মাস্টারমশাই শারদ সংখ্যা
মাস্টারমশাই শারদ সংখ্যা


হরেন আজও স্কুলে আসেনি। এই নিয়ে সাতদিন পরপর হরেন স্কুল কামাই করল। প্রত্যেক দিনই ভাবানিচক প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার অনাদিবাবুর ঘরের সামনে হরেন ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অনাদিবাবু ঘরে এলে হরেন তার পায়ে ফুল দিয়ে প্রণাম করে। প্রথম প্রথম হরেন বাবুর অসস্তি হত, এখন বেশ ভালই লাগে। ছেলেটার বাড়ির শিক্ষা দীক্ষা বেশ ভালই তাহলে । আজ কাল তো শিক্ষককে সম্মান করার কথা ছাত্র ছাত্রীরা ভুলেই গেছে। ছোট স্কুল, জনা সত্তর মত ছাত্র ছাত্রী । অনাদীবাবু ছাড়া আর চারজন শিক্ষক। সকলেই এই গ্রামে থাকেন। শুধু তিনি আসেন সেই সাতমাইল গ্রাম থেকে। কিলোমিটার দশেক রাস্তা গ্রামের মধ্যে দিয়ে সাইকেল চালিয়ে আস্তে হয়। পঞ্চান্ন বছর বয়সী একজন প্রায় প্রৌঢ়ের পক্ষে গ্রামের ভাঙ্গা চরা রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে আসতে কষ্ট হয় ঠিকই কিন্তু স্কুলে ঢুকে কচিকাঁচাদের হাসিমুখ দেখে আর তাদের চঞ্চলতা উদারতা, তার সেই কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। শুধু এদের জন্যেই তার এত কষ্ট করে আসা সার্থক মনে হয়। হরেন রোজ তার জন্যে ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত তার ঘরের সামনে। ক্লাস টু এ পড়ে হরেন। পুরো নাম হরেন্দ্রনাথ দাস। পড়াশোনায় খুব একটা ভালো নয়। মাঝারি। কোনোমতে পাশ করে যায়। তা, পড়াশোনায় সবাই যে খুব ভালো হবে তার তো কোনো মানে নেই, চরিত্রের গঠনই হলো আসল গঠন। তা হরেন খারাপ ছেলে ছিল না। রোজ তাকে ফুল দিত, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করত, তারপর নিজের ক্লাসে গিয়ে বসত। কারোর সাথে ঝগড়া ঝাটি মারামারি করত না। একেবারে নিজের মতই থাকত। এই সাতদিন ছাড়া কোনোদিনই হরেন স্কুল কামাই করেনি। রোজই এসেছে। তাহলে এখন কি হল? শরীর খারাপ? নাকি বাড়িতে কোনো সমস্যা? অনাদিবাবু ঠিক করলেন প্রথম ক্লাস শেষ হলে তিনি একবার ক্লাস টু এ গিয়ে খোঁজ নেবেন, কেউ যদি বলতে পারে হরেনের কথা।
এমনিতেই অনাদিবাবু স্কুলের প্রত্যেকের সম্পর্কেই ওয়াকিবহাল। কে কি করছে না করছে সবই তার নখদর্পণে। সে স্কুলের ছাত্রই হোক, বা শিক্ষক বা ক্লার্ক বা দারোয়ান। সকলেরই খবরাখবর তিনি নিয়মিত নেন। কারোর কোথাও কোনও অসুবিধা হচ্ছে কিনা, বা কারোর কিছু প্রয়োজন আছে কিনা। আসলে তিনি মনে করেন, এই স্কুলে তিনি তাদের প্রত্যেকের অভিভাবক। তার দায়িত্ব সকলকে ভালো রাখার।
ক্লাস শেষ হওয়ার ঘন্টা পড়তেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন অনাদী বাবু। ক্লাস টু এ আজ বেশি স্টুডেন্ট আসেনি। তাদের মধ্যে ই জিজ্ঞাসা করলেন,
- তোমরা কেউ হরেনের খবর জানো?
- না স্যার। সবাই একসাথে চিৎকার করে বলে উঠল।
- কেউ ওর বাড়ি চেনো?
- না স্যার। আবারও সবাই একসাথে বলে উঠল।
- ওর বাড়ি কোনদিকে তাও জানো না, না?
