AYAN DEY

Children Drama Fantasy

3.8  

AYAN DEY

Children Drama Fantasy

নন্দীপুরের দুঃখ

নন্দীপুরের দুঃখ

13 mins
3.5K


নন্দীপুর রাজ্যের রাজা শ্রী করুণাসিন্ধু দীনবন্ধু সেন | রাজার ভীষণ দুঃখ | রানী অধিকারিনী রায়বাঘিনী সেন মহারাজের বহু অনুরোধের পরেও রাজাকে একটি ব্যাঙ পুষতে দিচ্ছেন না | রানী বলেন , “ আপনার অদ্ভুত এক শখ বটে , বাপের জন্মে শুনি নি কাউকে ব্যাঙ পুষতে | আপনি ব্যাঙ পুষবেন সে বাপু এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াবে , এইসব অনাসৃষ্টির কান্ডি আমি সহ্য করবো না | ”

রাজা বলেন , “ আজি আমি মধুচরণ ব্যবসায়ীকে দিয়ে ব্যাঙ আনাবো , তোমার আর কোনো বাধা মানবো না | ”

রানী বলেন , “ আপনি আনবেন আর সেটা আমি পাশের পুকুরে গিয়ে ফেলে আসবো | ” অগত্যা রাজা রানীর ভয়ে চুপ করে যান |

এদিকে রানীর আর এক দুঃখ | বারংবার করুণাসিন্ধুকে বললেও মহারাজ কাঁকড়ার খোলসের একটি গহনা বানিয়ে দেন না | রাজা শুধু বলেন , “ ছি ছি , কাঁকড়ার খোলসের গহনা | তোমায় যে কি কুক্ষণে মোকামপুর নিয়ে গিয়েছিলুম কে জানে ? আদিবাসীদের সাথে মিশে একটা জঘন্য রুচিবোধ তৈরি হয়েছে ... ছি ছি ছি | ইস নাকেতে আমার মনে হয় এখনই আঁশটে গন্ধ আসছে , ওয়াক থু ... ”

রাজার বমি বমি ভাব দেখে রানী “ মাগো ” বলে দৌড়ে পালালেন |

এদিকে রাজপুত্র অনির্বচন সাহসিক সেন , তার আবার আরেক দুঃখ | সে অনেক দিন ধরে রাজাকে বলে আসছে তার জন্য ব্যাঙ্গমা ও ব্যাঙ্গমি নিয়ে আসতে | রাজা এমনিতে রাজপুত্রের কোন অনুরোধই ফেলতে পারেন না এবং যথাসাধ্য তা পূরণের চেষ্টা করেন | পাঠশালায় পুস্তক পড়ে যে সে এই অপার্থিব পাখির কথা জেনেছে তা বলাই বাহুল্য কিন্তু রাজা সেই সব কিছু ভ্রুক্ষেপ না করেই রোজ রোজ মধুচরণকে বলেন নতুন নতুন বিদেশি পাখি , দেশি পাখি এনে দিতে | কিন্তু রাজপুত্র সবেতেই বলে , “ না এটা নয় | ” রাজা এই কথা জানতেন না যে সেই পাখি শুধুমাত্র রূপকথার দেশেই পাওয়া যায় তাই হরিহর পন্ডিত একদিন রাজার কাছে এসে বললেন , “ রাজামশাইকে কি আর বলি ! আপনি পুত্রের খুশির জন্য এসব করছেন , কিন্তু এমন পাখি বাস্তবে কোথাও নেই | সে নিতান্ত ছেলেমানুষ , আপনি তো বুঝুন | সেদিন মধুচরণ জানতে এসেছিল যে ঠিক কি পাখি অনির্বচন চাইছে , তার ছবিও দেখতে চেয়েছিল | আমি তাকে বোঝালাম এমন পাখি সে কোনভাবেই আনতে পারবে না কারণ এই পাখি বাস্তবে নেই | ”

রাজামশাই সব শুনে কি করবেন রাজপুত্র কে বোঝানোর জন্য চেষ্টা করতে লাগলেন কিন্তু না ছোট রাজপুত্র সে মানতে নারাজ | অগত্যা রাজপরিবারের সকলেরই মন খারাপ |

রাজা কিন্তু নিজের নামকে যথাসম্ভব সার্থক করতে সচেষ্ট | প্রত্যেকটি প্রজার কথা তিনি নিজে শোনেন বটে তবে হায় পোড়া কপাল , রাজ্যের কারোর দুঃখ লাঘব হয় না | নন্দীপুরের সকলে কিছু না কিছু কারণে দুঃখী | তবে প্রত্যেকের দুঃখের কারণ বিভিন্ন রকম হলেও তা যেন একই সূত্রে বাঁধা |

এই যেমন ব্যবসায়ী মধুচরণ রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় মোকামপুর এ অহমপুরি ঠাকুরের রাজ্য ছেড়ে নন্দীপুরে চলে আসেন বাণিজ্য করতে | কোনরকম দৈনন্দিন জিনিস নেই যেটা মজুদ থাকে না | ভোরবেলা জেলেরা মাছ ধরে দিয়ে যায় , তারপরে চাষিরা শাক-সবজি চাল ডাল দিয়ে যায় , ঘানির মালিক কলুবদন দিয়ে যায় তেল শহর থেকে তার লোকেরা নিয়ে আসে খাতাপত্র , কলম , বই ও আরও নানা সামগ্রী |

রাজার খাস ব্যবসায়ী হিসেবে মধুচরণের নামডাক রয়েছে | তবে এতদসত্ত্বেও একটা দুঃখ মধুচরণকে কুরে কুরে খায় | সে সবকিছু ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করে | কোনরকম ঠকানোর ব্যবসা রাজা মধুচরণকে করতে দেন না |

মধুচরণ অনেকবার বলেছেন , “ রাজামশাই মাসিক একটি দিন একটু চড়া দামে বেচবো | মহারাজ তাতে কোন আপত্তি নেই তো ? ”

রাজামশাই ততোবারই একই উত্তর দিয়েছেন , “ ওরে কোথায় ভাবলাম তুই বলবি মাসের একটা দিন বিনামূল্যে সবকিছু বেচবো তা নয় ... যা যা কাজ কর গে | ”

মধুচরণ আর কিছু বলতে পারেন না | গোপনেও বেশি দামে বেচার সাহস পান না কারণ সর্ব জায়গায় রাজার চর | মধুচরণের একটু আফিমের শখ | মাসের শেষ দিনেও বেশি লাভ করতে রাজা যখন বাধ সাজেন তখন ঐ আফিমের নেশায় ডুবে থাকেন মধুচরণ | কিন্তু আফিম যখন একটা সময় শেষ হয় তখন আর দুঃখের শেষ থাকে না |

ব্যবসায়ী ছাড়াও অনেক ছোট ব্যবসায়ীরাও ওই রাজ্যে বাস করেন যাদের পসার বেশ কম | মধু চরণের থেকে কিছু আর শহর থেকে কিছু মাল আনিয়ে এনারা ব্যবসা করেন | কিন্তু মধুচরণের 10% রোজগারও এই ব্যবসায়ীরা করতে পারেন না | এই লাভে তাদের ঘর চলে না |

তার উপর রয়েছে নন্দীপুরের কৃষকদের দুঃখ | কৃষকরা চাষের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনে মধুচরণ ও কিছু মহাজনদের থেকে টাকা ধার ক'রে | মধুচরণ বলে , “ এক বছরে ঋণের টাকার দ্বিগুণ হয়ে যাবে কিন্তু , অতএব সেই বুঝে ঋণ নে |” সুদ যে প্রতি মাসে অনেক তা বুঝেও তাদেরকে ঋণ নিতে হয় | মহাজন বলতে ছিলেন কিছু ব্রাহ্মণ | প্রাসাদে যোগ্য পূজা অর্চনা করে টাকা পেতেন | তো এই ব্রাহ্মণেরাও চড়া সুদে টাকা ধার দিয়ে থাকেন | কৃষকরা ঋণ পেলেও সুদ মেটাতে যে তাকে লাভের দুই-তৃতীয়াংশ দিয়ে দিতে হয় সে কারণে তাদের কষ্টের সীমা থাকে না | এদিকে মহারাজ যেহেতু বলে দিয়েছেন কৃষকরা যত বছরেই হোক টাকা শোধ দিক না কেন তাদের ঘরবাড়ি বা জমি কেউ যেন দখল না নেয় | ঠিক এই কারণে মহাজনদের মনে দুঃখ | তবে চাষীদের নাজেহাল করতে মহাজনেরা ছাড়তেন না | তাই কেউ কেউ দুঃখেতে আত্মহত্যার চেষ্টা করত | তবে সে চেষ্টা কারো সফল হতো না কারণ কোত্থেকে জানি রাজার পেয়াদা এসে যে আত্মহত্যা করতে যেত , তাকে চ্যাংদোলা করে রাজার কাছে নিয়ে আসে | রাজা বলেন একটি কাগজের 11 হাজার বার লিখতে “ আত্মহত্যা মহাপাপ ” | টানা দু'দিন ব্যাপী লিখতে লিখতে ওই চাষিকে পোলাও কালিয়া খাওয়ানো হয় আর লেখা শেষ হতেই তাকে ধমক দিয়ে বাড়ি পাঠানো হয় |

তো এই হলো নন্দীপুর এর অবস্থা | সবায়ের জীবন আপাতদৃষ্টিতে নির্বিকার মনে হলেও সবাই খুব দুখী , খুব খুব দুখী | এই দুঃখ মাঝে মধ্যেই এমন জাঁকিয়ে বসে সকলের মধ্যে যে রাজ্যের সব কাজ থেমে যায় | তখন রাজপ্রাসাদ থেকে কুঁড়েঘর সর্বত্রই ফ্যাচফ্যাচ কান্নার শব্দ শোনা যায় |

মোকামপুর এর জমিদার অহমপুরি ঠাকুর এসব দেখে মজা পান | মনে মনে বলেন , “ সকলের আবদার মেটাতে পারা যায় না বাপু , তাই সকলের কথা শুনেও কাম নাই | এই সহজ কথাটা বোঝো না বলেই তো তোমাদের গ্রামে এত দুঃখ | আমায় দেখো আমি কত সুখী আর আমার রাজ্যের কোন লোকটা দুঃখ দুঃখ করে মাথা কুটে মরে বল তো ? ”

এমতাবস্থায় নন্দীপুরে আসেন দুখভঞ্জন শর্মা কবিরাজ | তিনি যে কোত্থেকে কি উদ্দেশ্যে এই রাজ্যে এসেছিলেন কেউই কোনো দিন খোঁজ করেনি তবে তিনি সত্যিই সকলের ত্রাতা হিসেবে উদিত হয়েছিলেন | কাঁধে তুলি নিয়ে একদিন দুখভঞ্জনকে বটগাছের নিচে বসে থাকতে দেখা গেল | এমন সময় একটি বাচ্চা মেয়ে ও একটি ছেলে দূর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল তবে তারা বেশ জোরে জোরেই কথা বলায় তাদের কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলেন তিনি |

দূর থেকে বসে শুনতে পেলেন ছেলেটা বলছে , “ জানিস তো বোন , আজও পন্ডিত মশাই পাঠশালা থেকে বের করে দিলেন শুধু বাড়ির কাজ করিনি বলে | কি বলবো বল তো আমার মাথায় যে কিছু ঢোকে না ! পন্ডিত মশাই তো ... "

দুখভঞ্জন ডাক দিলেন এই বলে , “ এসো বাবু হেই দাওয়া এটা খাও দেখবে সব দুঃখ কেটে যাবে |কই এসো ! "

ছেলেটা কিছুটা কাছে এগিয়ে এসে বলে , “ আমার তো দুঃখ আমার পড়াশোনা মাথায় ঢোকে না | সেটা আবার কি করে কাটবে ? ”

ঝোলা থেকে একটা পুটলি বার করতে দেখে বাচ্চা মেয়েটি বলল , “ চ না দাদা , অনেকেই বলছেন খেয়েই দেখ না ? ”

ছেলেটি তখন দুখভঞ্জন কবিরাজের দিকে এগিয়ে সেই ওষুধটি নিজের হাতে নিয়ে খেয়ে নিল | অবাক কান্ড যে ওষুধ খাওয়ার পরপরই তার সবকিছু ঠিক হতে শুরু করল | সব পড়া মাথায় ঢুকতে শুরু করল তো বটেই এমনকি পরীক্ষায় ভালো ফল পর্যন্ত করলো সে | শিক্ষায় ভালো ফল করার পর একদিন ছেলেটি তার বাবা-মাকে গল্পের ছলে দুখভঞ্জনের কথা বলে |

সে বলে , “ জানো তো ঐ লোকটা আমায় একটা ওষুধ খাওয়ানোর পর মাথা ঢুকতে শুরু করে পড়াশোনা | উনি বলেছিলেন আমি ওষুধ খেলে সমস্ত দুঃখ নাকি ঘুচে যাবে | "

বাড়ির কাজের লোক খবর শুনে তৎক্ষণাৎ বট গাছের সামনে এসে ওই কবিরাজকে খুঁজতে থাকে | খুঁজে না পেলেও খবরটা গোটা রাজ্যে চাউর হয়ে যেতে বেশি সময় লাগে না এমনকি রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত খবরটা ছড়িয়ে যায় |

খবর পেয়ে রাজা সবেমাত্র ব্যবস্থা করছেন সারা রাজ্যে ওনার অনুসন্ধানের জন্য ; এমনি সময় একজন পেয়াদা এসে খবর দিল যে স্বয়ং দুখভঞ্জন এসেছেন রাজার সাথে দেখা করতে |

রাজা বললেন , “ শীঘ্র উনাকে নিয়ে এসো প্রাসাদের মধ্যে | ”

দুখভঞ্জনকে দেখে রাজা প্রথমেই বললেন , “ আরে কি সৌভাগ্য , আপনি নিজে এসেছেন ! ”

কবিরাজ বললেন , “ সব জায়গায় শুনলুম রাজপ্রাসাদে বড় দুঃখ এবং রাজ্যের সব মানুষেরই বড় দুঃখ তাই নিজেই চলে এলুম | ”

রাজা মশাই বললেন , “ আপনি ঠিকই শুনেছেন | সব শোনার আগে একটু আমাদের আপ্যায়ন গ্রহণ করুন | ”

দুখভঞ্জন বললেন , “ সেই সব এর কোন দরকার নেই | আপনি আগে সমস্ত কথা বিস্তৃত আমাকে জানান | ”

করুণাসিন্ধু একে একে সকলের সব রকম দুঃখের কথা বললেন | এইসব কথা শুনে দুখভঞ্জন আকস্মিকভাবে বললেন , “ সব কথা শুনে যা বুঝলাম সব দুঃখের কেন্দ্রবিন্দুতে কিন্তু আপনি তাই ঔষুধ আপনাকে দিলেই কাজ হবে | ”

রাজা মশাই বললেন , “ সে আবার কি কথা ? দুঃখের কেন্দ্রবিন্দুতে আমি আছি , তার মানে কি ? ”

দুখভঞ্জন বললেন , “ একটি ঔষধ দেবো যেটি খেলে আপনার ব্যাঙ পোষার ইচ্ছা দূর হবে | আপনার স্ত্রীর কি যেন শখ , কাঁকড়ার খোলসের গহনা , তাই না ? আবার রাজপুত্রকে আপনি ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী এনে দিতে পারছেন না , কি তাইতো ? ব্যবসায়ীকে আনন্দ দিতে পারছেন না , কৃষককে সুখ দিতে পারছেন না | এই ওষুধটি একটিবার আপনি খেয়ে দেখুন সব সমস্যার এক নিমেষে সমাধান করে ফেলবেন | তখন বুঝবেন কেন বলেছিলাম সব দুঃখের কেন্দ্রবিন্দুতে আপনি | ”

রাজি হয়ে করুণাসিন্ধু সেই কবিরাজি ওষুধ খেলেন | কবিরাজ প্রণাম ঠুকে চলে গেলেন এবং এরপরই ঘটতে শুরু করল কিছু অবাক করা পরিবর্তন |

সত্য সত্যই রাজার ব্যাঙ পোষার ইচ্ছা দূরীভূত হলো | রাজার মাথায় এক বুদ্ধি খেললো | তিনি হরিহর পন্ডিতকে ডেকে পাঠালেন | হরিহরকে বললেন , “ আচ্ছা পন্ডিত মশাই কাঁকড়ার রস গায়ে লাগলে কি কি ক্ষতি হতে পারে তা খুঁজে বার করে দিতে পারেন ? না মানে রাণীমাকে জানানোর ছিল | আজ সন্ধ্যার মধ্যে আপনি কোনোভাবে সেগুলো খুঁজে বার করে রাণীমাকে জানাতে পারবেন ? তবে এমনভাবে বলতে হবে যাতে রানীর ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় | ”

হরিহর বললেন , “ খোঁজার দরকার তো নেই আমি এখনই বলতে পারি | ”

করুণাসিন্ধু বললেন , “ ঠিক আছে | রানী মাকে আমি এক্ষুনি ডেকে পাঠাচ্ছি না তাতে উনি সন্দেহ করতে পারেন | একটু পরে উনি হেঁসেলে যাবেন সেই মুহূর্তে আপনি আপনার গল্প চালিয়ে যাবেন | বলাবাহুল্য সেই গল্প হবে কাঁকড়ার অপকারিতা বিষয়ক | আমি হেসে উড়িয়ে দেবো কিন্তু তবু আপনি দাপিয়ে গল্পটা বলে যাবেন | গল্প বানাবেন বটে তবে তাতে অতিরঞ্জনের সাথে সত্যতাও থাকতে হবে | ”

কিছুক্ষণের মধ্যেই রাণীমা হেঁসেলের দিকে যেতে গেলে হরিহর পন্ডিতের কথা কানে আসে | হরিহর বলছিলেন , “ জানেন মহারাজ , সমুদ্র থেকে মাছ তুলতে গিয়ে প্রচুর কাঁকড়া জেলেদের পায়ে জড়িয়ে যায় | সে ময়নাপুরীর ঘটনা | ওই জেলেদের গায় বড় বড় ঘা বেরিয়ে সে একাকার কান্ড | তাদের প্রত্যেকের গায়ে এখন প্রচুর জ্বর | ময়না পুরীর ডাক্তার বদ্যিদের এখন পাগল পাগল অবস্থা | তাই বলি মহারাজ , আপনি যে মতি স্থির করেছেন রানী মার জন্য কাঁকড়ার খোলসের গয়না বানাবেন সে বিষয়ে ভেবেচিন্তে নেবেন নইলে ... ”

কথা শেষ হতে না হতেই রাজামশাই হো হো করে হেসে উঠলেন | আড়চোখে মন্ত্রী রতন চিন্তামণি সেন রানীমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাজাকে আলতো পরশ করে জানান দেন বিষয়টা | বিষয়টা বুঝে রাজা আরো জোরে হেসে ওঠে বলে উঠলেন , “ কি পন্ডিত তুমি কি বলো ? কাঁকড়া থেকে জ্বর ? হাসালে বটে হাসালে | কি বলতে চাও রাণীমার আবদার আমি পূর্ণ করব না ? ”

হরিহর বললেন , “ তা কেন ? তবে সাবধানের মার নেই | ”

রাজামশাই বললেন , “ ধুর তুমি থামো তো | ইতিমধ্যেই রানী দুঃখ কাটানোর ব্যবস্থা করতে আমি ... ”

রাজার কথা শেষ হতে না হতেই রানী এসে বললেন , “ রক্ষে কর মা , ওই গহনার দরকার নেই | তারপর জ্বর হয়ে মরি আর কি ? ”

তো এইভাবে রানীর দুঃখ ঘোচে | এবার রাজার রাজপুত্রের দুঃখ কাটানোর ব্যবস্থা করলেন | অনেক অনুসন্ধানের পর দূর রাজ্যের এক ছবি দেখানো ওয়ালা মনোরঞ্জন সাউ এর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেন | লোক পাঠিয়ে মনোরঞ্জন কে ডেকে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন মহারাজ | ঠিক দু'দিন পর মনোরঞ্জন স্বয়ং এলেন রাজার সঙ্গে দেখা করতে |

মহারাজ বললেন , “ আপনি শুনে থাকবেন আমার ছেলের কথা | সে ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী দেখতে চায় | আপনি শুনেছি নানান রকম চলমান ছবি আপনার যন্ত্রের সাহায্যে দেখিয়ে থাকেন | এই রাজ্যেও মানুষ কম নেই | আপনি দিব্য এই রাজ্যে থেকে গিয়ে ছবি দেখিয়ে পয়সা রোজগার করতে পারবেন | শুধু রাজপুত্রের জন্য আপনি ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী সম্বলিত কিছু ছবি দেখানোর ব্যবস্থা করুন | অসুবিধা হবে না আপনি প্রাসাদেই থাকতে পারবেন | আপনার দেখাশোনার দায়িত্ব আমাদের | ”

মনোরঞ্জন রাজার কথা মেনে নিলেন | কথা মতো প্রতিদিন তিনি রাজপুত্রকে রূপকথার কিছু ছবি দেখাতে লাগলেন যাতে রয়েছে রঙিন ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী ও তাদের রঙিন রঙিন ডিম | অনির্বচনের সে কি আনন্দ ! এইভাবে রাজ বাড়ির সকলের আনন্দ ধীরে ধীরে ফিরে এলো |

মধুচরণ ব্যবসায়ীর জন্য রাজা একটি উপায় বাতলালেন | তিনি ঠিক করলেন মাসের যে একটি দিন সে বেশি লাভ করার জন্য রাজার কাছে অনুমতি চাইতে আসে সেই দিন রাজা মধুচরণের হয়ে জিনিস কেনার অর্ধেক দাম দিয়ে দেবেন ফলে মধুচরণ বেশি লাভ করতে পারবে | মধুচরণকে সে কথা জানাতে সে ও খুব খুশি |

এদিকে চাষীদের জন্য তিনি আর এক উপায় স্থির করলেন | ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে চাষীদের নানান রকম শস্য বিক্রয় করার কেন্দ্র খুলে দিলেন | তারা ওইসব কেন্দ্রে গিয়ে নিজেদের শস্য নিজেদের লোকদের দিয়ে ভালো দামে বিক্রি করতে সমর্থ হল | ফলে তাদের মাথায়ও আর ঋণের বোঝা রইল না | ফলে মহাজনদের চিন্তাও দূরীভূত হলো |

ক্রমে রাজ্যের সকলের দুঃখ ধীরে ধীরে চলে যেতে থাকে এবং রাজ্যে খুশির আমেজ আসতে থাকে | রাজ্যে সকলে সুখে শান্তিতে বাস করতে শুরু করে এবং জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হতে শুরু করে | তবে সংকট উপস্থিত হয় ঠিক একমাস পরে |

একমাস পরের একটি সকালে রাজা ঘুম থেকে উঠেই জোর হুংকার দেন , “ কই কে আছিস , ব্যাঙ আজকেই আনতে যাব | দেখি আমাকে কে আটকায় | ”

রানি এই সব কথা শুনতে পেয়ে রে রে করে তেড়ে আসেন | তিনিও চেঁচিয়ে বলেন , “ দাও আমায় কাঁকড়ার খোলসের গয়না | ”

ব্যাস , রাজার মাথায় যে যে বুদ্ধিগুলো এসেছিল সকলের দুঃখ দূর করার জন্য সব এই অদ্ভুত ইচ্ছের কারণে আবার দূর হয়ে গেল মাথা থেকে | আবার ফিরে এলো রাত যে সকলের মধ্যে দুঃখ |

তবে অদ্ভুত ভাবে রাজা দেখলেন যে রাজপুত্র কিন্তু তখনও সুখী কারণ সে তার ক্ষুদ্র আবদার মেটাতে পেরেছে | মনোরঞ্জন প্রতিদিনই তাকে কথা মতন ছবি দেখিয়ে খুশি রাখতে পেরেছেন |

রাজ্যে ফের দুঃখের আবহাওয়া শুরু হওয়ায় সকলের মনে আবার দুখভঞ্জন কবিরাজের কথা মনে এলো | তবে তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোথাও পাওয়া গেল না তাঁকে | এরই মধ্যে রাজ্যের একমাত্র সুখী মানুষ এক রাতে এক স্বপ্ন দেখলো |

রাজপুত্র অনির্বচন ঘুমের মধ্যে দেখলো দুখভঞ্জন কবিরাজ বিলাপ করছেন এই বলে , “হায় হায় হায় , সব ওষুধ বানানোর পদ্ধতি যে গিয়েছি ভুলে কি হবে হায় হায় হায় ! ” এরপর অদ্ভুতভাবে কবিরাজের মাথার ওপরে থাকা এক টুকরো চাঁদ ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামতে থাকলো এবং ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি আসার মুহূর্তে একটি পরীর আকার ধারণ করলো | একটা যাদু কাঠির মত কিছু ছোঁয়াতেই কবিরাজ আনন্দে আত্মহারা হয়ে চিৎকার শুরু করে দিলো , “ মনে পড়ে গেছে , মনে পড়ে গেছে | ”

পরী বললো , “ এখন থেকে ওষুধ বানাতে তুমি আর কখনোই ভুলবে না | তোমার বানানো ওষুধের গুণও থাকবে এখন আমরণ | ”

কবিরাজ বললেন , “ ধন্যবাদ , স্বর্গের দেবী , ধন্যবাদ | ” হঠাৎ এক সময় পরী মিলিয়ে গেল | এক সময় রাজপুত্র দেখল কবিরাজ মুখ তুলে যেন তার দিকে চেয়ে কিছু বলছে | খুব দূর থেকে সে কন্ঠস্বর আসছে বটে তবে সে স্পষ্ট শুনতে পেল , “ এখন একটা ওষুধ বানিয়ে থলিতে বেঁধে এই বট গাছের নিচে পুঁতে দেবো | তুমি এখন রাজ্যের একমাত্র সুখী মানুষ তাই তুমি কাল সকালে এসে এই ওষুধ নিয়ে যেও | একটুখানি মাটি সরালেই পাবে | তোমার পিতাকে খাওয়ালি কাজ হবে | আর কোনদিন নন্দীপুরে দুঃখ ফিরবে না | ”

ধীরে ধীরে স্বপ্ন টা কেটে দিতে লাগলো আর হুট করে রাজপুত্রের ঘুম সেই মুহূর্তে ভেঙে গেল | খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো রাজপুত্রের | তখনো রাজপ্রাসাদের সকলে ঘুমোচ্ছে | মাকে না জাগিয়ে ধীরে ধীরে বছর দশের রাজপুত্র ঘর থেকে বেরিয়ে প্রাসাদের দরজার দিকে এগোতে লাগলো | এক প্রহরীর জেগে থাকার কারণে তাকে সমস্ত ঘটনা বলতে সে বাধ্য হল | সব শুনে প্রহরী নিজে প্রাসাদের দরজা খুলে রাজপুত্রকে নিয়ে সেই বট গাছের দিকে এগোতে লাগলো |

এদিকে ততক্ষনে রানীমা জেগে উঠেছেন | রাজপুত্র কে দেখতে না পেয়ে তিনি বাড়ি মাথায় করলেন | খোঁজ নিয়ে জানা গেল এক প্রহরী প্রাসাদে নেই | রাজামশাই মন্ত্রী যখন পেয়াদা পাঠিয়ে রাজপুত্র কে খোঁজার জন্য আদেশ করলেন ঠিক সেই মুহূর্তে ওই প্রহরী রাজপুত্রকে নিয়ে প্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করলো |

রাজাকে সমস্ত কথা জানাল রাজপুত্র | বিশ্বাস ভরে রাজা সেই ওষুধ রাজা গ্রহণ করলেন | সকলকে অবাক করে দিয়ে রাজা পুনরায় সেই ইচ্ছা মুক্ত হয়ে সকলের দুঃখ দূরীকরণে সচেষ্ট হলেন | আগের মতই ধীরে ধীরে গোটা রাজ্যে সুখ নেমে এলো |

নন্দীপুর গ্রামে সব দুঃখ চিরতরে ছুটে পালালো |

রাজার এখন বয়স হয়েছে | রাজপুত্রের অভিষেক হয়ে গেছে এবং বিবাহ সম্পূর্ণ হয়েছে | আজ রাজার মনে হয় , কোত্থেকে সেদিন সেই কবিরাজ এসেছিলেন রাজ্যে এবং সব দুঃখ দূর করে তিনি আবার কোথায় চলে গেলেন , কি করেই বা রাজপুত্র স্বপ্নে তার দেখা পেল , এই সব কথা ভাবতে ভাবতে রাজার চোখ ভারী হয়ে আসে |


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Children