STORYMIRROR

Manab Mondal

Abstract Tragedy

4  

Manab Mondal

Abstract Tragedy

পনে পাওয়া ধান জমি

পনে পাওয়া ধান জমি

6 mins
247

জোছনায় স্নান করে ধানক্ষেতটা সতেজ আর আরো সুন্দরী হয়ে গেছে। হালকা হালকা হাওয়ায় মাথা দুলিয়ে জানান দিচ্ছে তারা কত খুশি। খুব খুশি আমিও । অনেক ধান হয়েছে। গতবছর হয়েছিল। কিন্তু কারা যেন রাতের বেলায় এসে আমার ধান নষ্ট করে দিয়েছে। এ বছর হয়তো লাভের মুখ দেখবো। শহর থেকে এসে ধান চাষ করে লাভবান হওয়া সহজ কথা নয়। তবু স্বপ্ন দেখছি। যদিও আমি আর আমার ইউনিভার্সিটির কিছু বন্ধু স্বপ্ন দেখতাম দিনবদলের। নীলবিদ্রোহ থেকে সিঙ্গুর জমি আন্দোলন সবতো এই জমিকে ঘিরে। আমরাও তাই গ্রামে গ্রামে ঘুরতাম ,এই কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করে,এই দুনিয়ার ভিত কাঁপিয়ে দিতে পারবো এই ভাবনা নিয়ে।

বাংলার জীবনকে দেখে বুঝতে পেরেছিলাম, বাংলার ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির সাথে জড়িত এই ধানচাষ। নবজাতককে তরল থেকে স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাসে নিয়ে আসার সময় তাকে সেদ্ধ ভাত খাইয়ে অন্নপ্রাশন-এর আয়োজন একেবারেই বাঙালি সংস্কৃতি। ধান এবং দূর্বা ঘাস দিয়ে বাবা-মা আশীর্বাদ করার পরেই যে কোনও বিবাহ অনুষ্ঠান শুরু হয়। মৃত্যুর পরেও শ্মশান অবধি খই ছড়াতে ছড়াতে যাওয়া হয়। বাংলা সাহিত্যেও ধান ও ধানক্ষেতের সৌন্দর্য্য নিয়ে বহু ছড়া, কবিতা, গান লেখা হয়েছে। এভাবেই ধান বাঙালি জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ধানক্ষেত।



খ্রিস্টপূর্ব ১১,৫০০ থেকে ৬২০০ অব্দের মধ্যে চীনে ধান উৎপাদন শুরু হয় প্রথম। তার পর পরই ভারতে ।প্রত্নতাত্ত্বিকদের গবেষণা অনুযায়ী, খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০ অব্দ থেকে ধান চাষ বঙ্গ জীবনের অঙ্গ। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী অবিভক্ত বাংলায় প্রায় ৫০০০ রকমের ধান উৎপন্ন হত এক সময়।আধুনিক প্রজাতির ধানের আগ্রাসনে এখনও যদিও সব রকমের পুরনো ধানকে উচ্ছেদ করা যায়নি। এখনও ৪৭২ রকমের পুরনো আমলের ধান পাওয়া যায়। বর্ষার সময়ে এই সব ধান চাষ করা যায় রাসয়নিক সার কিটনাশক ছাড়াই। বাজারে থেকে কিনতে হয়না এর বীজ।

বাংলাদেশের এক পত্রিকায় পড়েছিলাম। ২০০৯-১০ সালে প্রায় ৩০ হাজার টন ধানের হাইব্রিড বীজ ব্যবহার হয়েছে। সেচের জলের উত্তোলনের জন্য ও দেশে কৃষকদের প্রতি বছর প্রায় ৮০ কোটি লিটার ডিজেল কিনতে হচ্ছে। এই সঙ্গে ব্যবহার করতে হচ্ছে বিদ্যুৎ। সাধারণ হিসাবে কৃষকদের কমবেশি ২৫ হাজার কোটি টাকার সার, ১ হাজার কোটি টাকার কীটনাশক, ৬ হাজার কোটি টাকার ডিজেল এবং ৫ শ’ কোটি টাকার নতুন জাতের ও ৬ শ’ কোটি টাকার হাইব্রিড ধানের বীজ কিনতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে কৃষকদের বছরে ৩৩ হাজার কোটি টাকার কৃষি উপকরণ ব্যবহার করতে হচ্ছে। কৃষিকাজ যত খরচ বেড়েছে ততোটা আয় বড়েনি কিন্তু হয়তো উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু অর্থনীতি তো বলেই যোগান বাড়লে দাম কমে।

ধানের দু’টি দূর সম্পর্কীয় জাতের পরাগমিলনে উদ্ভুত প্রজনিত প্রথম পুরষটির নাম হাইব্রিড ধান। সহজ কথায় হাইব্রিড ধান দু’টি জাতের প্রথম অপত্য বংশধর। উচ্চফলনশীল বা হাই ইল্ডিং ধানগুলিও দু’টি জাতের সংকরীকরণের মাধ্যমে উদ্ভুত। তবে এই জাতগুলি পিতৃপুরুষের ষষ্ঠ/সপ্তম/অষ্টম অপত্য বংশধর। ১৯২৬ সালে বিজ্ঞানী জোনস দেখেছিলেন দু’টি মানানসই ধানের যৌন মিলনে উদ্ভুত প্রথম অপত্য বংশধরটির ফলনক্ষমতা পরবর্তী বংশধরদের ফলনক্ষমতা অপেক্ষা বহু গুণ বেশি হয়। কিন্তু এই হাইব্রিড ধান আজ যেনো একটা ফাঁদ। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত সার ও পাম্প কেনার জন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হয়। ওদিকে ভূগর্ভস্থ জল সেচ দিয়ে উচ্চ ফলনশীলধান চাষআবাদেও কৃষকরা উৎসাহিত হতে থাকেন সরকারে ।এভাবে দেশে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। কিন্তু কৃষকের হাল বদলায় না।এ সব কাজকর্মের ফলে দেশে ধানের উৎপাদন বেড়েছে ঠিকই, তবে কৃষকরা আটকা পড়েছেন তিনটি ফাঁদে। এরপর থেকে তারা বীজ, সার ও সেচের জন্য অন্যের মর্জির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন। এগুলোর সরবরাহে কোন সমস্যা হলে বা এগুলোর দাম বেড়ে গেলে চাষাবাদের কাজই বন্ধ হওয়ার দশা হয়।



ইউনিভার্সিটি পড়ার সময় থেকেই আমি আর বন্ধুরা জৈব সার ব্যবহার পক্ষে, কিটনাশক ব্যবহারে বিরুদ্ধে কাজ অনেক সভা , প্রচার করেছি। কিন্তু কাজে দেয়নি। পরে বুঝতে পেরেছি হাইব্রিড ধান চাষ হয়তো আমদের আসল শত্রু।পরে তাই নিজে চাষ করতে এলাম এই গ্রামে। নিজেকে উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে । গ্রামের সাদা সিধে মানুষ গুলো আমার বন্ধু। কিন্তু শত্রুর অভাব নাই। কারণ আমার সবচেয়ে বড় শত্রু তো সিস্টেম। তাই রাত জেগে পাহারা দিতে হচ্ছে এই ধানক্ষেত আমাকে।

হঠাৎ চমকে গেলাম । মাথায় কে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তাকিয়ে দেখি সুন্দরী। সুন্দরী নাম হলেও ও কিন্তু সুন্দরী নয়। হি হি করে হেঁসে বছর ষোলোর সুন্দরী বলে উঠলো -"ভয় পেয়ে গেছিস নাকি শহুরে বাবু"

আমি বললাম - " না, কিন্তু এই রাত বিরাতে ঘুরে বাড়াতে তোর ভয় করে না।"

কেমন একটা উদাস হয়ে বলল " ভুতের ভয় আমি পাই না আর। মানুষদের ভয় পাই। কিন্তু তুই ভালো মানুষ তাই তোকে আমি ভয় পাই না।"

ও কেউ না থাকলেই মাঝে মাঝে গল্প করতে আসে আমার সাথে। উপকার পেয়েছি ওর থেকে। পিসির বাড়িতে মাত্র দুটো ঘর।ছেলে মেয়েদের পড়ানোর জায়গা খুঁজছিলাম, তখন ও আমাকে হারান ঠাকুরের ঠিকানাটা দিয়েছিলো। দালালি হিসেবে কিছু টাকা দিতে চেয়েছিলাম, নেয় নি। বলেছিল সময় হলে ও চেয়ে নেবে অন্য কিছু। ও মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর কতো গল্প বলছে এ গ্রামের। আমার বেশ ভালোই লাগছে।

গ্রাম মানুষের গল্প কথা অন্ধবিশ্বাস আমাদের অনেক সময় লাভবান করে। এই জমিটা কিনেছি সস্তা দরে। এবং আসে পাশের জমি গুলো আমি অনেক জলে দরে বিক্রি করবে বলছে অনেকেই। এ জমিতে ভুত আছে কিনা জানিনা, তবে NRC CAA নিয়ে এ অঞ্চলের মুসলিমরা ভুত দেখছে। সবার ধারণা এ দেশ থেকে হয়তো‌ ওদের উচ্ছেদ হতে হবে।

