প্রান্তিক প্রেম অষ্টম পর্ব
প্রান্তিক প্রেম অষ্টম পর্ব
পর্ব ৮
সন্ধ্যে থেকে শুরু হল আলোচনা। একমাত্র বিষয় 'বেগুনকোদর' । তার আগে বিকেলে পুরুলিয়া শহর প্রদক্ষিণ । সাহেব বাঁধ, সৈনিক স্কুল, রাজস্থান বিদ্যাপীঠ, কুমারী কানন ও ড্যাম, জেলা সায়েন্স সেন্টার ইত্যাদি দেখার পর সকলে মিলে এক দুর্দান্ত মুখরোচক খাবার ' ভাবরা ' ও চা পান করলেন ।
কথাপ্রসঙ্গে সায়ন্তিকা জানতে চাইল ভাবরা কি দিয়ে তৈরি । দোকানী বলল - মা গো! খাঁটি বুটের ( ছোলা ) বেশন আর নুন , গুঁড়ো লঙ্কা মিশিয়ে কড়ুয়া তেলে ( সরষের তেলে ) ভাজা।
- - ভাজা মানে তো কুড়মুড়ে হয়ে যাবার কথা ।
দোকানী বলল - ওইখানেই ওস্তাদি মা ! যে কেউ পারবে না । এর কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। বলব ?
মদনমোহন একটু অধৈর্য্য হয়ে বললেন - ফেরার পথে শোনো না হয় । এখন চল বিশ্রাম নিয়ে আগামী কালের সূচী তৈরি করি গে ।
রাতে খাবার টেবিলে চলছে আলোচনা। বেগুনকোদরে ভুত দেখতে গেলে রাতে থাকতেই হবে ওই স্টেশনে।
পবিত্রবাবু বললেন - ১৯৬৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্য্যন্ত স্টেশনটি বন্ধ ছিল স্রেফ ভুতের গুজবের জন্য । সপরিবার স্টেশনমাস্টার মারা যাবার পর রাতারাতি কর্মচারীরা পালিয়ে যায়। ২০১০ সালে পুরানো বাড়ি রং করে হল্ট স্টেশন হিসাবে চালু করা হয়েছে। তবে এখনও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। দিনে কেউ কেউ নামলেও সন্ধ্যের পর আর জনপ্রাণী থাকে না।
এখনও স্থানীয়দের মুখে শোনা যায় রাত নামলে হঠাৎ হঠাৎ এখানে দেখা যায় অদ্ভুত আলো । যত রাত বাড়ে; বাতাসে ভেসে আসে অদ্ভুত সব গন্ধ, মাঝে মধ্যেই শোনা যায় অশরীরী কন্ঠস্বর । দিনের বেলাতেও নাকি ঘাড়ের কাছে অদ্ভুত শব্দ শুনে চমকে উঠেছেন অনেকেই। চারপাশে তাকিয়ে কাউকেই নাকি দেখা যায়নি । অনেক সময় লোকজনের গা ঘেঁষে চলে গিয়েছে অশরীরী কেউ। আচমকা ধাক্কা খেয়ে সচেতন হয়েছেন কেউ কেউ। কিন্তু যার সঙ্গে ধাক্কা লাগল তার দেখা মেলেনি।
এসবই লোকমুখে শোনা। আমি তো বলব এগুলো গুজব ছাড়া কিছু নয় ।
মদনমোহন শুধালেন - আচ্ছা পবিত্রবাবু ! আপনি কোনদিন গিয়েছেন ?
- অনেকবার গেছি। তবে দিনের আলোয়। এসব কিছুই অনুভব হয়নি।
- রাতে থেকেছেন কখনও ?
- না । সে সৌভাগ্য আমারও হয়নি। কাজের চাপে রাত্রিবাস হয়নি।
বলে একটু হাসলেন পবিত্রবাবু।
- তবে আপনারা এসেছেন ; যদি মনে করেন তো রাতে থাকলে আমিও সঙ্গী হব ।
কমলসাধন খুশি হয়ে বললেন - সেজন্যই তো এখানে আসা। তোকে সঙ্গে পাব বলেই না এই পথ ধরেছি !
পবিত্র বললেন - আমি যাব ঠিকই কিন্তু ভাই, ফ্যামিলিকে প্রেসার দিবি না। দু'দুটো বাচ্চা নিয়ে সামলাতে পারব না।
- বেশ তাই হবে ।
মদনবাবু তখন বললেন - ভালোই হল । সায়ন্তিকারও যাবার প্রয়োজন নেই । ও বরং এখানেই থেকে যাক।
প্রতিবাদে গর্জে উঠল সায়ন্তিকা।
- তাই হয় নাকি ! কি ভেবেছেন আমি মেয়ে বলে ভীতু নাকি ?
- ঠিক সে কথা বলতে চাইনি। তবে একলা মেয়ে যদি কোন অঘটন ঘটে যায় !
- ঘটবে। তা বলে এতদূর এসে রণে ভঙ্গ দিতে পারব না।
কমলসাধন ওকে আশ্বস্ত করে বললেন - এলার্ট থাকতে হবে কিন্তু।
- আমি সবসময় তাই থাকি। নইলে একলা মেয়ে চাকরি করতে পারতাম না।
সুকুমার এবং হরিপ্রসাদ দুজন চুপ করে সব শুনছিল । বাগাড়িয়া বললেন - ম্যাডামকে না হয় দিনের বেলায় দেখিয়ে দিয়ে এখানে পৌঁছে দেব।
আবারও গজগজ করতে লাগল সায়ন্তিকা।
- তাহলে আমাকে আনার প্রয়োজন কি ছিল ?
পবিত্রবাবু বললেন - ঠিক আছে বোন। তুমিও যাবে , আমাদের সঙ্গে রাতেও থাকবে। ওকে ? কিন্তু এখনও সন্ধ্যে ছ'টার পর ত্রিসীমানায় কাউকে দেখা যায় না। বিকেল ৫.৫০ এ শেষ ট্রেন রাঁচি-চন্দ্রপুরা-ধানবাদ প্যাসেঞ্জার ছেড়ে গেলে সারারাত স্টেশন ফাঁকা পড়ে থাকে।
- তবে ওই কথাই রইল। কাল ১২টায় লাঞ্চ সেরে রওনা দেব। কারণ দুপুরবেলাটাও ওখানে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সে সময়ও কোন লোকজন প্রায় থাকে না বললেই চলে। কারণ নাকি একটি আদিবাসী পরিবার তাদের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যাচ্ছিল ওই স্টেশন সংলগ্ন রেললাইন পেরিয়ে। কোন দিকেই কোন ট্রেন বা ইঞ্জিন বা মালগাড়ি আসছিল না। হঠাৎ জোড়া লাইন ডিঙিয়ে যেতেই নাকি একটা এক্সপ্রেস ট্রেন এসে ওদের সবাইকে পিষে দিয়ে চলে যায় । অথচ রেলের খাতায় সেই সময় কোন শকটযান ওই পথ দিয়ে যায়নি বলে কথিত।
বাগাড়িয়া বললেন - এ তো বড় অদ্ভুত ঘটনা হে মদন। কি করবে ভেবে বল।
সুকুমার প্রধান খেকিয়ে উঠলেন - তোর এই আলটপকা কথাবার্তা ভাল লাগে না হরিয়া। সাহস জোগাবি কোথায় - না আরও ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছিস। এবার চুপ কর । এমন জানলে তোকে বাদ দিয়ে দিতাম ।
বাগাড়িয়া আবার গলত বাত বলে ফেলেছে ভেবে চুপ করে গেল ।
রাত হয়েছে। প্রায় দুপুর রাত । আর বেশি কথা না বলে যে যার নির্দিষ্ট বিছানায় শুয়ে পড়ল । একটা রুমে ওরা চারবন্ধু - মদনমোহন, কমলসাধন, সুকুমার , বাগাড়িয়া। আর সায়ন্তিকা চলে গেল পবিত্রবাবুর স্ত্রীর রুমে। পবিত্র কমলের পাশে শুয়ে পড়লেন ।
( চলবে )

