি কিছু আরো উল্লেখযোগ্য কিছু মনে পরে তো প্লিজ আমাদের জানাতে ভুলবেন না। কারণ বুঝতেই পারছেন মার্ডার কেস। ছোট থেকে অতীব ছোট ব্যাপার হেল্প করবে রহস্যের জট ছাড়াতে।
অশ্বিনী চলে যেতেই মিস্টার প্রকাশ ইন্টারকমে তার সেক্রেটারি রঞ্জিত কে ডেকে পাঠালো। রঞ্জিত বছর বত্রিশ এর একজন সুদর্শন ব্যাক্তি। প্রকাশ জানতেন যে রঞ্জিত তৃনা কে পছন্দ করে। তাই তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন , "তুমি কি তৃনার সম্বন্ধে কিছু জানো ?" তুমি তো বেশ ইন্টারেস্টেড ছিলে তৃনার ব্যাপারে। রঞ্জিত বলে উঠে "স্যার আপনি ঠিক ই বলেছেন , আমার তৃণা কে ভালো লাগতো। অনেক চেষ্টা করেছিলাম ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করবার , মনের কথা বলবার , কিন্তু ও ভীষণ অদ্ভুত ছিল। সবার সাথে হাসি খুশিতে কথা বললেও নিজের বাইরে একটা প্রাচীর তৈরি করে রাখতো। সেটা ভেদ করে ওর মনের নাগাল পাওয়া ছিল খুব শক্ত। " প্রকাশ বললেন , "তুমি তো সবসময় ওর কাছা কাছি থাকার চেষ্টা করতে, তো ইদানিং কি কিছু অন্য রকম কিছু দেখেছিলে?”
"না স্যার , সেরকম তো কিছু চোখে পড়েনি। কারণ এতো রিজার্ভ থাকতো যে মুখে কোনো দিন কোনো চিন্তার চিহ্ন পর্যন্ত চোখে পড়েনি। তবে গত সপ্তাহে একদিন একটা ফোন এলো আর খানিকক্ষণ এর জন্য তৃনাকে দেখলাম মন দিয়ে কি একটা ভাবছে এবং অন্য মনস্ক হয়ে গিয়েছিলো। আরে স্যার যেদিন প্রেসেন্টেশন দিতে গিয়ে ভুল হয়ে গিয়েছিলো। "
রঞ্জিত তার নিজের জায়গায় ফিরে গিয়েছিলো। চেয়ারতে বসে সে তৃনার কথা ভাবতে থাকে। কত চেষ্টা করেছে তার সঙ্গে ভাব জমাতে। কিন্তু এতো হীম শীতল মেয়ে সে আর দেখেনি। সুদর্শন পুরুষ হিসাবে সে মহিলা মহলে খুবই পপুলার। কিন্তু তৃনা কোনোদিন ই তাকে পাত্তা দেয়নি।
মনে মনে রাগ হতো , কিন্তু ঠিক আছে। মনে পড়ছিলো একবার অফিস এর অ্যানুয়াল ডে ফাঙ্কশন এর পর কেউ কেউ পাব তে নিজেদের পছন্দ মতো ড্রিঙ্কস অর্ডার করছিলো , ডান্স ফ্লোরে মস্তি তে কোমর দোলাচ্ছিলো। তৃনা ডান্স ফ্লোর এ খানিক্ষন সময় কাটিয়ে ড্রিঙ্কস এর কাউন্টার এর সামনে গিয়ে বসলো। সবাই এর সাথে তাল মিলিয়ে টেকিলা শটস নিচ্ছিলো। কিন্তু চারটা শট এর পর সে গাত্রোত্থান করলো। তার কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছিলো , রঞ্জিত জিজ্ঞাসা করেছিল বাড়ি পৌছে দেবে কিনা। কিন্তু তৃনা সামলে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি করে বেরিয়ে গেল। বললো,”আমি ঠিক আছি , কোনো চিন্তা নেই ।“ পরদিন আবার সেই একরকম পরিপাটি তৃনা অফিস তে এলো। আগের রাত্রের কোনো অবসাদ বা শরীর খারাপের কোনো লক্ষণ নেই। এর থেকে বোঝা যাচ্ছিলো যে সে খুব ব্যালান্সড আর নিজের খেয়াল সে নিজেই রাখতে পারে। কাউকে কোনো সুযোগ দিতে চায় না।
তিন
পোস্টমর্টেম এর রিপোর্ট এসেছে। দুখানি নাইন এম এম বুলেট মত্যুর কারণ। মৃতদেহ আবিষ্কারের পাঁচ দিন আগে মৃত্যুর দিন সনাক্ত করা হয়েছে। মনে আছে সেদিন খুব জোর বৃষ্টি পড়ছিলো , জায়গায় জায়গায় জল জমে গিয়েছিলো।
তৃনার মৃতদেহ তার বাড়ির লোকেদের হাতে তুলে দিতে হবে। অনাপোলিশ এর এইচ আর ডিপার্টমেন্ট এর রেকর্ড থেকে জানা যাচ্ছে যে তৃনা কলকাতার ভবানীপুরের মেয়ে , স্কুল , কলেজ কলকাতাতেই । তাছাড়া পুনা ইউনিভার্সিটি থেকে মার্কেটিং এ MBA করেছে ডিস্ট্যান্ট করেসপন্ডেন্স কোর্স এ। কন্টাক্ট ফোন নম্বর যেটা দেওয়া আছে তা আউট অফ অর্ডার। আশ্চর্যের বিষয় তৃনার মোবাইল ফোন থেকে বাড়ির লোকেদের কোনো কন্টাক্ট নম্বর পাওয়া যাচ্ছে না। অবশ্য কর্তব্য যে তাড়াতাড়ি ভবানীপুর থানার সঙ্গে কন্টাক্ট করার দরকার। মৃতদেহটা মর্গে রাখা হয়েছে। অ্যাসিস্ট্যান্ট চন্দ্রু কাজে লেগে গেল।
শুধু মিস্টার জয়প্রকাশ বলে একজন এর নম্বর দেওয়া আছে , একটি পেয়িং গেস্ট এর মালিক। যখন তৃনা প্রথম এর শহরে এসেছিলো তখন তার PG তে থাকতো।
অশ্বিনী আই টি ডিপার্টমেন্ট কে তৃনার সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্ট গুলো ভালো করে দেখতে বলল তৃনার স্টোরি জানার জন্য। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়াতে তৃনার কোনো একাউন্ট নেই। IT সেল এর সাথে আবার যোগাযোগ করে আর তৃনার মোবাইল ফোন টিকে ভালো করে নেড়েঘেঁটে দেখতে বললো। কার সাথে কথা বলেছে কতক্ষন কথা বলেছে সব কিছুর রিপোর্ট দিতে বলে।
মহা মুশকিল কোন দিক দিয়ে যে তদন্ত শুরু করবে , এখনো পর্যন্ত সমস্ত ঘটনাকে মনে মনে সাজানোর চেষ্টা করে , যত টুকু জানতে পারা যাচ্ছে তাতে তৃনা একজন ইন্ট্রোভার্ট , রিজার্ভ ও ব্যালান্সড মেয়ে ছিল। সেখানে এই মার্ডার কিছুতেই ম্যাচ করছে না।
অশ্বিনী ভাবতে থাকে। সে নিজে একজন স্বাধীনচেতা ও আত্ম বিশ্বাসে ভরপুর ওয়রকিং ওয়মান । পুলিশ এর চাকরি ছিল তার স্বপ্ন । নিয়মিত শরীর চৰ্চা এবং বিভিন্ন সাবজেক্ট এর উপর পড়াশুনা করা তার হবি। সবথেকে প্রিয় সাবজেক্ট হলো মানুষের মন এবং চরিত্র বিশ্লেষণ করা। যখন সে কোনো ব্যাক্তির সঙ্গে কথা বলে তখন সে বুঝতে চায় যে সেই ব্যাক্তির মনের গভীরতা , বা যেন সে তার মনের ভিতর টা দেখতে চায় কোন রাসায়নিক বিক্রিয়া হচ্ছে , খুব ইন্টারেষ্টিং লাগে ব্যাপারটা। আর তার এই জিজ্ঞাসু চরিত্রই অশ্বিনী কে সবার থেকে আলাদা করে।
অশ্বিনীর সামনে তৃনার ফ্ল্যাট থেকে পাওয়া জিনিসের লিস্ট গুলো টেবিলের উপর ছিল। সে তার উপর চোখ বুলাতে লাগলো। যদি কোনো সূত্র পাওয়া যায়।
চার
ইতিমধ্যে প্রায় দশদিন অতিবাহিত হয়েছে। গোল্ডেন চ্যারিওট বিল্ডিং এর সিসিটিভি ক্যামেরা রেকর্ডিং এর সিডি এসেছে। ল্যাপটপ তে পনেরো দিনের রেকর্ডিং দেখা হচ্ছে , যেদিন খুব বৃষ্টি হয়েছিল সেদিনের ফুটেজ বার বার করে ঘুরিয়ে দেখা চলছে। সিকিউরিটি রেজিস্টার অনুযায়ী সেদিন তৃনার ফ্ল্যাটের কোনো ভিজিটর ছিল না । এছাড়াও সাত তলায় কোনো ফ্ল্যাটএই বাইরে থেকে কেউ আসেনি তা সিকিউরিটি গার্ড দু জনকেই জিজ্ঞাসা বাদ করে জানা গেছে। সকালের সিকিউরিটি গার্ড কৃষ্ণা বলে যে রাত্রের সিকিউরিটি গার্ড একটু দেরি করে পৌছেছিল সেদিন , বৃষ্টি পড়ছিলো , সে পুরো ভিজে গিয়েছিলো। রাত্রি সাড়ে আটটার সময় হবে । বিল্ডিং এর ভিতর লিফটের পাশে অফিস রুম তে জামা চেঞ্জ করতে গিয়েছিলো। ঠান্ডা লাগছিলো তাই দু জনে মিলে ইলেকট্রিক কেটলি তে চা বানিয়ে খেয়েছিলো। তার জন্য হয়তো দশ মিনিটের মতো লেগেছিলো। সে সময় কোনো গাড়ি বাইরে থেকে আসেনি বা বিল্ডিং থেকে বাইরে যায়নি।
কিন্তু খুন তো একটা হয়েছে। সাত তলার সিসিটিভি ফুটেজে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে এই খুন ভাবনা চিন্তা করে ঠান্ডা মাথায় করে হয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজ কে ট্যাম্পার করা হয়েছে।
অশ্বিনী আজ গোল্ডেন চ্যারিওট এ এসেছে। বিল্ডিং সেক্রেটারি কে ডাকা হলো। সে তো খালি বলতে থাকে সে কিছু জানে না। এমনিতেও তৃনা কারুর সাথে পাঁচে থাকতো না তো শত্রূতা কোথা থেকে হবে। তৃনার ফ্ল্যাটে ভিজিটার কেউ আসতো না। কেউ আসলেও কোনো টেকনিশিয়ান, সার্ভিস প্রোভাইডার কোনো না কোনো কাজের জন্য। তৃনার সঙ্গে সবথেকে ভালো সম্পর্ক ছিল পাশের ফ্ল্যাট এর সুরভীদের সঙ্গে। সুরভী , তার স্বামী বিশ্বনাথ পাটিল , দুটি বাচ্চা আর তাদের ঠাকুমা মানে বিশ্বনাথের মা । সুরভী হাউস ওয়াইফ , স্বামী বিশ্বনাথ সফ্ট ওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। তৃনা কখনো কখনো সুরভীদের সঙ্গে কথা বলতো আর ছোট্ট বিটটু কে ভীষণ ভালোবাসতো। ক্যাডবেরি, খেলনা নিয়ে এসে বাচ্চাগুলো কে দিতো। তৃনার সঙ্গে তাদের খুব ভাব ছিল। তৃনার মৃত্যু তে তারা সবাই দুঃখিত এবং হতভম্ভ।
অশ্বিনী চন্দ্রু কে বলে যে তৃনা বিশেষ ভাবে নিজেকে সব কিছু থেকে আলাদা রাখতে চেয়েছে। হতে পারে যে তৃনার আরেকটা জীবন ছিল সবার অলক্ষে । এরপর সে চন্দ্রু কে জিজ্ঞাসা করে কলকাতা থেকে কোনো খবর এসেছে ?? সে বললো না ম্যাডাম এখনো আসেনি।
অশ্বিনী বিষয়টা অন্য ভাবে চিন্তা করতে লাগলো। হঠাৎ তার মাথায় বিদ্যুতের ঝিলিক খেলে যায় , এভাবে তো সে চিন্তা করেনি। চন্দ্রু কে বললো “শিগগির তৃনার ফ্ল্যাটের দরজা খোলো।“ চন্দ্রু অবাক হয়ে ম্যাডাম এর দিকে তাকিয়ে থাকে , যদিও সে ম্যাডাম কে ভালো করে চেনে যে নিশ্চয় তিনি কোনো সূত্রের সন্ধান পেয়েছেন। অশ্বিনী বলে , সমস্ত ফ্ল্যাট টা তন্ন তন্ন করে খোঁজ। দেওয়াল থেকে কাপবোর্ড থেকে মেঝে থেকে সবকিছু ভালো ভাবে খোঁজা চাই। মুহূর্তের মধ্যে গোটা ফ্ল্যাট তোলপাড়। ফ্ল্যাট টা সুন্দর করে সাজানো ছিল ঠিক যে রকম তৃনা নিজে পরিপাটি ছিল। ডাইনিং কাম ওপেন কিচেন এর মধ্যে উডেন জালির পার্টিশন। ঘর সাজানোতে পেইন্টিং এর আধিক্য দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। সব থেকে চোখ টানছে তৃনার একটা পোর্ট্রেট , স্কোয়ার সাইজের দুই ফুট দৈর্ঘে ও প্রস্থে। অশ্বিনী খানিক্ষন সেই পোর্ট্রেট এর দিকে তাকিয়ে ছিল। ডিম্বাকৃতি মুখ , দৃঢ় চিবুক , পাতলা ঠোঁট সঙ্গে উজ্জ্বল চোখদুটি তার এক ব্যাক্তিত্বের আভাস দিচ্ছে। অশ্বিনীর সিক্সথ সেন্স কিছু বলছে। চন্দ্রু কে বললো দেওয়াল থেকে ছবিটা সরাতে। একটা ছোট সুইচ রয়েছে এর তলায়। সুইচ টিপতেই দেওয়ালের গায়ে একটা ১ফুট জায়গার একটি কুলুঙ্গির আকার নিলো। হাত ঢুকিয়ে তার থেকে একটা স্মার্ট ফোন পাওয়া গেল। ব্যাটারী সম্পূর্ণ ডিসচার্জ হয়ে গেছে। আরও চমক বাকি ছিল। চিরুনি তল্লাশি করে কিচেন এর এক কাবার্ড থেকে বেরিয়ে এলো একটা অটোমেটিক পিস্তল।
অশ্বিনী এতটা আশা করেনি। এই সফলতা তাকে আরো আত্মবিশ্বাসী করে তুললো। অশ্বিনী ইতিমধ্যে তার টীম কে তৃনার নামে ব্যাঙ্ক একাউন্ট ডিটেলস খুঁজতে বলেছিলো , তার সঙ্গে স্যালারি একাউন্ট ছাড়া অন্য ব্যাংকে একাউন্ট থাকলে তার ট্রানসাকশান ও দেখতে বলে ও লকার হোল্ড করছে কিনা তার ডিটেলস ও নিতে বলে। চন্দ্রু কে তাড়া দেয় কলকাতার সঙ্গে কন্টাক্ট করতে। তৃনার অতীত সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া খুব জরুরি। ফরেনসিক রিপোর্ট তে আগেই বলা হয়েছে যে তৃনার ঘরের মধ্যে কোনো ব্যাক্তির ফুট প্রিন্ট বা ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেই। খুনি ঘরের মধ্যে ঢোকেনি।
পাঁচ
কলকাতার ভবানীপুর থানা , সাব ইন্সপেক্টর মিস্টার মল্লিক ইন্সপেকশন করতে গিয়ে জানতে পারে যে তৃনা হাজরার এক নার্সিং হোমে জন্মেছিলো। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বেলতলা গার্লস স্কুল থেকে আর হাজরার ওমেনস কলেজ থেকে অনার্স গ্রাজুয়েট। যে এড্রেস লেখা ছিল, গত পাঁচ বছর হলো তৃনার বাড়ির লোকেরা কেউ সেখানে থাকে না। প্রতিবেশী রা জানালো যে খুব শান্ত শিষ্ট পরিবার ছিল। বাবা মা , ভাই বোন এই নিয়ে ছিল ছোট্ট সংসার। পড়াশুনাতে দুই ভাই বোন খুব ভালো ছিল। তৃনার বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়ার দুই তিন বছর পর তার ভাই বাবা ও মা কে নিয়ে এখান থেকে চলে যায়। এরপর আর কোনো যোগাযোগ নেই তাদের সাথে। মিস্টার মল্লিক আর দেরি করলেন না। সঙ্গে সঙ্গে বেঙ্গালুরু তে যোগাযোগ করলেন।
গোপন মোবাইল ফোন টি পাসওয়ার্ড প্রোটেক্টেড ছিল। সেটা অনেক কষ্টে খোলা হয়েছে। তার থেকে থেকে গুটি কয়েক ফোন নম্বর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। কাদের নামে সেগুলো রেজিস্টার করা আছে তা বের করা হচ্ছে।
চার পাঁচ টি নম্বর এর মধ্যে একটি হলো অনলাইন হেলথ কেয়ার এর কাস্টমার কেয়ার নম্বর। বাকি নম্বর এর আরেকটি লোকাল এসটিডি বুথ এর নম্বর , একটা প্রাইভেট মোবাইল নম্বর , মনে হয় কোনো VIP নম্বর। চমকের মধ্যে রয়েছে দুটো কানাডার নম্বর।
ফোন নম্বর গুলোকে ভালো ভাবে যাচাই করা হচ্ছে। পুলিশের স্পেশাল সেল এই কাজে লেগে পড়েছে। এখন কোনো ভাবেই এই কেস সাধারণ মার্ডারএর পর্যায় পড়ছে না। অশ্বিনী ডেপুটি কমিশনার অফ পুলিশ কে নিয়মিত এই কেসের আপডেট দিয়েছে আর রিকোয়েস্ট করেছে যাতে দরকার মতো সবরকম সাহায্য পাওয়া যায়।
ছয়
বিশেষ নম্বর গুলো কে যাচাই করতে গিয়ে নানা চমক প্রদ তথ্য সামনে উঠে এলো।
প্রথমে অনলাইন হেলথ কেয়ার কাস্টমার কেয়ার নম্বর টা আসলে একটি ইউনিসেক্স ম্যাসেজ পার্লার। অনুমান করা হচ্ছে যে এটা আসলে একটা মধু চক্র। অল্প বয়সী ছেলে মেয়ে রা শহরের নামি দামি কাস্টমার দের ম্যাসেজ করে থাকে। অশ্বিনী এখানে পুলিশ রেইড করতে নির্দেশ দিলো।
কানাডা এর দুটো নম্বরের একটা তে পুলিশ IT ডিপার্টমেন্ট থেকে কল করে। ওপাশ থেকে কল রিসিভ করে এক পুরুষ কণ্ঠ হ্যালো বলে ওঠে। পুলিশ অফিসার তৃনার নাম করতেই সঙ্গে সঙ্গে ফোন কেটে যায় রং নম্বর বোলে। তৃনার নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই যেন ফোন টা তাড়াহুড়ো করে কেটে দেয় । কানাডার দ্বিতীয় নম্বরটা সুইচড অফ বলছে। এখন সেখানে রাত্রি।
এরপর আসে এস টি ডি বুথ এর নম্বর এর পালা। এই শহরের কে আর পুরোম এর কাছে এক সবজি মান্ডি এর সামনে এক টি ভি রিপেয়ার দোকানের লাগোয়া এই বুথ টা। প্রাইভেট ভি আই পি নম্বর টার ও খোঁজ চলছে। শিগগির তার হদিশ মিলবে।
তৃনার ল্যাপটপ থেকে উল্লেখযোগ্য কিছু পাওয়া যাই নি। পুরোপুরি অফিসের কাজেতে ব্যবহার করা হয়েছে।
অটোমেটিক পিস্তল এর উইপেন নম্বর থেকে জানা গেছে দিল্লী এর একটা সিকিউরিটি এজেন্সি এর নামে রেজিস্টার করা।
চমক এর পর চমক। প্রাইভেট ভিআই পি ফোন নম্বর টা বিশিষ্ট এক এম এল এ মিস্টার কার্তিক এর। গত কয়েক বছর ব্যাঙ্গালোরের পলিটিক্স এর ক্ষেত্রে একজন ক্ষমতাশালী ব্যাক্তি। স্মাগলিং , অস্ত্র চোরাচালান ও নানা বেআইনি বিজনেস থেকে মধুচক্র , খুন , জখম নানা কুকর্মের অধিকারী। তার বিরুদ্ধে অনেক কমপ্লেন থাকলেও প্রমান ও সাক্ষী এর অভাবে তাকে কিছুতেই কব্জা করা যাচ্ছে না।
অশ্বিনী ভাবতে পারেনি যে ব্যাপারটা এইভাবে মোড় নিতে চলেছে। তৃনার মতো একটি শিক্ষিত আধুনিকা রিজার্ভ প্রকৃতির মেয়ের সাথে এই দুষ্কৃত এম এল এ র কি সম্পর্ক ? সত্যি ধাঁধায় পরা গেলো। পলিটিকাল বডি এর নাম যুক্ত হওয়ায় খুব সাবধানে ব্যাপারটা সামলাতে হবে। চন্দ্রু কে বোল্লো এম এল এর সাথে দেখা করার এপয়েন্টমেন্ট নিতে।
সাত
হোয়াইটফিল্ড এর এক বিল্ডিং এর সেকেন্ড ফ্লোর। ঝাঁ চক চকে ম্যাসেজ পার্লার "রিলাক্স "। পুলিশের রেইড পড়েছে আজকে। সংস্থা টি র কর্ণধার একজন কেরালীয়ান। নাম মিস্টার জন চাকো। লক ডাউন এর পর আবার বিজনেস ভালোই চলছে। সে দিব্যি আয়েশ করে নিজের চেম্বার তে বসেছিল। হঠাৎ পুলিশের আগমনে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে। সে তার চেম্বার থেকে হা হা করে ছুটে এলো। বললো কি হয়েছে ? পুলিশ কেন ?? অন্যান্য এমপ্লয়ীজরা ও এসে জুটলো চারধার থেকে। সমস্ত ঘর তল্লাশি করা হলো। যদিও সময়টা দুপুর , তাই সেরকম কাস্টমার ছিল না । আজকাল আবার হোম সার্ভিস ও দেওয়া হচ্ছে এক্সট্রা চার্জেস বিনিময়ে।
অশ্বিনী তৃনার ফটোগ্রাফ সামনে তুলে ধরে সবাই কে জিজ্ঞাসা করে , আপনারা কেউ এই ফটোর মহিলা কে চেনেন ? যদি চেনেন তো আমাদের তার সম্পর্কে জানান। কিন্তু আশ্চর্য সবাই এককথায় বলে উঠে যে তারা কখন তৃনাকে দেখেনি।
চন্দ্রু ফিসফিস করে অশ্বিনী কে বলে ম্যাডাম , মনে হয় রং কানেকশন। কোনো তথ্য ই তো হাতে আসছে না।
অশ্বিনীর মনের থেকে খটকা কিছুতে যাচ্ছে না। তার মন বলছে যে কিছু না কিছু কানেকশন আছেই। হঠাৎ সে বলে উঠলো “ আপনাদের সকল এমপ্লয়ীস আর এসোসিয়েটস দের নম্বরের ইনফরমেশন আছে ? তাহলে সেই লিস্ট বার করুন। “ চন্দ্রু কে বললো সেই লিস্ট এর মধ্যে তৃনার দুটি মোবাইল ফোনের নম্বর আছে কিনা তা চেক করতে । অশ্বিনীর অনুমান সঠিক। সেকেন্ড মোবাইল নম্বরটা লিস্ট তে রয়েছে। কিন্তু অবাকের বিষয় নম্বরটা "সামাইরা" নামে লিস্টে সেভ করা রয়েছে। ইনকোয়ারি করে জানা গেল যে সামাইরা ম্যাসেজ পার্লার এর একজন পার্ট টাইম কর্মী। সাধারণত স্যাটারডে , সানডেতেই তার সিডিউল থাকতো। তবে কোনো কোনো স্পেশাল ক্লায়েন্টদের রিকোয়েস্টে সে হাজিরা দিতো।
হেলথ কেয়ার এর এক মহিলা কর্মী মীনা হঠাৎ বলে উঠে মীনার সঙ্গে তার রাস্তায় পরিচয় হয়েছিল। কে বা কারা তাকে মীনার বাড়ির সামনে মারধর করে ফেলে দিয়ে গিয়েছিলো। মীনা তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে সেবা শুশ্রুষা করে। সামাইরা বলেছিলো যে তারা খুব গরীব। বাড়িতে মা আর ছোট ছোট ভাই বোন দের নিয়ে সংসার। পড়াশুনা বেশি দূর করতে পারেনি তাই চাকরি পাওয়া মুশকিল ছিল। পেটের দায়ে তাকে অনেক খারাপ কাজ করতে হয়েছে। সামাইরা বলেছিলো যে সকালের দিকে সে এক কারখানায় চাকরি করে। কিন্তু যা মাইনে পায় তাতে চলে না। সাইড ইনকাম হলে খুব ভালো হয়। তার সমস্ত কথা শুনে মীনা তার পার্লার এ চাকরির কথা বললে সামাইরা রাজি হয়ে যায়। তার পর থেকে গত ছয় মাস সে এখানে পার্ট টাইম তে কাজ করে। তবে গত শনিবার , রবিবার সে আসেনি। ফোন করেও পাওয়া যায় নি। সবাই ভেবেছি যে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। শুনেছে উলসুর বাজারের কাছে সামাইরা রা থাকে। জাতে ক্রিশ্চান। অশ্বিনী সব কথা শুনে মীনা কে পরের দিন পুলিশ স্টেশন এ ডেকে পাঠায়। সামাইরার একটা স্কেচ তৈরি করতে হবে।
কে আর পুরমের এসটিডি বুথের মালিক মিস্টার বেগ একটি টিভি রিপেয়ার এর দোকান চালান। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল যে সে কিছুই জানেনা। সারাদিন কত লোক আনাগোনা করছে। এখন সবার কাছে মোবাইল তা হলেও মাঝে মাঝে পাশের বস্তি থেকে লোক ফোন করতে আসে। সেখানে সব ওয়ার্কার্সদের বাস। তৃনার ছবি দেখানো হলে দোকান মালিক সাফ জানায় যে তাকে চেনেনা। কোনো দিন দেখেনি। তারপর সে তাড়াহুড়ো করে কোথায় চলে গেল । ইতিমধ্যে পুলিশের কাছে এটা পরিষ্কার যে গোল্ডেন চ্যারিওট বিল্ডিং এর CCTV ক্যামেরার রেকর্ডিং হ্যাক করা হয়েছে। না হলে ভাবতে হয় যে ভুতুড়ে কান্ড।
আট
ম্যাসাজ পার্লার এর মীনা পুলিশ স্টেশন তে স্কেচ আর্টিস্ট এর সঙ্গে বসে সামাইরা এর ছবি আঁকিয়েছে। ছবি দেখে তো সবাই থ। এ যে এক অন্য মেয়ে গোল মুখ , সোজা চুল , চটুল চাহনি , পুরু ঠোঁট , আবার ঠোঁটের পাশে কালো তিল।
অশ্বিনী তার চেম্বারে বসেছিল। আজকে বাবা ও মায়ের সঙ্গে একটু মনোমালিন্য হয়েছে। বিষয়টা আর কিছুই নয়। বাড়িতে তার বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজা চলছে। কিন্তু সে এখন বিয়ে করতে চায় না। তার যে কাজ সেটা বোঝার মতো লোকের বড়োই অভাব। এই সময়
দরজার কাছে এক ভরাট পুরুষ কণ্ঠ ভেসে এলো "এক্সকিউস মি, আমি কি ভিতরে আসতে পারি ? "অশ্বিনী চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো ভদ্রলোকের বয়স তিরিশের কাছাকছি , মানে প্রায় তারই সমবয়সী। অশ্বিনী তাকে ভিতরে আসতে বলে। সামনের চেয়ার দেখিয়ে দেয়। অশ্বিনী স্বভাব অনুযায়ী আগুন্তক কে ভালো করে জরীপ করতে থাকে । তার মনে হয় , এই ব্যাক্তিটি ইন্ডিয়া এর বাইরে থেকে সদ্য দেশে ফিরেছে । গায়ের রং খুব ফর্সা আর ব্যাঙ্গালোরের এই সময়ের মনোরম আবহাওয়াতেও ঘামের চিহ্ন স্পষ্ট। হাতে বিলাতি ঘড়ি , ব্র্যান্ডেড পোশাকআশাক , হাতে মিনারেল ওয়াটার বোতলের আধ খালি বোতল। তবে মুখে চোখে প্রবল উৎকণ্ঠার চিহ্ন বর্তমান। কিছু কারণে মন বিষন্ন।
ব্যাক্তি টি চেয়ার তে বসতে বসতে বলে , "হ্যালো , আমার নাম সুজিত মিত্র , আমি তৃনার ভাই। " অশ্বিনী তার চেয়ার এ এবার নড়েচড়ে বসে। সুজিত বলতে থাকে , " আমি বাবা ও মা কানাডা তে সেটল। তৃনা এখানে চাকরি করছিলো , তার সাথে সপ্তাহে প্রায় দুবার কথা তো হতোই। কিন্তু লাস্ট দুই সপ্তাহে তার কোনো খবর নেই। ফোন ও তার সুইচ অফ ছিলএরমধ্যে সুজিত ও নানা কাজে ব্যাস্ত হয়ে পরে , কিন্তু পরে তৃনার অফিস তে ফোন করে জানতে পারে যে তৃনার মার্ডার হয়েছে। মাথার উপর আকাশ ভেঙে পরে। সে সোজা ইন্ডিয়ার ফ্লাইট ধরে। বাবা মা কে কিছু জানানো হয়নি।
অশ্বিনী বলে , "আমি সত্যি খুব দুঃখিত আপনাদের এর লস এর জন্য। আমরা যথা সাধ্য চেষ্টা করছি এই খুনের কিনারা করবার কিন্তু এখনো সেরকম সূত্র হাতে আসেনি। সত্যি কথা বলতে কি আপনার দিদি একজন রহস্যময়ী নারী। আপনি কি কিছু সাহায্য করতে পারেন এই ব্যাপারে ? তার বর্তমান জীবন এবং কি এবং কাদের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন তার কিছুমাত্র যদি আপনি জেনে থাকেন তো প্লিজ সবটুকু বলুন। "
সুজিতের চোখ ছলছল করে উঠে। সে বলে , "বলতে তো আমাকে হবে আজ , না হলে যে এ বড়ো অন্যায় হবে তার প্রতি। " সুজিত বলতে শুরু করে।
নয়
আজ থেকে প্রায় বছর বত্রিশ আগেকার কথা। কলকাতার ভবানীপুরেএর একটি ছোট্ট বাড়িতে আজ খুশির মেলা। বিমল ও শর্মিলার প্রথম কন্যা সন্তান এসেছে। নার্সিং হোম থেকে বাড়ি ফিরেছে তারা। তুলতুলে নরম মিষ্টি ছোট্ট হাত দুটো সবসময় কিছু ধরার চেষ্টা করছে। নাম করণ হলো তৃনা। এরপর বছর তিনেক পর জন্মায় একটি পুত্রসন্তান। ভাই বোন বাবা মা নিয়ে ছিল ছোট্ট সুখের সংসার। বিমল তার সাধ্যমতো দুই সন্তান কে সমভাবে পড়াশুনা শেখান। তার কাছে ছেলে ও মেয়ে র মধ্যে কোনো ফারাক ছিল না। স্টেট গভর্নমেন্ট এর চাকরির অল্প মাইনেতে পুরো পরিবার কে খুশিতে রাখতে চেষ্টা করতেন। তার সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ যায়নি। ছেলে মেয়ে দুই জনেই পরীক্ষায় রেজাল্ট ভালো করতো। তৃনা খুব ভালোভাবে মাধ্যমিক , উচ্চমাধ্যমিক এবং স্নাতক হয়েছিল। ইচ্ছাছিলো সে সাংবাদিকতা পড়বে অথবা এমন কিছু একটা করতে চাইতো যেটা তার মনের গভীরে এডভেঞ্চার প্রিয়তার সার্থকতা খুঁজে পাবে। ছোট্ট বেলা থেকে বাবার উৎসাহে নিয়মিত খেলা ধুলা ও শরীরচর্চা করতো। বিমল সবসময় চাইতো মেয়ের যেন সবকিছুর সাথে মোকাবিলা করার সামর্থ থাকে। এদিকে তার ভাই ও কিছুতে কম ছিল না। স্কুলের শিক্ষা শেষ করে ডিস্টিংসহ তার পর জয়েন্ট এন্ট্রাস পরীক্ষায় ও ভালো রেজাল্ট করে দুর্গাপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ পড়তে চলে যায়।
সময়ের ধারার সাথে তৃনার সঙ্গে একদিন সিদ্ধার্থ এর পরিচয় হয়। কিছুদিনের মধ্যে তাদের সম্পর্ক অতীব গভীর হয়। তৃনার সবসময়ের স্বপ্ন ছিল দুজনে মিলে কোনো ইনস্টিটিউট বা কোম্পানি তৈরি করবে। সিদ্ধার্থ আর তৃনা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো। দুইজনেই তখন চাকরি করছে । তৃনা সিদ্ধার্থর থেকে রোজগার বেশি করতো। দুইজনেই ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল নিজের নিজের কাজের ক্ষেত্রে। সময় দিতে পারছিলো না। দূরত্ব তৈরি হচ্ছিলো। যখন হুঁশ ফিরলো তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। সিদ্ধার্থ অন্য মহিলার সঙ্গে অ্যাফেয়ার এ লিপ্ত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত দুজন আলাদা হয়ে যায়। সব স্বপ্ন ভেঙে যায়।
এদিকে তৃনার ভাই ও ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ তে ভালো কোম্পানি তে চাকরি হয়ে যায়। তৃনা তো এরমধ্যে পুনা ইউনিভার্সিটি থেকে মার্কেটিংতে এম বি এ করার প্রস্তুতি নেয়। শেষপর্যন্ত এক বন্ধুর চেষ্টায় সে দিল্লী তে এডভার্টাইসিং এজেন্সী তে চাকরি পায়। তৃনা কলকাতা থেকে দূরে থাকতে চাইছিলো। তার ভাইও মুম্বাই তে খুব ভাল চাকরি পেয়ে বাবা মা কে সাথে নিয়ে ভবানীপুরের বাড়ি বিক্রি করে চলে যায়।
দিল্লিতে তৃনা নতুন উদ্দমে কাজে যোগ দেয়। সঙ্গে সঙ্গে ডিস্ট্যান্ট করেসপন্ডেন্স কোর্স চলতে থাকে। এইভাবে প্রায় দুইবছর কেটে গেল কিন্তু হঠাৎ এক রাত্রের ঘটনা তার জীবন কে আমূল পাল্টে দিয়েছিলো। সে রাত্রে অফিস থেকে বেরোতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিলো। তৃনা তার আরেক মহিলা সহকর্মীর সাথে স্কুটার করে বাড়ি ফিরছিলো। রাস্তা কিছুটা সুনসান হয়েছিল , টোয়েন্টি টোয়েন্টি এর ক্রিকেট ম্যাচ চলছিল। কিছুদূর যাবার পর তারা বুঝতে পারে যে তাদের স্কুটার কে ফলো করছে একটা টয়োটা ইনোভা গাড়ি। কিছুটা ফাঁকা জায়গা দেখে গাড়িটা স্কুটার টা কে গার্ড করে দাঁড়ায়। গাড়ি থেকে দুইটি লোক বেরিয়ে এসে তাদের রাস্তা আটকায় ও অসভ্য ইঙ্গিতে গাড়িতে উঠতে বলে এবং আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে গায় হাত দেবার চেষ্টা করে। এক লহমায় ঘটনাটা ঘটে যায়। তৃনা এক নিমেষে লোকদুটো কে লাথি মেরে ঘায়েল করে। একজন উঠে আবার এগিয়ে আসতেই তৃনার জামাতে লাগানো পেন তার ঘাড়ে সজোরে বসিয়ে দেয়। সে আর উঠতে পারে না। তৃনার নিয়মিত শরীরচর্চা এতদিনে কাজে দিয়েছে। ততক্ষনে সামনে কিছু লোক জমা হয়। কাছের থানাতে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ অফিসার তৃনার সাহসের প্রশংসা করে বলে প্রত্যেক মেয়ে যদি নিজের আত্মরক্ষা নিজেই করার প্রচেষ্টা করে তো এই রকম ঘটনা অনেক কমে যাবে।
এর পর কয়েকদিন বাদে তৃনার কাছে এলো নতুন এক জব এর অফার। ইন্টারভিউ ডেট এবং সময় এস এম এস এ জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যথাসময়ে তৃনা পৌছে গিয়েছিলো। ইন্টারভিউ নিচ্ছিলেন একজন বয়স চল্লিশের ব্যাক্তি। শক্তপোক্ত রীতিমতো শরীরচর্চা করা চেহারা। চোখদুটো অসম্ভব উজ্জ্বল। নিজেকে তিনি মিস্টার এ কে বিশ্বাস বলে পরিচয় দেন। প্রথমেই তৃনাকে ইন্ট্রোডাকশন দিতে বলেন।
খানিকক্ষণ কথা বলেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তৃনা অন্য মেয়েদের থেকে আলাদা। অফুরন্ত এনার্জি আর স্ফূর্তি তে ভরা। মিস্টার বিশ্বাস এবার সোজাসুজি জানালেন যে তিনি কোনো এডভার্টাইসিং কোম্পানি এর লোক নন। তিনি ভারত সরকারের স্পেশাল ইনভেস্টগাশন ডিপার্টমেন্ট এর একটি উইংস এর সাথে যুক্ত আছেন। সেখানে যারা কাজে করেন তারা সবাই আন্ডার কভার থাকেন মানে সমাজে তাদের পরিচয় অন্য। দেশের বিভিন্ন আন্টি সোশ্যাল এলিমেন্টসদের নিঃশেষ করতে তারা নিজের লাইফ রিস্ক নিয়েও কাজ করে যান। এই কাজে একদিকে যেমন খুব এডভেঞ্চার পূর্ণ তেমনি বিপদ সংকুল। আমরা আপনার সাহসিকতার পরিচয় পেয়েছি এবং আমরা চাই যে আপনি আমাদের ডিপার্টমেন্টের একজন সদস্য হন। যদি এই কাজে যুক্ত হতে চান তো কল মি। আপনার ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করতে হবে।
দশ
সুজিত বলে চলে গত তিন চার বছর এই কাজে যুক্ত। সে একজন আন্ডার কভার স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন অফিসার কিন্তু বাইরে সে এডভার্টাইসিং এজেন্সীর এমপ্লয়ী।
সুজিত আরো বলে গত কয়েক বছরে আমি আরো ভালো অপর্চুনিটি পাই আর বাবা এবং মা কে নিয়ে কানাডাতে সেটল হয়ে যাই। তৃনার এই দুঃসাহসিক কাজের কথা সুজিত জানতো। ভাই বোন এর মধ্যে কোনো গোপন কথা ছিল না। তাছাড়া কোনোকারণে যদি তৃনার কিছু ভালো মন্দ হয়ে যায় তাহলে নিদেনপক্ষে তার খবর পাওয়ার সুবিধা হবে। গত কয়েকদিন দিদির কোনো খবর না পেয়ে একটু অদ্ভুত লাগছিলো। হঠাৎ ইন্ডিয়া থেকে একটা ফোন আসায় সে ঘাবড়ে গিয়ে ফোন কেটে দেয়। কারণ সে জানতো তৃনা কখনোই তার বাড়ির লোকেদের কন্টাক্ট নম্বর দেবে না। তাই তার মনটা কু ডেকে উঠে আর সে এম জি রোড এর অফিসএ যোগাযোগ করে ও ঘটনাটা জানতে পারে। সুজিত আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। রীতিমতো ভেঙে পরে।
অশ্বিনী জলের গ্লাসটা এগিয়ে দেয় সুজিতের দিকে। মনটা তার তৃনার প্রতি এক অদৃশ্য ভালোলাগায় ভরে ওঠে। জীবনের সব প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও হার মেনে নিজেকে গুটিয়ে নেয়নি বরং নিজের জীবনের একটা নিদ্ধিষ্ট লক্ষের দিকে ছুটে চলেছিল। এই মেয়ে সত্যি শ্রদ্ধার যোগ্যা। কিন্তু তার আসল পরিচয় তো গোপন রাখতেই হবে তদন্তের স্বার্থে।
অশ্বিনী আবার সুজিত কে জিজ্ঞাসা করে গত কয়েক মাসে কখনো তৃনা এমন কিছু বলেছিলো যা থেকে তার খুনের কোনো সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। সুজিত বলে , “না সেরকম তো কিছু বলেনি তবে একবার বলেছিলো , ভাই যদি কখনো আমার কিছু খারাপ খবর শুনিস বা যদি আমার মৃত্যু হয় তাহলে আমার IMD ব্যাংকের লকার চেক করিস।“
অশ্বিনী এবার তার তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে তার চিন্তাধারাকে অন্য পথে চালিত করলো। চন্দ্রু কে বললো তৃনার গাড়ির নম্বর ট্রাফিক ডিপার্টমেন্ট এর সাথে শেয়ার করো। গত দুই মাসে এই গাড়ি কোথায় কোথায় গেছে তার ট্র্যাক রেকর্ড চাই। ইতিমধ্যে এম এল এ কার্তিক এর সাথে এপয়েন্টমেন্ট ফিক্স হয়ে গিয়েছিলো।
এম এল এ কার্তিক দেখতে নিপাট ভালো মানুষের মতো , যেন ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না । গায়ের রং ফর্সা। চোখ দুটো ঢুলু ঢুলু। বয়স বছর পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। সাদা ধুতির উপর সাদা শার্ট পড়েছিলেন। অশ্বিনী সরাসরি তার প্রসঙ্গে চলে এলো। স্পেশাল ফোন নম্বর টা র সম্পর্কে বলে উঠে যে আমরা জানতে পেরেছি এই নম্বরটা আপনি ব্যবহার করেন। কার্তিক বলে উঠে ,"আরে তাতে কি কোনো অপরাধ হয়ে গেছে। একের বেশি ফোন নম্বর তো থাকতেই পারে।“ অশ্বিনী বলে উঠে , "না তাতে কোনো অপরাধ নেই। " দেখুন তো এই মেয়েটাকে চিনতে পারেন কিনা।" বলে তৃনার ছবিটা তুলে ধরে। এম এল একবার দেখে মুখ ঘুরিয়ে বললো না তিনি চেনেন না। এরপর অশ্বিনী চন্দ্রু কে বললো যে সামাইরা নামে মেয়েটির ছবি দেখাতে বলে। কার্তিক এর সামনে ছবিটা আসতেই যেন মনে হলো সে ভিতরে কেঁপে উঠেছে , কিন্তু সেটা বাইরে প্রকাশ করলো না। উল্টে বলে উঠে "না আমি এইসব মেয়েদের চিনিনা , কেন আমাকে এই বাজে ব্যাপারে জড়াচ্ছেন। নিশ্চয় বিরোধী পার্টির ষড়যন্ত্র। "
অশ্বিনী হেসে উঠে বললো , "আরে আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন? " তারপর কৌতুক করে বললো ,"আপনি যে গুনের সাগর তা আমরা জানি , সেই গুনগুলোর প্রমানের খোঁজ চলছে। চিন্তা করবেন না বেশিদিন নয়, আপনার নামের জয়জয়কার হতে চলেছে। "
এই কথা বলে আর না দঁড়িয়ে সোজা বেরিয়ে এলো। এর মধ্যে সে তার অবশ্য কর্তব্য ঠিক করে ফেলেছে। চন্দ্রু কে বলে , " কার্তিক এর ফোন ট্যাপ করার ব্যবস্থা করো এখনই ''। তার মনে হয়েছে যে কার্তিক তৃনা কে না চিনলেও সামাইরা কে চেনে।
ট্রাফিক পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে রিপোর্ট এসেছে। তৃনার গাড়ি বেশিরভাগ সময় সকালে অফিস থেকে বাড়িতে অথবা কোনো শপিং মলের কাছে দেখা গেছে। তবে প্রায় প্রত্যেক শুক্রবার থেকে রবিবার তার গতিবিধি সন্দেহজনক। এই দিনগুলোতে প্রায় তার গাড়ি কে, কে আর পুরোম এর কাছে একটি পার্কিং লটে গাড়ি পার্ক করতে দেখা যাচ্ছে। সিসিটিভি ফুটেজ থেকে জানতে পারা যাচ্ছে যে এই সময় সে চুড়িদার পাজামা আর ওড়না ব্যবহার করেছে। সব চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় , এসটিডি বুথ এর যে নম্বর পাওয়া গিয়েছিলো সেই জায়গাটা ওই পার্কিং লট থেকে প্রায় কুড়ি মিটার দূরে হবে।
অশ্বিনী প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি বের করতে বলে চন্দ্রু কে। শিগগির কে আর পুরোম এর টি ভি রিপেয়ার এর দোকানে যেতে হবে
মিস্টার বেগ দোকানের মালিক তখন তার দোকানেই ছিলেন। পুলিশ কে আসতে দেখে তার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া। অতি কষ্টে বলে ,"ম্যাডাম কি হলো ?", অশ্বিনী বলে উঠে ,"দোকানের তল্লাশি নিতে হবে।দোকানদার বলে উঠে আমি কিছু জানিনা , আমি কিছু করিনি , দোকানের ভিতর ডাই করে ইলেকট্রনিক্স পার্টস , টিভি তাছাড়া টুল বাক্স । একপাশে রয়েছে একটি টেবিল যেখানে বসে রিপেয়ার করা হয়। টেবিল এর ড্রয়ার চেক করার সময় হঠাৎ একটা সুইচ দেখতে পাওয়া যায়। সুইচ টেপার সাথে সাথে পিছনের দেয়ালে একটা ছোট হাফ দরজা খুলে যায় । সেই দরজা দিয়ে হাঁটু মুড়ে ভিতরে ঢুকতেই অবাক হবার পালা। একটা চার ফুট দৈর্ঘে ও আট ফুট প্রস্থে ঘর , একদিকে রয়েছে একটা আয়না , তার সামনে মেকআপ এর সরঞ্জাম। অপরদিকে মেয়েদের সস্তা চটুল জামাকাপড় ,পরচুলা আর আছে একটা মানুযের মুখের নকল। সে মুখটা দেখে আর কোনো সন্দেহ রইলো না। অবিকল "সামাইরার " মুখের আদল।
ঘটনাটি ক্রমশ পরিষ্কার হতে লাগলো। তৃনাই সামাইরা আর সামাইরা ই তৃনা। প্রস্থেটিক মেকআপ এর কামাল। স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন অফিসার্স দের ছদ্মবেশ ধারণ করারও ট্রেনিং দেওয়া হয়।
দোকানদার মিস্টার বেগ কে থানায় নিয়ে আসা হলো। প্রথমে সে কিছুই বলতে চায় না। তারপর সে বললো যে প্রায় তিন বছর ধরে তিনি এই ম্যাডাম কে চেনেন। তাঁর এই দোকান থেকে অনেক স্পেশাল অপারেশন করা হয়েছে। এটা একটা গোপন ঘাঁটি। তার দোকানে যে গোপন জায়গাটা আছে সেটা যদি দেশের জন্য কোনো ভালোর কাজে লাগে তাতে তিনি নিজেকে ধন্য মনে করেন । STD বুথের থেকে তিনি ম্যাডাম কে ফোন করতেন কখন কোন জায়গায় যেতে হবে তা জানানোর জন্য। গত তিন চার মাস ধরে ম্যাডাম হোয়াইটফিল্ড এর ম্যাসেজ পার্লার তে যাচ্ছিলেন। তার দোকান থেকে মেক আপ করে তিনি যেতেন। সব ঠিক চলছিল , কিন্তু হঠাৎ একদিন একটা লোক দোকানের সামনে ঘুরঘুর করছিলো। দোকানে এসে নানা প্রশ্ন করতে থাকে আর উঁকি ঝুঁকি দিতে থাকে। সন্দেহজনক হওয়ায় ম্যাডাম কে ফোন করে জানায় এই কথা। তার কয়েকদিনের পরই এই ঘটনা।
ম্যাডামের প্রতি তার অসম্ভব শ্রদ্ধা। এতটুকু মেয়ে তার বিপদের কথা ভুলে গিয়ে দেশের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিল , দোকানদার জানে এই কাজে অনেক বিপদ। আর একবার কোনো ভাবে কিছু ভালোমন্দ হয়ে গেলে সরকার তার আসল পরিচয় প্রকাশ করে না। তাই সে ও মুখে কুলুপ এঁটেছিলো।
এদিকে এম এল এ কার্তিক এর কার্যালয়ে , তার ব্যাক্তিগত সচিব এর সাথে পরামর্শ করতে বসেছে। তার ভাবমূর্তির উপর বিপদ ঘোরাফেরা করছে।
বেঙ্গালুরু আর হায়দ্রাবাদের বর্ডার তেনুকুন্ডার কাছে বেআইনি অস্ত্রের কনসাইনমেন্ট ভর্তি গাড়ি একটা বাড়িতে লুকিয়ে আছে। ফোন করে কন্টাক্ট করতে পারা যাচ্ছে না কার্তিকএর সঙ্গে । খবর পাওয়া গেছে তার মোবাইল ফোন ট্যাপ করা হয়েছে।
কার্তিক একটু অন্য মনস্ক হয়ে যায়। সামাইরার সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল ম্যাসেজ পার্লারে। সাধারণত এই দিন গুলোতে সে আয়াস করতে যেত। মেয়েটাকে দেখেই তার উপর মোহ জন্মে যায়। সব চেয়ে আকৃষ্ট করতো ঠোঁটের পাশে কালো তিল টা। মেয়েটার ব্যবহারও অন্য মেয়েদের থেকে আলাদা। ম্যাসেজ করার সময় তার সান্নিধ্য খুব লোভনীয় ছিল। ম্যাসেজ পার্লার এ ভালো করে পরিচয় হয়ে উঠেনি। হাইওয়ে এর কাছে কার্তিকের বাংলোতে ও সামাইরা আসতো। সামাইরার মদ এর প্রতি ভীষণ আসক্তি ছিল। বাংলোতে আসলেই সামাইরা মদের বোতল খুলে বসত আর গ্লাস এর পর গ্লাস শেষ হয়ে যেত। সেখানে মদ খেতে খেতে নানা কথা হতো । সামাইরার কাছে কার্তিক এক খোলা বই ছিল। অন্তরঙ্গ মুহূর্তে অনেক গোপন কথা কার্তিক ফাঁস করেছিল সামাইরার কাছে। এভাবেই মদের নেশায় দুজনে মাতাল হয়ে গিয়ে শেষপর্যন্ত কোথায় গিয়ে রাতের গল্প শেষ হতো তা সকালবেলা উঠলে তার কিছুই মনে থাকতো না। হঠাৎ করে কয়েকদিন যাবৎ সামাইরার কোনো খবর নেই। কার্তিকের সমস্ত বেআইনি কার্যকলাপ এর উপর পর্দা ফেলে রাখতে সাহায্য করছে পুলিশ ডিপার্টমেন্টএরই লোকজন কিন্তু বিনা পয়সায় নয়। নিয়মিত তাদের দাবি পূরণ করতে হয়। আর সেদিন তো তার বাংলোতে যে মিটিং হয়েছিল তখন সামাইরা সেই সময় সেখানে উপস্থিত ছিল। সে মিটিংতে শহরের অনেক নামি ব্যাক্তি এসেছিল। সামাইরা মিটিং এর আগে হঠাৎ এসে উপস্থিত হয়েছিল। কিন্তু সেদিন তার আসার কথা ছিলোনা। সামাইরা বললো যে তার কোনো জরুরি কাজ আছে পরের শনিবার তাই সে আজ এসেছে। এরপর কার্তিক ভেবেছিলো সামাইরা অন্য ঘরে নিশ্চিন্তে মদ খাচ্ছে। কিন্তু তার ভুল ভেঙেছিল। সবার অলক্ষে কখন যে সে মিটিং এর ঘরের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল তা কেউ জানতে পারেনি। বিড়ালের মতো নিঃশব্দে সে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছিলো। এই সময় মিটিং থেকে একজন ঘরের বাইরে ওয়াশরুম যাওয়ার সময় সামাইরা কে দেখে ফেলে। সামাইরা তাড়াতাড়ি সরে গিয়েছিলো। তার এই আচরণ খুব অদ্ভুৎ লেগেছিলো , যেখানে সামাইরা কার্তিকের সমস্ত অপকর্মের খবর জানতো সেখানে লুকিয়ে শোনার তো কোনো কারণ ছিল না। সে দিন মিটিং এ বেআইনি অস্ত্রের একটা ডিল হওয়ার ছিল , তা ছাড়া বিরোধী নেতা সুকুমারণ কে পৃথিবী থেকে সরানোর ষড়যন্ত্র ও করা হচ্ছিলো।
বারো
গোল্ডেন চ্যারিওট এর সাত তলায় সুজিত তার দিদির মৃতদেহ দাহ করার পর বাকি শ্রাদ্ধ শান্তির কাজ যথাসম্ভব করার চেষ্টা করছে । অশ্বিনী এর সঙ্গে সুজিতের এর আগে কয়েকবার দেখা হয়েছে। তৃনার শ্রাদ্ধের দিন ও অশ্বিনী সেখানে উপস্থিত আছে। পুলিশ জীবনে নানা ঘটনার সঙ্গে অশ্বিনীর মোকাবিলা হয়েছে। কিন্তু আজ তৃনার স্মরণে তার চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। মনে মনে ভাবে যে এই নারীর বলিদান কি কখনো কেউ মনে রাখবে। আজ সমাজ শিক্ষা , প্রযুক্তির দিক থেকে উন্নত হলেও মানুষের মন এখনো সে ভাবে বিকশিত হয়নি। শিক্ষা মানুষের মনের প্রসার ঘটায়নি। এখনো মেয়ে সন্তান জন্মালে তাদের বোঝা বলে মনে করাহয়। মেয়েরা শুধু সন্তানের জন্ম দেবার মেশিন নয় বা পুরুষদের শারীরিক চাহিদা মেটাবার পণ্য নয়। অশ্বিনী সত্যি ভাবুক হয়ে উঠে।
এরপর অশ্বিনী গোল্ডেন চ্যারিওট এর সিসিটিভি ক্যামেরা কে হ্যাক করার বিষয়ে আইটি ডিপার্টমেন্ট এর সাথে কথা বলে বুঝতে পারে যে হতে পারে হ্যাকারকে বিল্ডিং এর কাছে আস্তে হয়েছে। বিল্ডিং এর সিসিটিভি ফুটেজ থেকে তো এর কিছুই জানা যাবে না। অশ্বিনী এবার অন্য রাস্তা ধরল। বিল্ডিং এর ওপর পারে একটি কেক শপ , বিউটি পার্লার আর রিটেল শপ রয়েছে । তৎক্ষণাৎ এই তিনটি জায়গায় পুলিশের টীম পৌছে গেল। ধারণা ঠিক ছিল , রিটেল শপ এর সিসিটিভি ফুটেজ থেকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যে সেদিন বৃষ্টির দিন ছিল। রাত প্রায় আটটার সময় একটু আগেই তৃনার নীল গাড়িটা বিল্ডিং এর মধ্যে ঢোকার তিন মিনিট পরেই একটা মেরুন কালার এর অল্টো গাড়ি এসে বিল্ডিং এর মেইন গেট ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে মেইন রাস্তার একপাশে দেওয়াল ঘেসে দাঁড়িয়ে পড়লো । সে দিন খুব বৃষ্টি পড়ছিলো সিকিউরিটি চেঞ্জ হবার সময় রাত আটটা। এরপর আরেকজন সিকিউরিটি বৃষ্টি তে ভিজে এসে গেটের সামনে এসে তারপর দুইজনে মিলে অফিস ঘরের দিকে গেল। এই সময় অল্টো গাড়ি থেকে রেইনকোট পড়া একটি লোক বেরিয়ে এলো তারপর মেন গেটের এর পাশের ছোট জায়গাটা দিয়ে ভিতরে ঢুকে যায়। এরপর প্রায় ৯ মিনিট পর লোকটাকে আবার বেরিয়ে আস্তে দেখা যায়। তখন ও সিকিউরিটি দুই জন অফিস রুম এর মধ্যে ছিল কারণ গেটের সামনে তাদের দেখা যাচ্ছিলো না। অল্টো গাড়ির নম্বর টা নোট করা হলো। আর ট্রাফিক পুলিশের সাথে কথা বলে এই গাড়ির ট্র্যাক রেকর্ড বার করতে বলা হোল।
সুজিতের সঙ্গে IMD ব্যাংকের ম্যানেজার এর সাথে কথা হয়েছিল। তিনি সুজিত কে পুলিশের থেকে একটা অনুমতি পত্র নিয়ে দেখা করতে বলেন। অশ্বিনী ডিসিপি কে ফোন করে কথা বলে আর অনুরোধ করে তিনি যেন ব্যাংকে কথা বলে রাখেন। অশ্বিনী আর সুজিত ব্যাংকে পৌছায়। মিস্টার সুন্দরম , IMD ব্যাংকের ইউ বি সিটি ব্রাঞ্চের ম্যানেজার ওদের কে তার চেম্বার বসান। তারপর তার অ্যাসিস্ট্যান্ট কে ডেকে পাঠায়। ফর্মালিটি অনুযায়ী একটা রেজিস্টার এ নাম সই করে তিন জন লকার রুমের দিকে এগিয়ে যায়। লকার নম্বর ২১২ তে চাবি ঘুরিয়ে ব্যাঙ্ক ম্যানেজার চলে যান। এবার সুজিত লকার থেকে একে একে তিন টি পেন ড্রাইভ , একটা ডাইরি আর কিছু সার্টিফিকেট বের করে নিয়ে আসলো। সুজিত খানিক টা বিহ্ববল হয়ে উঠলো। তার মন ভারী হয়ে আসছে। অশ্বিনী বুঝতে পেরে বলে ওঠে , মন খারাপ হওয়া খুব স্বাভাবিক , কিন্তু এখন মন শক্ত করতে হবে। যারা তৃনার মৃত্যুর জন্য দায়ী তাদের ধরতে হবে , শাস্তি দিতে হবে। সেটাই এখন সবচেয়ে প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত। সুজিত নিজেকে সামলে নেয়।
মোটর ভেহিকেলস থেকে জানা গেলো যে অল্টোর নম্বরটা ভুয়ো। ট্রাফিক ডিপার্টমেন্ট থেকে জানা যাচ্ছে যে গাড়িটা সেদিন দেখা গেছে হোয়াইটফিল্ড এর দিক থেকে আসতে। এরপর তৃনার গাড়ির পিছন পিছন সেই বিল্ডিং এর ধারে এসে দাঁড়ানোর পর গাড়িটা হাই ওয়ে এর পাশে একটা ডান্স বার এর কাছে প্রায় দুঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিল।
ডান্স বার এর পাশে ছিল একটা এটিএম, সেখানএর সিসিটিভি ফুটেজ থেকে আল্টো গাড়ি থেকে দুইজন কে বেরোতে পরিষ্কার দেখা যায়। জুম্ করে দুজনের চেহারা ভালো করেই দেখা যাচ্ছে।
অশ্বিনী ডি সি পি এর সাথে সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ করলো এবং হেড অফিসে দেখা করার জন্য বেরিয়ে গেল।
তেরো
আজ এম এল এ কার্তিক এর বাড়িতে খুব রমরমা। তার জন্মদিনের পার্টি তে শহরের নামি দামি বিল্ডার্স , উচ্চপদস্থ কর্মচারী , সেলিব্রিটি , নামি কোম্পানি এর সিইও সবাই উপস্থিত। এম এল এ কার্তিক আজ খুব খুশি । বেআইনি অস্ত্রের ভালো খরিদ্দার পাওয়া গেছে। চারিদিকে মদের ফোয়ারা ছুটছে। স্বল্পবসনা লাস্যময়ী হোস্টেস গেস্ট দের দেখভাল করার জন্য প্রস্তুত। রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার ক্যাপ্টেন জগদীশ, এম এল এ কার্তিক এর সঙ্গে সুইমিং পুলের এক কোনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো। হঠাৎ কার্তিক এর শরীরে বিদ্যুতের ঝলক খেলে যায়। এ কি সামনে কে এগিয়ে আসছে ?? এও কি সম্ভব ?? এ কিছুতেই হতে পারে না । এযে সামাইরা!! এম এল এ কার্তিক চমকে উঠে অসতর্কতায় সুইমিং পুলের জলে পরে যায়।
সামাইরা এগিয়ে আসতে থাকে , ক্যাপ্টেন জগদীশ এর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরে। প্রশ্ন করে তাকে " কি স্যার , কেমন আছেন ? আমাকে দেখে এমন ঘাবড়ে গেছেন কেন ??" চারিদিক থেকে অন্যান্য আমন্ত্রিত রা ও এগিয়ে আসে সুইমিং পুলের দিকে। কার্তিক এখনো জলের মধ্যে , তার হতভম্ব ভাব কাটেনি। ক্যাপ্টেন জগদীশ কাষ্ট হেসে বলে উঠে , কি আবার হবে , কিছু না , কিছু না , "বলতে বলতে পিছনে হঠতে থাকে। তার সারা মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠেছে। সামাইরা বলে চলে, "কি হলো আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে। ততক্ষনে ক্যাপ্টেন জগদীশ বলতে থাকে, এ কি করে সম্ভব, তোমাকে তো মেরে ফেলা হয়েছে , আবার কি ভাবে বেঁচে উঠলে। "
এম এল এ কার্তিক জলের মধ্যে বিড়বিড় করে রাম নাম জপ করতে লেগেছে। এবার সে সাঁতরে ওপর পারে যেতে চেষ্টা করলো। ক্যাপ্টেন জগদীশ খাবি খেতে থাকে। । সামাইরা বলে উঠে , " আমি কি ভাবে বেঁচে গেলাম তা নয় জেলেতে বসে শুনবেন , আপাতত আপনাদের খেলা শেষ।" আপনাদের সমস্ত অপরাধের প্রমান আমি দেব। পালানোর চেষ্টা বৃথা। চারিদিকে পুলিশের লোক ঘিরে রেখেছে। এবার সে এগিয়ে গিয়ে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দেয় জগদীশের হাতে।
নিউজ চ্যানেল থেকে যারা হাই প্রোফাইল পার্টি বা পেজ ত্রি কভার করতে এসেছিলো তাদের ভাগ্যে দুর্দান্ত স্টোরি জুটে গেল। পুলিশের জিপে দুই মক্কেল কে তুলে দিয়ে অশ্বিনী তার গাড়িতে ফিরলো। সামাইরা থেকে তাকে আবার নিজের রূপে ফিরে আসতে হবে। পরচুলা আর মেকআপ তুলতে তুলতে ভাবছিলো, এই নাটকীয়তার দরকার ছিল যাতে সবার সামনে অপরাধ প্রমান করা যায়। যেখানে লুকিয়ে চুরিয়ে নয় , আসল কালপ্রিট কোনোভাবে যেন ফস্কে না যায় এবং দোষ স্বীকার করে সবার সামনে।
পরের দিন সকাল থেকে সমস্ত নিউজ চ্যানেল তে একটাই খবর বার বার প্রচারিত হচ্ছে। পুলিশের কর্মদক্ষতার জন্য ভূয়সী প্রশংসা করা হচ্ছে। ডেপুটি কমিশনার অফ পুলিশ আজ প্রেস কনফারেন্স ডেকেছেন সকাল এগারোটার সময়। কনফারেন্স হলে এতটুকু ফাঁকা জায়গা নেই।
ডিসিপি গৌরচন্দ্রিকা না করে বলতে শুরু করেন। তিনি এই রহস্যের কিনারা করার পুরো ক্রেডিট সিনিয়র ইন্সপেক্টর অশ্বিনী দিবাকর কে দিলেন আর সমস্ত বৃত্তান্ত অশ্বিনীর মুখ থেকে বলার জন্য তার দিকে মাউথ পিস্ টা এগিয়ে দেন।
অশ্বিনী আরম্ভ করে , তৃনার মৃত্যু ঘটনা থেকে একবারের জন্য অনুমান করা যায়নি যে তারা তাবড় অপরাধীদের নাগাল পাবে এবং তাদের হাতকড়া পরিয়ে সবার সামনে দাঁড় করাতে পারবে। এম এল এ কার্তিক যে নানা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত তার খবর আগে থেকেই ছিল , কিন্তু যথেষ্ট প্রমানের অভাবে তাকে ধরা সম্ভব হচ্ছিলো না। অশ্বিনী এবার আরো বলে , একজন পুলিশ অফিসার হয়ে আজ আমার একথা বলতে সত্যি গভীর দুঃখ বোধ করছি যে , কোনো কোনো পুলিশ অফিসার এর জন্য আমাদের গোটা ডিপার্টমেন্ট এর বদনাম হয় । সর্ষের মধ্যে ভূত। আজকে তৃনার মত্যুর হয়েছে উ বি সিটি থানার ইন্সপেক্টর মিস্টার অশোক চন্দ্রানের এর হাতে। মার্ডার এর দিনে , অশোক কে আমরা হাইওয়ে এর পাশে এটিএম এর সিসিটিভি ফুটেজ থেকে ট্র্যাক করি। তার সাথে ছিল এক সঙ্গী যে ক্যামেরার ফুটেজ হ্যাক করতে সাহায্য করেছিল। এরপর সে কয়েকদিন এর জন্য কোবিদ হয়েছে এই অছিলায় ছুটিতে চলে যায় যাতে এই খুনের তদন্ত তাকে না করতে হয়। জেরার চোটে সে স্বীকার করেছে পয়সার লোভে সে এমন কাজ করেছে। আর তাকে এই কাজে নিযুক্ত করেছিল স্পেশাল ইনভেস্টিগেশনের চিফ, রিটায়ার্ড ক্যাপ্টেন জগদীশ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন ? অশ্বিনী বলে চলে, “ আমাকে আজ তৃনার আসল পরিচয় দিতে হবে। তৃনা এডভার্টাইসিং এজেন্সির একজন এমপ্লয়ী ছিলেন না , তিনি ছিলেন স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন উইংস এর অফিসার। দিল্লি থেকে এখানে তাকে বিশেষ অপারেশন এর জন্য পোস্টিং করা হয়েছিল। নিজের জীবন বিপন্ন করে তৃনা সমাজের এই নরকের কীটের বিরুদ্ধে প্রমান জোগাড় করছিলো যাতে সুযোগ মতো এদের হাতে হাতকড়া পরানো যায়। তৃনা মেকআপ এর সাহায্যে নিজেকে একদম বদলে ফেলে এবং ক্রমশ সে নিজের লক্ষ্যে এগুতে থাকে। নাম ধারণ করে " সামাইরা ''। এই ছদ্মবেশে সে কার্তিকের অনেক কাছে চলে আসে। বাংলোতে মদের ও সামাইরার দেওয়া ড্রাগের নেশায় কার্তিক তার জীবনের অনেক গুপ্ত কথা ফাঁস করে তার কাছে এবং সেটা সামাইরার দেহে লুকানো ক্যামেরাতে বন্দি হয়ে যায়। কিন্তু বাদ সাধলো ক্যাপ্টেন জগদীশ , সে কার্তিকের দুস্কর্মের সঙ্গী এবং তার সরকারি ক্ষমতার বলে সে কার্তিককে এতদিন বাঁচিয়ে এসেছিলো। এরমধ্যে একদিন সামাইরার কাছে খবর আসে , কার্তিক এর বাংলোতে গোপন মিটিং হতে চলেছে। সামাইরা সেখানে হঠাৎ উপস্থিত হয়। কার্তিক অবাক হলেও তাকে পাশের একটা ঘরে অপেক্ষা করতে বলে। সামাইরা সেই ঘর থেকে বেরিয়ে জানলার ফাঁক দিয়ে মিটিং এর ছবি তুলতে থাকে। কিন্তু একটু অসতর্কতার বশে তাকে একজন দেখতে পেয়ে যায়। আমার ধারণা ,সামাইরা ক্যাপ্টেন জগদীশ কে সেখানে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। কারণ প্রতক্ষ সাক্ষাৎ না থাকলেও সে স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের সাউথ ইন্ডিয়ার চিফ কে চিনতো। ক্যাপ্টেন জগদীশ পোড় খাওয়া দাগি লোক , সে সঙ্গে সঙ্গে সামাইরার পিছনে লোক লাগায় এবং সত্যি টা জানতে পারে। এরপর তৃনা যে রিপোর্ট তৈরি করে ইমেইল করেছিল সেটাও হ্যাক করে ডিলিট করে দেওয়া হয় । তৃনা অপেক্ষা করতে থাকে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য। দিল্লি থেকে কোনো রেসপন্স আসে না। ফোন করে জানানোর চেষ্টা করে কিন্তু কোনো ভাবে অসফল হয়। হয়তো তৃনা দিল্লি যাবার প্ল্যান ও করে থাকবে। এরই মধ্যে ইন্সপেক্টর অশোক তাকে খুন করে দেয়। কিন্তু তৃনা সবসময় তার কাজের ব্যাকআপ পেনড্রাইভে সেভ করে রাখতো তার পার্সোনাল কালেকশন এর জন্য . আমরা সেই পেনড্রাইভের থেকে গোটা ঘটনার ভিডিও ফুটেজ পেয়ে গেছি যা কিনা কার্তিক, জগদীশ ও তাদের আরো সাঙ্গ পাঙ্গ দের কঠিন শাস্তি দেবার জন্য যথেষ্ট। আমি আজ আমাদের পুলিশ ডিপার্টমেন্টের তরফ থেকে তৃনা মিত্রর প্রতি আমাদের অসীম শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি আর স্যালুট করছি দেশের এই মেয়ের সাহসিকতার প্রতি।
সুজিত কনফারেন্স হল এর একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখ ছল ছল করে উঠলো।
------------