নির্মলা
নির্মলা
এক
এ আজ অনেক বছর আগেকার কথা। টিভিতে মেগা সিরিয়াল বলতে তখন শুধু রামায়ন , মহাভারত। ভীষণ জনপ্রিয় ছিল মেয়েটা ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরত তার সেতারের ক্লাস থেকে। প্রত্যেক রবিবার ছোট্ট মেয়েটা সকালবেলা বাবার সাথে সেতার শিখতে যেত তাদের বাড়ি থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে।
বাড়ি ফেরার পথে রাস্তায় "মহাভারত।। " গানটা শুনতে পেতো , বাবাকে পিছনে ফেলে বাড়ির দিকে ছুটতো এপিসোড টা যাতে একেবারে প্রথম থেকে দেখতে পায়।
কি ভালোই না ছিল সেই দিনগুলো। মনের আনন্দে দিনগুলো পেরিয়ে যাচ্ছিলো। স্কুলে তার ক্লাসে সেই ছিল মধ্যমনি। যেমন পড়াশুনা , খেলাধুলায় সে সবচেয়ে সেরা ছিল তেমনি বন্ধুদের দলে প্রাধান্য পেতো সেই।
ধরা যাক সেই মেয়েটির নাম ''পৃথা ''। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। সে নিজে একা একা সময় কাটাতে ভালোবাসতো। কিছু না কিছু নিয়ে সে সবসময় ব্যাস্ত থাকতো। একদিকে যেমন চিন্তাশীল আবার খুব দুরন্ত ছিল ,খানিকটা টম বয়ের মতো।
তার সমবয়সী মেয়েদের মতো সাজগোজ এর প্রতি সেরকম উৎসাহ ছিল না। গল্পের বই ছিল তার প্রধান সঙ্গী। এখনকার দিনের মতো তখন না ছিল ইন্টারনেট , মোবাইল ফোন , কম্পিউটার। সে খুবই কল্পনাপ্রবণ ছিল , মনে মনে অনেক কিছু কল্পনা করে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগতো তার। তবে মাঝে মাঝে বাবার কাছে বকা ঝকা খেলে মনে হতো কবে সে বড়ো হবে। কিন্তু সে বুঝতো না যে বড়ো হবার অনেক জ্বালা। এই ছোট বেলাই সবথেকে নিষ্পাপ ও আনন্দের সময়। যেখানে সে না বুঝে ভুল বলে বা করে তাতে কোনো ক্ষতি নেই।
পাশের বাড়িতে ছিল তার অবাধ যাওয়া আসা। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও সেই বাড়ির লোকেদের সঙ্গে ছিল অচ্ছেদ্য সম্পর্ক। সেই বাড়ির বৃদ্ধ গৃহকর্তা মোহনবাবু পৃথার মাকে নিজের এক মেয়ের মতো দেখতেন। পৃথার বাবা সরকারি চাকুরে , স্বামী , স্ত্রী ও এক মেয়ে এই নিয়েছিল ছোট সংসার। কোনো আলাদা ঝঞ্জাট ছিলোনা তাদের জীবনে। পৃথার মা নীলা বরাবরই খুব আবেগপ্রবন ছিল। নিজের বাপের বাড়িতে তেমন কেউ না থাকায় সে মোহনবাবুদের বাড়ির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে পড়েছিল।
মোহনবাবুর ছিল তিন মেয়ে আর এক ছেলে। স্ত্রী সূচি দেবী ছিলেন বরিশালের মেয়ে, রান্নার হাত ছিল খুব ভালো। মোহনবাবুদের আদি বাড়ি ছিল এখনকার বাংলা দেশের ফরিদপুরে। কলকাতাতেই দুইজনের বিবাহ হয়েছিল। সূচীদেবী অত্যন্ত ভালো মহিলা ছিলেন , কিন্তু তার চিন্তা ধারায় কিছুর যেন অভাব ছিল। তিনি ছিলেন খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। অবশ্য এটাকে অন্য কথায় শুচিবাই গ্রস্থ ও বলা চলে। সংসার আগলে রাখার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। মোহনবাবু বয়সকালে ভালো কোম্পানি তে চাকরি করতেন এবং কলকাতা শহরের থেকে একটু দূরে প্রায় দশ কাটা জমির উপর বাড়ি বানিয়েছিলেন সপরিবারে বাস করার জন্য। মোহন বাবুর মা তখন ও বেঁচে ছিলেন এবং তিনিই বাড়িটাকে আগলে রেখেছিলেন।
তখন পশ্চিমবঙ্গে মার্কস বাদের ঢল এসেছে। নারী পুরুষ বাচ্ছা বুড়ো এই শ্রমিক পার্টির আদর্শের কিছুই বুঝুক ছাই না বুঝুক এই নিয়ে বেশ মেতে উঠেছিল। অনেক কোম্পানি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আর তাঁর মধ্যে মোহনবাবুর কোম্পানি টি ও একটি।
সংসারে অভাব দেখা দিয়েছিলো। তখন পাড়ায় বড় রাস্তার ধারে কাঠের খেলনা তৈরির দোকান করেছিলেন। এই ভাবেই চলছিল।
পৃথার মা নীলা ছিলেন খুব ফর্সা ,ব্যাক্তিত্ব ছিল সম্ভ্রান্ত বংশের মেয়েদের মতো আর সেই কারণেই হয়তো মোহনবাবুর খুব প্রিয় ছিল নীলা। নীলার থেকে মোহনবাবুর বড়ো মেয়ে রমলা ও ছেলে দীপক বড় ছিল। মেজো মেয়ে মিত্রা আর ছোট মেয়ে বকুল ছিল ছোট। তারা নীলাকে দিদি বলে ডাকতো।
এর মধ্যে মোহনবাবুর মায়ের মৃত্যু ঘটেছিলো। সংসারের হাল ধরার কেউ ছিল না। তাই ছেলে মেয়ে রা তাদের জীবনের লক্ষ্য ঠিক করতে পারে না । পড়া শুনা সেভাবে করে উঠতে পারে না।
এরপর কোনো ভাবে দীপক একটা চাকরি পায় আর সংসারের কিছুটা ভালো দিন আসে। কমুনিস্ট পার্টির জের মোহনবাবুর জীবনে একটি বড় ছাপ ফেলেছিলো । তিনি তাঁর পাড়ার নেতা স্থানীয় ব্যাক্তি ছিলেন এবং প্রায় প্রত্যেক রবিবার তাঁর বৈঠকখানায় পার্টির মিটিং হতো। অবারিত চা ও জলযোগ সহকারে মিটিং চলতো
এবার আসি মোহন বাবুর ছেলেমেয়ে দের বিষয়। বড়ো মেয়ে রমলা ছিলেন অতি সরলমনা ,অতি সাজুনী , অতি কথুকে , দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা আর উঠেই বারান্দায় বসে রাতের স্বপ্ন দেখার কথা বলা ছিল নিত্য অভ্যাস। বয়সে বড়ো হলেও তিনি বড়োর মতো কোনো কাজ করেননি। তাঁর জন্য পাত্র দেখে দেখে সবাই হয়রান। কাউকে তাঁর পছন্দ হয়না। তার উপর বয়স তো থেমে থাকে না। তখনকার দিনে গ্রামের শিশু ও তার মায়ের স্বাস্থ্য দেখভাল করার জন্য রাজ্য সরকার থেকে মহিলা কর্মী নিযুক্ত করতো যারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে এই কাজ করবে । রমলা সেই কাজে নাম লিখিয়েছিল।
ছেলে দীপকএর ছিল কার্তিক মার্কা চেহারা। ফর্সা লম্বা । ভালো ঘরের মেয়েরা তাকে দেখে পাগল ছিল। কিন্তু এই মূর্তিমান যে কি ভাবছে আর কি কাজ করবে তা জানা ভগবানের ও অসাধ্য ছিল। সে যে আসলে কি চায় তা সে নিজেই ঠিক করতে পারতো না।
মেজো মেয়ে মিত্রার ছিল লম্বা দোহারা চেহারা। তখন কার সিনেমা অভিনেত্রী পারভীন বাবি , জীনাত আমন এর মতো খানিকটা। পড়াশুনা সেও বেশিদূর করেনি। তার পাশেও অনেক ভোমরা গুনগুন করলেও শেষ পর্যন্ত মিত্রা যাকে জীবনসঙ্গী হিসাবে বেছে নিয়েছিল সেটা হয়তো কাম্য ছিলোনা। কারণ সেই দিন থেকে সে তার পায়ে নিজের হাতে কুড়ুল মেরেছিলো। অবশ্য এই নিয়ে বেশি কথা না বলাই ভালো।
ছোট মেয়ে বকুল ছিল স্পষ্টবাদী, একরোখা , সে তার ভাই বোনেদের থেকে আলাদা ছিল। তার মর্যাদা , আত্মসম্মান বোধ ছিল ভীষণ। মোহনবাবু যখন তার বাকি ছেলে মেয়েদের দেখে হতাশ হয়েছিলেন তখন এই ছোট মেয়ের উপর তিনি ভরসা করতে থাকেন। সংসার চালানোর কাজ সে নিজো কাঁধে তুলে নিয়েছিল। মোহন বাবু সংসার খরচের টাকা থেকে বাড়ির অনেক বড়ো ডিসিশন এই ছোট মেয়ের সাথে আলোচনা করতেন। আর নির্ভর করতেন নীলা ও শান্তনুর উপর।
পৃথা ছোটবেলায় মামার বাড়ির অভাব বুঝতে পারেনি , তার কারণ ছিল এই পরিবার। মোহন বাবুর পৃথার প্রতি অপত্য স্নেহ ও ভালোবাসা তার নিজের নাতনির চেয়ে কম ছিল না। বকুলও নীলা ও শান্তনু র উপর নির্ভর করতো। কারণ তাদের বাড়িতে এমন কেউ ছিল না যে তার উপর ভরসা করা যায়। দিদি ও জামাইবাবু হিসাবে বকুল সবসময় তাদের সন্মান করতো। পৃথার বাবা প্রত্যেক পুজোয় কলকাতার বাইরে ঘুরতে যেতে ভালোবাসতেন। কাছাকাছি পুরী , রাজগীর , ঘাটশিলা এইসব জায়গায় পুজোর কটাদিন কাটিয়ে আসতেন সপরিবারে। বকুলকেও সঙ্গে নিতেন তারা। পৃথা বকুলকে তার প্রায় সমবয়সী এক বন্ধু বলে ভাবতো। সম্পর্কে মাসি হলেও পৃথা বকুলকে তুই বলতো। বকুল ডানাকাটা পরী না হলেও সুশ্রী ছিল। গায়ের রং ছিল কাঁচা হলুদের মতো আর ছিল কালো কোঁকড়া চুল। একটা আলগা শ্রী ছিল তার মধ্যে। বড়ো মেয়ে রমলার বিয়ে হচ্ছিলো না , এক তো তার নানা বায়না তার উপর ছিল বয়সের চাপ। বড় মেয়ের বিয়ে না দিয়ে কি করে ছোট মেয়েকে বিয়ে দেয়। এদিকে বকুল ও এক ছেলের সঙ্গে জড়িয়ে পরে। ছেলেটি ছিল মাছের ব্যাবসায়ী। কিন্তু কোনো কারণে সে সম্পর্ক টেকে না ।
পৃথার তখন বারো কি তেরো বছর বয়স। একদিন এক ভোর রাত্রে বকুল তার গায়ে আগুন দিয়েছিলো। এ ঘটনার প্রায় একমাস আগেকার কথা। সময়টা কালীপূজা শেষ হয়ে অল্প অল্প শীত পড়ছে। বকুল তার এক বন্ধুর বিয়ের নিমন্তন্ন রক্ষা করতে গিয়েছিলো। রাত্রি প্রায় সাড়ে দশটার সময় দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ি ঢুকেছিলো। তার সারা গায়ে ধুলো মাখা। জামাটা একটু ছিড়ে গেছে। নীলা সেসময় তাদের বাড়িতে উপস্থিত ছিল। সে জিজ্ঞাসা করে ,"বকুল তোর কি হয়েছে ?" বকুলের তখন উদ্ভ্রান্ত অবস্থা। ঠিক করে কথা বলতে পারছেনা। এরপর থেকেই তার মানসিক স্থিতির পরিবর্তন হয়। সবসময় সে বলতে থাকে "তোরা কেউ বাইরে বেরোস না। মেরে ফেলবে , সবাই কে মেরে ফেলবে। " এরপর সে উন্মাদে পরিণত হয়। নীলাই তাকে কলকাতার মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যায়। ডাক্তার পরীক্ষা করে বলেন যে " কোনো গভীর শোক পেয়েছে। " কিন্তু আদতে কি যে হয়েছে তা কেউ বুঝতে পারছে না। তার অসলগ্ন কথা থেকে কিছুই বোঝার উপায় নেই। বকুলের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলেও কিছু বোঝা যায় না। সেদিন সে বিয়ের অনুষ্টান থেকে প্রায় সাড়ে আটটার সময় বেরিয়ে এসেছিলো। এরপর তার সাথে কি হয়েছিল তা কেউ বলতে পারছে না।
দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠেছিল। সে ঘরে সেদিন বকুলের সঙ্গে তার দিদি রমলা ও শুয়েছিল। সেদিন যেন রমলা কে মরণ ঘুমে পেয়েছিলো। তার ছোট বোন যে এই রকম একটা কাজ করতে চলেছে তা সে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি। বকুলের শরীর প্রায় এইটি পার্সেন্ট পুড়ে গেছিলো। তাকে হাসপাতাল এ নিয়ে যাওয়া হয়। আগুনের তাপে তার ফর্সা মুখটা পুড়ে গেছিলো। এতটুকু ছোট মেয়েটা কিভাবে এই জ্বালা সহ্য করে চুপ করে ছিল তা সত্যি ভাবনার অতীত। কি এমন হয়েছিল যে সে নিজেকে শেষ করে ফেললো।
পৃথার ছোট্ট মনে ঘটনাটা একটি দাগের মতন। তার মনে হামেশা প্রশ্ন উঠতো কেন ? কেন ? কেন ? সে ছোট ছিল তাই তার সামনে কেউ কোনো কথা আলোচনা করতো না।
হাসপাতাল এ একদিন পর বকুল মারা গিয়ে ছিল। পুলিশ কেস হয়েছিল। বকুল অনেক কষ্টে পুলিশ কে বলেছিলো যে তার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।
এই দুর্ঘটনার ভার মোহনবাবু নিতে পারেননি। তিনি বিছানা নেন আর তারপর কখনো সুস্থ হননি। পনেরো দিনের মাথায় নিজের বাড়িতেই মারা যান। সূচি দেবী চিৎকার করে কাঁদতে পারতেন , কিন্তু মোহনবাবু তা করতে পারেননি , তাই এতো তাড়াতাড়ি এই পরিণতি। সবাই এর কাছে এই ঘটনা অত্যন্ত দুঃখ জনক। কিন্তু মানুষ সময়ের সঙ্গে সব ভুলে যায়।
দুই
জল গড়িয়ে যায় আর যায় সময়ও। আজ দুইহাজার সতেরো সালের নভেম্বর মাস , পৃথা এখন ইউনাইটেড স্টেটস এর নর্থ ক্যারোলিনার বাসিন্দা। তার বয়স চল্লিশের কোঠায়। নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করছে। মা নীলা কয়েক বছর হলো মারা গিয়েছেন। বাবা শান্তনু ও তার সাথে এখন আমেরিকার অধিবাসী। কলকাতায় আত্মীয় স্বজন দের সাথে আজকাল বেশিরভাগ সময় স্কাইপি তেই কথা হয়। তাছাড়া ফেইসবুক , ওয়াটসআপ তো আছেই। পৃথার বড়ো পিসির ছেলে কল্যাণের বিয়ে। পিসি থাকেন কলকাতার ডায়মন্ড হারবার এর দিকে। অনেক করে নিমন্ত্রণ করেছেন তাদের আসতে। শেষপর্যন্ত কলকাতায় আসার দিন ঠিক হলো। এমনিতেও যাদবপুরে পৃথাদের যে ফ্ল্যাট বাড়িটা আছে তার একটা ব্যবস্থা করার দরকার।
পৃথা বিয়ে করেনি। আসলে অনেকের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকলেও বা তাদের ভালো লাগলেও , তারা ঠিক হাসব্যান্ড মেটেরিয়াল বলে মনে হয়নি। সে আধুনিক মনস্কা হলেও তার কাছে স্বামী সেই হওয়া উচিত যেএকদিকে ভালো বন্ধু ও নির্ভরতার একটা জায়গা আর একটা শক্ত খুঁটি যেখানে জীবনে ঝড় ঝাপ্টা যাই আসুক , সেখানে নির্ভয়ে আশ্রয় পাওয়া যায়। সে হবে শ্রদ্ধার পাত্র। কিন্তু সেই বৈশিষ্ট যুক্ত ব্যাক্তির বড়োই অভাব আজকাল। তাতে পৃথার কোনো আক্ষেপ নেই। জীবনে পুরুষ না থাকলে কি নারী জীবন ব্যর্থ?
কলকাতায় আসলে তারা যাদবপুরের ফ্ল্যাটে থাকে। অনেক দিন পর প্রায় বছর আটেক আগে এসেছিলো মা এর মৃত্যুর সময়।
বিয়ের দিন বরযাত্রী যাওয়ার জন্য বলেছিলো পৃথাদের। কনের বাড়ি অশোক নগরের দিকে। গাড়ি করে অন্যান্য বরযাত্রীদের সঙ্গে বাসে করে পৃথাও চলেছে। পৃথা বরাবরই রুচি সম্পন্ন সাজগোজ করে। দেখাবা করাটা তার মোটেও ভালো লাগে না। আর ক্রিসমাস ট্রি এর মতন একগুচ্ছ গয়না পরে লোক দেখানো তো একেবারেই অসহ্য।
হঠাৎ একটি জায়গা তার চেনা চেনা লাগছে। এইতো সেই বড়ো রাস্তা টা যেখান দিয়ে সে রিক্সা করে স্কুল যেত। চারপাশে ফাঁকা জায়গার বদলে এখন দেখা যায় সারি বেঁধে দোকান। তবে যে চিড়ার মোড় জায়গাটি ছিল যা সে ছোট বেলায় রোজ দেখতে পেতো তা এখন ও সেই রকম আছে। এখানেই তার ছোটবেলা কেটেছে। আগে সে শুনেছিলো যে কনের বাড়ি এই দিকে , কিন্তু সেই জায়গাটা যে তাকে তার ছোটবেলার কথা মনে করিয়ে দেবে তা সে বুঝতে পারেনি।
এরপর বাসটা যখন কনের বাড়ির সামনে গিয়ে থামলো তখন সে বুঝতে পারে যে তার সেই জায়গাতেই পৌছে গেছে। কনের নাম হলো স্মিতা। স্মিতা সেই বাড়ির মেয়ে যারা ঠিক মোহনবাবুর পাশের বাড়িতে থাকেন। বাস থেকে নেমে পৃথা চারিদিক দেখতে থাকে। বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য প্যান্ডেলের ঘেরাটোপে স্মিতাদের বাড়িটি। চারিদিক আলো ঝলমল করছে। পৃথা ছোট বেলায় তার বন্ধুদের সঙ্গে নিত্য খেলা ধুলা করতো পাড়ায় তাদের বাড়ির সংলগ্ন এক বড় খেলার মাঠে। কিন্তু আজ আর সে মাঠ নেই। তার অর্ধেকটা পূর্ণ হয়েছে আধুনিক ফ্ল্যাট বাড়িতে। পাড়ার চারিদিকে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে ফ্ল্যাট বাড়ি। ফাঁকা জায়গা খুঁজে পাওয়া ভার। ছোট দুই কামরার পায়রার খোপ। প্রোমোটারি বিজনেস আজকাল খুবই লাভের। একেকটা ফ্ল্যাট বিক্রি করলে তার থেকে ভালোই কমিশন।
বরযাত্রীদের বাসটা থেমে ছিল একটা অন্ধকার বাড়ির সামনে। বাড়িটা অন্ধকার , চারিদিক আগাছা ভর্তি। দেখে বোঝাই যায় সেখানে কেউ থাকে না। মোহনবাবুদের বাড়িটা বিষন্ন , নিঝুম , নিঃশ্চুপ। পাড়াতে এই বাড়িটা চারিদিকে উদীয়মান ফ্ল্যাট বাড়িগুলোর সামনে বেমানান। সবার সাথে পৃথা তাল মেলাবার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। কারণ তালে তাল মেলাতে সে কোনোদিনই পারেনা।
সে একটু উৎকণ্ঠিত। তাকে ওই বাড়িটা টানছে। পৃথা আস্তে আস্তে ভিড় এড়িয়ে বাড়িটির গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার মনে পড়ছে পুরানো দিনের কথা। অপলক একদৃষ্ঠে সে তাকিয়ে থাকে বাড়িটির দিকে .
কতক্ষন যে সে দাঁড়িয়ে ছিল তা সে জানে না। তারপর হুঁশ ফিরতে সে পিছন ফিরে যাবার উদ্যোগ করতেই কে যেন তার ডাক নাম ধরে ডেকে উঠলো। এই নাম এখানে কারুর জানার কথা নয়। একমাত্র তার খুব পরিচিত ছাড়া। পৃথা মাথা ঘুরিয়ে কাউকে দেখতে পায় না। না তার আগে না তার পিছনে। পৃথা ভাবে হয়তো তার মন দুর্বল হয়ে গিয়েছে। ছোটবেলার কথা মনে করে তাই সে আবার এগিয়ে যায় স্মিতাদের বাড়ির দিকে।
আবার সে শুনতে তার ডাক নাম ধরে কেউ ডাকলো। এবার কোনো ভুল নয়। সে পিছন ফিরে কাউকে দেখতে পায়না। ধীর পায়ে সে এগিয়ে চলে মোহনবাবুদের বাড়ির দিকে। আবার সে গেটের সামনেটা তে গিয়ে দাঁড়ায়। একটা ঠান্ডা বাতাস যেন তাকে ছুঁয়ে যায়। পৃথা বলে উঠে : কে আছেন ? কে ? "আমি আপনাকে দেখতে পাচ্ছিনা । "
হঠাৎ পিছন থেকে সন্দীপ , পিসির ছোট ছেলে ডেকে উঠলো, "পৃথাদি তুমি এখানে কি করছো ? বিয়ে যে শুরু হয়ে গেল । " পৃথা বললো , "হ্যা আমি আসছি। " বলে সে সন্দীপ এর সাথে হাটতে শুরু করে কিন্তু সে একদম কনফিডেন্ট যে তার নাম ধরে কেউ ডেকেছিল। "
বিয়ে হয়ে গেল। তারপর সবার সাথে কথাবার্তা বলে খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে আবার বাসে করে ফেরা। কিন্তু পৃথার মন পরে রইলো সেই বাড়িতেই। ছোটবেলায় সে হামেশাই ও বাড়িতে হইচই করতো।
মোহনবাবুর মৃত্যু হওয়ার প্রায় কয়েকমাস পরে পৃথার বাবার অন্য ডিপার্টমেন্ট এ বদলি হওয়ায় সরকারি কোয়ার্টার এ উঠে যায় হাওড়ার দিকে। পৃথার বাকি স্কুল কলেজ সেখানেই। পৃথা বরাবরই মেধাবী ছিল এবং ভালো রেজাল্টের সাথে মুম্বাই তে চাকরি আর তারপর আরো ভালো জবের অফার পাওয়ায় ইউ এস এ তে চলে যায়। আজ তো সে পাকাপাকি গ্রীন কার্ড হোল্ডার।
বকুলের দুর্ঘটনাটি পৃথার মনে দাগ কেটেছিল বরাবরই। কিন্তু সে ছোট ছিল তখন। এরপর পড়াশুনা ও চাকরি জীবনের নানা ওঠাপড়াতেও তার মনে মাঝে মাঝে ঘটনাটা উঁকি ঝুঁকি মারলেও সে সেই মুহূর্তে কিছুই করতে পারেনি।
পরের দিন , উৎসবের 
;বাড়ি সবাই কোনো না কোনো বিষয়তে কথা বলছে না হয় কাজে ব্যস্ত। বেলা বাড়ার সাথে বরকনে বাড়িতে এসেছে। বধূবরণ চলছে। নতুন বউয়ের সাথে তার ছোট বোন এসেছে। খুব মিশুকে স্বভাব তার। নিয়মপালা শেষ হবার পর নতুন বউকে বিশ্রাম করতে দেওয়ার জন্য একটি ঘরে রাখা হলো। পৃথা তক্কে তক্কে ছিল , সে এসে নতুন বউয়ের সাথে ভাব পাতানোর চেষ্টা করলো। সারা রাতের বাসর জাগা ও এতদূর আসার ক্লান্তিতে বউ নাজেহাল। তাও বরের মামাতো বোন বলে হেসে হেসে তার সঙ্গে কথা বললো।
পৃথা একথা সেকথা পর আসল কথায় এলো। পৃথা জিজ্ঞাসা করে , " তোমাদের বাড়ির পাশে ওই ফাঁকা বাড়িটা পাড়ার মধ্যে কিরকম বেমানান । ওখানে তো কেউ থাকে বলে মনে হয়না। "
স্মিতা বলে " আরে না না, ওই বাড়িতে কেউ থাকে না। বাড়িটা ঐরকম ভাবেই রয়েছে। বাড়ির আসল মালিকরা বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে যাবার পর থেকে কোনো লোকই সেই বাড়িতে থাকতে পারে না । ওই বাড়িটা অভিশপ্ত। বাড়িটি প্রায় পাঁচ জন খরিদ্দারের হাত বদল হয়েছ। এখন এক প্রফেসর এর বর্তমান মালিক। কিন্তু তিনিও ওই বাড়িতে থাকতে পারেন নি। তা এও প্রায় চার পাঁচ বছর হয়ে গেল। সেই থেকে বাড়িটা পরিত্যক্ত হয়ে রয়েছে। বাড়িটার এমন বদনাম যে নতুন খরিদ্দার পাওয়া খুব কঠিন হয়েছে।
পৃথা বলে ওঠে , "অভিশপ্ত কেন ? কি হয়েছিল ?" এবার স্মিতার ছোট বোন মিশা বলে উঠে ,"শুনেছি ওই বাড়ির আসল যে মালিক ছিলেন তার ছোট মেয়ে আত্মহত্যা করার পর সেই শোকে ১৫ দিনের মাথায় তিনি ও মারা যান। এরপর বাড়ির ছেলে মেয়েরা বিয়ে থা করে বাড়ি বিক্রি করে চলে যায়। প্রথমে যারা বাড়ি কিনেছিলেন তারা কাপড়ের ব্যাবসায়ী ছিলেন। কিন্তু একমাসের মধ্যে বাড়ির বড়কর্তা অসুস্থ হয়ে পড়েন আর ব্যবসায় লোকসান হতে শুরু করে। বাড়ির লোকেরা সবসময় কারোর অস্তিত্ব অনুভব করতো। পূজাপাঠ করেও কিছু হয়নি। কোনো এক জ্যোতিষী তাদের বলেন ওই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে কারণ ওই বাড়িতে অনেক কান্না জমে আছে। এরপর একের পর এক হাত বদল হতে থাকে বাড়িটা। এখন জঙ্গলে পরিণত হয়ে আছে। কেউ সেখানে যেতে ভয় পায়। রাতের বেলা পাঁচিলের অপরপারের দিকে তাকাতে ভয় করে। আমরাও মাঝে মাঝে অদ্ভুত শব্দ শুনতে পাই। পৃথার মনটা ভরাক্রান্ত হয়ে উঠে। সে বলে "আচ্ছা এবার তোমরা বিশ্রাম করো। আমি আসি ।"
পৃথা মনে মনে ভাবতে থাকে। যাদবপুরের ফ্ল্যাটে রাত্রিবেলা সে তার বাবাকে জিজ্ঞাসা করে , "বাবা তোমার বকুলের কথা মনে আছে ?''। তিনি চমকে উঠে তাকালেন , বললেন , "হা , কিন্তু আজ এ কথা কেন ?'
তুমি কি জানো যে বাড়িতে কল্যাণের বিয়ে হয়েছে তা বকুলদের বাড়ির পাশে। আর বাড়িটা এখন একটা পোড় বাড়ি। পৃথা তার বাবাকে জিজ্ঞাসা করে । শান্তনু বলেন , "শুনেছিলাম ঐদিকে বিয়ে হয়েছে , কিন্তু এতটা কাছে তা জানতাম না। "
পৃথা তার বাবাকে বলে , "আমি তখন ছোট ছিলাম। তাই তোমরা আমাকে কিছুই বলোনি। তুমি কি জানো কেন বকুল এরকম করেছিল ? আজ তো বলতে কোনো অসুবিধা নেই। "
শান্তনু বলতে শুরু করেন। সেদিন বকুলের বন্ধুর বৌভাতের নিমন্ত্রণ থেকে ফেরার সময় বোধকরি কেউ বা কারা বকুলের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিল। বাড়ি ফেরার পর তার জামা ও মুখের অবস্থা দেখে সেটাই অনুমান করা যায়। কিন্তু বকুলের কাছ থেকে আসল ঘটনা টা কিছুতেই জানতে পারা যায় নি। আজও অন্ধকারে সেই কারণ। তবে এইটুকু বোঝা গেছিলো যে কেউ বা কারা ওকে ভীষণ ভাবে ভয় পাইয়ে ছিল যা তার মস্তিস্ক বিকৃতি ঘটিয়ে দেয় ও ফলাফল আত্মহত্যা।
তিন
পৃথা এরই মধ্যে স্মিতার সঙ্গে বেশ ভাব জমিয়ে ফেলেছে। দ্বিরাগমনে যাবে কল্যানেরা। তখন স্মিতা পৃথা কেও তাদের সাথে যেতে বলে। কারণ ইতিমধ্যে সে জানতে পেরেছে যে পৃথার ছোটবেলা কেটেছে তাদেরই পাড়ায়। হয়তো এতদিন বাদে সেখানে গেলে তার ভালো লাগবে।
পৃথা রাজি হয়ে যায়। সবার একটু অদ্ভুত লাগলেও পৃথার তাতে কিছু এসে যায় না। তার উদ্দেশ্য তাকে পূরণ করতেই হবে। পৃথা গিয়ে পৌছায় স্মিতাদের বাড়িতে। সকালবেলা সে ভালোকরে দেখতে পায় মোহনবাবুদের বাড়িটা। মনে পড়ে যায় ছোটবেলার তার হাসিখেলার দিনগুলো।
পৃথার পরনে আজ একটা নীল আকাশি চুড়িদার , তার খুব পছন্দের রং। মনের মধ্যে একটু হালচাল। তার মনে পড়ছে মোহনবাবুদের ঠিক পিছনে ছিল তাদের ভাড়া বাড়ি। মোহনবাবুদের বাড়িটা মধ্য খানে রেখে বাম পাশে ছিল আরেকটি বাড়ি। এক পূজারীর বাড়ি। নাম ছিল তার শ্রীকান্ত ভট্টাচার্জি। তার মেয়ে পিয়া ছিল ডাক সাইটে সুন্দরী
ছোটবেলায় বকুল , পিয়া আর পৃথা একইসঙ্গে অনেক সুন্দর সময় কাটিয়েছিলো। সরস্বতী পূজা , হোলি দুর্গাপূজা বিভিন্ন উৎসবে একসঙ্গে অঞ্জলি , আনন্দ। পৃথা সবচেয়ে ছোট ছিল বয়সে তাদের মধ্যে।
বকুলদের বাড়িটা ছিল প্রায় দশ কাটা জমির উপর। মেন্ রাস্তার গায়ে ছিল প্লটটা। বাড়িটা ছিল জমিটার সামনের দিকে । বাড়িটা একতলা, পিছনে জমিতে নানা রকম ফুল ফলের গাছ ছিল । বৈশিষ্ট ছিল একটি বড়ো কুলের গাছ। যখন কুল হতো আর পাকত তখন পাড়ার ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ভিড় হতো এর তলায়। তখনকার দিনে বাড়ির মধ্যে টয়লেট থাকতো না , বাড়ির একটা কোনে বাথরুম ও সাথে হাতে চাপা জলের কল ছিল। আর ছিল একটি তুলসীতলা। তার পাশে জবা গাছে কত ফুল ফুটত। পেয়ারা , আতা গাছ ভর্তি ফল ছিল। সূচীদেবীর হাতের রান্না ছিল চমৎকার সামান্য আলুর খোসা থেকে এমন সুস্বাদু রান্না , আঙ্গুল চেটে খেতে ইচ্ছা করবে।
পৃথার মনে পড়ছিলো মহালয়ার গান শুরু হতো মাইকে সকাল পাঁচটায়। দুর্গাপুজোর আগে আগে তাদের বাড়ির সামনে শিউলি ফুলের গন্ধ পাওয়া যেত। সে সব তার এখনো মনে আছে। এখন সেই বাড়িটা দেখে মায়া হচ্ছে। চারিদিকে আগাছার জঙ্গল। তার মধ্যে বাড়িটার গায়ে শেওলা ধরেছে।
পৃথা স্মিতাদের বাড়ির লোকেদের সঙ্গে ঘুলে মিলে গেছে। খাওয়া দাওয়ার পর দুপুরে সে বেরিয়ে পড়ে চারিদিক দেখতে। নভেম্বর মাসের অল্প ঠান্ডা হাওয়ায় তার ভালোই লাগছিলো। বাড়িটার কাছে পৌছে যাবার সাথে সাথে ভিতরে যাবার তাগিদ অনুভব করলো। গেট খুলে ধীরে ধীরে সে এগিয়ে যায়। রাস্তার ধারে পাঁচিলের পাশে টগর ফুল গাছটি এখনো ফুল বিছিয়ে রেখেছে রাস্তায়। তুলসী তলাটা এখনো সেরকমই আছে। সেখানে খানিক্ষন দাঁড়িয়ে সে এগোয় বাড়ির সামনের বারান্দার দিকে। তাতে পা ঝুলিয়ে বসে পড়ে। চারিদিকে আগাছা ভর্তি সে ভ্রূক্ষেপ করে না। এমনটা সে ছোট বেলায় প্রায়ই করতো। একটা ঠান্ডা বাতাস তাকে ছুঁয়ে যায়। মনে হলো কেউ যেন তার গায়ের খুব কাছে পাশেই বসে আছে। পৃথার গা টা শির শির করে উঠে। হঠাৎ করে সে উঠে পড়ে বেরিয়ে আস্তে চায়। তার ওড়না টা একটা খাঁজে আটকে যায়। কানের কাছে শুনতে পায় তার নাম খুব আস্তে ফিসফিস করে। চমকে বলে উঠে , "কে ? কে ? "কিন্তু কোনো সাড়া নেই। খানিক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে সে ফিরে আসছিলো। গেটটা বন্ধ করে পিছন ফিরতে একটি লোক বলে উঠে ,"ম্যাডাম এই বাড়িতে কেউ থাকে না। আপনি এর মধ্যে কি করছিলেন ? এমনিতে এই বাড়িতে কোনো লোক টিকতে পারেনি। কত লোক এলো আর গেলো। সবাই রাতের বেলা কোনো মেয়েকে ঘুরতে দেখেছে। মাঝে মাঝে কান্নার শব্দ ও শোনা যায়। এক অতৃপ্ত আত্মার হালচাল বলে সবাই মনে করে।
পৃথা লোকটিকে বলে , "শুনেছি এই বাড়ির আসল মালিক যে ছিলেন তার মেয়ের কিছু দুর্ঘটনা হয়েছিল। " পৃথার কথা কেড়ে নিয়ে লোকটি বলতে থাকে, "হ্যা ম্যাডাম , এ কথা সত্যি গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করে মেয়েটি আর তার ঠিক ১৫ দিনের মাথায় তার বাবা মারা যায়। "
পৃথা বলে "আপনি দেখছি অনেক কথা জানেন। , কত দিন আছেন এখানে ?" লোকটি বলে "আমি এখানকার বাসিন্দা নোই। থাকতাম আগে বারুইপুর এর দিকে। প্রায় বছর চারেক হল এখানে এসেছি। আমার বাড়ি এই রাস্তার বাঁদিকে একটি গলির ভিতরে। আমার নাম অরূপ বিশ্বাস।
পৃথা বলে ," আপনি কি জানেন এই বাড়ির আর কোনো লোকের কথা , মানে আমি শুনেছি যে আরো মেয়ে আর ছেলে ও তাদের মা ছিলেন। তারা কোথায় থাকেন বর্তমানে ? " অরূপ বিশ্বাস বলেন ,"বড় মেয়ের আর একমাত্র ছেলের বিয়ে হয়ে যাবার পর বাড়িতে ঝামেলা শুরু হয়। ছেলের বউ মিশুকে ছিল না। বাড়িতে ননদদের থাকা পছন্দ করতো না। তাদের মা সূচি দেবী তখন ও বেঁচে ছিলেন। কোনোদিনই তিনি সংসার সামলাতে পারেননি , তাই শেষ পর্যন্ত তাকে ছেলের এবং ছেলের বউয়ের সঙ্গে নিজের স্বামীর বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হয়। বাড়ি বিক্রি হয়ে যায়।
পৃথা বলে ,"আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আসলে আমি এই বাড়িটা কিনতে চাই , তাই একটু খোঁজ খবর নিচ্ছিলাম। আপনি কি জানেন এই বাড়ির বর্তমান মালিক কে ? " অরূপ বিশ্বাস বলেন , "হ্যা ম্যাডাম আমি জানি। উনি একজন প্রফেসর , এখানে অবসর সময় কাটাবার জন্য বাড়িটা কিনেছিলেন। কিন্তু তিনিও এখানে থাকতে পারেনি। আমি ওনার নম্বর টা জোগাড় করে দেব। " এরপর দুজনে মোবাইল নম্বর আদান প্রদান করলো।
সন্ধ্যে হয়ে এসেছিলো , পৃথা তাই পা চালায় স্মিতাদের বাড়ির দিকে। রাত্রে খাওয়ার টেবিল এ পৃথা সবার সঙ্গে বসে কথা বলছিলো।
মিশা বলে উঠলো , "পৃথাদি আপনি ওই বাড়িটাতে গিয়েছিলেন , আমি দেখলাম। ভয় করলো না "?
পৃথা বলে উঠে , "ভয় করার কিছু নেই। ওই বাড়িতেই আমার ছোটবেলার অধিকাংশ সময় কেটেছে । বলা যায় দুর্ঘটনার সময়টাতে আমি অনেক ছোট ছিলাম। চোখের সামনেই দুইজন কে মারা যেতে দেখেছি। সেই থেকে আমার মনের মধ্যে জানার ইচ্ছে প্রবল হয়ে ওঠে।
সবাই চুপ করে থাকে। স্মিতার বাবা হঠাৎ বলে উঠেন , "আমার মনে হয় ব্যাপারটা ভুলে যাওয়াই ভালো। কানাঘুষোয় শুনেছি অনেক গন্ডগোল ছিল এই ঘটনার পিছনে। তিনি আরো বলেন ,"আমি বেশি কিছু জানিনা , মোহনবাবু সেসময়কার পার্টির একজন সক্রিয় নেতা ছিলেন আর কিছু ব্যাপার নিয়ে তার সঙ্গে বাকি সদস্যদের মধ্যে মতের অমিল দেখা দিয়েছিলো। "
পৃথা বলে , "কার কাছ থেকে এব্যাপারে জানতে পারা যাবে।" স্মিতার বাবা বলেন , কিছু উঠতি ছেলে ছোকরা যারা পার্টির ক্যাডার হিসাবে কাজ করতো তখন , তাদের মধ্যে এখন অনেকেই হোমরা চোমরা হয়েছে শুনেছি। একটু খোঁজ নিলে হয়তো আসল ঘটনাটা জানতে পারা যাবে। তবে আমার মনে হয় তুমি এই ব্যাপারে বেশি ভেবো না। যা হয়ে গেছে তা নিয়ে এখন কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরোতে পারে।
পৃথা চুপ করে থাকে , এরপরের দিন পৃথা যাদবপুর রওনা দেয়। অরূপ বিশ্বাসের সাথে কথা হয়ে গিয়েছে , সে যদি আসল খবর টা জেনে দিতে পারে তাহলে সে কিছু ভালো পারিশ্রমীক পাবে ।
চার
পৃথা দৃঢ় মনস্ক , সে এই বাড়িটা কিনবে। সেখানে সে একটি বৃদ্ধাশ্রম করবে। অনাথ শিশুদের জন্য ও কিছু করার ইচ্ছে আছে। বাড়ির ড্রয়িং নিয়ে আর্কিটেক্ট এর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। যথেষ্ট জায়গা আছে। ঠিক মতো প্ল্যান করলে সবকিছু করা যাবে। ফুলের বাগান , ভেজিটেবল গার্ডেন , ছেলে মেয়েদের খেলার জায়গা , যোগা অভ্যাসের জায়গা , সঙ্গে ছোট পোল্ট্রি আর গরু রাখার জায়গা। এর থেকে ডিম্ , দুধ ও সবজির যোগান সেখান থেকেই কিছুটা মিটবে। বৃদ্ধদের অবকাশ যাপনের জন্য বিভিন্ন কাজ কর্ম যেমন ইনডোর গেমস, পটারি ওয়ার্কশপ , পেইন্টিং, গান বাজনা আর নানা হাতের কাজ করার জায়গা করা হবে।
বাড়িটা এখন একতলা আছে। তলাতে বাড়িয়ে নিলেই হবে। একেকটি ফ্লোরে বিভিন্ন বিভাগ থাকবে। বাচ্চাদের স্কুলের শিক্ষিকা কেউ পার্ট টাইম বা ফুল টাইম কাজ করবে। স্থানীয় শিক্ষিত যুবতীদের এই কাজে নিযুক্ত করা যাবে। কিছু বেসরকারি সংস্থার সাথে তার ভালো যোগাযোগ আছে। স্পন্সরস পেতে অসুবিধা হবে না। তাছাড়া বিদেশে তার বন্ধুদের কাছ থেকেও কিছ সাহায্য পাওয়া যাবে। এই বাড়ির নতুন নামকরণ হবে "নির্মলা'। এখানে সবাই জীবনের নতুন আশা আর আনন্দ খুঁজে পাবে।
পৃথা তার কাজ শুরু করে দেয়। প্রথমত: বর্তমান বাড়ির মালিক প্রফেসর গুপ্তের সঙ্গে দেখা করে। তিনি বালিগঞ্জ এর কাছে একটি ফ্ল্যাটে থাকেন। পৃথা কার রেন্টাল কোম্পানি থেকে গাড়ি ভাড়া করেছে। সে নিজেই ড্রাইভ করছে। বাড়িটা বিক্রির জন্য প্রফেসর গুপ্ত এমনিতেই খরিদ্দার খুঁজছিলেন। সেক্ষেত্রে সামনে থেকে কেউ এগিয়ে এসে বাড়ি কিনতে চাইলে না করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। বাড়িটার এমন বদনাম শুনেও যে পৃথা বাড়িটা কিনতে চায় তাতে ভদ্রলোক অবাক হন। দামের ক্ষেত্রে একটু দরাদরি করে শেষে রাজি হয়ে যায়। পৃথা বলে যে সে তিন চার দিনের মধ্যেই বাড়িটি রেজিস্ট্রি করতে চায়। তিনি যেন সব বন্দোবস্ত করে রাখেন। পৃথা তার ব্যাংকের চেক বই থেকে একটা চেক কেটে দেন তাকে ।
অরূপ বিশ্বাস করিৎকর্মা লোক , সে তার কাজে লেগে পড়েছে। ম্যাডাম কে খবর জোগাড় করে দিলে ভালো রোজগার হতে পারে। সে শুনেছিলো তখনকার পার্টির সক্রিয় সদস্যের মধ্যে কনক বসু ছিল একজন। তার সঙ্গে কাজের সূত্রে ভালোই পরিচয় আছে। সে সোজা হাজির হয় তার বাড়িতে । একথা সেকথার পর মোহনবাবুর প্রসঙ্গে এসে পৌছায়। কনক বসু ছিল মোহনবাবুর খুব কাছের লোক। ঘটনাটা জানতে পাড়া যায় এইভাবে
যে খেলার মাঠে পৃথা ও তার বন্ধুরা খেলা ধুলা করতো , সেই মাঠ নিয়ে হয়েছিল এই ঘটনা। পার্টির কিছু সদস্যের সঙ্গে মোহন বাবুর মনোমালিন্য হচ্ছিলো কারণ মোহনবাবু চেয়েছিলেন খেলার মাঠের খানিকটা চিলড্রেন্স পার্ক তৈরি হবে। কিন্তু তাতে কিছু সদস্যের মত থাকলেও বাকিদের মোটেও মত ছিল না। তারা চেয়েছিলো মাঠের জমিটাতে ফ্ল্যাট তৈরি করা হোক না হয় কাউকে প্লট হিসাবে বিক্রি করা হোক তাতে পার্টির ফান্ডে পয়সা আসবে। শিশুদের পার্ক হলে তাদের পেট ভরবে না। সে সময় অধিকাংশ বেকার যুবক পার্টির ভাওতায় নিজের আঁখের গোছাতে ব্যস্ত ছিল। তাদের তো এসব ভালো লাগেনি। মোহনবাবু বয়স্কস্থানীয় ব্যাক্তি ছিলেন। সামনে তাকে সেভাবে কিছুই বলতে পারেনি , কিন্তু তারা অন্য রাস্তা ধরেছিলো কিভাবে তাকে চাপে ফেলা যায়।
সুযোগ মিলেছিল। সেদিন বকুল রাতের বেলা বিয়েবাড়ি থেকে বাড়ি ফিরছিলো। নির্জন গলির মধ্যে দিয়ে সে শর্টকাট রাস্তা ধরেছিলো। পাড়ার উঠতি বখাটে ছেলেরা যারা কিনা বকুলের সঙ্গেই ছোট থেকে বড় হয়ে উঠেছে , মদ্যপ অবস্থায় বকুলকে আক্রমণ করে তার শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে। তার সঙ্গে তাকে ভীষণ ভাবে ভয় পাইয়ে দেয় , যেন মোহনবাবু মাঠের ঝামেলা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। নাহলে পুরো পরিবার কে শেষ করে দেবে তারা। আরও ভয় দেখায় যে এই ব্যাপারে সে যেন কারোর সামনে মুখ খোলে না খোলে। বকুল প্রথমে খুব অবাক হয়েছিল। কারণ ছোটবেলা থেকে যারা একই পাড়ায় বন্ধুর মতো খেলা ধুলা করে বড় হয়েছে , তারাই আজ তার সর্বনাশ করতে চায়। সে অসহায় বোধ করে , মানসিক ভাবে ভেঙে পরে , কিন্তু কোনো রকমে সেখান থেকে সে পালিয়ে আসে। আজকের দিনের মতন মেয়েরা এতটা আধুনিক মনস্কা ছিল না। তার যে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করা হয়েছে তা সে মানসিক ভাবে মেনে নিতে পারেনি। এবং সেটা ঢাক ঢোল পিটিয়ে সবাই কে জানাতে পারেনি লজ্জায় নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল ফুলের মতন নিষ্পাপ মেয়েটি।
হঠাৎ করে এই আকস্মিক ঘটনা তার মনের উপর গভীর চাপ সৃষ্টি করেছিল , মানসিকভাবে ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। এরপর সে আত্মহত্যা করে। এই ঘটনার রেশ যে এতটা মারাত্মক হবে তা এই ছেলে ছোকরারা বুঝে উঠতে পারেনি। তারা সঙ্গে সঙ্গে পাড়া ছেড়ে গা ঢাকা দিয়েছিলো। পরে সব মিটলে তারা ফিরে আসে ভিজে বেড়ালের মতো।
কিন্তু মদ মানুষ কে বন্ধু আর শত্রূ দুই দেয়। মদের নেশায় এই ঘটনার সত্যতা অনেকের সামনে এসে গেল। কিন্তু বকুল তো কারোর নাম বলে যায়নি। তাই আইনের শাস্তি থেকে তারা বাঁচলেও ভগবানের মার্ থেকে তারা রক্ষা পায়নি। অরূপ বিশ্বাসের কাছ থেকে জানতে পারে দলের যে আসল পান্ডা , মোহনবাবুদের বাড়ির পাশেই থাকতো। এখন সে রীতিমতো রোগগ্রস্থ , পঙ্গু ও অথর্ব। কোনোরকমে জীবন কাটছে। সে তার পাপের সাজা পেয়েছে। অন্য সাঙ্গপাঙ্গ দের অবস্থাও শোচনীয়। অর্থই অনর্থের মূল। তৎকালীন বেকার যুবকরা পথভ্রষ্ট হয়েছে এইভাবেই। পার্টির ছাতার তলায় নানারকম কুকর্ম তো হামেশাই হচ্ছে। পৃথার মতে কোনো রাজনৈতিক পার্টির মতাদর্শ হয়তো খারাপ হয়না। কিন্তু সেই দলের নাম খারাপ হয় সেই দলের কর্মীদের জন্য যারা নিজেদের আঁখের গোছাতে পার্টিতে যোগ দেয়।
যাইহোক পলিটিকাল আলোচনা আমাদের বিষয় বস্তু নয়। ফিরে আসি " নির্মলা " তে , মোহন বাবুদের বাড়ির নতুন নামকরণ । বাড়ির আগাছা পরিষ্কার করা হয়েছে। আজ নির্মলা তে রাধা কৃষ্ণর ছোট্ট মন্দির প্রতিষ্ঠা হতে চলেছে তুলসী তলার কাছে । বাড়ির বাকি কাজ শীগ্র শুরু হতে চলেছে। কলকাতার কিছু এন জি ও এই কাজে এগিয়ে এসেছে। বৃদ্ধাশ্রমের জন্য কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। যে সমস্ত বৃদ্ধ বৃদ্ধারা একটু সুখের মুখ দেখতে আর জীবনের অপূর্ণ সাধ পূরণ করতে চান তারা এখানে তাদের জীবনটা আবার নতুন ভাবে ফিরে পেতে পারেন। অনাথ বাচ্ছাদের দেখভাল আর পড়াশুনা শেখানোর জন্য স্থানীয় মহিলাদের এই কর্মকান্ডের একজন কর্মী হয়ে এই আশ্রম কে সফল হবার সুযোগ করে দিচ্ছে।
পৃথা অনুভব করলো তার গায়ে ঠান্ডা বাতাস ছুঁয়ে গেল , আর যেন কানে কানে বলে গেল , আজ আমি মুক্ত । পৃথার মনটাও আনন্দে ভরপুর। সে যে আজ জীবনের আসল লক্ষ্য খুঁজে পেয়েছে।