Aparna Chaudhuri

Comedy Classics Inspirational

4  

Aparna Chaudhuri

Comedy Classics Inspirational

পদ্ম

পদ্ম

5 mins
322



মানুষের বুদ্ধির সঙ্গে যে শিক্ষার কোনও সমানুপাতিক সম্বন্ধ নেই, এ প্রমাণ আমি বহুবার পেয়েছি। ছোটবেলা থেকেই আমার ঠাকুমাকে দেখেছি যে কোনও সমাস্যার সমাধান খুব সহজেই করতে পারতেন। অথচ মাত্র তের বছর বয়সে ওনার বিয়ে হয়ে যায় এবং প্রথাগত শিক্ষারও ওখানেই ইতি।

আমাদের বাড়ীতে একটি ছেলে আসতো তার নাম হারু। পাশের বস্তিতে থাকতো। কোনদিন স্কুলে যায় নি কিন্তু যেকোনো কাজ ওকে দিয়ে করানো যেত। সে বাগানে বেড়া দেওয়া হোক বা বাড়ীর ফিউজ ঠিক করা হোক। একবার একটা পুরনো ছবির ফ্রেম ও কাঁচ ভেঙ্গে যাওয়াতে ওকে ডেকে দেখালাম, বলল, ”ঠিক আছে দিদি দেখি।“

পরেরদিন সেটা ঠিক করে এনে দিল। আমি বললাম ,” তুই কি এই কাজটাও জানিস?”

হেসে বলল,” জানতাম না ...... শিখে নিলাম। ভগ্যিস তুমি এই কাজটা দিলে।“

পদ্ম আমাদের বাড়ী কাজে আসে বছর দুয়েক আগে। বয়স পঞ্চান্ন থেকে ষাটের মধ্যে। বিধবা মানুষ। ছেলে মেয়েরা আছে কিন্তু তারা ওর খুব কাছের নয়। বিশেষ করে ছেলের বৌয়ের সাথে খুব একটা বনিবনা নেই।

এসে আমাদের বাড়ীর সকলের সাথে ওর বেশ ভাব হয়ে গেল। ওর কতক গুলো গুণ সকলকে আকর্ষিত করে। এক সর্বদা হাসি মুখ আর অনলস পরিশ্রম করবার ক্ষমতা ।

কাজে যে খুব ভালো তা বলতে পারিনা। কিন্তু শিখে নেবার ক্ষমতা অসাধারণ। কিছুদিনের মধ্যেই পদ্ম আমাদের বাড়ীর অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে গেল।

একটা মজার ব্যাপার হল, যে করে, কাজ তার কাছেই আসে। কাজেই এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। কিন্তু পদ্ম তার স্বভাব সিদ্ধ ভাবে নিজের কর্তব্যের বাইরের কাজগুলিও হাসি মুখে করতে লাগলো।

তার ফল যে সবসময় ভালো হত তা নয় ।

“পাটিসাপটা গুলো তিনটে টিফিনবাক্সোয় সমান ভাবে ভাগ করে রেখো।“ বলে নিশ্চিন্ত হয়েছিল সবাই।

কিন্তু বিকাল বেলায় ভাগবাটোয়ারার বহর দেখে সবার চক্ষু চড়কগাছ। তখন জানা গেল যে পদ্ম একেবারেই গুনতে জানে না । দশ অবধি হাতের আঙুল দিয়ে গুনতে পারে। কিন্তু তার পরেই ......।

কিন্তু আশ্চর্যভাবে ঘড়ি দেখতে পারে মোটামুটি ঠিক ঠাক।

পদ্মর যে উপস্থিত বুদ্ধি আছে তার প্রমাণ আমরা অনেক বার পেয়েছি।

একবার বাড়ীতে কেউ নেই, এমন সময় একটা কুরিয়ার এসেছে। ও ফোন করে আমাদের জানালো সে কথা। আমরা সবাই এতদূরে যে বাড়ী ফিরতে অনেক সময় লেগে যাবে।

“ পদ্ম কোনও রকমে ম্যানেজ করে কুরিয়ারটা রেখে দাও না। “

“ আচ্ছা দেকতিচি......” বলে পদ্ম ফোন রেখে দিল।

বাড়ী এসে দেখলাম কুরিয়ারের খামটা রাখা রয়েছে টেবিলের ওপর। কার্যসিদ্ধি হয়ে যাবার পর কি ভাবে কাজটা হল সে আর কে জানতে চায়? তাই ব্যাঙ্কের ডেবিট কার্ডএর মত একটা ডকুমেন্ট পদ্ম কিভাবে পেলো সেটা জানার আমরা আর চেষ্টাই করলাম না।

আমাদের অন্যমনস্ক ভাবে ছুড়ে দেওয়া ধন্যবাদে ও যেন বর্তে যেত।

যারা ছোট শহরে থাকেন তারা জানেন যে এখানে সবার সঙ্গে সবার একটা পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। বড় শহরে যেটা হয়তো হয় না। এখানে দুধওয়ালা, পেপারওয়ালা, কাচড়াওয়ালা, পোস্টম্যান সবাই ভাইয়া, চাচা ইত্যাদি সম্পর্কে বাঁধা। সেই সম্পর্কের জোরে এরা কখনো অভিমান করে, কখনো আবদার করে আবার বললে একটা আধটা এক্সট্রা কাজও করে দেয়।

সপ্তাহ খানেক বাদে আমাদের পোস্টম্যান চাচা আবার এলো আমাদের বাড়ী, অন্য একটা চিঠি নিয়ে।

যেহেতু আমি বাড়ী ছিলাম তাই আমিই চিঠিটা নিতে গেলাম। প্রচণ্ড রোদে সাইকেলে করে এসে আমাদের দরজার সামনে সিঁড়ির ওপর বসে পড়েছে চাচা,”এক গ্লাস পানি...”

আমি পদ্মকে একগ্লাস জল আনতে বললাম। জলটা ঢকঢক করে খেয়ে নিয়ে গ্লাসটা পদ্মর হাতে দিয়ে চাচা বলল,“ আপ কিউ আয়ে বিবিজি। লাছমি হি লে লেতি।“

আমি একটু থতমত খেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “ লাছমি কউন?”

“ ইয়েহি লাছমি । পিছলি বার ইসেহি তো চিঠি দেকে গয়া থা। অচ্ছি পড়হি লিকখি হ্যাঁয় উও। বঙ্গালি মে সাইন করকে চিঠি লিয়া উসনে।“

আমি আর বেশী কথা না বাড়িয়ে চিঠিটা নিয়ে ভিতরে চলে এলাম। দেখলাম পদ্ম মিটি মিটি হাসছে।

“ কি ব্যাপার বলত? তুমি লেখাপড়া জানো সেটা তো আমার জানা ছিল না। আর তুমি লক্ষ্মীই বা হলে কি করে?”

বলতেই হেসে গড়িয়ে পড়লো পদ্ম,” কি করব বৌদি অনেকবার ওকে আমার নাম বললাম, কিন্তু ও কিছুতেই বুঝতে পারলো না। তখন বললাম আমার নাম লক্ষ্মী। ও সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেল। আমায় বলল সই না করলে চিঠি দেবে না। তাই আমি পেনটা নিয়ে বেশ করে খানিকটা গোলগোল করে আঁকিবুঁকি কেটে দিলুম। ব্যাটা আবার জিজ্ঞাসা করে এটা কি? আমি বললাম বাংলায় নাম লিখেছি।“

ইদানিং পদ্মর টিভি দেখার প্রবণতা বেশ বেড়েছে। এই কথাটা শুনে যে কোনও লোক বলবে এ আবার নতুন কথা কি? বাড়ীর কাজের লোকেরা তো মালকিনদের সঙ্গে জমিয়ে বসে বাংলা সিরিয়াল দেখে। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। আমাদের বাড়ীতে কেবল টিভি কানেকশন নেই।

যদি দেখার হয় তাহলে আমরা মোবাইল থেকে টিভিতে খবর চালাই আর কখনো ইচ্ছা হলে আমার ছেলে ইংরাজি সিনেমা দেখে।

সেদিন আমার ছেলে হাসতে হাসতে এসে আমাকে বলল, ” জানো মা পদ্ম দিদি আমার পিছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইন্দিয়ানা জোন্স অ্যান্ড দ্য ক্রিস্টাল স্কাল দেখছিল।“

আমি ওকে বকে দিলাম, ” ছি বাবাই একটু দেখেছে তো কি হয়েছে? ও বেচারি সারাদিন এই বাড়ীটার মধ্যে বন্দী।“

বকলাম ঠিকই, কিন্তু ব্যাপারটা আমারও যে একটু অবাক লাগেনি তা নয়।

ছেলের বৌয়ের সাথে যতই ঝগড়া থাক না কেন নাতি পুতিদের সঙ্গে পদ্মর বেশ দহরম । তারা রোজ ফোন করে ওর সাথে গল্প করে। আর পদ্ম ফোনে এতো জোরে জোরে তাদের সাথে কথা বলে যে মাঝে মাঝে মনে হয় বেকারই ওই যন্ত্রটার সাহায্য নিচ্ছে। খালি গলাতেই ওর আওয়াজ ওর দেশের বাড়ী পৌঁছে যেত।

সেদিন দুপুর বেলায় পদ্মর ঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে শুনলাম ও ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে, ” হ্যাঁ সেই গপ্পটা বাকি আচে না? টা কদ্দুর বলেচিলুম বল দেকি?”

“....... “

“ ও হ্যাঁ মনে পড়েছে। তারপর এই এতো এতো পিমড়ে বুঝলি মাটির তলা থেকে বেইরে এসে সেই বদমাশ গুলোকে একেবারে ছেঁকে ধরল। আর এই ভালো নোকগুলোর কাচে তো সেই যে কাঁচের তৈরি মড়ার মাতাটা ছেল। সেই মাতাটাকে দেকে পিমড়েগুলো আর ওদের ধার কাচে ঘেঁষলো নি। আর ব্যাস ওরা পাইলে গেলো।“

আমি এই পর্যন্ত শুনে নিজের কাজে চলে গেলাম। মিনিট পাঁচেক পরে যখন ফিরছি তখনও গল্প চলছে। বর্ণনা শুনে বুঝলাম ইন্ডিয়ানা জোন্স অ্যান্ড দ ক্রিস্টাল স্কাল ছবির প্রায় শেষের দিকের বর্ণনা চলছে। আমাকে দেখে লজ্জা পেয়ে গেল পদ্ম। তাড়াতাড়ি বলে উঠলো,” আজ এই পজ্জন্তই থাক। একন আমার অনেক কাজ, বাকিটা আবার কাল বলব’খন। “

“............”

“ নক্কি বাপ আমার। আজ আর না, কাল ঠিক বলব।“

“...............”

“ কাল এই সময় ফোন করিস কেমন?” আমার দিকে একটা লাজুক হাসি ছুঁড়ে দিয়ে পদ্ম ফোনটা রেখে দিল।

আমি ফোনের ওদিকের কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু আন্দাজ করতে পারছিলাম। গল্পের আকর্ষণ চিরকালীন । সেই আরব্য রজনীর সুলতান বা পদ্মের নাতি নাতনিরা, সবাই গল্পের কাঙাল। আর সেই গল্প যদি বারবার শোনা পুরনো রাজারানির গল্প না হয়ে হয় নতুন ব্লক বাস্‌টার সিনেমার গল্প, তা হলে তো কথাই নেই। পদ্ম তার সহজাত বুদ্ধিতে খুব সহজ একটা সমাধান খুঁজে বার করে নিয়েছে এই খুদেগুলোর মন জয় করার। ভাষা না বুঝলেও দেখা ছবির সঙ্গে নিজের কল্পনা মিলিয়ে যে গল্পটা সে শোনায় তা ওর নাতি নাতনিদের যে মাতিয়ে রাখে সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।

আমি অবাক হয়ে ভাবলাম , সত্যি সম্পর্ক বজায় রাখতেও বুদ্ধি লাগে। আজ পদ্ম আমাকে সেটা শেখাল।



Rate this content
Log in