আমার এখনো অনেক জমি দরকার। আমি কীটনাশক ব্যবহার করি না। তাই আমার জমিতে রাতারাতি মৌমাছি চলে আসবে, পোকা খাওয়া জন্য ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি, ব্যাঙ চলে আসবে এমনটা তো নয়। তাই আমার অনেক জমি দরকার। কারণ আমি চাষবাস নিয়ে একটা অন্যরকম পরিকল্পনা করেছি। জমির চারি দিকে পরিখা কাটবো , সাই মাটিতে চওড়া করবো আল, আলে সবজি চাষের সাথে সাথে কিছু বড়ো গাছ পুতবো। ঐ গাছে যাতে নিরাপদে মৌমাছিরা মৌচাক করতে পারে, পাখিরা করতে পারে বাসা। আর কিছু খেজুর গাছ পুতলে গুড় পাওয়া যাবে। পরিখা তে চাষ হবে মাছ আর ব্যাঙ । যা আমার জমির ক্ষতি কর পোকা মাকড় খেয়ে। সাফ করে দেবে।



সুন্দরী হঠাৎ করে বললো " সাত পাঁচ না ভেবে তুই শ্যামলী কে বিয়ে করে নে। তোর ভালো হবে। আর আমাকে তোর উপকার করা হয়ে যাবে"

বলে ও হারিয়ে গেলো কুয়াশা র অন্ধকারে।

বাবা মা আমার জীবনের ব্যাপারে নাক গলায় না আর । কিন্তু আত্মীয় স্বজন আমাকে ছাড়বে কেন। আমার বিয়ে নিয়ে তাদের উৎসাহের অন্ত নেই। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছি কেউ বলতে পারে না। কারণ বিদেশে চাকরি করেই যে টাকা রোজগার করেছি। তাই দিয়ে আমি এই সব পাগলামি করছি। তাই এই পাগলামো থামাতে বিয়ে দিতে চায় ওরা। চাষবাস ছাড়া কি ঐ শহরটা চলতে পারে। তবু এ দেশ চাষবাস নাকি শুধু গরীব দুঃখী মানুষের কাজ। যাইহোক মাছির মতো ঘ্যান ঘ্যান করছিলো অনেক দিন ধরে পিসা মশাই। পন টনের আমি ঘোর বিরোধী। কিন্তু কোথাও যেন একটা লোভ আমারও কাজ করলো। শ্যামলী গ্রামের পড়াশোনা জানা শিক্ষিত মেয়ে। চাষবাস কাজ এ সাহায্য করতে পারবে। তাছাড়া আমার জমির পাশেই ওদের বড় দুই টো চাষের জমি আছে। ওটা আমার হয়ে যাবে ওকে বিয়ে করলেই। কারণ ওর কোন ভাই বোন নেই।

মেয়েরা কি আলু পটল মুলো, যে তাদের দেখতে যেতে হবে , পছন্দ করতে হবে। তবু যেতে হলো। একদিনে তুমি তো সমাজ বদলাতে পারো না।ঘরে বসে থাকতে থাকতে এদিকে ওদিকে দেখতে চমকে উঠলাম আমি। শ্যামলীর ছোট বেলার একটি ছবি। ওকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে ষোল সাতরো বছরের সুন্দরী। ওর মা চোখের জলে বললো সাথে বললো বছর দশেক আগে । স্কুলে থেকে বাড়ি ফিরে নি সুন্দরী। পরেরদিন সকালে আমারই ধানক্ষেতে ওর ধর্ষীত লাশ পাওয়া গেছিলো।

কাকতাড়ুয়া দেখেছেন, সুন্দরী চেহারাটা ঐ রকম। যৌবনের কোন আকর্ষন চিহ্ন নেই ওর শরীরে। সরকার বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে মেয়েদের শিক্ষিত করতে চাইছে। কিন্তু এ গ্রামে এসে দেখেছি উচ্চ শিক্ষার প্রতি মেয়েদের কোন আগ্রহ নেই এদের। এখানে কন্যাশ্রী পাওয়া টাকায় মেয়ে বিয়ে হয়, সবুজ সাথীর পাওয়া সাইকেলটাও ছেলে পন হিসেবে দেওয়া হচ্ছে জামাইকে। এ নিয়ে মাঝে মাঝে তর্ক বিতর্ক বাঁধে গ্রামের মোড়লদের সাথে।

আজ ওই মৌলভী সাহেব দাড়ি ধরে টেনে সুন্দরীর ছবিটা দেখতে ইচ্ছে করছিলো। যে কয়েক দিন আগে বলছিলো -" মেয়ে মানুষের অতো পড়াশোনা দরকার কি? এই ধানক্ষেত এর মতো মেয়েমানুষ। বাচ্চা পড়বে আর মানুষ করবে, স্বামীর সেবা করবে। এই আজ এতো ধর্ষণ বেড়েছে তার কারণ কি? বোরখায় আড়াল থেকে বেরিয়ে মেয়েরা এখন বিকিনি পরে নাচবে , তো ধর্ষণ হবে না।"

কিন্তু সুন্দরীরা তো খোলামেলা পোশাক পরে না। টাইট পোশাক পরে নিজের যৌবনকে মেলে ধরে না, সবার সামনে তবু কেন ধর্ষিত হয়ে পড়ে থাকে এই ধানক্ষেত-এ ,,,,,




,,,,,,,,


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract