Srabani Mukhopadhyay

Drama Crime Thriller

4.7  

Srabani Mukhopadhyay

Drama Crime Thriller

বিষাক্ত অর্কিড

বিষাক্ত অর্কিড

37 mins
656


এক 


বিজনবাড়ি ও দার্জিলিং এর মাঝখানে একটি ছোট জনপদ , রঙ্গীত নদীর তীরে এই জায়গাটি নৈসর্গিক সৌন্দর্যের পসরা নিয়ে বর্তমান। এখানকার অধিবাসীদের প্রধান জীবিকা নির্ভর করে নানা ফলের বাগান ও পাহাড়ের ঢালের সবজির চাষের উপর । কাছেই রয়েছে ঋষি হাট , মারিবং চা বাগান। সিঙলিলা রেঞ্জ এর ট্রেককিং রুট এখানেই শেষ হয়েছে। কুয়াশা ঘন ছায়া মাখা বনের পথ হাতছানি দেয়। বনের পথে নানা ফুলের সমারোহ , দেখা যায় বহুমূল্য অর্কিড যা কিনা হেলায় ছড়িয়ে আছে এই বনানীতে। স্থানীয় লোকেরা নেপালি ভাষায় কথা বলে। রেশমা এই গ্রামের মেয়ে। আজকাল দার্জিলিং এর অনতিদূরে এই রকম ছোট্ট গ্রাম গুলো টুরিস্ট দের কাছে আকর্ষণের কারণ হয়ে উঠেছে । দার্জিলিং শহরের ভিড় এড়াতে একটু নিশ্চিন্তে নিশ্চুপ এই ছোট্ট গ্রাম গুলোতে হারিয়ে যেতে অনেকেই পছন্দ করে। আর তাই কেউ কেউ এখানে এসে গ্রামের বাড়িগুলো তে কয়েকদিনের অতিথি হিসাবে থেকে যায়। তাতে এই গ্রামগুলোর অর্থনীতি ও কিছুটা সবল হয়েছে। শুধু মাত্র পাহাড়ি ক্ষেতে চাষ বাস বা পশুপালন করে নয় , নিজেদের ছোট্ট বাড়িগুলো অতিথিদের আপ্যায়ন করার উপযোগী করে অতিরিক্ত আয়ের পথ বেছে নিয়েছে। রেশমা দের বাড়িটিও সেই একই পন্থা অবলম্বন করেছে ।

রেশমা কাছাকাছি প্রাইমারি স্কুলে পড়াশুনা করেছে। কিন্তু পড়াশুনায় তার মন নেই। সে ভালোবাসে পরিপাটি ভাবে সাজতে গুজতে। দেখতে ও সে সুন্দরী , তার একটু দেমাক ও আছে কারণ গ্রামের সমবয়সী মেয়েদের থেকে সে দেখতে সবচেয়ে ভালো। তা সে গ্রামের পুরুষ মানুষদের চাহনি দেখে বুঝতে পারে ভালোভাবেই। রেশমাদের পরিবার খুবই পরিশ্রমী , বাড়িতে রেশমার মা , দাদা , বৌদি ও তাদের ছোট্ট দশ বছরের মেয়ে। সারাদিন তারা ঘরের নানা কাজে ব্যস্ত থাকে। রেশমার দাদা নারাং এর একটা পুরানো জীপ্ গাড়ি আছে। তা সে রোজ ভাড়া খাটায় দার্জিলিং ও শিলিগুড়ি থেকে যাত্রী নিয়ে আসা যাওয়া করার জন্য। রেশমা হোম স্টে এর টুরিস্ট দের সুবিধার খেয়াল রাখে। অতিথিদের জন্য খাবার বানানো ও পরিবেশনে তার মা ও বৌদি কে সাহায্য করে। রেশমার বয়স এখন ১৮ বছর , উচ্ছল যৌবন ভরা। এবার পাত্র দেখে লগন করতে হবে। 

অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ , আজ কয়েকদিন হলো বছর পঁচিশের এক তরুণ শহরের একঘেয়ে জীবন থেকে হাপ্ ছেড়ে বাঁচতে পাহাড়ের কোলে এই নিরালী তে এসে উঠেছে। যে সময়টার কথা এখানে বলা হচ্ছে তখন মোবাইল নেটওয়ার্ক এর এতটা উন্নতি হয়নি। বেশ কিছু দিন এখানে থাকবে বলে ঠিক আছে । বাকি টুরিস্ট স্পট গুলো আস্তে আস্তে ঘুরে দেখে নেওয়া যাবে। তার ঘরটা বাড়ির দক্ষিণে। জানলার পর্দা সরালে দেখতে পাওয়া যায় মেঘের আনাগোনা। সময় কেটে যাচ্ছে অলসভাবে পাহাড়ের কোলে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখে আর বনের আঁকাবাঁকা পথে। 

রেশমার বেশ মনে ধরেছে এই তরুণটিকে। তার মনে হয়, ভগবান যেন এই রাজপুত্রটিকে শুধু তারই জন্য এখানে পাঠিয়েছে , যে কিনা তাকে তার ঘোড়ায় চড়িয়ে সুদূরে পাড়ি দেবে। তরুণটির সরল চাহনি আঠারো বছরের রেশমার হৃদয়ে মাদলের ধুন তোলে। হয়তো বয়সটার বৈশিষ্ট এইটাই। মন মানতে চায়না কোনো কিছুর বন্ধন। কোনটা ঠিক বা বেঠিক তা বিবেচনা করাও যায় না। পুরুষদের চাহনি কে বুঝতে রেশমার কষ্ট হয়না। গ্রামের অনেকেই তার সঙ্গ কামনা করে। এমনকি আধবুড়ো গ্রামের মোড়ল ওঁৎপেতে চেয়ে থাকে তার চলার পথের দিকে। বাগে পেলে একেবারেই গিলে খাবে। অবশ্য তার দাদা নারাং কে গ্রামে সবাই ডরায় । 

তা এই রেশমা সেই তরুণটির প্রেমে মজে গেলো। শহরের মেকি কেঠো সৌন্দর্যের যুবতীদের দেখে দেখে গা সওয়া তরুণটি , প্রকৃতির কোলে এই সদ্য ফোঁটা ফুলের মতো রেশমা কে দেখে , তার সান্নিধ্যে এসে নিজেকে বেশিদিন দূরে রাখতে পারেনি । ছোট্ট ছোট্ট কথা দিয়ে আলাপ শুরু আর অল্পদিনের মধ্যে তারা দুইজনেই ভালোবাসার সীমা লঙ্ঘন করেছিল। দুইজনেই পরস্পরে প্রতি অঙ্গীকার করে সাথে সাথে ভবিষৎ জীবনের পরিকল্পনাও। ধীরে ধীরে ছুটি শেষ হয়ে এসেছিলো। এবার বাড়ি ফেরার পালা । রেশমার কাছে তরুণটি যেন ভগবানের জীবন্ত অবতার , সরল বিশ্বাসে সে নিজেকে সপেঁ দিয়েছে তার কাছে। একবারও তার মনে হয়নি যে এই পরদেশী যদি কখনো আর ফিরে না আসে। যদি তাকে ভুলে যায় ?


দুই

ব্যাঙ্গালোরের একটি থ্রী ষ্টার হোটেল রয়্যাল রেসিডেন্সি এর রুফ টপ সুইমিং পুলের ধারে রিও নামক একটি প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির কোয়ার্টারলি সেলস অ্যাচিভমেন্ট এর উপলক্ষে ককটেল পার্টি চলছে। সবাই খুব আমোদ করছে। জমজমাট পরিবেশ । খাণিকক্ষন হলো মনিকার একটা অস্বস্থি হচ্ছে। মনের নয় দেহের ভিতরের। তাড়াতাড়ি পার্টি শেষ করে বাড়ি পৌছালে খুব ভালো হয়। ওয়েটাররা নানারকম ড্রিঙ্কস আর ভেজ ও নন ভেজ স্টার্টার অতিথিদের কাছে পালায় পালায় নিয়ে আসছে। মনিকা তারই মধ্যে এক জন ওয়েটার কাছ থেকে একটা পানীয়ের পাত্র আর চিকেনের স্টার্টার নিয়েছিল। বুফে ডিনার সার্ভ করা হবে আর কিছু সময় বাদে। কিন্তু মনিকার শরীরে অস্বস্থি বেড়েই চলেছে । মনে হচ্ছে যে ডিনার খাওয়া হবে না। বাড়িতে একবার ফোন করলো। আজ সারাদিনে কাজের ঝামেলায় বাড়িতে ফোন করা হয়নি। ফোন ধরেছে রিঙ্কি, মনিকা ও কৃশানুর ছয় বছরের মেয়ে। রাত সাড়ে নয়টা বাজে। রিঙ্কি বললো বাবা ফিরেছে একটু আগে। বিমলা আন্টি এখুনি বাড়ি চলে গেছে। মনিকা বলে, বাবাকে বলো ডিনার খেয়ে নিতে। আমার খাবার খাওয়ার ইচ্ছা নেই। বলে ফোন টা রেখে দেয়। বিমলা মনিকার বাড়িতে সবসময়ের কাজের লোক। কাজের লোক বলা ভুল হবে। রিঙ্কির জন্মের পর থেকে বিমলার কাছে মানুষ। মনিকা যে ছোট্ট মেয়েকে ছেড়ে নিশ্চিন্তে তার অফিস তে কাজ কর্ম করতে পারে তার কারণ এই বিমলা। তার উপর মনিকা খুবই নির্ভর করে। 

পার্টি তো এখনো ভালো করে শুরু হয়নি। কিন্তু তার মনে হচ্ছে সে বেশিক্ষন সেখানে থাকতে পারবে না। খাবারের কিছু অনিয়ম হলো নাকি ? কয়েকদিন যোগা অভ্যাস বন্ধ ছিল। কালকে ডাক্তারের সাথে এপয়েন্টমেন্ট করতে হবে। তার চেহারা মোটামুটি ভালোই , না রোগা না মোটা , সুন্দরী হিসাবেও নাম আছে। বিয়ের একবছরের মধ্যে মেয়ে হবার দরুন চেহারাটা খানিকটা মুটিয়ে গেছিলো , কিন্তু সেটা এখন অনেকটাই সামলে নিয়েছে।

মনিকা আর থাকতে পারছে না। অস্বস্থিটা বেড়েই চলেছে। কি যে হচ্ছে তা সঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। একটা জেলুসিল খেয়ে নিলো হ্যান্ডব্যাগ থেকে। তারপর সঞ্জয় , তার অফিসের বস কে বললো সে খুবই দুঃখিত যে আর থাকতে পারবে না। তার মুখের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। 

বাড়ি ফিরলো প্রায় দশটা চল্লিশের এর সময়। ড্রয়ইং রুমে আসতেই কৃশানু মনিকাকে দেখে বলে , আমি খেয়ে নিয়েছি। তুমি তো খাবে না বলেছিলে। তাহলে একটু ফ্রেশ হয়ে নাও , কিছু কথা বলার ছিল। মনিকা তার উত্তরে বলে প্লিজ , এখন কথা বলতে পারছিনা। কাল সকালে বলবো , আমার শরীর টা ভালো নেই, তাই তো তাড়াতাড়ি ফিরলাম না হলে হয়তো আরো বেশি রাত হতো। একথা বলে আর না দাঁড়িয়ে সে শোবার ঘরের দিকে এগোয়। কোনোরকমে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় যাবার আগে তার প্রিয় রেড ওয়াইনের বোতল থেকে গ্লাসে কিছুটা ঢেলে নিলো। 

পরেরদিন সকাল আটটা , তখন ও মনিকার ঘুম ভাঙেনি। কৃশানু অবাক হয় , মনিকা বরাবর খুব তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠে নিজে প্রথমে যোগা বা ফ্রীহ্যান্ড করবার পর বিমলার সঙ্গে জলখাবার , লাঞ্চ আর ডিনার এর সব কিছুর মেনু ঠিক করে দেওয়া থেকে রিঙ্কি কে স্কুলের জন্য তৈরি করে। তা এহেন মনিকার আজ এতক্ষন পর্যন্ত ঘুম খুবই বেমানান। কৃশানু আজকাল বেশির ভাগ সময়টা স্টাডি তে কাটায় , কিছুদিন ধরে তার মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে । নানা অজুহাতে মনিকার থেকে সে বেশ দূরে দূরে থাকে। 

মনিকার মোবাইল ফোন বাজছে। তাও মনিকার ঘুম ভাঙছে না। বিমলা একবার বলেও গেল , কি হলো ম্যাডাম ঘুম থেকে উঠেনি নাকি , জলখাবার কি বানাবো?। কি আর করা কৃশানু মনিকাকে প্রথমে ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে গিয়ে ঠেলে তুলতে যায়। অদ্ভুত ভঙ্গিতে সে শুয়ে আছে। কখনো এরকম ভাবে তাকে শুতে দেখেনি কৃশানু। সে চমকে উঠে , মনিকার সারা দেহ যেন বরফ ঠান্ডা। ছিটকে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে , তার মন এক অঘটনের কু গাইতে শুরু করেছে । দেরি না করে সে এম্বুলেন্স কল করে হসপিটালে নিয়ে যাবার জন্য। হাসপাতালে নিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার পরীক্ষা করে মনিকাকে মৃতা বলে ঘোষণা করে। প্রায় কয়েক ঘন্টা আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। বডিতে অলরেডি রিগর মর্টিস সেট ইন করেছে। মৃত্যুর সঠিক কারণ পোস্টমর্টেম রিপোর্ট থেকে জানা যাবে । মৃত্যু রহস্যজনক বলে পুলিশ স্টেশন এ জানানো হয়েছে। সকালবেলা সদাশিবনগরের লোকাল থানায় হাসপাতাল থেকে ফোন এসেছে। এক মহিলার অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। থানার ইনচার্জ ইন্সপেক্টর শ্রীহরি সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেল হসপিটালের উদ্দেশ্যে। 


তিন

আজ অশ্বিনী সকালবেলা হসপিটালে এসেছিলো ডাক্তার জগন্নাথের সঙ্গে দেখা করতে একটা কেসের পোস্টমর্টেম সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করার জন্য। আগে যারা অশ্বীনির ইনভেস্টিগেশন সম্বন্ধে জানেন , তাদের জন্য অশ্বিনী কোনো নতুন চরিত্র নয়। ইন্সপেক্টর থেকে সিনিয়র ইন্সপেক্ট আর তারপর স্পেশাল টাস্ক ফোর্স এর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন অফিসার এর সফলতার পথ এতো অল্প সময়ে অতিক্রম করা সত্যি অভাবনীয়। তার ক্ষুরধার বুদ্ধি ও সঙ্গে অনুভবী মননশীলতার জন্য অনেক জটিল রহস্যের সফল সমাধান করতে পেরেছে। আজ সে কোনো থানার অধীনে নয় , যে কোনো বিশেষ কেসের তদন্ত করতে তার কোনো বাধা নেই। সবসময় পুলিশের ইউনিফর্ম তাকে পড়তে হয়না এখন। আজ তার পরনে সাদা ঢোলা শার্ট আর জিন্স প্যান্ট। ছিপছিপে চেহারার নিয়মিত শরীর চর্চা করা , উচ্চতা প্রায় ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি , দেখে তাকে পুলিশের এতো বড় অফিসার বলে মনেই হবে না। 

ডক্টর জগন্নাথ এর কাছে সকালবেলা একটা নতুন কেস এসেছে। এক মহিলার অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে , কারন জানার জন্য পোস্টমর্টেম রিপোর্টের অপেক্ষা করছে। মহিলার বয়স তিরিশ থেকে বত্রিশের মধ্যে। তেমন কোনো জটিল মেডিকেল হিস্ট্রি নেই। এইরকম অকস্মাৎ মৃত্যুতে তার স্বামী হতবাক। মনে হচ্ছে যেন হঠাৎ করে হৃদপিণ্ডের কাজ করা বন্ধ হয়ে গেছে। 

অশ্বিনী ডক্টরের চেম্বারে ঢুকতে যাবে, এই সময় করিডোরে একজন লম্বা , ফর্সা , ও চোখে পড়ার মতো এক ব্যক্তির মুখোমুখি হলো। একবার দেখলে তাকে ভুলে যাওয়া মুশকিল। তার মুখের একটি আলাদা বৈশিষ্ট আছে যা সবার নজর কাড়ে। সে তখন কারুর সাথে ফোনে খুব আস্তে কথা বলছিলো। ইংরেজিতে টুকরো টুকরো কথাগুলো অশ্বিনীর কানে এসেছিলো। কি বলছো ? আমি তো কিছু করিনি , আমি কেন করবো ? আমি রাতেই বলতে চেয়েছিলাম তার সুযোগ পেলাম কোথায়, , বিলিভ মি আমি ইনোসেন্ট । 

অশ্বিনী ডাক্তারের চেম্বারে ঢোকে। সেখানে ইন্সপেক্টর শ্রীহরি কে দেখে সহাস্যে সম্ভাষণ জানায়। শ্রীহরি ডাক্তার জগন্নাথের সঙ্গে মনিকার কেস তা নিয়ে আলোচনা করছিলো। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত মৃত্যুর সঠিক কারণ বলা যাবে না। তবে মনে হচ্ছে বিষক্রিয়ার ফলে এই মৃত্যু। এই মুহূর্তে বডিতো ছাড়া যাবে না।  শ্রীহরি বলে উঠে মৃতার স্বামী বাইরে অপেক্ষা করছেন। ডাক্তার বলেন ঠিক আছে তাকে ডেকে পাঠাচ্ছি। এর খানিক্ষন পর মনিকার স্বামী কৃশানু ঘরে ঢুকলো। অশ্বিনী তাকিয়ে দেখলো তাকে। এরপর কৃশানু যখন কথা বলে বাইরে বেরিয়ে যায় তখন অশ্বিনী শ্রীহরি কে বলে , এই ভদ্রলোকটির উপর নজর রাখুন। কিছু গন্ডগোল আছে বলে মনে হচ্ছে। 

ওই ঘটনার তিনদিন পর। গোয়েন্দা বিভাগের হেড মিস্টার কে কে মেনন অশ্বিনী কে ডেকে পাঠিয়েছে। অশ্বিনী ঘরে ঢুকতেই তিনি বলে উঠেন যে একটা স্পেশাল কেসের ইনকোয়ারির জন্য রিকোয়েস্ট এসেছে উপর মহল থেকে। কেসটা সদাশিবনগর থানার অন্তর্ভুক্ত। এক মহিলার অদ্ভুতভাবে মৃত্যু হয়েছে। পোস্টমর্টেম করে জানা গেছে যে স্ট্রিকনিন নামক একটি বিষাক্ত পদার্থের বেশিমাত্রায় সেবনের কারণে এই মৃত্যু। মনিকা নামক এই মহিলা রিও নামক একটি প্রতিষ্ঠানে এক্সিকিউটিভ পদে চাকরি করতেন এবং স্বামী ও ছয় বছরের কন্যা নিয়ে তার ছিল ছোট সংসার। পুলিশ এই কেসে মনিকার স্বামী কৃশানু কে গ্রেপ্তার করেছিল। কিন্তু কৃশানুর এক মাসতুতো দাদা ভারত সরকারের এক উচ্চপদস্থ কর্মচারী এবং তাঁরই সহায়তায় সে জামিনে মুক্তি পেয়ে বাড়িতে রয়েছে । কৃশানু কিছুতেই এই মৃত্যুর দায়িত্ব নিতে চায় না। কিন্তু কেন এরকম মৃত্যু , তার কারণ অনুসন্ধানের জন্য সে তার দাদার মাধ্যমে পুলিশের উপরতলায় সুপারিশ করে এই বিষয়ে আলাদা করে তদন্ত করতে অনুরোধ করেছে।

কেস ফাইলটা হাতে নিয়ে অশ্বিনী চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলো। তখনই তার চোখে পড়লো কৃশানুর ছবি। সে বুঝতে পারলো এটা সেই কেস। তারপর মিস্টার মেনন কে বললো ঠিক আছে আমি একবার স্টাডি করে নি। যদি কোনো দরকার হয় আপনার সাথে কনসাল্ট করবো। 

অশ্বিনী তার জায়গায় ফিরে আসে আর কেসের রিপোর্ট দেখা শুরু করে। সদাশিবনগর থানার ওসি শ্রীহরি ইনভেস্টিগেশন রিপোর্টতে লিখেছে যে মৃত্যুর আগের দিন মনিকা তার অফিস এর পার্টির থেকে বাড়ি ফেরে প্রায় দশটা চল্লিশ , তার নাকি খানিকটা শরীর খারাপ লাগছিলো। বাড়ি ফেরার পর সে তাড়াতাড়ি শুতে চলে যায় এবং পরের দিন সকালে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। মৃত্যুর কারণ হলো স্ট্রিকনিন বিষের প্রভাব যা কিনা রেড ওয়াইন এর মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করেছে। জানা গেছে যে রেড ওয়াইন মনিকার খুবই প্রিয় ছিল , রোজ রাত্রে সে শুতে যাবার আগে খানিকটা রেড ওয়াইন খেত। অবশ্য এই অভ্যাস টা প্রায় গত ছয় মাস ধরে শুরু হয়েছে। কৃশানুর বিরুদ্ধে জোরালো মোটিভ হলো , সে প্রায় বেশ কয়েক মাস হলো একজন মহিলার সঙ্গে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িত এবং সম্পর্কটি বেশ সিরিয়াস। মনিকা এসম্বন্ধে না জানলেও কৃশানু তাকে ডিভোর্স দেবার কথা ভাবছিলো এই কথা কৃশানু জেরার মুখে স্বীকার করেছে। সে মনিকাকে সব কথা বলার চেষ্টা করেছিল মৃত্যুর আগের রাত্রে , কিন্তু মনিকা বলেছিলো সে সকালবেলা এ ব্যাপারে কথা বলবে। রেড ওয়াইনের বোতলটি শোবার ঘর থেকে পাওয়া গেছে যাতে বিষ ছিল। মনিকা রোজ রাতের বেলা রেড ওয়াইন পান করে শুতে যেত , বাড়িতে আর কেউ বাইরে থেকে সেদিন আসেনি। সুতরাং কৃশানু ছাড়া আর কেউ নেই যে বিষ দিতে পারে। উল্লেখযোগ্য যে বোতলের গায়ে মনিকা ছাড়া আর কারুর হাতের ছাপ নেই। তাতে অবশ্য অবাক হবার কিছু নেই। কারন হত্যাকারী বিষ মিশিয়ে তার হাতের চাপ মুছে দিয়েছে। 

অশ্বিনী কিছুক্ষন পর শ্রীহরি কে মোবাইল থেকে ফোন করে , অপর প্রান্ত থেকে শোনা গেলো , হাল্লো ম্যাডাম কেমন আছেন ? অশ্বিনী সরাসরি আসল বিষয়ে এসে গেল। বললো , আপনার হেল্প লাগবে। এই কেসের ইনভেস্টিগেশন আপনি করেছেন । মনিকা ও কৃশানুর কেসের সম্পর্কে বলে , শ্রীহরি বলে হ্যা ম্যাডাম , আপনিই তো পথ দেখিয়েছিলেন , মনে আছে হাসপাতালতে। কৃশানু কে ফলো করে দেখা গেল সে ছাড়া আর কারুর মোটিভ ছিল না। কিন্তু সে তো কিছুতেই অপরাধ স্বীকার করছে না। অশ্বিনী বলে ঠিক আছে এখন এই কেস টা আমি দেখছি , কিন্তু আপনাকে হেল্প করতে হবে। অশ্বিনী আবার বলে, মনিকার বাড়ি থেকে কি কি জিনিস পাওয়া গেছে ? তার লিস্ট আছে ? আর এভিডেন্স হিসাবে কি কি রাখা আছে ? শ্রীহরি , আপনি লিস্ট আর এভিডেন্স গুলো ঠিক করে রাখুন , আমি এখুনি আসছি , আর তাছাড়া একবার মনিকাদের বাড়িতেও যেতে হবে। বাড়িতে কি কেউ থাকবে এই সময় ? শ্রীহরি বলে আমি কৃশাণুকে ফোন করে দিচ্ছি। পুলিশ কেসে জেল হবার কারণে চাকরি তে তার প্রভাব পড়েছে। তাৎক্ষণিক সাসপেনশন হয়েছে। তাই বোধ করি বাড়িতেই থাকার কথা এসময়। কৃশানু বেশ ভালো পোস্ট তেই ছিল। মাইনে পত্তরও ভালো , গাড়ি বাড়ি কোনো কিছুর অভাব নেই। তাছাড়া বড়োলোক ঘরের ছেলে। চাকরি গেলেও কিছু এসে যায় না । 


চার

অশ্বিনী তার মাহিন্দ্রা বোলেরো গাড়িতে উঠে বসলো, গন্তব্ব্য সদাশিবনগর থানা। থানায় পৌছে রেড ওয়াইনের বোতল থেকে গ্লাস সবকিছু ভালোকরে পরীক্ষা করে দেখলো। ওয়াইনের বোতলের এক তৃতীয়াংশের ও কম খালি হয়েছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে সদ্য ব্যবহার করা হয়েছে। শ্রীহরি বলে ম্যাডাম আমরা বোতলের গায়ের লেবেল এর বার কোড থেকে কোন দোকান থেকে কেনা হয়েছে তা বের করে নিয়েছি , ঘটনার ঠিক একদিন আগে এই বোতলটি খরিদ করা হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। কিন্তু কথা হচ্ছে যে দোকানদার ঠিক করে বলতে পারছে না যে এই বোতলটা কে কিনেছে। পার্টিকুলারলি এই ওয়াইনটা মনিকাই নিজে কিনে নিয়ে আসতো। বাকি হার্ড ড্রিঙ্কস অনলাইন অর্ডার করা হতো। অশ্বিনী বলে , ঘটনাটি মনে হচ্ছে না এতটা সোজা। আমাদের কোথাও ভুল হচ্ছে। কৃশানু যদি মনিকা কে হত্যা করবে তাহলে তার বিরুদ্ধে সব প্রমান কেন সে সাজিয়ে রেখে দেবে। প্রমান লোপাটের তো যথেষ্ট সময় ও সুযোগ তার ছিল। কেউ বুঝতেই পারতো না যে কিভাবে মনিকার মৃত্যু হয়েছে। দ্বিতীয়ত : কৃশানু এক বারও তার বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কথা লুকায়নি। প্রথম থেকেই সে নিজেকে জোরের সঙ্গে নির্দোষ বলেছে। চলুন একবার মনিকাদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসা যাক। 

কৃশানু আজকাল বাড়িতেই থাকে। রিঙ্কি কে মামার বাড়ি পাঠানো হয়েছে। তার ক্যারিয়ার নিয়ে টানাটানি অবস্থা। জেলে যাওয়া আসামিদের কোম্পানিতে জায়গা হয়না তার উপর আবার পরকীয়ার স্ক্যান্ডাল। তবে সান্তনার বিষয় দীপা এই কঠিন মুহূর্তেও তার সঙ্গে আছে। জীবনে হয়তো এই প্রথম বার কৃশানু তার সোল্ মেট কে খুঁজে পেয়েছে। মনিকার সঙ্গে তার অর্র্যানজেড ম্যারেজ হয়েছিল। ছোটবেলাতেই কৃশানু তার বাবা আর মা কে হারিয়েছিল। পয়সার অভাব কোনোদিন ছিল না। হোস্টেল থেকে পড়াশুনা ও পরে চাকরি। দেখতে সুদর্শণ এবং আকর্ষণীয় চরিত্রের দরুন তার প্রচুর মহিলা অনুরাগী ছিল। কৃশানু ও বেশ উপভোগ করতো মেয়েদের এই বেহায়াপনা এবং সুযোগের সদ্ব্যাবহার করতেও সে ছাড়েনি। কিন্তু সত্যিই কারের ভালোবাসা সে কোনোদিন বাসেনি। যৌবনের উন্মত্ততায় অনেক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পরে কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি কোনোটাই । সব মেয়েদের মধ্যে সে তার ড্রিমগার্ল কে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করতো কিন্তু প্রতিবারই সে হতাশ হতো , রূপ যৌবন থাকলেও মেয়েগুলোর মধ্যে কিসের যেন অভাব। 

মনিকার সাথে তার বিয়ের সাত বছরের দাম্পত্য জীবন কেটে গেছে এক লহমায়। বিয়ের পর তার ক্যাসানোভা চরিত্র কে অনেক সংযত করার চেষ্টা করেছে। মনিকাকে বউ হিসাবে পারফেক্ট বলা যায়। অফিসের কাজ সামলেও সে নিজের , কৃশানু আর তাদের ছয় বছরের মেয়ে রিঙ্কির ভালোই খেয়াল রেখেছে। জীবন কেটে যাচ্ছিলো নিস্তরঙ্গ ভাবেই কিন্তু কৃশানু আবার ভেসে গেল অন্য এক খেয়ালে । 

কৃশানু এই সবই ভাবছিলো। হঠাৎ তার চিন্তার রেশ কাটলো। অশ্বিনী এসেছে দেখা করতে। অশ্বিনী কৃশাণুকে সেদিনকার ঘটনার আরেকবার বিবরণ দিতে বলে যদিও সে আগে পুলিশকে সব কথা বলেছে। তাহলেও অশ্বিনী সরাসরি কৃশানুর মুখ থেকে সবকথা আরেকবার শুনতে চায়। 

কৃশানু খানিক চুপ করে থাকে , তারপর বলতে শুরু করে , মৃত্যুর আগের দিন মনিকার অফিস এর সেলেব্রেশন ছিল রয়্যাল রেসিডেন্সি হোটেল এ। রাতের বেলা হোটেল থেকে বাড়িতে ফোন করে আমাকে ডিনার খেয়ে নিতে বলে। আমি চেয়েছিলাম সেদিনই সব কথা মনি কে জানাবো কিন্তু বাড়ি ফিরে সে বলে তার অসুস্থ বোধ হচ্ছে তাই সে শুতে চলে যাচ্ছে। অভ্যাস অনুযায়ী রাতে সবার আগে রেড ওয়াইনের বোতল থেকে খানিক টা নিয়ে নেয়। গত ছয় মাস হলো সে রেড ওয়াইন খাওয়া শুরু করেছে। ও বলতো রোজ অল্প মাত্রায় খেলে স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। মেয়েদের স্কিন ও ভালো রাখে। এরপর আর কোনো কথা হয়নি। আর সকালবেলা এই অবস্থা। অশ্বিনী জিজ্ঞাসা করে রেড ওয়াইনের বোতল কি মনিকা নিজে কিনে আনতো ? কৃশানু বলে হাঁ , সবসময় মনিকাই নিয়ে আসতো। বেশির ভাগ সময় বিউটি পার্লার থেকে ফেরার পথে মনিকার সঙ্গে রেড ওয়াইনের বোতল থাকতো। খুব খুশি থাকতো সেই সময়। আপনি বলছেন মনিকা পার্টি থেকে ফিরে আসে অসুস্থ অবস্থায় ? অশ্বিনী জিজ্ঞাসা করে। কৃশানু বললো , হাঁ পার্টির থেকে ফিরে তো তাই বলেছিলো আর বেড রুম এ চলে যায়। অশ্বিনী জিজ্ঞাসা করে , আর কেউ কি বাইরে থেকে এসেছিলো সেদিন । কৃশানু বলে না আমাদের কাজের লোক বিমলা বেশিরভাগ সময় সারাদিন বাড়িতে থাকে সকালবেলা আটটার সময় আসে আর মনিকা অফিস থেকে বাড়ি ফিরলে সে বাড়ি যায় প্রায় সন্ধ্যায় সাড়ে সাতটার সময়। সেদিন তো মনিকা একেবারে পার্টির জন্য রেডি হয়ে বেরিয়েছিল। ঠিক ছিল অফিস থেকে বেরিয়ে বিউটি পার্লর থেকে রেডি হয়ে পার্টি তে যাবে। বাইরের কোনো লোক তো আসেনি। অশ্বিনী বলেন , কৃশানু এবার আপনাকে কিছু পার্সোনাল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছি। কারণ এটাও পরোক্ষ ভাবে এই খুনের সঙ্গে যুক্ত। কৃশানু বলে হাঁ কি জানার আছে বলুন ? অশ্বিনী বলে আপনার এই বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কটা কতটা সিরিয়াস ? সাধারণত এই রকম সম্পর্কগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্ষণস্থায়ী ও টাইম পাস্ হয়ে থাকে। সত্যি কি ভবিষ্যৎ প্রসারী ? কৃশানু বলে দীপার ব্যাপারে আমি সিরিয়াস এবং বাকি জীবনটা তার সঙ্গেই কাটাবো। দীপা সবসময় আমাকে সাহস দিয়েছে ,তার মতো চাহিদাবিহীন মেয়ে আমি খুব কম দেখেছি। অশ্বিনী বলে , যদি বলি যে দীপা এই খুনের ব্যাপারে আপনার সহযোগী? কৃশানু বলে না , এটা একেবারে আবসার্ড। তাছাড়া আমি তো আগেই বলেছি যে সেই রাত্রিতে সব কথা মনিকে বলতে চেয়েছিলাম। অশ্বিনী বলে এর তো কোনো সাক্ষী নেই। তারপর আবার বললো মনিকার বন্ধু বান্ধব বা অফিসে কারুর সঙ্গে কোনো শত্রুতা ছিল কি ?কৃশানু বলে, না মনিকা খুব হিসাবি এবং হাসিখুশি চরিত্রের ছিল। সহজে কারুর সঙ্গে সামনাসামনি ঝামেলায় যাবে না। অফিসে তে সবার সঙ্গে সম্পর্ক ভালোই ছিল। 

প্রশ্ন আসছে তাহলে কি মনিকা আত্মহত্যা করেছে ? অশ্বিনীর বারে বারে এই কথা মনে হতে লাগলো। কিন্তু সে ব্যাপারে কোনো কথা না বলে মনিকার জিনিসপত্র গুলো আর শোবারঘরটি একবার দেখতে চাইলো। কৃশানু বলে , নিশ্চয় , এই তদন্তের জন্য আমি সবরকম ভাবে সহযোগিতা করবো। শ্রীহরির দিকে তাকিয়ে অশ্বিনী প্রশ্ন করে মনিকার ফোন রেকর্ডস এ কি কিছু এবনরমাল পাওয়া গেছে ? সে উত্তরে বলে না সেরকম কিছু লক্ষ্য করা যায়নি। অশ্বিনী মনিকার শাড়ি জামার কাপবোর্ড টা ভালো করে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। সবই রুচি সম্মত দামি শাড়ি ও আধুনিক পোশাকে ভর্তি। সঙ্গে কিছু হালকা জুয়েলারি ও আছে। বোঝাই যায় যে মহিলা সাজগোজ সম্বন্ধে ভালোই ওয়াকিবহাল ও পরিপাটি ছিলেন। হাতড়াতে হাতড়াতে একটা খাপের মধ্যে পুরানো বাক্সর সন্ধান পাওয়া গেলো। সরু ও ১০ ইঞ্চি লম্বা বলা যায় অনুমানে। ড্রেসিং টেবিলের উপর একটা হ্যাপি ফ্যামিলি ফটো আর প্রসাধনের সমস্ত উপকরণ রয়েছে। আয়নার গায়ে একটা রঙিন পোস্ট পেপার এ ছোট ছোট নোট লেখা , ৫ ,৩০ : পার্লার আবার ৭:৩০ হোটেল - এইভাবে। 

পুরানো বাক্সটা একটু নাড়াচাড়া করতেই একটি খাপ বেরিয়ে এলো যা কিনা উপর থেকে সহজে বোঝার উপায় নেই। কাগজের মতন পাতলা কিছু কে লুকিয়ে রাখতে বেশ ভালো জায়গা। আর হলোও তাই। এর নিচে পুরানো একটা কাগজ চিঠি জাতীয় কিছু বেরিয়ে এলো। অশ্বিনী বাংলা ভাষা পড়তে জানে না। কৃশানু কে লুকিয়ে সে টা শ্রীহরির কাছে চালান দিলো। ট্রান্সলেট করে দেখে নিতে হবে কিছু গুরুত্ব পূর্ণ আছে কিনা। কারণ যে এতো জায়গা থাকতে এই চিঠির মতো জিনিসটা সযত্নে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। 

মনিকাদের বাড়ি থেকে ফেরার পথে অশ্বিনী শ্রীহরি কে জিজ্ঞাসা করে , আপনার কি মনে হয় ? এটা আত্মহত্যার কেস নয়তো ? শ্রীহরি বলে , কিন্তু সলিড কোনো কারণ তো পাওয়া যাচ্ছে না। স্বামী স্ত্রী ও ছোট বাচ্চা এই নিয়ে সুখী সংসার। ঘরের ফটোগুলো তো তাই প্রমান দিচ্ছে। যদিও কৃশানুর মনে কি আছে তা মনিকা জানতো না। 

অশ্বিনী বলে মনিকার মতো এতো বুদ্ধিমান মেয়ে কি স্বামীর ব্যাবহারে কোনো অস্বাভাবিকতা দেখেনি ? মেয়েদের সিক্সথ সেন্স এই ব্যাপারে সবসময় কাজ করে।

আলোচনা করতে করতে দুইজনে থানায় এসে পৌছায়। শ্রীহরি কে আরো কিছু কাজের কথা বলে নিয়ে অশ্বিনী বেরিয়ে গেল। অশ্বিনী আজকাল একটি অনাথ আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত। তার রোজগারের একটা অংশ সে এই প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্ধ করে রেখেছে। তার সঙ্গে ছোট ছেলেমেয়েগুলো কে সেলফ ডিফেন্স এর উপর ট্রেনিং দেওয়া তার আরেকটি কাজ। অশ্বিনীর মনের খিদে টা বরাবরই অন্যরকম। 


পাঁচ

মনিকার বাপের বাড়ি কোরামঙ্গল অঞ্চলে। তারা বলা যায় প্রবাসী বাঙালি। সেই বাড়িতে বসেই কথা হচ্ছিলো। শোকের পরিবেশ এখনো কাটেনি। অশ্বিনী মনিকার বাবা আর মা এর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়। আপনারা কি মনে করেন কৃশানু এই খুনটা করেছে? মনিকার বাবা বলে উঠেন , তা ছাড়া আর কি বলতে পারি। যে কিনা বাইরে অন্য এক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। অনায়াসে মুক্তি পাবার এর থেকে শর্টকাট রাস্তা হতে দোষ কোথায় ?

রিঙ্কি হঠাৎ কোথাথেকে ছুট্টে বাইরে বেরিয়ে এলো। ছোট মুখটা সরলতার আর মিষ্টিত্বতায় ভরপুর। অশ্বিনীর খারাপ লাগছিলো বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে। মা মারা গেছে আর তার বাবাকে মায়ের মৃত্যুর জন্যও দায়ী করা হচ্ছে। যখন সে বড়ো হবে তখন এই ইতিহাস তার জীবনে কি বার্তা বয়ে আনবে তা কে জানে ? মনিকা তার বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে , তার ছোট এক ভাই ও আছে। বেঙ্গালুরু তেই তার পড়াশুনা ও বড়ো হয়ে উঠা। বর্তমানে মনিকার বয়স তিরিশের কোটায়। বিয়ে হয়েছিল প্রায় সাত বছর আগে। হাসব্যান্ড বড়ো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে , তা সত্ত্বেও মনিকা তার নিজস্ব ক্যারিয়ার কে ঠিক বজায় রেখেছিলো , ছোট মেয়েকে সামলে , সংসারের সব দিক ঠিক করে রেখে দিন চলে যাচ্ছিলো। স্বভাবে সে খুব হিসাবি ও মেপে চলা মেয়ে। মুখের উপরে সোজা কথা বলতো না। বেশ ডায়নামিক চরিত্রের ও পরিপাটি। অশ্বিনী আবার বলে উঠে কিছু মনে করবেন না একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতেই হচ্ছে। মনিকার কি বিয়ের আগে কোনো অ্যাফেয়ার ছিল ? মনিকার মা রিনা দেবী ঝংকার দিয়ে বলে উঠে , তাতে কি হয়েছে ? সে তো সবারই থাকে। আজকালকার মেয়ে , কলেজে কত বন্ধু বান্ধব হয়েছিল। কিন্তু আমাদের মেয়ে মনি খুব বুদ্ধিমান ছিল। বিয়ের ব্যাপারে সে অরাজি হয়নি। সে তার বিয়ে ও সংসার দুটোই ঠিক ভাবে বজায় রেখে চলেছে। আপনি হঠাৎ একথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন ? অশ্বিনী বলে , আমরা একটা চিঠি পেয়েছি , যা প্রায় অনেক বছর আগে লেখা , আমরা ল্যাঙ্গুয়েজে স্পেশালিস্ট দেখিয়ে তার বিষয়বস্তু জানতে পারি। অভিষেক বলে কোনো এক ব্যাক্তি মনিকাকে এই লেটার লিখেছিলো। সোজা কথায় এটা একটা লাভ লেটার। রীনা দেবী খানিক্ষন চুপ করে থাকেন তারপর আস্তে আস্তে বলেন , হ্যা মনি আর অভিষেক দুই জনের একটা সম্পর্ক ছিল। কিন্তু মনি বুঝতো যে সবাই কে জীবনসঙ্গী করা যায় না। তারা বন্ধু বা প্রেমিক হিসাবেই ভালো লাগে। যোগ্য স্বামী হতে গেলে যে বৈশিষ্টগুলো প্রয়োজন হয় সেটার অভাব ছিল। আমার মেয়ের সম্বন্ধে বলতে বাধা নেই , মনিকা হিসাবি মেয়ে ছিল যখন কৃশানুর সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ আসে তখন তার চাকরি ও পরিবারের প্রভাব প্রতিপত্তি দেখে মনিকা এক কথায় রাজি হয়ে যায়। আমরা আমাদের মেয়েকে স্বাধীন ভাবে মানুষ করেছিলাম। বিয়ের ব্যাপারে তার উপর কোনো জোর ছিল না।  

তাহলে প্রশ্ন আসে যে বিয়ের পর ও কি মনিকা অভিষেকের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছিলো ? মানুষের চরিত্র বড়োই জটিল। উপর থেকে সেই ব্যাক্তির মনের তল খুঁজে পাওয়া শক্ত। আরো প্রশ্ন আসে যে কি এমন হয়েছিল যে মনিকার মৃত্যু হলো বা তাকে মেরে ফেলা হলো ?

মনিকার অফিস মল্লেশ্বরাম এর একটি বহুতল বিল্ডিং এর ছয় তলায়। মনিকার বস সঞ্জয় তার চেম্বারেই ছিল। অশ্বিনী ও শ্রীহরি একসাথে ঘরের মধ্যে ঢুকে আসে। সঞ্জয় বলে ঘটনাটি খুবই দুঃখের। কিন্তু আমি আগেও বলেছি এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানিনা। মনিকাকে কখনো ও অসুখী দেখিনি। সে খুবই বুদ্ধিমতী ছিল। সব কিছু গুছিয়ে কাজ করাটা তার চরিত্রের বিশেষ দিক। পার্টির দিন অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে ছিল যাতে পার্লার এ গিয়ে রেডি হয়ে আবার ফিরে আসে হোটেল এর পার্টিতে। হোটেল এ এসে পৌছেছিল প্রায় আটটার সময়। 

কিন্তু সাড়ে নয়টা নাগাদ সে আমাকে বলে যে সে বাড়ি যেতে চায় কারণ তার খুব আন ইজি লাগছে। মনে হচ্ছে যে খাবারের কিছু অনিয়ম হয়েছে। এরপর একটু পরে মনিকা বাড়ি চলে যায়। তখন ডিনার সার্ভ করা হয়নি। তারপরতো পরেরদিন আমরা ওর হাসব্যান্ড কৃশানুর কাছ থেকে জানতে পারি। অশ্বিনী প্রশ্ন করে অফিস এর কারুর সঙ্গে কি কোনো প্রকার শত্রুতা বা রেষারেষি ছিল ? ধরুন যদি পার্টিতে কোনো ড্রিংকসের মধ্যে বিষটা মিশিয়ে দেওয়া হতে পারে। ? সঞ্জয় এক কথায় সে সম্ভাবনা নাকচ করে দিলো। সে বলে , আপনারা মনিকাকে দেখেননি , সে অত্যন্ত মেপে চলতো। ডাইরেক্ট ফাইট সে কোনোদিন করবে না। সুতরাং তার শত্রুর সংখ্যা হাতে গুনতে পারবেন না। মনিকা ছিল মিছরির ছুরি। আমি তার বস তাই আমি জানি আর এতো এমপ্লয়ীজ দের হ্যান্ডেল করে মানুষের চরিত্রের সম্বন্ধে অভিজ্ঞতাও কম নয়। 

অফিস থেকে বেরিয়ে অশ্বিনী বলে , আচ্ছা হোটেল এর সিসিটিভি ফুটেজে চেক করা হয়েছিল তো ? আমার মনে হয় আরেকবার চেক করুন। হয়তো কিছু চোখে পড়তে পারে ? শ্রীহরি আগেই ফুটেজ চেক করেছিল , কিন্তু ম্যাডাম যখন বলছেন তাহলে আরেকবার দেখে নিতে হবে । অশ্বিনীর এক্সসেপশনাল চিন্তা ভাবনা সম্বন্ধে শ্রীহরি আগেই শুনেছিলো। একটা কেস কে প্রথাগত ভাবে চিন্তা না করে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিবেচনা করাটা তার স্বভাব। এ, বি , সি যত ভাবে ঘটনাকে চিন্তা করা যায় এবং উপস্থিত প্রমানের ও কার্যকারণ বিবেচনা করে সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়া। একে বলে মাল্টিডিরেক্শনাল থিংকিং। 

আজও বিকালে ছুটির এর পর অশ্বিনী লিটল হোপের অফিস রুম বসেছিল। একটু আগেই সে যোগার ক্লাস নিচ্ছিলো। এখন পরনে তার স্পোর্টস প্যান্ট ও টিশার্ট। সেখানকার মিসেস গোয়াডা এর সঙ্গে কথা হচ্ছিলো। আলোচনার বিষয়বস্তু হলো এর মধ্যে একটা প্রকল্প হচ্ছে সেইসব ছেলেমেয়েদের জন্য যারা লেখাপড়াতে বিশেষ ভালো নয়। কিন্তু জীবন ধারণের জন্য রোজগারের উপায় তারা খুঁজে পাবে এই প্রকল্প থেকে। যেমন মেয়েদের জন্য বিউটি পার্লার , ফ্যাব্রিক প্রিন্টিং বা গার্মেন্টস কাটিং এন্ড স্টিচিং এর কথা ভাবা হচ্ছে । এই প্রতিষ্ঠানটি বয়স প্রায় দুইবছর। এখনো তাদের অনেক দূর এগোতে হবে। 


হোটেল এর সিসিটিভি ফুটেজ কে ভালো করে বার বার চালিয়ে দেখা হয়েছে। মনিকা একটা ব্ল্যাক এন্ড গোল্ডেন কম্বিনেশন ড্রেস পড়েছিল পার্টির দিন। সদাহাস্য কথা বলছিলো কে ড্রিঙ্কস নেয়নি কে কি খাচ্ছেন তা দেখভাল করছিলো। মাঝে চিকেন এর স্টার্টার আর একটা ককটেল এর গ্লাস তুলে নিতেও দেখা গেলো। তারপর আস্তে আস্তে কেমন যেন একটু ম্লান লাগছিলো। বোঝা যাচ্ছে যে তার দেহের ভিতর কিছু অস্বস্থি হচ্ছে। ককটেল এর গ্লাস তো সে ভ্রাম্যমান ওয়েটার এর কাছ থেকে নিজেই তুলে নিয়েছিল , সুতরাং সেখানে কোনো রকম গন্ডগোল নেই তা ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে। এছাড়া মনিকার ফোন রেকর্ডস ও আর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট কেও ভালো ভাবে দেখা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কোনো আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে না। ফোনের কল রেকর্ডস থেকে জানা যাচ্ছে যে সারা দিনে অনেকগুলো কল এসেছিলো। কিন্তু সবই প্রায় সাধারণ রোজকার কল। বাপের বাড়ি থেকে অফিসের ক্লায়েন্ট , তাছাড়া অফিস পার্টির জন্য হোটেল এর থেকে কল। শুধু একটি কল এসেছে যা কিনা কোনো ল্যান্ড লাইন থেকে। সেটার খোঁজ চলছে।

অশ্বিনীর বার বার মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়তো চোখের সামনে আছে কিন্তু তা তারা ধরে উঠতে পারছে না। অশ্বিনী আরেকবার কৃশানুর সঙ্গে কথা বলতে চায়, আত্মহত্যার সম্ভাবনার দিকটা একবার যাচাই করে নিতে চায়। 


ছয়

কৃশানুর বাড়িতে আজ সে একা নয় , সঙ্গে দীপা কে ও দেখতে পাওয়া গেলো। রিঙ্কি না থাকলেও বিমলা বাড়ির রোজকার কাজ কর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। এটা তার রুজি রুটির ব্যাপার। অশ্বিনী কৃশানুর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে , দীপা পাশেই বসে। জামিনে ছাড়া পেলেও কৃশানু বাড়ি ছেড়ে কোথাও বেশি বেরোচ্ছে না। দীপা যদিও তার পাশে আছে এই দুঃসময়েতে। 

অশ্বিনী মনিকার পুরানো প্রেমিক অভিষেকের সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে। উত্তরে কৃশানু বলে যে সে এ ব্যাপারে কিছুই জানে না। তবে তার মনে হয় যে বিয়ের পর মনিকার কারুর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না। হতে পারে স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে চিঠিটা রাখা ছিল। কথায় বলে মানুষের মনের তল পাওয়া ভগবানের অসাধ্য। তবে আমার মতে মনিকার মতো মেয়ে কখনো আত্মহত্যা করবে না। তাহলে তো একটা চিঠি বা কোনো স্বীকারোক্তি ছেড়ে যেত। তা তো লেখা পাওয়া যায়নি। 

বিমলা চা দিতে এসেছিলো ড্রয়িং রুম এ। আলোচনাগুলো তার কানে আসছিলো। সে উৎসুকভাবে শুনছিলো। চা পরিবেশন করে চলে যাবার সময় অশ্বিনী হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে , বিমলা তুমি কি কিছু বলতে পারো তোমার ম্যাডামের সম্পর্কে। বিমলার চোখ ছল ছল করে উঠে , সে বলে ম্যাডাম খুব ভালো ছিল। কোনোদিন এতটুকু খারাপ কথা বলতে শুনিনি। রিঙ্কি কে আমি আমার নিজের মেয়ের মতো ছোট থেকে বড়ো করেছি। এমনিতে সে আমার বড়োই ন্যাওটা। আমি থাকলে তার আর কারুর দরকার হয় না। সারাদিন আমার কাছে থাকে। 

অশ্বিনী জিজ্ঞাসা করে , যেদিন ম্যাডামের মৃত্যু হয় সেদিনের কথা তোমার মনে আছে? বিমলা বলে হা মনে আছে , সেদিন ম্যাডামের অফিসার পার্টি ছিল রাতেরবেলা। পার্টির জন্য সব জামাকাপড় গুছিয়ে নিয়ে গেছিলেন সকালবেলা অফিসে যাবার সময়। আমাকে বলেছিলেন যে তিনি সেদিন একটু বেশি রাত্রে ফিরবেন , তাই আমি যেন স্যার আসা পর্যন্ত থেকে যাই। বিকেলবেলা আমরা মানে আমি আর রিঙ্কি নাচের স্কুলে গিয়েছিলাম। এখান থেকে কয়েক বাড়ি পরেই একটা ডান্স স্কুল আছে। সেখানে বাচ্ছাদের নাচ শেখানো হয়। তারপর বাড়ি ফিরে আসি প্রায় সাড়ে ছয়টার পর। ঘরে ঢুকে মনে হলো যে কেউ যেন এখুনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। মনে হচ্ছিলো যে মনিকা ম্যাডাম ই বাড়িতে এসেছিলো আর পার্টিতে যাবার জন্য রেডি হয়ে বেরিয়ে গেছিলো। পরে পাশের বাড়ির কাজের লোক করুনা আমাকে বলেছিলো সে ম্যাডামকে বাড়ির সামনে থেকে গাড়ি করে চলে যেতে দেখেছে। অশ্বিনী জিজ্ঞাসা করে মনিকার সাথে আর কেউ ছিল কি ? বিমলা বলে না এ ব্যাপারে আর বেশি কথা হয়নি , একে তো মার্ডার কেস তাই কিছুতে মুখ খুলতে চায় না। যদি কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে। 

অশ্বিনী বলে বিমলা আজ তুমি একটা নতুন ইনফরমেশন দিলে। এতক্ষন আমরা জানতাম যে মনিকা একবারই রাত্রিতে বাড়ি ফিরেছে। কিন্তু মনিকা তার প্ল্যান চেঞ্জ করেছিল এবং বাড়ি এসেছিলো। একবার কি করুনার সাথে কথা বলা যায় ? বিমলা বলে ঠিক আছে আমি ওকে ডেকে আনছি। কৃশানু এতক্ষনে মুখ খুললো। বিমলা এইসব কথা তো আমাকে কিছু বলেনি আগে। অশ্বিনী বলে উঠে মানুষ অনেক সময় চুপ থাকে নানা কথা ভেবে। হয়তো বিমলা আপনাকেই সন্দেহ করেছে এই মৃত্যুর জন্য। 

খানিক্ষন পরেই করুনা কাঁচু মাঁচু মুখে এসে উপস্থিত হলো বিমলার সঙ্গে। জিজ্ঞাসা করতে সে বলে উঠে ,আমি ম্যাডামকে দূর থেকে বাড়ি থেকে বেরোতে দেখেছিলাম। কারণ গোল্ডেন কালার ড্রেস এর জন্য নজর টা এমনি চলে গিয়েছিলো। সামনে থেকে একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে ছিল আর মনে হলো যে ম্যাডাম কিছু একটা বলে উঠলো আর গাড়িতে চেপে চলে গেলো। গাড়িটা কি রকম দেখতে ছিল বলতে পারবে ? অশ্বিনী জিজ্ঞাসা করে। করুনা বলে হ্যা তো ওই স্যারের যেমন গাড়ি আছে কিন্তু রংটা আলাদা। দূর থেকে তো খয়েরি কালার এর মনে হচ্ছিলো। অশ্বিনী মনে মনে ভাবলো হয়তো কোনো কলিগ অফিস পার্টিতে যাবার জন্য লিফ্ট দিয়েছিলো। এই সম্বন্ধে অফিস তে জিজ্ঞাসা বাদ করতে হবে। 

তাহলে এই মুহূর্তে জানা যাচ্ছে যে মনিকা অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে বাড়িতে এসেছিলো এবং সেখান থেকে রেডি হয়ে অফিস পার্টিতে যোগ দেয় এবং বাড়ির সামনে থেকে সে গাড়ি করে বেরিয়ে ছিল। কিন্তু কেন এই পরিবর্তন ? যদিও খুব ছোট ব্যাপার। নিজের বাড়িতে ফিরলে ক্ষতি কি ? কিন্তু মনিকার সম্বন্ধে যা জানা যাচ্ছে তাতে এই প্ল্যান চেঞ্জ একটু অস্বাভাবিক। তার প্ল্যান অনুযায়ী অফিস থেকে সোজা বিউটি পার্লার তে যাবার কথা ছিল। তাহলে কি বাড়িতে সবার অলক্ষে মনের মানুষের সাথে দেখা করতে এসেছিলো ? কিন্তু তাও বা কি করে হয়। মনিকার চরিত্রের সঙ্গে এইরকম হটকারিতা মানাচ্ছে না। সে এতো কাঁচা কাজ করবে বলে মনে হচ্ছে না। যে কিনা ধীরস্থির ও হিসাব করে পা ফেলে চলা মেয়ে। তাহলে কিসের জন্য ?

মনিকার অফিস কলিগ দের সঙ্গে কথা বলার দরকার। অশ্বিনী শ্রীহরি কে মনিকার অফিসে যেতে বলে। দেখুন যদি কিছু জানতে পারা যায়। সেদিন কি কেউ মনিকাকে লিফ্ট দিয়েছিলো ? তার প্ল্যান চেঞ্জ এর কারণ যদি কিছু জানতে পারা যায়। 

পোস্টমর্টেম রিপোর্ট তে পরিষ্কার জানা যাচ্ছে যে মুখের উপর স্কিন ট্রিটমেন্ট করা হয়েছিল , হেয়ার জেলও এপ্লাই করা হয়েছে যা কিনা বেশিরভাগ সময় হেয়ার স্টাইলিস্টরাই ব্যবহার করে। তাহলে কি মনিকা বিউটি পার্লারতে গিয়েছিলো ? কোন বিশেষ কারণে সে বাড়ি ফিরে এসেছিলো ? সে কি কিছু ভুলে ফেলে গেছিলো যা কিনা খুব দরকারি ? পাকস্থলীতে অন্য খাবারের সাথে চিকেন ও রেড ওয়াইন এবং এক জাতীয় ককটেলের মিশ্রনের ট্রেস পাওয়া গেছে। তবে মৃত্যু হয়েছে রেড ওয়াইন এর মধ্যে স্ট্রিকনিন বিষক্রিয়ায়। মৃত্যুর সময় রাত বারোটা তিরিশ থেকে একটার মধ্যে।


সাত

মল্লেশ্বরামর রিও এর ছয়তলায় অফিসে শ্রীহরি অফিসে ইনচার্জ সঞ্জয় এর সাথে কথা বলে জানতে পারে যে মনিকার খুব কাছের কলিগ হলো মিস রিতা। সেও বাঙালি , দুইজনের মধ্যে খুব ভালো বন্ডিং ছিল। একসাথে লাঞ্চ , গসিপ সব শেয়ার করতো। শ্রীহরি মিস রিতা র সঙ্গে কথা বলতে চায়। মিস রিতা তখন অফিসে তে ছিল। সঞ্জয় তাকে মিটিং রুমে ডেকে পাঠায়। 

শ্রীহরি রিতাকে জিজ্ঞাসা করে , ম্যাডাম আপনার সঙ্গে তো মনিকার বেশ ভালো ভাব ছিল। আপনি কি জানেন যে মনিকার সেদিনকার প্ল্যানড স্কেডিউলে কিছুটা চেঞ্জ হয়েছিল ? রিতা খানিক্ষন চুপ করে থাকে , তারপর বলে , হ্যা চেঞ্জ হয়েছিল। সেদিন মনিকার অফিসে থেকে বিউটি পার্লর যাবার কথা ছিল বিকাল পাঁচটার সময়। বিউটি পার্লার টা অফিসের প্রায় কাছেই। মনিকা নিয়মিত এই পার্লার তেই যেত। কিন্তু প্রায় সাড়ে চারটের সময় একটা ফোন আসে মনিকার মোবাইলতে। তারপর সঙ্গে সঙ্গেই মনিকা বেরিয়ে পরে অফিসে থেকে। 

শ্রীহরি জিজ্ঞাসা করে কোথায় যাচ্ছেন তা কি কিছু বলেছিলেন ? রিতা বলে হ্যা , বললো আমাকে এখুনি একটু বাড়ি যেতে হবে। আর কিছু বলেনি। তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যায়। শ্রীহরি বলেন , ঠিক আছে , এছাড়া যদি কিছু মনে পরে তাহলে জানাবেন প্লিজ। শ্রীহরি বেরিয়ে আসছিলো। হঠাৎ রিতা বলে উঠে, ইন্সপেক্টর , জানিনা এটা আপনার কাছে ইম্পরট্যান্ট মনে হবে কিনা, যেদিন মনিকার মৃত্যু হলো মানে পার্টির পরের দিন সকালে অফিসে মনিকার জন্য একটা ফোন এসেছিলো। এক মহিলা কল করেছিল ইন্টারকমে রিসেপশন থেকে কল ট্রান্সফার হয়ে এসেছিলো ? প্রথমেই জিজ্ঞাসা করে , আমি কি মনিকার সাথে কথা বলছি ? তো আমি উত্তরে বলি না , আমি ওর কলিগ কথা বলছি। তো মহিলা জিজ্ঞাসা করে মনিকা অফিসে তে এসেছে কিনা ? আমি বললাম না আসেনি। শুনে হঠাৎ বলে উঠলেন , মনিকা সুস্থ আছে তো ? আমার একটু অবাক লাগলো। তখন আমি বললাম যে এখনও অফিসে আসার সময় রয়েছে , তাছাড়া কাল অফিসের পার্টি ছিল তো একটু লেট নাইট হয়ে গেছিলো। ঠিক আছে আপনি আমাকে আপনার নাম আর কন্টাক্ট নম্বরটা দিয়ে দিন , আমি মনিকা আসলে আপনাকে কল করতে বলবো। কিন্তু ততক্ষনে ওপর দিকে লাইন কেটে গেছে বা কেটে দেয়। আর তার কিছুক্ষন পরেই মনিকার মৃত্যু সংবাদ পাই। আমার কিছুটা অস্বাভাবিক লাগছিলো ব্যাপারটা , তাই আপনাকে জানালাম। শ্রীহরি বলে , ম্যাডাম আপনাকে ধন্যবাদ , এই ছোট ছোট খবরগুলোই অনেক সময় ভীষণ হেল্প করে। 


অশ্বিনী কাছে খবর এসেছে নিউ বেল রোড এর কাছে রিনিউ বলে একটি বিউটি পার্লারএ মনিকা রূপ চর্চার জন্য নিয়মিত যেত। রুটিন ইনকোয়ারি করতে অশ্বিনী একবার সেখানে ঢুঁ মারলো। জানা গেলো যে পার্লার এর মালিক এক মহিলা , তার নাম লাভলিন। তিনি অবশ্য সেই সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। পার্লার এর কর্মচারীদের কাছ থেকে জানা গেলো লাভলিন তার দেশের বাড়িতে গেছে কারণ তার ছেলের অসুখ হয়েছে। যেদিন মনিকার অফিসের পার্টি ছিল সেইদিনই লাভলিন দেশে গিয়েছিলো। মহিলার কন্টাক্ট নম্বর নেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে আরো জানা গেলো যে মনিকা গত ছয় মাস ধরে বরাবর আসলেও মৃত্যুর আগের দিন কিন্তু সে আসেনি। একটা ব্যাপার বেশ লক্ষ করার মতো যে পার্লার এর সবাই নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়া এর ছেলে মেয়ে। বিউটি পার্লার টি একটি তিন তলা বাড়ির গ্রাউন্ড ফ্লোর ও ফার্স্ট ফ্লোর নিয়ে। বাইরে থেকে এত ঝক ঝকে না হলেও ভিতরে ঢুকলে একেবারে বদলে যায়। ঘরের মধ্যে সমস্ত অত্যাধুনিক সরঞ্জাম রয়েছে , ফেসিয়াল রুম , বডি ম্যাসাজের আলাদা ছোট ঘর পার্টিশন দিয়ে তৈরি করা হয়েছে সঙ্গে স্লাইডিং ডোর। অশ্বিনী স্বভাব অনুযায়ী ভালো করে দেখছিলো সব কিছু। সাধারণত তাকে রূপচর্চার জন্য বিশেষ তদবির করতে হয়না। এমনিতেই তার গায়ের রং ফর্সা আর স্কিন ও খুব ভালো। মাঝে মাঝে আইব্রাউস করতে কোনো এক পার্লারএ চলে যায়। বাঁধা ধরা কোনো জায়গা নেই। হঠাৎ এক ফেসিয়াল রুম এর মধ্যে তার চোখ চলে যায়। রুমের এক কোনে একটা ছোট টেবিল এর উপর একটা রেড ওয়াইনের বোতল দেখতে পায়। বোতলটা লক্ষণীয় কারণ একই ব্রান্ডের ওয়াইন মনিকার ঘর থেকে পাওয়া গেছে। মনিকা আরো ভালো করে দেখার উদ্যোগ করতেই একটি মেয়ে সেটা তুলে নিয়ে চলে যায়। আর বলে যে তারা ওয়াইন ফেসিয়াল করার জন্য ব্যবহার করে। যদিও কথাটা বলার সময় মেয়েটা একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলো। অশ্বিনীর সিক্সথ সেন্স তাকে খোঁচা দিচ্ছে। 

অশ্বিনী তার গুপ্ত খবরি কে বিউটি পার্লর এর উপর নজর রাখতে বলে। তার মন বলছে এখানে কিছু গড়বড় আছে। কয়েকদিন পর তার কাছে খবর এলো , এবং তাকে একটি সিদ্ধান্ত নিতে হলো।


আট 

বাগডোগরা এয়ারপোর্টতে একটু আগে ইন্ডিগো ফ্লাইটটি ল্যান্ড করেছে। বেঙ্গালুরু থেকে ভায়া কলকাতা হয়ে বাগডোগরা পৌঁছেছে। অশ্বিনীকে রিসিভ করার জন্য স্থানীয় থানার স্পেশাল অফিসার মিস্টার সেন এসেছেন। এয়ারপোর্টের বাইরে জীপ্ রয়েছে। প্রাথমিক আলাপের পর তারা রওনা দিলো। গন্তব্য দার্জিলিং।

অশ্বিনী আগে কখনো ভারতের এইদিকে আসেনি। তবে সে শুনেছে যে ওয়েস্ট বেঙ্গল হলো সেই রাজ্য যেখানে একসাথে হিমালয় আর সমুদ্র দুই এর সমাবেশ। আর দার্জিলিং হলো কুইন অফ হিলস। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এক কথায় অতুলনীয়। জীপ্ ন্যাশনাল হাইওয়ে নম্বর থার্টি ওয়ান দিয়ে , বাগডোগরা টাউনশিপ ও মার্কেট পেরিয়ে নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস কে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলেছিল। শর্টকাট রুট ধরতে শিমুলবাড়ী থেকে ড্রাইভার গাড়িটা বাঁক নিলো পাঙ্খা বাড়ির দিকে। রাস্তার দুই ধারে চা বাগান , খাড়া পাহাড়ি রাস্তা। কাঠের ছোট্ট বাড়িগুলির সামনে হাত নাড়তে থাকা  খুদে ছেলেমেয়েদের দল। এখানেই আছে পৃথিবী বিখ্যাত মোকাইবাড়ি টি এস্টেট। সেটা পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো কার্শিয়াং এর দিকে। মধ্যে রাস্তায় একটু দাঁড়িয়ে চা খাওয়া হয়েছিল। অশ্বিনী একটু ও ক্লান্ত অনুভব করছে না। তার খুব ভালো লাগছে। এক নতুন অভিজ্ঞতা। এরপর গাড়ি হিল কোর্ট রোড হয়ে দার্জিলিং পৌঁছে গেলো। তখন বিকাল গড়িয়েছে। সোজা সার্কিট হাউস পৌছে গেলো গাড়ি। মিস্টার সেন বললো আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন। তার পর চা খেতে খেতে কথা হবে। যদিও গাড়িতে আসার সময় নানা রকম কথা হচ্ছিলো কিন্তু তা বেশির ভাগই দার্জিলিং এর উপর। আসল প্ল্যান অফ অ্যাকশন কি হবে তা নিয়ে কোনো কথা হয়নি। এই সময় টা অগাস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহ। দার্জিলিং এর আবহাওয়া খুব মনোরম। যদিও বৃষ্টির সময় এখন। অশ্বিনী গরম জলে খানিক্ষন গা ডুবিয়ে রাখলো বাথ টবে। খুব রিলাক্স লাগছে। এই রকম একটা জায়গায় এসে তার মনে একটা অন্য ভাব জাগছে। হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করছিলো ওই বনের পথে। ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসে দেখলো ডাইনিং রুমে মিস্টার সেন বসে আছে। সামনে টি পট ও কিছু স্ন্যাক্স রাখা রয়েছে। চা কাপে ঢালতেই একটি সুন্দর গন্ধে জায়গাটা সুরভিত হয়েউঠলো। আসল দার্জিলিং টি র কামাল। 

অশ্বিনী বলে , কালকে আমাদের সেন্ট জোসেফ বয়েস স্কুল যেতে হবে প্রথমে। এরপর সামান্য কিছু জরুরি আলোচনার পর মিস্টার সেন উঠে পড়লেন। সামান্য ডিনার করে অশ্বিনী শোবার তোড়জোড় করলো। আরামদায়ক ব্যবস্থা সার্কিট হাউসের। তার কোনো রকম অসুবিধা হচ্ছিলো না নতুন জায়গায়। আর নেপালি কুকের রান্নার হাতও যথেষ্ট ভালো। 

সকালবেলা অশ্বিনীর ঘুম ভাঙলো , জানলার পর্দা সরাতেই চারিদিকে পাহাড়ে সবুজের , এক অনিন্দ্য সৌন্দর্যের সমারোহ। সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো জানলার বাইরে। হালকা একটা চাদরে গা টা জড়িয়ে নিয়েছে। বেশ একটা হলিডে মুড তৈরি হচ্ছে। যদিও অশ্বিনী বেশিক্ষন এই মনোভাব কে প্রশ্রয় দিলো না। তাড়াতাড়ি সে রেডি হয়ে নিলো। মিস্টার সেন এসে পড়লো বলে। মোবাইল নেটওয়ার্ক খুব একটা ভালো নয় যদিও, তাও সে একবার বাড়িতে মায়ের সাথে কথা বলে নিলো। মিস্টার সেন এসে গেছেন। গুড মর্নিং বলে গ্রিটিংস জানালো। ব্রেকফাস্ট একই সঙ্গে করলো তারা। এরপর বেরোনোর পালা । 

প্রথমেই তারা পৌঁছালো নর্থ পয়েন্ট এর কাছে সেন্ট জোসেফ বয়েস স্কুলে। ম্যাল রোড দিয়ে জীপ্ চলেছে। মেঘ আর সূর্যের খেলা চলছে আকাশে। দূরে বরফের চূড়ার আলগা আভাস পাওয়া যাচ্ছে। মিস্টার সেন অশ্বিনী কে বললো ম্যাডাম দার্জিলিঙে এসে কেভেন্টার্স এর ছাদে বসে হট চকলেট আর চিকেন স্যান্ডুইচ মিস করবেন না আর সঙ্গে দার্জিলিঙে এর মনোরম দৃশ্য।    

স্কুলের প্রিন্সিপাল এর সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করতে হলো না। তিনি অফিসে ছিলেন , পুলিশ এর স্পেশাল ডিপার্টমেন্টর তার স্কুলে এর সাথে কি সম্পর্ক , সেটা জানার জন্য উৎসুক হয়েছিলেন। মিস্টার সেন তাকে আস্বস্থ করলেন। তিনি ঋষভ বলে একটি দশ বছরের ছেলের খোঁজে এসেছেন। প্রিন্সিপাল বললেন হা ঋষভ তো আমাদের বোর্ডিং স্কুলের খুব ভালো ছাত্র। ওর মা সাধারণত দেখা করতে আসে স্কুলের হলিডে এর সময়। ওদের বাড়ি যদিও এই দার্জিলিঙের থেকে একটু দূরে। তাহলেও সে এই বোর্ডিং স্কুলে থাকে। অশ্বিনী মিস্টার সেন কে বললো যে সে একবার ঋষভের সাথে কথা বলতে চায়। কিছুক্ষন পর ধীরে ধীরে একটা ছোট্ট ছেলে ঘরের মধ্যে এসে উপস্থিত হলো। তার মুখের দিকে তাকিয়েই অশ্বিনী চমকে উঠলো। এই মুখ সে খুব ভালো করে চেনে। কারণ ঋষভের মুখের একটি বৈশিষ্ট। 

ঋষভের সরল চোখে একটা জিজ্ঞাসা। অশ্বিনী সস্নেহে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে প্রশ্ন করলো ? হোয়াট ইস ইওর নেম ? মিষ্টি গলায় উত্তর এলো। এরপর আরো কিছু প্রশ্ন করার পর অশ্বিনী ও মিস্টার সেন সেখান থেকে বিদায় নিলো।

 এরই মধ্যে মিস্টার সেনের মোবাইল ফোন দুইবার বেজে উঠেছিল। প্রথমবার মোবাইল নেটওয়ার্ক ঠিক মতো না পাওয়ায় কথা অসম্পূর্ণ ছিল। এরপর মাল রোডের কাছে আসতেই আবার ফোন বেজে উঠেছে। কথা হলো , মিস্টার সেন একটু উত্তেজিত, বললো ম্যাডাম আমাদের বিজনবাড়ির দিকে যেতে হবে। এরপর ড্রাইভার কে নির্দেশ দিলো বিজন বাড়ির দিকে গাড়ি ঘোরাতে। রঙ্গীত নদীর ব্রিজ পেরিয়ে গাড়ি পাহাড়ি রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলো। অশ্বিনী একবার জিজ্ঞাসা করলো , আপনার খবর পাক্কা তো ? মিস্টার সেন জোরের সঙ্গে বলে উঠে , হা ম্যাডাম , ভরসা যোগ্য সোর্স। 

গাড়ি গিয়ে থামলো একটি হোম স্টে এর সামনে। ছিমছাম সুসজ্জিত বাড়িটি। বাড়ির নাম নিরালা। গেটের ভিতরে ঢুকতেই সামনে একটা রিসেপশন মত। ছবির মতো সুন্দর জায়গায় এই বাড়িটি। রিসেপশন এ একজন স্থানীয় অল্পবয়সী ছেলে বসেছিল। মিস্টার সেন বাড়ির মালিকের সঙ্গে দেখা করতে চায়। ছেলেটি উত্তরে বলে যে মালিক এই সময় উপস্থিত নেই বাড়িতে। 

অশ্বিনী ইতিমধ্যে সব দিক খুঁটিয়ে দেখছিলো। চোখে পড়লো একটা ফটো যা কিনা রিসেপশন এর এক কোনে লাগানো ছিল। একটা গ্রুপ ফটো। অশ্বিনী প্রশ্ন করে ফোটটার দিকে তাকিয়ে, উত্তরে রিসেপশনিস্ট ছেলেটি বলে যে এই ফটো মালিকের পরিবারের। মালিক ও তার ছোট বোন সঙ্গে বউ ও তার মা ও ছোট ছেলে। মিস্টার সেন অবশ্য ততক্ষনে মালিকের ফোন নম্বর টি লিখে নিয়েছে। 

অশ্বিনী না জানি কি মনে করে মিস্টার সেন কে বললো, যে সে এখানে আজ রাতটা কাটিয়ে যেতে চায়। যদিনা মিস্টার সেনের আপত্তি থাকে। কি আর করা ম্যাডাম কে তো এক ফেলে চলে যাওয়া যায় না, তাই মিস্টার সেন কেও সেখানে আশ্রয় নিতে হলো। সঙ্গে জামাকাপড় পাল্টানোর কোনো ব্যাপার নেই। রিসেপশন তে বলে ভালো দুটি ঘরের ব্যবস্থা করা হলো। অশ্বিনী হঠাৎ করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলো। তার সিক্সথ সেন্স তাকে খুব একটা ধোঁকা দেয়না। 

অশ্বিনী কিছুক্ষন সামনের বাগিচা তে ঘুরে বেড়ালো। তারপর বাড়িটা থেকে বেরিয়ে সামনের পথ ধরে এগিয়ে চললো সামনের দিকে। কুয়াশা মেঘের আকারে ঘুরে ঘরে আসছে। সামনের এক ছোট দোকানের সামনে গিয়ে সে দাঁড়ালো। ছোটোখাটো একটা ষ্টেশনারী শপ। হিন্দিতে আলাপ জমালো দোকানির সাথে। নানা কথায় সে কিছু খবর সংগ্রহো করলো যা কিনা তার মনের সন্দেহকে পাক্কা করছে। রহস্যের সমাধান সে করে নিয়েছে। শুধু দরকার কিছু প্রমান ও স্বীকারোক্তি।

নিরালা তে সবই কিরকম চুপচাপ। মিস্টার সেন আগেই ভালো করে জেনে নিয়েছেন। এই সময়টা টুরিস্ট সিসন নয় তাই ভিড় কম আর দুইজন ফরেনার কে দেখা গেলো সাইকেল থেকে নেমে বাড়িতে ঢুকতে। সাকুল্যে তিন জন গেস্ট রয়েছে।

রাত্রিতে ডিনার এর পর সবাই যে যার ঘরে চলে গেছে। বাইরেটা অন্ধকার। রাত প্রায় একটা মনে হচ্ছে কোথায় যেন একটা কান্নার আওয়াজ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। অশ্বিনী কান পেতে আছে। কেউ যেন ফুঁপিয়ে কাঁদছে। অশ্বিনী তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। একটু এগোতেই একটা করিডোরের ধারে বা দিকে একটা ঘর থেকে আওয়াজ টা আসছে। এই জায়গাটা অতিথিদের থাকার ঘরগুলো থেকে আলাদা করা হয়েছে বাড়ির লোকেদের ব্যবহার করার জন্য। অশ্বিনী এগিয়ে চললো নিঃশব্দে। একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। দরজাটা আলগা ভাবে ভেজানো রয়েছে। উঁকি মেরে অশ্বিনী দেখতে পায় দরজার দিকে পিছন ফিরে রয়েছে এক মহিলা। মুখ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। সামনে একটা  যীশুর ক্রস বিদ্ধ মূর্তি , মোমবাতি জ্বালানো। মহিলা ঢুকরে কাঁদছে। ঘরের মধ্যে নজর বুলিয়ে নেয়। সুসজ্জিত ঘরটির মধ্যে একটি টেবিলের উপর ফুলদানির পাশে একটি ছোট ছেলের ফটো। 

অশ্বিনী বেড়ালের মতো নিঃশব্দে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেছে। মহিলাটি তার নিজের মধ্যে এমন ভাবে নিয়োজিত ছিল যে সে অনুভব করতে পারেনি যে কোনো দ্বিতীয় ব্যাক্তি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেছে। অশ্বিনী আস্তে আস্তে দরজাটা বন্ধ করে দেয় আর ছিটকানি তুলে দেয়। ততক্ষনে মহিলার হুশ ফিরেছে। সে চমকে পিছনের দিকে তাকিয়ে অশ্বিনী কে দেখে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে ইংলিশ এ , হু আর ইউ। এখন মহিলাকে ভালো করে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। নেপালি সুন্দরী বললে ভুল হবে না। বয়স তার তিরিশের কাছাকাছি। অশ্বিনী খুব আস্তে বলে উঠে , প্লিজ ভয় পাবেন না , আমি অশ্বিনী , একটা বিশেষ কারণে বেঙ্গালুরু থেকে এসেছি। মহিলা বলে কেন , আর এই রাত্রিবেলা এরকম ভাবে আপনি আমার ঘরে কি করছেন ? অশ্বিনী বলে , লাভলিন আপনি বেঙ্গালুরু থেকে ওরকম পালিয়ে এলেন কেন ? মহিলা বলে উঠে, কি বলছেন , আমি কেন বেঙ্গালুরু থেকে পালতে যাবো ? আমার ছেলের অসুখের খবর পেয়েই আমি চলে আসি। অশ্বিনী বলে উঠে আমরা আপনার ছেলের স্কুল এ গেছিলাম এবং ঋষভের সঙ্গেও দেখা করেছি। তার তো কোনো অসুখ হয়নি। লাভলিন এর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। তাও সে জোরের সঙ্গে বলে , তাতে কি , আমি আমার বাড়ি আস্তে পারবো না , এতে কি কোনো অপরাধ হয়েছে ? অশ্বিনী বলে , না তাতে কোনো অপরাধ নেই যদি না আপনি কাউকে খুন করে পালিয়ে আসেন। লভেলিন অকস্মাৎ এরকম কথা শুনে চমকে উঠলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বলে , কি আবোলতাবোল বলছেন ? আমি কেন কাউকে খুন করতে যাবো ? কার সাথে শত্রুতা আছে আমার ? অশ্বিনী বলে, তা আপনি ভালো করেই জানেন , কেন আপনি একজন নিরপরাধ মহিলাকে তার বাচ্চার কাছ থেকে কেড়ে নিলেন ? আপনি মনিকাকে চেনেন না ? আপনি কৃশানু কে চেনেন না ? লাভলিন চিৎকার করে উঠে বলে, না আমি চিনি না , চিনতে চাই না। বলে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না , কান্নায় ভেঙে পড়লো। অশ্বিনী এগিয়ে গিয়ে তার কাঁধে হাত দেয়। বলে রেশমা , আমার আপনার জন্য সম্পূর্ণ সহানুভূতি আছে। আমি যতটা ধারণা করেছি তাতে হয়তো আমি যদি আপনার জায়গায় থাকতাম তো আমার মনেও এই একই অবস্থা সৃষ্টি হতো। আমি জানি আপনার আসল নাম রেশমা, আর ঋষভ হলো আপনার ও কৃশানুর ছেলে। এটা অস্বীকার করার জায়গা নেই। কারণ ঋষভের কপালের ধারে একই জায়গায় রয়েছে লাল জরুল এবং মুখের আদল যা কিনা হুবহু কৃশানুর সাথে মিলে যায়। 

লাভলিন ওরফে রেশমা অশ্বীনির দিকে তাকিয়ে থাকে কান্না থামিয়ে। তারপর বলেন হা , ঋষভ আমার আর কৃশানুর ছেলে। একটা দুর্বল মুহূর্তে ভুল বসত এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। বিনা বিবাহে সন্তান সম্ভবা হওয়ার কলঙ্কের বোঝা বইতে হয়েছিল আমাকে। আমি নিজেকে দোষী না বলার কোনো কারণ নেই। আমারই দোষে এর শাস্তি পেতে হয়েছে। তার সাথে আমার পরিবারকেও। লোকের কটু কথা সব কিছু মেনে নিয়ে শুরু করেছিলাম এক নতুন জীবন , শুধু এই ছেলের কথা ভেবে। কৃশানু আমাকে কখনোই ভালোবাসেনি। তার কাছে আমি ছিলাম এখানে সময় কাটানোর একটা পুতুল খেলার উপকরণ মাত্র। কৈশোরের ও যৌবনের সন্ধিক্ষণে কৃশাণুকে কল্পনার রাজপুত্র বলে ভেবে নিয়ে তার হাতে নিজেকে সম্পূর্ণ সপেঁ দেওয়া আমার নির্বুদ্ধিতা। কৃশানু আমাকে তার সঠিক পরিচয় দেয়নি আর বাড়ির ঠিকানাও না। অশ্বিনী বলে উঠে , আমার বড়োই কৌতহূল হচ্ছে , আপনি কিভাবে কৃশানুর খবর পেলেন ? রেশমা বলে উঠে , সব কথা বলতে গেলে রাত ভোর হয়ে যাবে। আপনার কি শুনতে ভালো লাগবে ? অশ্বিনী বলে , আপনি বলুন , আমি সবটা শুনবো। অশ্বিনী বরাবরই অপরাধ মনস্তাত্বিক দিকটা বিচার করে দেখে। তার সবথেকে প্রিয় সাবজেক্ট হিউমান সাইকোলজি। রেশমা অশ্বিনীর দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করে তার জীবন বৃত্তান্ত।


নয়

ভোর হয়েছে , পাহাড়ের কোলে সূর্যোদয় হচ্ছে। অশ্বিনী রেশমার ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে আসছে। রেশমা ঘরের মধ্যে চুপ করে বসে আছে। অশ্বিনী নিজের ঘরে গিয়ে তৈরি হয়ে নেয়। মনটা বিষাদে ভরে আছে। কিন্তু তাকে তার কর্তব্য করতে হবে। মিস্টার সেনের ঘরের বাইরে দরজায় নক করে অশ্বিনী। মিস্টার সেন দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। অশ্বিনী সংক্ষেপে তাকে ব্যাপারটা বলে দেয় এবং অবশ্যকর্তব্য এর নির্দেশ দেয়। বেলা বাড়ছে , অশ্বিনী বেশি দেরি করতে চায় না। রাস্তায় লোক চলাচল বেড়ে যাবার আগেই সে মিস্টার সেন ও রেশমাকে নিয়ে জীপ্ করে রওয়ানা দেয়। রেশমার দাদা নারাংকে ফোন করে দার্জিলিং এর সদরের পুলিশ স্টেশনে আসতে বলা হয়। নারাং ফোনে চিৎকার করছিলো। সে কিছুতেই তার বোন কে নিয়ে যেতে দেবে না। শেষে রেশমা তাকে বলে , যে সে নিজের ইচ্ছায় তাদের সঙ্গে যাচ্ছে। যাবতীয় পুলিশি ফর্মালিটিজ এর পর অশ্বিনী সার্কিট হাউসে ফিরে এলো। আর এক দিন তাকে এখানে থাকতে হবে। রেশমার স্বীকারোক্তি নথিভুক্ত করা হয়েছে। নারাং অনেক ভাবে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিল , কিন্তু সব দোষের এর ভাগই সে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। রেশমাকে বেঙ্গালুরু নিয়ে যেতে হবে। তার জন্য জরুরি ব্যবস্থা চলছে। বিকালের পরন্ত রোদে অশ্বিনী সার্কিট হাউসের লন এ চেয়ারে বসেছিল। তাকে স্পেশাল ডিপার্টমেন্ট হেড মিস্টার কে কে মেনন কে রিপোর্ট পাঠাতে হবে। হাতে কলম নিয়ে লিখতে বসেছে।

লাভলিন ওরফে রেশমার সঙ্গে কৃশানুর পরিচয় এই দার্জিলিঙে এ প্রায় এগারো বছর আগে। কৃশানু রেশমার সম্পর্ক অতি গভীর হয়। কিন্তু কৃশানু উদেশ্য ছিল শুধু ছুটি উপভোগ করা। কোনো সম্পর্কে নিজেকে বাঁধতে নয়। কৃশানু চলে যাবার কিছুদিনের পর রেশমা জানতে পারে এই সম্পর্কের পরিণতি কি ভয়ানক। সমাজের চোখে অবাঞ্ছিত সন্তানের গর্ভধারণ এক অপরাধ। সকলের চোখ এড়িয়ে তাই তার দাদা নারাং রেশমাকে শিলিগুড়িতে তার এক নিকট বন্ধুর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তোলে। যেখানে জন্ম হয় ঋষভের। কিন্তু এই মেয়ের কি ভবিষ্যত। না জানে পড়াশুনা না আছে পয়সার জোর। বেঁচে থাকার জন্য কি উপায়, তাছাড়া সবসময় তো দাদার উপর নির্ভর করা যায়না। শেষ পর্যন্ত সে শিলিগুড়ি তে একটি বিউটি পার্লার এর কাজে যোগ দেয়। সে ধীরে ধীরে সেখানে কাজ শিখতে থাকে। সাজগোজের দিকে রেশমার একটা আগ্রহ বরাবর ছিল। তাই খুব তাড়াতাড়ি সে এই ব্যাপারে পটু হয়ে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে তার ব্যবহার কাস্টমারদেরও ভালো লাগতে থাকে । কিন্তু কপাল যে তার জন্ম থেকে ফুটো। বিউটি পার্লার এর নামে সেখানে হচ্ছিলো ড্রাগ এর ব্যবসা। কিছু না করেও রেশমা তার মধ্যে জড়িয়ে পড়লো।  

একবার সেই পাঁকে পড়লে সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়া মুশকিল । রেশমার নতুন নামকরণ হলো লাভলিন, তার সৌন্দর্য আর ব্যাক্তিত্ব তাকে সমাজের উপর মহলে যাওয়া আসার অবাধ সুযোগ করে দিলো। এই ভাবেই সে বেঙ্গালুরু তে সদাশিবনগরের মতন লাক্সজেরিওস ও উচ্চমধবিত্ত দের এলাকায় বিউটি পার্লর খুলে বসে। নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়া এর থেকে যত ছেলেমেয়ে বেঙ্গালুরু তে কাজের খোঁজে আসে তো তাদের সে এখানে থাকা খাওয়া সহ মাসিক মাইনেতে কাজে রাখে। সকলের সামনে বসে সে অবাধে ড্রাগের ব্যবসা করে যাচ্ছিলো। তার নিজের জীবনের পরিণতি তাকে ভালো মন্দর ফারাক করতে ভুলিয়ে দিয়েছিলো। তার এই বেঁচে থাকা শুধু তার ছেলের জন্য। ছেলেকে ভালো ভাবে মানুষ করতে হবে। ভালো এডুকেশন দিতে হবে যাতে তার দিকে কেউ আঙ্গুল তুলতে না পারে। এখন অবশ্য সিঙ্গেল মাদারদের সমাজে কিছুটা জায়গা মিলেছে। এরপর হঠাৎ একদিন তার বিউটি পার্লারএ মনিকার আগমন হয়। নতুন কাস্টমার তাই লাভলিন নিজেই দেখভাল করছিলো। কারণ মনিকাকে দেখে বেশ ধনী ঘরের বউ বলে মনে হচ্ছিলো। এরপর আলাপ জমে উঠে। রেশমা ঘুনাক্ষরেও জানতো না যে মনিকা কৃশানুর স্ত্রী। এর মধ্যে মনিকা রেশমার দেওয়া রেড ওয়াইনের ভক্ত হয়ে উঠেছিল। কারণ এটা বলা হতো যে অল্প পরিমান ওয়াইনে স্কিনের গ্ল্যামার বাড়িয়ে দেয়। 

ঘটনাচক্রে একদিন স্কীন ট্রিটমেন্ট করার সময় মনিকার মোবাইল ফোন বেজে উঠায় ফোনের স্ক্রীন এর উপর কৃশানুর ফটো দেখে চমকে উঠে। আলাপ তো আগেই ছিল , এবার আরো বেশি করে ভাব জমায় লাভলিন ওরফে রেশমা। যার জন্য আজ তার এই অবস্থা তাকে সে কি করে ভুলে যাবে। মনিকার কাছ থেকে সব খবর নেয়, সে মনিকাকে ফলো করে এবং জানতে পারে যে এই সেই কৃশানু যে কিনা তাকে পথে বসিয়েছে। যদিও আজ তার পয়সার অভাব নেই। কিন্তু পয়সা তো জীবনের সব কিছু নয়। সে নিজে সঙ্গী হারা জীবন কাটাচ্ছে আর এমন কঠিন অভিজ্ঞতার পর আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারবে না। সবচেয়ে বড় হলো তার ছেলের কোনো পরিচয় নেই , তাতে সে কিছু মাত্র দমে যায়নি , নিজের পরিচয় দিয়ে সে তাকে যথাসাধ্য মানুষ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু আজ সে এক পাকচক্রে জড়িয়ে গিয়েছে। ড্রাগ ব্যবসা থেকে সে সহজে মুক্তি পাবে না । গ্রামের সরল সাধাসিধে মেয়েটা এখন একজন ক্রিমিনাল। 

কৃশাণুকে সে রোজ ফলো করা শুরু করে। প্রথমে সে আবেগতাড়িত হয়ে ভেবেছিলো যে কৃশানুর সামনে গিয়ে দাঁড়ায় আর এর বিচার চায়। কিন্তু পরোক্ষনে নিজের মনের রাশ টেনেছিল। কৃশানু বিবাহিত। ফলো করতে গিয়ে তার নজরে এলো কৃশানুর চরিত্র এখনো বদলায় নি। সে তার স্ত্রী কে ধোঁকা দিচ্ছে। মনে হচ্ছিলো একবার গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলে কৃশাণুকে। কিন্তু তাতে কি চরম শাস্তি হবে তার। এমন শাস্তি কৃশাণুকে দিতে হবে যা তাকে জীবনভর ভোগ করতে হয়। সমাজের চোখে তার সন্মান , প্রতিপত্তি কে ধুলায় মিশিয়ে দিতে হবে। কুরে কুরে দগ্ধ করতে হবে তাকে। 

রেশমা এক ভীষণ বিপজ্জনক প্ল্যান তৈরী করে। পরিকল্পনা মতো সে মনিকার সাথে গভীর বন্ধুত্ব পাতিয়েছে। সব কথা মনিকা তার সাথে শেয়ার করে বিউটি পার্লার গেলে। তাছাড়া এসটিডি বুথ থেকে মাঝে রেশমা মনিকাকে ফোন করে কথা বলে। সুযোগ এলো যেদিন মনিকার অফিসের পার্টি হওয়ার কথা। আগে ঠিক হয়েছিল মনিকা তার পার্লার এ গিয়ে পার্টির জন্য তৈরি হবে। কিন্তু পরিকল্পনা মতো এসটিডি বুথ থেকে মনিকাকে নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে বলল রেশমা । আর বললো সে মনিকার বাড়িতে আসছে তাকে রেডি হতে সাহায্য করতে। প্রথম বার মনিকার বাড়িতে আসছে তাই উপহার স্বরূপ সে রেড ওয়াইনের বোতল নিয়ে এসেছে। রেশমা মনিকাকে পার্টির জন্য তৈরি করার সময়ই রেড ওয়াইনের বোতল থেকে তাকে একটু খেতে দিয়েছিলো যেটাতে অল্প মাত্রায় বিষ ছিল। পরে বোতলের মধ্যে ম্যাক্সিমাম পরিমান বিষ মিশিয়ে রেখে দেওয়া হয় মনিকার অলক্ষে। রেশমা চেয়েছিলো কৃশাণুকে আর স্ত্রীর হত্যার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করতে , মোটিভ হিসাবে তার এক্সট্রামারিটাল অ্যাফেয়ার্স ছিল মোক্ষম অস্ত্র। 

 তার প্ল্যান প্রায় সাকসেসফুল হয়ে গিয়েছিলো। কৃশাণুকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছিলো এবং এখনো তার উপর কেস চলছে স্ত্রী হত্যার অভিযোগে। কারণ কোনোদিন কেউ তাকে ধরতে পারতো না যদি না সে নিজে থেকে দোষ স্বীকার করে। তাই সেইদিন রাত্রে সে বেঙ্গালুরু থেকে দার্জিলিঙে ফিরে আসে, আগে থেকেই বন্দোবস্ত করা ছিল।  

অশ্বিনীর গুপ্ত খবরি তাকে জানিয়েছে এই বিউটি পার্লর এ কিছু গন্ডগোল আছে। যেটা উপর থেকে বোঝা মুশকিল। নতুন কাস্টমার এর সম্পর্কে নিশ্চিত হবার পরই ড্রাগ এর নেশা ধরানো শুরু করে , এমন ভাবে নেশা ধরানো হবে যে টের পাবার পর ফেরার রাস্তা থাকবে না , প্রথমে মনে হবে কোনো হেলথ ড্রিংক খাচ্ছ শরীর সুস্থ রাখার জন্য। বিউটি পার্লর এ অশ্বিনীর রেড ওয়াইনের বোতল দেখেই মনে সন্দেহ জেগেছিলো এবং আরো খুঁটিয়ে তদন্ত করে জানা গেলো যে এর মালিক লভেলিন দার্জিলিঙে এর মেয়ে। তার সাথে মনিকার খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিল। কারণ মনিকা প্রায় সেখানে যাওয়া আসা করত। লভেলিন এর সম্বন্ধে আরো জানা গেছিলো যে সে সিঙ্গেল মাদার , তার ছেলে দার্জিলিংয়ের বোর্ডিং স্কুল এ পড়াশুনা করে। 

বিভিন্ন ড্রাগস্ নাড়াচাড়া করে রেশমার তাদের কেমিকাল রিঅ্যাকশন সম্বন্ধে ভালো নলেজ হয়ে ছিল আর নিজের হাতে কারুর মুখে বিষ তুলে দেবার সাহসও। প্রতিশোধের জ্বালা মেটাতে গিয়ে সে এক নির্দোষের প্রাণ নিয়েছে। এর জন্য অবশ্য অনুশোচনায় রাতের পর রাত জেগে প্রার্থনা করে কাটিয়ে দিতো। দু চোখের পাতা এক করতে পারছিলো না।

অশ্বিনী তার রিপোর্ট লেখা শেষ করেছে। তার মনে হচ্ছে একটি মানুষের কিছু ভুলের জন্য কতগুলো জীবন আজ বিপর্যস্ত। কৃশানুর চরিত্রদোষে একটি সহজ সরল মেয়ে খুনিতে পরিণত হয়েছে । একটি নিরপরাধ স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে। আর দুটি শিশুর ভবিষৎ অনিশ্চিত। আইনের সাজা থেকে মুক্তি পেলেও কৃশানু কে সারা জীবন এই অপরাধের ভার বহন করে যেতে হবে। এতক্ষনে সূর্য পাহাড়ের কোলে অস্ত গেছে। অশ্বিনী চেয়ে থাকে সামনের দিকে , ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে আসছে উপত্যকায় ।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama