Pronab Das

Tragedy

3.7  

Pronab Das

Tragedy

পাশ ফেল ।

পাশ ফেল ।

5 mins
811


 মতিউর রহমান দক্ষিণ কলকাতায় টানা রিকশা চালায় । বয়স সঠিক জানা নেই , তবে মনে হয় ষাট ছুঁই ছুঁই। জন্ম বিহারে। সেই কোন ছোট্ট বেলায় এখানে এসেছে ঠাওর করতে পারে না। কেউ তাকে তার দেশের কথা জিজ্ঞেস করলে মনের মধ্যে ছেড়া ছেড়া, ভাসা ভাসা কয়েকটি ছবি আর ঘোলাটে কিছু ঘটনা ফুটে উঠে মিলিয়ে যায়। মাঝে মাঝে অবসরে সেগুলোকে জোড়া লাগানোর বৃথা চেষ্টা করে। বাবা, মা, কাকা, কাকিমা,পাঁচ ভাইবোন, দাদু দিদিমা সবাই ছিল। একটা সুখী যৌথ পরিবারে মতিউর সব থেকে ছোট সদস্য। 


        সেবার একটানা পাঁচ - ছদিন খুব বৃষ্টি হল। পাশের খরস্রোতা নদী বৃষ্টির জল পেয়ে ভয়াল ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করল। নদীর জল ধীরে ধীরে গ্রামে প্রবেশ করে একসময় নদীর পাশ্ববর্তী দশ-বারটি গ্রাম গ্রাস করে ফেলে। মাঝরাতের কোন এক সময়ে নদীর জল উঠোন ছাপিয়ে ঘরে প্রবেশ করে । ঘরের মধ্যে হুলুস্থুলু পরে যায়। প্রদীপের টিমটিমে আলোয় আর কালীপরা লণ্ঠনের আলোতে কিছু কাপড়, চাল, কয়েকটা বাসন নিয়ে সবাই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। ছোট্ট মতিউর তখন ছিল বাবার কোলে, ঘুমিয়ে। হটাৎ পায়ে জল লাগতেই জেগে যায়। দেখে গ্রামের প্রায় সকলেই এক কোমর জল নিয়ে কোন নিরাপদ জায়গায় যেতে ব্যাস্ত। এখন ব্যাপার টা বুঝতে পারলেও সেই শিশুমনে কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি কি ঘটে চলেছে বা কি ঘটতে চলেছে। কারো হাতে হারিকেনের লণ্ঠন, কেউ কেউ হাতে মশাল নিয়েছে। সবাই একই দিকে জল ঠেঙিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। কিছু দূর এগোনোর পর সবাই কেমন যেন থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কান পেতে সকলে কি যেন শোনার চেষ্টা করছে। একটা সো সো শব্দ শিশু মতিউরের কানে এল। সে বাবার কাঁধে বসে ঘাড়ের দুপাশে দু পা দিয়ে চুলের মুঠি ধরে খেলছে আনন্দে। এক পা এগিয়েই বাবা দাঁড়িয়ে পড়ল, দু হাতে শক্ত করে কব্জি চেপে ধরল। কচি কব্জিতে চাপ ক্রমশ বাড়তে লাগল। ব্যাথায় তারস্বরে কেঁদে উঠল ছোট্ট মতিউর । হঠাৎই নদী বাঁধ ভেঙে একটা বড় জলের ঢেউ এসে সব্বাইকে ছিটকে ফেলে দিল। তারপর শুধুই অন্ধকার,.....…. আর কিছু মনে নেই। শৈশব কেটেছে সমস্তিপুরের এক হোটেল মালিকের তত্ত্বাবধানে। হোটেলে কাজের বিনিময়ে খাওয়া মিলত। সেখান থেকে পালিয়ে হাওড়া স্টেশন। জীবন যুধ্যে অনেক ঘাত প্রতিঘাতের পর সে আজ কলকাতা শহরের একজন টানা রিকশাচালক।


   

      বুকটা ধড়াস ধড়াস করতে করতে ঘুমটা ভেঙে যায় মতিউরের। ভরদুপুরে আসক্ত শরীরটা কখন যে কাত করা টানা রিক্সার ওপরে ঘুমিয়ে পরেছিল খেয়াল নেই। কোমর থেকে গামছাটা খুলে মুখটা মুছে নেয়। তেষ্টাও পেয়েছে খুব। পাশের চাপ কল থেকে অনেকটা জল খেয়ে রিকশা নিয়ে ধীরে ধীরে প্রাইমারি স্কুলের দিকে এগিয়ে চলে। প্যাসেঞ্জার না থাকলে ওই স্কুলের চার-পাঁচটা বাচ্চাকে বিনেপয়সায় কখনো স্কুলে পৌছে দেয়, কখনো স্কুল থেকে বাড়ীর কাছে পৌঁছে দেয়। আজ পর্যন্ত কত বাচ্চাকে সে তার টানা রিকশায় চড়িয়ে পৌঁছে দিয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। অনেক বাচ্চা আবার তার প্রিয় চাচাকে এটা সেটা উপহার দেয়। পরম স্নেহে মতিউর সেগুলিকে আগলে রাখে, ব্যবহার করে না। চলতে চলতে গল্প করে, খোঁজ নেয় স্কুলে কি পড়া হল, আরও কত কি। বলা বাহুল্য এই কাজে মতিউর একটা মানসিক আনন্দ অনুভব করে। এই বাচ্চাদের কাছ থেকেই মতিউর প্রথম তার নামের বানান শিখেছে। স্কুলে তার পড়া হয়নি, ইচ্ছে ছিল। ছোট ছোট বাচ্চারাও মতিউর চাচাকে খুব ভালবাসে, ওদের মধ্যেই নিজের হারিয়ে যাওয়া শৈশবকে খোঁজার চেষ্টা করে। 


    --- হ্যা রে রাজু, আজ ইসকুলে নতুন কি শিখলি? মতিউর রিক্সা টানতে টানতে জিজ্ঞেস করে।


 পাশ থেকে করিম হি হি করে হাসতে হাসতে বলে,....


   ---জান চাচা, আজ রাজু কানমলা খেয়েছে, জলের আর এক নাম জীবন সেটা ও বলতে পারে নি,.....হি…. হি…


শুনে মতিউর থমকে দাঁড়িয়ে পরে।


   যে জল তার জীবনটাকে তছনছ করে দিয়েছে। বাবা, মা, ভাই, বোনের থেকে দূরে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, সেই জল নাকি জীবন!!!.....হায় আল্লাহ।


    সহসা চোখ যায় রাস্তার ওপর একটা টাইম কলের দিকে। অঝোরে জল পড়ে যাচ্ছে। কেউ হয়ত বন্ধ করতে ভুলে গেছে। মতিউর রিকশার হাতল নামিয়ে এগিয়ে যায়। হাতবাড়িয়ে কলের চাবি বন্ধ করে।



     স্কুলের কাছেই কমলা পার্কের পেছনে একচিলতে ঘরে একাই থাকে। নোনাধরা পুরোন দিনের ওই ঘরটায় একটা ছোট তক্তপোষ আর কিছু বাসনপত্র, দড়িতে টানা কিছু জামা কাপড় আর একটা ভাঙা কাঠের আলমারী। ওই আলমারিতে মতিউর ওই বাচ্চাদের দেওয়া উপহার গুলি সযত্নে সাজিয়ে রেখেছে। এগুলোকে দেখলে তার সব দুঃখ কষ্ট বেদনা নিমেষেই মিলিয়ে যায়, মনে জোর পায়। যে ঘরটিতে সে থাকে সেটা কুতুব মিঞা র। রিকশা টাও তার। তিন কুলে ওর কেউ ছিলনা। মতিউরকে খুব স্নেহ করত। বৃদ্ধ, অসুস্থ কুতুব চাচার সেবা যত্ন করায় ইনাম স্বরূপ সেসব তাকে দান করে যায়। রিকশা টানার তামিল কুতুবমিঞা ই তাকে দিয়েছে। যতটুকু ভালবাসা মতিউর কুতুবমিঞার কাছ থেকে পেয়েছে তা সে আল্লাহর রহমত বলে মনে করে। 



সম্প্রতি ওই প্রাইমারি স্কুলের পাশে একটা নামি দামি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল তৈরি হয়েছে। এলাকার বিত্তশালী পরিবারের ছেলেমেয়েরা সেখানে স্কুলের হলদে রংয়ের ইয়া বড় বড় গাড়ি চড়ে পড়তে আসে। ওই একই সময় প্রাইমারি স্কুল শুরু হওয়ায় বাচ্চাদের হেটে স্কুলে যেতে অসুবিধে হয়। আজও ফেরার পথে মতিউর চার পাঁচটা ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের স্কুল থেকে তার টানা রিকশায় বসিয়ে নেয়। ওদের পাশ থেকে ইংলিশ মিডিয়ামের সেই হলদে মোটর গাড়িটি ছাত্র-ছাত্রী বোঝাই করে হুঁশ করে বেরিয়ে যেতেই পুচকি মেয়ে কাজল তার সহপাঠী কুন্তল কে বলে……


----জানিস কুন্তল, আমাদের স্কুলে যদি অমন মোটর গাড়ী থাকত! …..কি মজা হত বল!


----ওটা বড় লোকের স্কুল, আমাদের স্যারদের অত টাকা নেই।…তাই না মতি চাচা?.....কুন্তল মুখ বেকিয়ে হতাশায় উত্তর দেয়।


মতিউর তার রিক্সায় বসা ছোট্ট ছোট্ট ছেলে মেয়েদের কথোপকথন উপভোগ করতে করতে এগিয়ে চলে। হঠাৎই একটি বাঁকের কাছে রাস্তার ওপর পড়ে থাকা পেরেকের ওপর মতিউরের একটা নগ্ন পা পরতেই সে ব্যাথায় দাঁড়িয়ে পরে। ঠিক সেই মুহূর্তেই পাশের স্কুলের ছাত্র বোঝাই আরেকটি হলুদ মোটর গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সজোরে মতিউরকে ধাক্কা মেরে ছিটকে ফেলে দেয়।রিক্সায় বসা বাচ্চাদের কিছু না হলেও মতিউর বেশ ভাল রকম জখম হয়ে সঙ্কটজনক অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।


পরদিন স্কুলের হেডমাস্টার ও কয়েকজন পুরোন ছাত্র হাসপাতালে এসে মতিউরের সাথে দেখা করে। ওদের দেখে মতিউরের চোখ ছল ছল করে ওঠে। চিকিৎসকের সামনেই সে তার কোমরের ঘুনসি থেকে একটা ছোট চাবি বের করে হেড মাস্টারের হাতে দিয়ে বলে তার সারা জীবনের সঞ্চয় তার ঘরের একটা কাঠের আলমারিতে রাখা আছে। এবং এই টাকাটা স্কুলের স্কুল বাস এর জন্যে সঞ্চয় করে রেখেছিল। কয়েক দিনের মধ্যেই সে টাকাটা স্কুল কতৃপক্ষের হাতে তুলে দেবে বলে মনস্থির করেছিল। কিন্তু অদৃশ্যের কি পরিহাস …...বলেই সে কাঁদতে লাগল। 


 চিকিৎসকের সাথে দেখা করে তারা জানতে পারে মতিউর খুবই সংকট জনক অবস্থায় রয়েছে। যেকোন মুহুর্তে ভাল-মন্দ কিছু হয়ে যেতে পারে। সেই আশঙ্কাই সত্যি হল। ভোর রাতে মতিউর মারা যায়। 


জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া, ফেল করে যাওয়া মতিউর আজ স-সন্মানে পাশ করে গেল।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy