শিপ্রা চক্রবর্তী

Comedy Romance Others

3  

শিপ্রা চক্রবর্তী

Comedy Romance Others

পাকাদেখা

পাকাদেখা

7 mins
231



সকাল থেকেই বাড়িতে চিল.... চিৎকার, কাক..পক্ষীও বসতে পাড়বেনা!!! একেবারে হুলুশস্থুলুশ কান্ড। মা... ঘেমে নেয়ে পঞ্চব‍্যাঞ্জন রাঁধতে ব‍্যস্ত, বাবা সকাল বেলায় গ‍‍্যাঁটের কড়ি খরচ করে গাদা বাজার করে এনেছে, আর তার হিসাব করতে বসেছে ওমনি প্রেশার বেরে যাচ্ছে, তাই বারবার মাকে চা... করার নির্দেশ দিচ্ছে, আর এই নিয়ে গৃহযুদ্ধ লেগে গেছে। বুনি ঘর, বাড়ি সুন্দর... পরিপাটি করে সাজিয়ে তুলছে। আর আমি!! আমার বেডরুমে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছি।


ঘুম ভেঙ্গে গেছে অনেকক্ষন! কিন্তু উঠতে ইচ্ছে হচ্ছেনা। আসলে মন ভালো নেই, আজ আমাকে দেখতে আসবে পঁচিশ তম বার। আর প্রত‍্যেকবারই এই. একই রকম অবস্থা হয় আমাদের বাড়িতে! আসলে যারা দেখতে আসে তাদের ঠিক... আমার পছন্দ হয়না! ঐ. আগের বার দেখতে এসেছিল আমার বাবার পিসতুতো বোনের, মাসতুতো ননদের, জ‍্যেঠতুতো দাদার ছেলে!বাবা... মা... খুব খুশি, চেনা জানার মধ‍্যে, দূর সম্পর্কের হলেও! আত্মীয় তো... বটে! ভালো সরকারি চাকরিও করে, কিন্তু বিয়েতে বাঁধ সাধল পেট! আসলে ছেলেটার ইইয়া..... বড়...... গামলার মত পেট! তার সাথে নাদুস নুদুস চেহারা, আর যে.... ভাবে হামলে পড়ে মিষ্টি খাচ্ছিল আমার কেমন জানি লাগল, তাই বিয়েটা আর হলো না! মা.... তো খুব রেগে গেছিল আমার ওপর।

আসলে সবাই বলে আমার বড্ড বেশি নাক উঁচু...! তাই তো... স্কুল...কলেজ লাইফে প্রেম করতে পারলাম না...!সবার মধ‍্যেই কিছু না.... কিছু খুঁত নজরে পড়ত, ব‍্যাস আমার প্রেমের বারোটা বেজে যেত! তারপর বন্ধু...বান্ধবীদের দুদিনের প্রেম কাহিনী,তারপর ব্রেকাপ দেখে... দেখে আমি অসহ‍্য হয়ে উঠেছিলাম! তাই প্রেম করার নাম শুনলেই গায়ে যেন ফোসকা পড়ত আমার, এই সব নানা... কারনে আমার আর প্রেম করা হয়ে উঠলো না...!

আর এদিকে আমার বুনি প্রেম করতে ওস্তাদ, এমনকি নিজের বিয়ে নিজেই ঠিক করে ফেলেছে, নেহাত বড়দিদির বিয়ে হয়নি! তাই অপেক্ষায় আছে! মা... অবশ‍্য বলে দিয়েছে তোর দ্বারা যেমন প্রেমটা করা হয়নি! এবার মনে হচ্ছে বিয়েটাও করা হবেনা! এটাই লাস্ট, আর এই ছেলে দেখতে আসার হ‍্যাপা বাবা, নিতে পারছেনা! উফ কি... অসহ‍্য ব‍্যাপার! আমি কি করবো বলুন তো....?যাকে তাকে তো... আর বিয়ে করতে পারিনা? সারা জীবনের ব‍্যাপার!

হঠাৎ পিঠে প্রচন্ড জোড়ে একটা চড় খেলাম ধড়পড় করে উঠে দেখলাম আমার রনচন্ডী মা.... দাঁড়িয়ে আছে।


আমি বলে উঠলাম, উফ.... এই ভাবে কেউ ডাকে, একটু ভালোবেসে আদর করেও তো.... ডাকতে পারো, ধূর... ভাল্লাগেনা।

মা বিরক্তি নিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে ঘরটাকে গুছিয়ে ফ্রেস হয়ে সেজে গুজে নিচে চলে আয়, আমাকে যেন আর বলতে না.... হয় ! আর এর পরের বার বলতে হলে, একটা নয় গোটা কতক চড় পড়বে পিঠে।


আমি বললাম হুম....। আর মনে মনে বিড়বিড় করে উঠলাম, এই বিয়ের চক্করে জীবনটা আমার ভাজাভাজা হয়ে গেল, ধূর.... অসহ‍্য! শান্তি নেই! একরাশ বিরক্তি নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠতে যাবো কর্কশ স্বরে ফোনটা বেজে উঠল, হাতে নিয়ে দেখলাম রণো ফোন করেছে, সাথে সাথে মুখে হাসি ফুটে উঠল। এই একটা মানুষ যার সাথে প্রান, মন খুলে সমস্ত কথা বলা যায়। রণো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড সেই স্কুল লাইফ থেকে। আমি সময় নষ্ট না.... করে ফোনটা ধরে হ‍্যালো.... বললাম,

রণো বলে উঠল কিরে.... পেত্নী এখনও ঘুমাচ্ছিস!তোকে না.... আজকে দেখতে আসবে!


আমি বললাম দূর...দূর.. ঘুম আর হলো কোথায়! সকাল থেকে বাড়িতে যা.... কান্ড চলছে, আমার সাধের ঘুম আমাকে ছেড়ে পালিয়েছে, তা.... হনুমান তুই কি জন‍্য এখন ফোন করলি? তোর না.... আজকে পাত্রি দেখতে যাওয়ার কথা।

রণো বলে উঠল হ‍্যাঁ.... এইতো বেড়োচ্ছি, তাই তোকে একবার ফোন করে নিলাম। এই তুই আজকে একটা টুকটুকে লাল শাড়ি পড়বি, আর চুলটাকে ছেড়ে রাখবি, চোখে কাজল, কপালে ছোট টিপ, আর ঠোঁটে হাল্কা লিপস্টিক ব‍্যাস এতেই হবে, আর সাজতে হবেনা... তাতেই বিয়ে পাকা হয়ে যাবে দেখবি।

আমি বলে উঠলাম ধূর.... আমার মনে হয় আর বিয়ে হবেনা! কাউকে ঠিক পছন্দ হচ্ছেনা.... তবে তুই যাকে দেখতে যাচ্ছিস তার বাবার একটা ছবি পাঠাস!

রণো বলে উঠল বাবার ছবি দেখে কি... করবি?

আমি হাসতে হাসতে বললাম, দেখবো কোন বাবা তোর মত বাঁদড়ের গলায় মুক্তোর মালা.... দিচ্ছে।

রণো বলে উঠল ফটোতে নয়, একেবারে চোখের সামনে সেই মহান ব‍্যাক্তিকে দেখাব তোকে! একটু অপেক্ষা কর, আর আমার মনে হচ্ছে এবার যে..... দেখতে আসবে, তাকে তোর ঠিক... পছন্দ হবে !

-------আমি হো.... হো... করে হেসে উঠে বললাম, হনুমান তুই কি.... জ‍্যোতিষি হয়ে গেলি নাকি!ভবিষ্যত দেখছিস! বাঃ বাঃ এটা কিন্তু ভালো ব‍্যবসা!!!


রণো বলে উঠল চুপ কর পেত্নী, আর তাড়াতাড়ি যা.... রেডি হয়ে নে.... আমি ফোন রাখলাম, আমাকেও বেড়তে হবে....... বাই।


আমি বললাম হ‍্যাঁ... রাখ,আমার মাদার ইন্ডিয়া একবার হুমকি দিয়ে গেছে দেরী হলে আর রক্ষে নেই... বুঝলি, বাই... বাই।

ফেনটা রেখে দিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যাব ওমনি..বুনি হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল একটা শাড়ি নিয়ে। আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,এই নে... মা.... বলল এটা পড়তে, আর দেড়ি না করে তাড়াতাড়ি নিচে চলে আয়। তোর জন‍্য সকাল থেকে আমাকে খেটে খেটে মরতে হচ্ছে, এবারও যদি তোর পাত্র পছন্দ না.... হয় তাহলে আমি মাকে বলবো আমার বিয়েটা দিয়ে দিতে, তোর আর বিয়ে করে কাজ নেই.... আর তাছাড়া শুধু.... শুধু বারবার বাবার গ‍্যাঁটের কড়ি খরচ হচ্ছে,আর তাছাড়া তো.... কিছু কাজের কাজ হচ্ছেনা।


আমি ওকে তবে.. রে... বলে যেই.. মারতে যাব ওমনি ও.... দৌড়ে ঘর ছেড়ে পালালো।

যাক ওর পিছনে সময় নষ্ট না.... করে আমি ফ্রেস হয়ে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিলাম, রণো যেমন বলেছিল ঠিক সেই রকম ভাবে। কেন জানি না ইচ্ছে হল। নীচে থেকে ততক্ষনে হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে, মনে হচ্ছে সব দল বেঁধে চলে এসেছে। আমি বিরক্তি নিয়ে আয়নায় একবার নিজেকে এদিক.. ওদিক.. করে দেখে নিলাম সব ঠিক আছে কিনা, তারপর খাটে বসে মোবাইল টা নিয়ে নেট অন করলাম। হ‍্যোয়াটস অ‍্যাপ খুলে স্ট‍্যাটাস চেক করে দেখলাম রণো লাল কাজ করা পাঞ্জাবী পড়ে ছবি দিয়েছে এবং লিখেছে......


তুমি আমার প্রথম এবং শেষ প্রেম,

তোমার স্মৃতিতে রঙিন আমার হৃদয় আবেগের ফ্রেম।


আমি সাথে সাথে হার্ট রিয়‍্যাক্ট দিয়ে রিপ্লাই করে দিলাম। আর কিছু লেখার আগেই মা ডেকে উঠল, ওলি চল সবাই এসে গেছে। আমি দাঁড়িয়ে শাড়ি ঠিক করতে করতে মায়ের পিছন পিছন বাইরে বেড়িয়ে এলাম। কিন্তু এসে যা.... দেখলাম তাতে আমার চক্ষু চড়ক গাছ!!! পায়ের ওপর পা... তুলে সোফায় আমার বাবার পাশে বসে আছে রণো, আর কাকু কাকিমা মুখোমুখি বসে আছে, রণোর পাশে দাঁড়িয়ে আছে বুনি। আমার অবস্থা দেখে সবাই মুচকি মুচকি হাসছে।

কাকিমা আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল আয়..আমার পাশে বোস।

আমি চুপচাপ বাধ‍্য মেয়ের মত কাকিমার পাশে গিয়ে বসলাম, কি.... বলব! কি.... করব কিছুই বুঝতে পারছিনা!!! রণো ওর বাবা,মাকে নিয়ে এসেছে আমাকে দেখতে,উফ... কি... যে হচ্ছে! সব কেমন তাল গোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

কাকিমা আমার গায়ে হাত বুলিয়ে বলল, আমার মেয়ে খুব পছন্দ, কবে থেকে বসে আছি বউ করে ঘরে নিয়ে যাব বলে।

সাথে সাথে বাবা বলে উঠল, আমাদেরও জামাই হিসেবে রণোকে খুব পছন্দ, কথায় আছেনা...." বগল মে ছোড়া অর গলিমে ঢিনঢোরা " আমাদের সেই রকম অবস্থা হয়ে ছিল!!! হাতে এত ভালো পাত্র থাকতে কোথায় কোথায় খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম!!! সে যা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে.., এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চারহাত এক করতে পারলেই হলো।

---------আমি সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে বললাম, এই হনুমান কে....আমি বিয়ে করতে রাজি নই!!! এই বিয়ে হবে না। আর কথা না.... বাড়িয়ে গটগট করে বেডরুমে চলে গেলাম। আমার যাওয়া দেখে সবাই হো... হো... করে হেসে উঠল। রাগে আমার সর্বশরীর জ্বলছে। শাড়ির আঁচল আঙ্গুলে জড়িয়ে বেডরুম জুড়ে পায়চারি করতে লাগলাম। আর বিড়বিড় করে বলতে লাগলাম, ওর জন‍্য তখন ঢং... করে আমাকে এইভাবে সাজতে বললো, আর কি.... যেন বলল, এবার যে.... দেখতে আসবে তাকে, তোর ঠিক পছন্দ হবে।

---------পিছন থেকে রণো বলে উঠল, এইভাবে আমার গুষ্টির ষষ্ঠী পূজো না.... করে যা.... বলবি জোড়ে সোজাসুজি বল।

--------আমি রণোকে মারতে মারতে বললাম হনুমান, বাঁদড়, ছাগল, বজ্জাত ছেলে, তুই আমাকে বলিসনি কেন.... যে.... তুই দেখতে আসবি।

-----------রণো আমার মারের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে বেডরুম জুড়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে, আর আমিও ওর সাথে সাথে দৌড়াচ্ছি। বেশ কিছুক্ষন টম অ‍্যান্ড জেরির মত দৌড়াদৌড়ি করে হাঁফিয়ে ধপ করে বসে পড়লাম খাটে।

----------রণো আমার সামনে পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, দেখ.. আমি হ‍্যান্ডসাম হিরো... হিরো দেখতে, তারপর তোর বেস্টফ্রেন্ড, আমার থেকে তোকে ভালো কেউ চেনেনা, তাই বলছি এই রকম ভালো পাত্র হাতছাড়া করা কি..... ঠিক হবে!!!! আর আমি না... হয় একটু অ‍্যাডজাস্ট করে নেব... তোর মত শ‍্যাঁওড়া গাছের পেত্নীর সাথে!!!

---------আমি রণোর পিঠে দু... চারটে দুম দুম করে দিয়ে বললাম, হিরো....!!! কোথাকার হিরো... রে তুই???ঐ... তো... বাঁদড়ের মত তোর মুখ, তার আবার হিরো!!! আর কি.... বললি আমি পেত্নী, তুই যদি এই... চেহারায় হিরো হোস তাহলে আমি হিরোইনের থেকে কোন অংশে কম নয় হুহু....।

---------রণো হাসতে হাসতে বলল, তাহলে কি.... পাকাদেখা কমপ্লিট। তুই রাজিতো আমার হিরোইন হতে।

---------আমি ভাবার ভান করে বললাম, রাজি হতে পারি....!!! তবে আমার দুটো শর্ত আছে...!!

-------রণো বলল আবার কি.....শর্ত???

--------আমি বললাম প্রথম শর্ত, বিয়ের পরও আগের মতই প্রত‍্যেক রবিবার আমাকে নিয়ে ফুচকা খেতে যেতে হবে!!!

------রণো মুচকি হেসে বলল, আর... দ্বীতিয়???

----------আমার সব অত‍্যাচার মুখ বুজে সহ‍্য করতে হবে, এই বলে ওর চুলটা ভালো করে ঘেটে দিয়ে ছুট লাগালাম, আর রণো আমার পিছন পিছন চিৎকার করে বলতে লাগল....

--------এই পেত্নী.... দাঁড়া,একবার তোকে ধরি তারপর তোর মজা দেখাচ্ছি আমি!!! সব সময় আমার চুলের পিছনে পড়ে থাকিস, আমার চুলটাকে নষ্ট না.... করলে তোর চলেনা... না...!!!

আমাদের এই টম অ‍্যান্ড জেরির দৌড়ে দেখে বাড়ির সবাই হো.... হো... করে হাসতে লাগল। পঞ্জিকা দেখে ঠিক করা হলো বিয়ের দিন ক্ষন। অবশেষে আমার বিয়ের পাকাদেখা মিটল।




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Comedy