DrArun Chattopadhyay

Children Stories Classics Inspirational

5.0  

DrArun Chattopadhyay

Children Stories Classics Inspirational

দত্যি দানো সত্যি মানো

দত্যি দানো সত্যি মানো

13 mins
1.0K


দত্যি-দানো কি সত্যি আছে? কিংবা ধর রাক্ষস-খোক্কস? এ সবের অনেক গল্প ঠাকুমার মুখে শুনেছে বিন্তি। আর শুনে আসছে সেই ছেলেবেলা থেকে। এখন বয়েসটা একটু বেড়ে আট বছরে দাঁড়িয়েছে। এখনও রাতে বিছানায় ঠাকুমা ছাড়া ঘুম আসে না। গল্প যেমন তেমন হলে চলবে না। রূপকথার গল্প হতে হবে। আবার রূপকথার গল্পে শুধু রাজারানী বা রাজপুত্তুর বা রাজকন্যে আছে তেমন গল্প চলবে না। এমন কি পক্ষীরাজ ঘোড়া কিংবা ময়ূরকণ্ঠী নৌকো থাকলেও হবে না। যে গল্পে দত্যি-দানো বা রাক্ষস-খোক্কস আছে সেই গল্প শুধু শুনবেই না। যেন গোগ্রাসে গিলবে বিন্তি। শোনার পর পাঁচ মিনিট সে চুপ করে পড়ে থাকবে। ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে যেই ঠাকুমা উঠতে যাবে অমনি তার আঁচল চেপে ধরবে বিন্তি। ভয়ে নাকি আরও শোনার ইচ্ছায় বুঝতে পারে না ঠাকুমা।

এখন একটু একটু বড় হচ্ছে সে। মনের মধ্যে প্রশ্ন ঘুরপাক খায়, আচ্ছা দত্যি-দানো বা রাক্ষস-খোক্কস কি সত্যি আছে? যদি থাকে তো কই দেখা যায় না তো তাদের আশেপাশে? ঠাকুমাকে জিজ্ঞেস করতে ঠাকুমা বলল, সে তো তোমার মত ভাল মেয়েকে দেখা দেয় না বিন্তি।

--কেন দেখা দেয় না শুনি?

--আহা ওদের কাজ হল খারাপ ছেলেমেয়ে মানে যারা দুষ্টু, যারা পড়াশোনা করে না, বাবা মা বা গুরুজনের কথা শোনে না, খারাপ কথা বলে, নানা দুষ্টুমি করে বেড়ায় তাদের শাস্তি দেওয়া। তোমার মত ভাল মেয়ে যে কখনও কারোর ভাল ছাড়া খারাপ করে না, কত ভাল পড়াশোনায় মন তাদের দেখা দিয়ে কী করবে বল তো দিদি ভাই?

ঠাকুমার উত্তরটা পছন্দ হয় না বিন্তির। একটু ভেবে নিয়ে বলল, কিন্তু ঠাম্মা যে শাস্তি দেয় খারাপ ছেলেমেয়েকে সে পুরস্কার দেয় না কেন ভালদের?

ঘাড় নেড়ে হেসে হেসে ঠাকুমা বলল, এটা তো আমি ভেবে দেখি নি। তবে আমার মনে হয় কী জান?

--কী গো?

--আমার মনে হয় ভাল ছেলেমেয়েদের দেখা না দিয়েই তারা পুরস্কার দিয়ে দেয়। আসলে তারা দেখা দিলে ছেলেমেয়েরা খুব ভয় পায়। সে কেন ভাল ছেলেমেয়েকে ভয় দেখাবে বল তো আমার সোনা দিদি? এই ভয় না পাওয়াটাই হল একটা পুরস্কার। 

বিন্তি ভেবে দেখল সত্যি তো। তার সামনে যদি একটা বিকট আকারের দত্যি-দানো হঠাৎ এসে পড়ে তো কী হবে? খুব ভয় পেয়ে যাবে। ভাবতেই তার পেটের ভেতরটা গুড়গুড় করতে থাকে। তবু দেখা পাওয়ার একটা সুযোগ পেলে মন্দ হয় না।

তা একদিন সুযোগ এল অবশ্য। সকাল বেলা হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। দেখে পাশে ঠাকুমা শুয়ে আছে। একটু আশ্চর্য হল। অন্যদিন তো মা শুয়ে থাকে। আসলে সে ঘুমিয়ে পড়ার পরে ঠাকুমা নিজের ঘরে চলে যায় আর মা তার পাশে এসে শোয়। কিন্তু আজ অন্য রকম কেন?

বাইরে এল। ইস এখনও যে ভাল করে ভোর হয় নি। কিছু পাখি দল বেঁধে উড়ে যাচ্ছে আকাশ দিয়ে আর কিছু গাছের ডালে বসে বসে ডাকছে। পূর্ব আকাশে বেশ লাল রঙ দেখে ঠাকুমায়ের কথাটা তার মনে পড়ে গেল। ঠাকুমা সেদিকে দেখিয়ে একদিন বলেছিল, ওই দেখ। ওই যে পূর্ব দিক লাল হয়েছে। এখুনি তোর সূয্যিমামা উঠবে। আর সারা আকাশ হয়ে যাবে আলোয় আলোময়।

সেদিন তো নিজেই বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। এক্ষুনি সূয্যিমামা উঠবে আকাশের ওই লাল মেঘটা ভেঙ্গে। বেশ মজা লাগছে তার। ইস্কুলে সবাইকে আজ বলতে পারবে সে সূর্যের ওঠা দেখেছে। সবাই খুব অবাক হয়ে যাবে।

কিন্তু সূয্যি ওঠার বদলে একটা ভারি মজার জিনিস হল। যেমন করে আকাশ থেকে বিদ্যুৎ চমকে মাটিতে এসে পড়ে তেমনি একটা আলোর ঝলক সেই রঙিন মেঘ থেকে ঠিক তার কাছে ছিটকে পড়ল। তবে বিদ্যুৎ সাদা রঙের হয় আর এটা সোনালী রঙের। আশ্চর্য এমন বিদ্যুৎ তো সে দেখে নি এ পর্যন্ত? তবে পুজোর আগে বা পরে আকাশে সোনালী রোদ দেখেছে সে। বেশ ভাল লাগে রোদের এই সোনালী রঙটা। মনে হয় যেন এই তো দুর্গাপুজো এসে গেল। 

কিন্তু এ যেন ম্যাজিক। সোনালী বিদ্যুৎ মাটিতে পৌঁছেই একটা বাদামী ঘোড়া হয়ে গেল। ঘোড়া তার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল, উঠে বস।

-আরে আমি পারব না। পড়ে যাব।

--খুব পারবে। এই দেখ আমি পা মুড়ে বসছি।

ঘোড়া পা মুড়ে বসল। আর ঝট করে ঘোড়ায় উঠে বসল বিন্তি। অবাক হয়ে ভাবল বা দারুণ সহজ তো। ঘোড়া চলতে লাগল। চলা তো নয় একেবারে ছোটা। কিন্তু বিন্তি তো অবাক। তার একটুও ভয় লাগছে না। মনে আছে ঘোড়ার ছোটা দেখে সে একদিন ভয়ে চোখ বুজে ফেলেছিল।

ঘোড়া ছুটতে ছুটতে এসে ঢুকল এক বনে। বিন্তি ভাবল কই তাদের বাড়ির কাছে এমন জঙ্গল তো সে কখনও দেখে নি। তাহলে কি অনেক দূরে এসে পড়ল নাকি? তা ঘোড়া ছুটিয়ে এলে তো অল্প সময়ে অনেক দূরে আসা যায়।

এক সময় ঘোড়া এসে থামল সেই জঙ্গলে। গাছ আর পাতার মধ্যে দিয়ে বিরাট একটা পাহাড় ক্রমশ ফুটে উঠছে। কিন্তু পাহাড়টা এমন ধোঁয়া ধোঁয়া কেন? যেন একরাশ ধুলোর ধোঁয়া তাকে ঘিরে রেখেছে সর্বদা। সেই পাহাড়ের কাছ থেকে জলের কলকল আওয়াজ আসছে। মনে হয় নদী বা অন্য কোনও জলাশয় আছে।

সে থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, ঘোড়া ভাই তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে এলে?

--একটু পরেই জানতে পারবে। ঘোড়া গম্ভীর ভাবে জবাব দিল।

ঘোড়া এসে দাঁড়াল একেবারে পাহাড়ের কাছাকাছি। ঘোড়া সামনের দুই পা মুড়ে মাটিতে রাখতেই লাফিয়ে নেমে পড়ল বিন্তি। আবার ছোটা দিল ঘোড়া। ছোটার আগে বলল, যখনই দরকার হবে তখনই আমাকে ডাক দেবে। তবে মনে রেখ একমাত্র সত্যিকারের দরকারেই ডাক দেবে। মিথ্যে বা অকারণ হলে কিন্তু আমি তোমায় এই জঙ্গলে ফেলে চলে যাব। আর তুমি বাড়ি ফিরতে পারবে না।

ঘোড়ার ছোটার আওয়াজ উঠল, টগ বগ টগ বগ। মিলিয়ে গেল সেটা। আর এগোতে ভয় পেল বিন্তি। সমস্ত জায়গাটা ভারি নির্জন। খুব ভয় করতে লাগল তার।

হঠাৎ একটা গরম হাওয়া তাকে ঠেলা দিল। সেই ঠেলায় সে চলতে লাগল। ঠেলা তাকে নিয়ে গেল একটা বিরাট বড় ঝিলের সামনে। কিন্তু সুন্দর চকচকে জল নয় তো এই সরোবরের? কেমন যেন ঘোলা ঘোলা। পাশে বাঁধান সিঁড়ির পাশে তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে ঠেলাটা চলে গেল।

ভাল করে লক্ষ করে দেখল সেই অপরিচ্ছন্ন অস্বচ্ছ জলে নানা রকম রঙিন মাছ নানা রকম রঙিন মাছ সাঁতার কেটে কেটে খেলা করে বেড়াচ্ছে। আরও অনেক জলচর প্রাণী। বেশ খেলা দেখছিল এমন সময় জলে বিরাট একটা উথাল পাথাল। দেখা গেল মাছেদের মধ্যে বেশ হৈ চৈ পড়ে গেছে। সবাই জোরে জোরে সাঁতার কেটে পালাতে ব্যস্ত। কী ব্যাপার? ভয় আর কৌতূহল দুটো একসঙ্গে কাবু করে দিল বিন্তিকে।

গভীর জলাশয় থেকে উঠে আসছে বিরাট কাল চেহারার একটা প্রাণী। যত কাছে আসছে তত তার শরীর বাড়ছে। কিন্তু মাথাটা মাছের মত হলেও শরীরটা যেন বিরাট একটা থপথপে কোলা ব্যাঙের মত। ভয়ংকর তার সেই মাথার গড়নও। চোখগুলো একেবারে ঠেলে ঠেলে বেরিয়ে আসছে যেন। বিরাট বড় বড় দাঁতগুলো সবাইকে যেন ভ্যাঙ্গাচ্ছে। ভয়ংকর বড় একটা নাক যেন সদাই কুঁচকে আছে। 

এটা মাছ না ব্যাঙ বোঝা মুশকিল। এমন বিশ্রী চেহারা তো কখনও চোখে দেখে নি। ভয়ে বিন্তির কান্না পেয়ে গেল। ঠাকুমার মুখে সুকুমার রায়ের অনেক ছড়াতে অবশ্য এমন কিছু আজব প্রাণীর নাম শুনেছে বিন্তি। হাসজারু, বকচ্ছপ, হাতিমি এইসব। এটা তবে কী? ব্যাঙ আর মাছ মিলিয়ে ব্যাঙাছ নাকি? ঠাকুমাকে সামনে পেলে না হয় জিজ্ঞেস করা যেত। কিন্তু এখন তো সে উপায় নেই। মাছগুলোকে ধরছে আর মুখে পুরছে সেই রাক্ষসটা। শুধু মাছ নয়। জলের ভেতরের যত প্রাণী ছিল সব এক এক করে সব মাছ মুখে পোরা হয়ে গেলে সে তাকাল বিন্তির দিকে। কী ভয়ানক তার দৃষ্টি। হা হা হা করে হেসে উঠল। যেন সাগরের ঢেউ ফুঁসে উঠল। উঁচু পাহাড়ের মাথা থেকে যেন বয়ে এল বিরাট জলপ্রপাত। এমন বিরাট শব্দ।

বিন্তি ভীষণ ভয় পেয়ে বলল, তুমি কে?

--আমি জল-রাক্ষস। জলের ভেতরে যা থাকে সব আমি কাঁচা চিবিয়ে খাই। হা হা হা।

-- কিন্তু কেন? ওরা তোমার কী ক্ষতি করেছে।

--আরে ওরা আমার কিছু ক্ষতি করে নি।

--তবে?

--এটাই তো আমার স্বভাব। হা হা হা হা--

বিন্তির মুখ দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে এল, খুব নোংরা স্বাভাব। ভারি দুষ্টু তো তুমি।

আবার হা হা করে হাসল জল-রাক্ষস। বলল, নোংরা স্বভাব তো হবেই। নোংরা থেকেই যে আমার উৎপত্তি। এই যে তোমরা রোজ জলে এত নোংরা ফেলছ, কলকারখানা আর বাড়ির নোংরা, তেল, কালিঝুলি কী নেই ওতে? কত দূষিত রঙ। ঠাকুর ভাসান দিচ্ছ। মাটিতে বুজে যাচ্ছে জলাশয়। রঙ, ফুল, কাগজ পাতা। এই সব পচে পচে আমি তৈরি হচ্ছি। হা হা হা আমি হলুম জল-রাক্ষস। জলের সব প্রাণী খেয়ে ফেলব এক এক করে। কাউকে ছাড়ব না। জল পচে দুর্গন্ধ ছাড়বে। কেউ ব্যবহার করতে পারবে না এই জল। নদীর এপার ওপার করতে পারবে না। নামতেও পারবে কেউ এই জলে। দুষিত পাঁক আর বিকট গন্ধ। একটা মাছও আর পাবে না তোমরা কেউ। আর পেলেও সেই বিষাক্ত মাছ খেয়ে সব মরবে।

বলেই জলের ভেতরে ডুবে গেল। ছড়িয়ে গেল চারিদিকে ভয়ানক দুর্গন্ধ। তবে ডুবে যাবার আগে চেঁচিয়ে বলল, তুমি ভাল মেয়ে। তাই তোমায় আমি খুব ভয় করি। কী জানি বাবা যদি আমার প্রাণ-ভোমরা একবার তুমি খুঁজে পাও তো—

জলের অনেক নিচে চলে গেছে সে। বাকি কথা আর শোনা গেল না। বুঝতেও পারল না জল রাক্ষসের পুরো কথাটা।  

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আর ভাল লাগল না বিন্তির। ঝিলের পাশ দিয়ে সে হাঁটতে শুরু করল। একসময় ঝিল শেষ হয়ে পড়ল এক মাঠ। কিন্তু এ মা সবুজের নামগন্ধ নেই। সব মরা শুকনো ঘাস। গাছগুলো শুকিয়ে আসছে। আশপাশে অজস্র ময়লা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। প্লাস্টিক, পলিথিন, গাছের পাতা আরও কত নোংরা। একেবারে স্তূপাকার হয়ে গেছে চারিদিকে। গাছে ফুল নেই, ফল নেই, পাতাও নেই তেমন। শুকনো ডালপালা নিয়ে কেমন যেন সঙের মত দাঁড়িয়ে আছে। 

বিশ্রী একটা গন্ধ ছাড়ল। নাকে চাপা দিল বিন্তি। না দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। এমন সময় এক অদ্ভুত কান্ড। একটা হাওয়া উঠল। বিরাট কোনও ঝড় না হলেও হাওয়ার বেশ জোর ছিল। কিন্তু সে হাওয়া বিন্তির পেছন দিক থেকে ছিল। তাই বিশ্রী গন্ধটা তার দিকে না এসে ক্রমশ তার দিক থেকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল অন্য দিকে।

চমকের পরে চমক। সব পাতা, প্লাস্টিক, আর নোংরার স্তূপ সেই হাওয়ায় উড়তে উড়তে গিয়ে শূন্যে যেন কোথাও জমা হতে লাগল। আর অবাক হয়ে বিন্তি দেখল সেই জঞ্জালের স্তূপ দিয়ে তৈরি হল বিশাল একটা চেহারা। হাত, পা, শরীর, নাক, মুখ, কপাল সব কিছু নিয়ে সে একটা বিশাল চেহারার মানুষ যেন।

তার মাথা অনেক উঁচুতে। উঁচু গাছের মাথা ছাড়িয়েও সে উঠে গেছে আরও অনেক ওপরে। ভয়ংকর তাকে দেখতে। সাদা জট পাকানো লম্বা মাথার চুল। চোখগুলো গোল্লা গোল্লা। বিরাট বড় বড় জ্বলন্ত দুই চোখ। যেন ছিটকে বেরোচ্ছে আগুনের হলকা। নাক দিয়ে বেরোচ্ছে গরম নিঃশ্বাস। তার সারা গা দিয়ে বেরোচ্ছে কী দুর্গন্ধ। সে গন্ধে মাথা ধরে এল বিন্তির। গা পাক দিতে লাগল। অসুস্থ বোধ করতে লাগল। নাকে হাত চাপা দিল।

একটু পরে সামান্য সুস্থ হতে দেখল সেই বিশাল চেহারা যেন তার দিকেই চেয়ে আছে। তেমন ভাবে চেয়ে থাকতে থাকতেই হেসে উঠল হা হা করে।

--তুমি কে? এমন করে হাসছ কেন? আমার বড় ভয় করছে।

হাসি থামিয়ে রাক্ষস বলল, আমি হলাম রাক্ষস। আমাকে দত্যি বলতে পার, দানো বলতে পার যা তোমার খুশি। 

বিন্তি ভয় পেল খুব। তার দিকেই চেয়ে আছে রাক্ষসটা। তার মানে তাকেই খাবে। রাক্ষস-খোক্কসে অবিশ্বাস করে সে কী তবে রাক্ষসের রাগ বাড়িয়ে দিল? কিন্তু ঠাম্মা যে বলেছিল রাক্ষস-খোক্কস-দত্যি-দানোরা বিন্তির মত ভাল ছেলেমেয়ের কিছু ক্ষতি করে না?

রাক্ষসটা হা হা হা করে হেসেই যাচ্ছে আর তার নিঃশ্বাসে সেই দুর্গন্ধ সে ছড়িয়েই যাচ্ছে। হাসতে হাসতেই বলল, আমার নাম জঞ্জাল-রাক্ষস। জঞ্জাল থেকে তৈরি হই। জঞ্জালে থাকে পচা সব জিনিস। দুর্গন্ধ হবে না তো কি ভাল গন্ধ হবে নাকি?

রামায়ণ মহাভারতে অবশ্য বেশ কিছু রাক্ষসের নাম শুনেছে ঠাকুমার গল্পে। পুতনা রাক্ষসী, তাড়কা রাক্ষসী, বকরাক্ষস এই সব। কিন্তু কই জঞ্জাল-রাক্ষস বলে তো কাউকে শোনে নি?

তার মনের কথা কেমন করে জেনে গেল রাক্ষসটা। চোখ লাল করে ঝাঁঝের সঙ্গে বলে উঠল, শুনবে কী করে? ও যুগে কি পৃথিবীতে এত জঞ্জাল ছিল? দিনের পর দিন তোমরা মানুষরা জঞ্জাল জমিয়েই যাচ্ছ আর জমিয়েই যাচ্ছ। এই জঞ্জাল পচছে। উঠছে দূষিত গ্যাস। মিশছে বাতাসের সঙ্গে। সেই বাতাস তোমরা নিচ্ছ নাকের মধ্যে দিয়ে। মানুষকে দিনের পর দিন খেয়ে চলেছি আমি। এই জঞ্জাল-রাক্ষস। হা হা হা। আর খেয়েই যাব কারণ জঞ্জাল তো তোমরা ক্রমশ বাড়িয়েই যাবে।

আবার অট্টহাসি। অনেক রূপকথার গল্প সে শুনেছে ঠাকুমার মুখে। সে শুনেছে সব রাক্ষসের নাকি প্রাণ কোথাও লুকোন থাকে। সেই লুকোন জায়গা থেকে প্রাণটা বার করে এনে নষ্ট করে দিতে পারলেই নাকি রাক্ষসটা মরে যায়। ইস ঠাকুমা যদি এখন এখানে থাকত।

কি আশ্চর্য এবারেও রাক্ষসটা তার মনের কথা ধরে ফেলল। হা হা হা করে অট্টহাসি হেসে বলল, আমার প্রাণ-ভোমরা কোথায় তা জানতে চাও?

অবাক হলেও বিন্তি কিন্তু সাহসের সঙ্গে হঠাৎ চেঁচিয়ে বলে উঠল, চাই চাই। অবশ্যই চাই।

--তবে শোন। জঞ্জাল থেকে আমি জন্ম নিই। এই নোংরা আবর্জনা দিয়ে আমি তোমাদের সব গিলে খাই। জল, হাওয়া সব দূষিত করে দিই। রোগ জীবাণুরা সব ঘুরে বেড়ায়। মানুষের অসুখ হয়। তবুও কেউ চেষ্টা করে না আমার প্রাণ-ভোমরা কোথায় আছে তা খুঁজে বার করার।

বিন্তি হঠাৎ বলে উঠল আমি কিন্তু সেটা জানি।

কী করে যে বলল তা সে নিজেও জানে না। কিন্তু মুখ চুন হয়ে গেল জঞ্জাল-রাক্ষসের। বলল, তুমি বাচ্চা বটে তবে বড় বুদ্ধিমান। তোমার কিছু করা যাবে বলে মনে হয় না।

তার মানে রাক্ষস একটু একটু করে পিছু হটছে। তাই বিন্তির মনে এখন খুব সাহস। চেঁচিয়ে প্রায় ধমকে বলল, আমি এই সব জঞ্জাল নষ্ট করে দেব। দেখি জঞ্জাল-রাক্ষস তুমি কী করে মানুষকে খাও।

ভয়ে সিঁটিয়ে গেল জঞ্জাল-রাক্ষস। আস্তে আস্তে সে মিলিয়ে গেল। মাঠের দশা আবার সেই আগের মত। এতক্ষণে জল-রাক্ষসের একটা কথা তার মনে পড়ে গেল। জলে ডুবে যাওয়ার আগে কিন্তু সে বলেছিল, কী জানি বাবা যদি আমার প্রাণ-ভোমরা একবার তুমি খুঁজে পাও তো—

তার মানে সব রাক্ষসদেরই একটা করে প্রাণ-ভোমরা থাকে। সেটাকে খুঁজে বার করা চাই।

এরপর আবার এগোতে লাগল বিন্তি। তার মনে শুধু চিন্তা কী করে সে বাড়ি ফিরবে। এমন সময় বাতাস খুব গরম হয়ে উঠল। ধুলো আর ধোঁয়া পাক খেয়ে খেয়ে উঠতে লাগল। আস্তে আস্তে হয়ে গেল এক বিশাল বড় চেহারা। সে চেহারা শুধু ধোঁয়া আর ধুলো দিয়ে তৈরি। অট্টহাসি হাসতে লাগল সেও। বিন্তি ভাবছিল এ কোন জায়গায় সে এসে পড়ল রে বাবা। দত্যি-দানো বিশ্বাস করে না বলেছিল ঠাকুমাকে তাই কী এরা সব লাইন দিয়ে দেখা দিতে আসছে আজ?

কালো ধোঁয়া আর ধুলোয় চোখ জ্বালা করতে লাগল বিন্তির। তবুও সে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?

আবার অট্টহাসি। হাসতে হাসতে সেই বিশাল দেহটা বলল, আমি হলাম বায়ু-রাক্ষস।

--সেটা আবার কি? তুমি এত গরম কেন আর এত ঝাঁঝাল?

--তোমরা এত গাছ কাটছ, কত হাজার হাজার কলকারখানা করছ। আগুন জ্বালাচ্ছ। তৈরি হচ্ছে বিষাক্ত গ্যাস। সেই গ্যাস আর ধোঁয়া দিয়ে আমি তৈরি হয়েছি। তৈরি হয়েছি সব খারাপ বায়ু দিয়ে। তাই আমার নাম বায়ু-রাক্ষস। আমি মানুষ আর পৃথিবীর সব প্রাণীদের নিঃশ্বাসের সঙ্গে তাদের বুকে চলে যাই। বুক একেবারে ঝাঁঝরা করে দিই। দূরারোগ্য সব ব্যাধি তৈরি করি তাদের শরীরে। তারা ভাল করে শ্বাস নিতে পারে না। অকালে সব মারা যায়। আর-

আরও আছে? যা শুনল তাতেই তো পিলে চমকে যাচ্ছে তার। রাক্ষসটা কিন্তু বলেই যাচ্ছে, বাতাস কিন্তু ক্রমেই গরম হচ্ছে। শীতকাল আর থাকবে না। বর্ষা করে দেব এলোমেলো। যখন খুশি সে আসবে যাবে। ফসল সব নষ্ট হয়ে যাবে। মানুষকে না খেতে দিয়ে মারব। বন-জঙ্গল শুকিয়ে যাবে। ঘাস-পাতা আর হবে না। জন্তুরা কী খাবে বল? তোমাদের সারা পৃথিবীটা আমি ধ্বংস করে দেব। হা হা হা। 

বিন্তি মনে মনে কেঁপে উঠল। বাবা এ তো তবে সবচেয়ে বড় রাক্ষস। কিন্তু কায়দা করে এর প্রাণ-ভোমরাটাও জেনে নিতে হবে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সেই বায়ু-রাক্ষস বলে উঠল, তো্মার মত বুদ্ধিমান মেয়ে আমাদের কাছে খুব বিপদের। আমার প্রাণ-ভোমরা তুমি নিশ্চয় বুঝে ফেলেছ।

বিন্তি খুব সাহসী হয়ে উঠল। চেঁচিয়ে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ আমি জেনে ফেলেছি। আমি ধরে ফেলেছি কী করে তোমাদের মত রাক্ষস তৈরি হচ্ছে আমাদের পৃথিবীতে। দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা। ঠাকুমাকে বললেই হবে।

বায়ু-রাক্ষস তো খুব ভয়ে পেয়ে গেল। ভয়ে মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, সত্যি তুমি ধরে ফেলেছ নাকি কোথায় আমার প্রাণ-ভোমরা আছে?

--হ্যাঁ হ্যাঁ। ধরে ফেলেছি। আমরা গাছ কাটা বন্ধ করব। বদলে অনেক অনেক গাছ পুঁতব। আমরা বায়ুতে কম আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করব। যতটা দরকার ঠিক ততটাই বিদ্যুৎ খরচ করব। না হলে বিদ্যুৎ তৈরি করতে বেশি কয়লা পুড়িয়ে সেই বিদ্যুৎ তৈরি করতে হবে। অনেক জল ফুটিয়ে বাষ্প করে টারবাইন ঘোরাতে হবে। বাতাসে তৈরি হবে আরও অনেক জলের বাষ্প, অনেক কার্ব-ডাই-অক্সাইড। মানে তোমার মত বায়ুরাক্ষস। প্রকৃতি-বিজ্ঞান আমি পড়েছি কিন্তু।

বায়ু-রাক্ষস ফুস করে চুপসে গেল। বিন্তি দেখল সত্যি তো তার মন্ত্রে কাজ হয়েছে। এক্ষুনি বাড়ি ফিরে গিয়ে ঠাকুমাকে বলতে হবে দত্যি দানো সত্যি সত্যি আছে। আর তারা এই পৃথিবীকে গিলে খাওয়ার জন্যে একেবারে রেডি হয়ে আছে। কিন্তু বিন্তিও জানে তাদের প্রাণ-ভোমরা আছে কোথায়। তাই দত্যি দানোকে সে আর বাকি সকলে মিলে ধ্বংস করতে অবশ্যই পারবে। এই সব রাক্ষসদের প্রাণ-ভোমরা লুকিয়ে আছে মানুষের শিক্ষা আর জ্ঞানের মধ্যে। শুধু একটু সচেতন হলেই সেই ভোমরাটাকে টিপে মেরে ফেলা যাবে। 

বাদামী ঘোড়া বলেছিল সত্যিকারের দরকার হলে বিন্তি যেন তাকে ডাকে। এখন এই বাড়ি ফিরে যাওয়াটা তার সত্যিকারের দরকার। মনে মনে বলল, ও আমার বাদামী ঘোড়া বন্ধু। শিগগির এস। আমাকে যে বাড়ি ফিরে যেতে হবে।

টগ বগ টগ বগ। ঘোড়া আসার শব্দ। কিন্তু একি! এ তো সেই বাদামী ঘোড়া নয়? এ যে ধবধবে এক সাদা ঘোড়া। অবাক হয়ে বিন্তি জিজ্ঞেস করল, তুমি সাদা কী করে হলে বন্ধু?

সাদা ঘোড়া চিঁ হিঁ হিঁ করে হেসে উঠে বলল, তখন তিন তিনটে বড় রাক্ষস ছিল। তাই আমার রঙ ছিল গাঢ় বাদামী। আজ সেই রাক্ষসগুলোকে তুমি মারবার প্রতিজ্ঞা করে বাড়ি ফিরছ। তাই আমি ধবধবে সাদা হয়েছি। তুমি যে সেই বীরাঙ্গনা রাজকন্যা যে একসঙ্গে তিন তিনটে রাক্ষস বধের প্রতিজ্ঞা করতে পেরেছ। জল-রাক্ষস, জঞ্জাল-রাক্ষস আর বায়ু-রাক্ষসই হল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় তিন রাক্ষস। এরা পৃথিবী দখল করবে আর কিছুদিন পরে। মানুষ আর থাকার জায়গাই পাবে না। কিন্তু তুমিই পারবে এই রাক্ষসগুলোকে জব্দ করতে।

বিন্তি লজ্জা পেয়ে বলে উঠল, কিন্তু আর সবাই?

চিঁ হিঁ হিঁ করে হেসে উঠল সাদা ঘোড়া। বলল, সবাই কি আর রাক্ষসদের চিনতে পারে? নাকি বুঝতে পারে তাদের প্রাণ-ভোমরা থাকে ঠিক কোনখানটায়? কিংবা হয়ত চিনে বুঝেও না বোঝার ভান করে। তুমিই ঠিক ঠিক পারবে পৃথিবীটাকে রাক্ষস মুক্ত করতে। চল এখন তোমার অনেক কাজ। সবাইকে এই প্রাণ-ভোমরার হদিস দিতে হবে তো?


Rate this content
Log in

More bengali story from DrArun Chattopadhyay