- না স্যার। আবারও একসাথে।
- আচ্ছা ঠিক আছে। তোমরা পড়াশোনা করো।
ক্লাস থেকে বেরোতে যাবেন, এমন সময় পিছন বেঞ্চ থেকে একটি ছেলে বলল, স্যার ওর বাড়ি আমরা চিনব কি করে, ও তো আমাদের সাথে খেলেই না। ও একা একা আসে, একা একা বাড়ি চলে যায়। কত করে বলি, আয় আমাদের সাথে খেলবি আয়, ও শোনেইনা আমাদের কথা। বগলে করে বই খাতা নিয়ে আসে আবার বগলে করেই বই খাতা নিয়ে বাড়ি চলে যায়। খুব ভীতু স্যার। খেলতে গেলে যদি হাত পা কেটে যায়, সেই ভয়ে ও খেলতে চায় না।
অনাদিবাবুর হাসি পেল ছেলেটার কথা শুনে। তিনি ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলেন। কিন্তু আশ্চর্য তো, একটা বাচ্চা ছেলে খেলাধুলা করতে চায় না? সে কি তবে অসুস্থ নাকি সে ভয় পায়?
অফিস ঘরে গিয়ে ক্লার্ক বিজন বাবুকে বললেন -
- বিজন বাবু একবার ক্লাস টু এর রেজিস্টার খাতাটা বের করে দিন না আমায়। হাতের কাজ শেষ করেই না হয় দেবেন।
অমায়িক অনুরোধ ফেলতে পারলেন না বিজন বাবু । বয়সে বিজন বাবু হেডস্যারের থেকে অনেক ছোট হলেও হেডস্যার তাকে বাবু বলে কথা বলেন। শুধু তাকেই নয়, স্কুলের প্রত্যেক কর্মচারী কেই তিনি যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে কথা বলেন। সে দারোয়ান হোক বা শিক্ষক। তিনি মনে করেন মানুষকে সম্মান করার মধ্যে দিয়েই নিজের সম্মান লাভ করা যায়। আর সেই জন্যে অনাদি বাবুকে সকলেই খুব শ্রদ্ধা করেন। তার কোনো কথায় কেউ না বলতে পারেন না।
বিজনবাবুও হাতের কাজ সরিয়ে রেখে আলমারি খুলে ক্লাস টু এর রেজিস্ট্রার খাতা টা বের করে অনাদীবাবুর হাতে দিলেন।
কি হবে স্যার? হটাৎ খাতা চাইলেন? বিজন বাবু কিছুটা আশ্চর্য হয়েই জিজ্ঞাসা করলেন।
অনাদি বাবু খাতায় চোখ রেখেই উত্তর দিলেন - ওই যে হরেন, হরেন্দ্রনাথ দাস, গত সাতদিন ধরে স্কুলে আসছে না। ওর ক্লাসে ওর কোনও বন্ধুও নেই যে ওর খবর দিতে পারবে। তাই ভাবছি ওর বাড়ির ঠিকানাটা একবার বের করে ওর বাড়ি থেকে একবার ঘুরে আসলে কেমন হয়? খবর নিয়ে আসা যাবে আর যদি কোনও বিপদ আপদ হয় তবে একটা কিছু ব্যবস্থা অন্তত করে আসা যাবে।
তারপর খাতা থেকে মুখ তুলে বললেন - কি বলেন বিজন বাবু? আমাদের তো এটাও দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, তাই না? আমরা ছাত্র পড়ানোর জন্যে যেমন মাইনে পাই ঠিকই কিন্তু যদি তাদের অন্তরের আত্মীয় না করে নিতে পারি তাহলে আমরাই বা ওদের কাছ থেকে কতটুকুই বা আশা করতে পারি তাই না? ওরা এখন ছোট, কাঁচা মাটির তাল। ওদের এখন যা শেখাবো, ওরা তাই শিখবে। দেখুন, পড়াশোনা তো সবার দ্বারা হয় না, কিন্তু মনুষ্যত্বের বীজটা যদি ছোট থেকেই এদের মধ্যে বুনে দিতে পারি তাহলে বড়ো হয়ে আর যাই হোক, অমানুষ হবে না। আমরা শিক্ষক। মানুষ গড়ার কারিগর। তা এই কারিগরী বিদ্যে টা কি শুধু ক্লাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখব? বাইরে ছড়িয়ে দেব না কেন বলুন তো?
মুগ্ধ হয়ে শোনেন বিজনবাবু। সবে এক বছর হয়েছে এই স্কুলে প্রধানশিক্ষক হয়ে এসেছেন অনাদি বাবু। এসেই শুধু নিজের প্রবল মুগ্ধ করা ব্যাক্তিতকে সঙ্গী করে শুধু স্কুল নয়, পুরো গ্রামকেই আপন করে নিয়েছেন। আগে এই স্কুলে কেউ তার ছেলেদের পড়তে পাঠাতে চাইত না। সবাই বলত এখানে যারা ভর্তি হয় তারা গুন্ডা ডাকাত চোর এইসব তৈরি হয়। আর এসব যদি না হতে পারে তাহলে ছোটখাট রাজনৈতিক মস্তান তো তৈরি হবেই।
আর বলবে নাই বা কেন। স্কুলে তো পড়াশোনা কিছু হতো না, স্যারের এসে আড্ডা মেরে বাড়ি চলে যেত। কেউ কেউ ক্লাস রুমে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়ত, উঠত ছুটির ঘন্টা পড়লে। মাঝে মাঝে এলাকার ছোটখাট নেতারা এসেও গুলতানি মেরে যেত। ছেলেদের নিয়ে যেত মিটিং এ মিছিলে। স্যার দের ভালই হত। তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যেতে পারত। স্কুলের তখন যিনি হেডমাস্টার ছিলেন, তিনি কিছুই বলতেন না। ভাবতেন বাধা দিলে যদি তার পেনশন আটকে যায়। সেই ভয়ে উনি সাপোর্ট করতেন বিষয় গুলোকে। ছাত্র সংখ্যা কমতে কমতে ১০ জন এসে ঠেকেছিল। গত পুজোর আগে ওই হেডমাস্টার চলে যাওয়ার পর অনাদিবাবু আসেন। আগে কলকাতায় কোনও এক স্কুলে হেডমাস্টার ছিলেন। এখন ট্রান্সফার হতে এখানে এসছেন। যেদিন প্রথম এলেন সেদিনই এলাকার কয়েকজন নেতা টাইপের লোক এসে বললেন, শেষ বয়সে এখানে এসে ভালই করেছেন দাদা। আর বেশিদিন স্কুলটি তো থাকবেনা। আর হয়ত বছর দুয়েক । তারপর তো অবসরের আগেই অবসর। মানে শরীরটাকে টেনে এনে স্কুলে ফেলতে হবে আর সময় হলে শরীরটাকে টেনে টেনে বাড়ি নিয়ে যেতে হবে। এইটুকু তো কাজ করতে হবে। ভালো থাকবেন আর আমরা মাঝে মধ্যেই আসব, আপনার খবরাখবর নেব, অসুবিধা হলে বলবেন দাদা, আমরা আপনার পাশে থাকবো। আপনিও আমাদের দেখবেন, মানে ওই মিটিং মিছিল হলে নিজে যাবেন, সবাই কে নিয়ে যাবেন, এই সব ক্লাসের ছেলেদেরও নিয়ে যাবেন, এই আর কি। আপনি দেখবেন, আমরা দেখব, ওই যে কবি বলেছে না, সকলের তরে সকলে আমরা। আপনি মাস্টার মানুষ, আপনি তো আরও ভালো জানবেন আমার থেকে। চলি তাহলে।
বিজনবাবু দূরে বসে সব কিছু দেখছিলেন। দেখলেন অনাদি বাবু ওদের কিছু না বলে শুধু হাসলেন। টিচাররা গদ গদ ভঙ্গিতে ওদের এগিয়ে দিতে গেলেন, ওদের কোনও প্রস্তাবে সম্মতিও দিলেন বোধহয়। বিজনবাবুর ভালো লাগে না এসব। নিজে শিক্ষক পরিবারের সন্তান। বাবাকে দেখেছেন কিভাবে তিলতিল করে নিজের শ্রমে এক এক জন ছাত্রকে গড়ে তুলতে। তাদের দুঃখে দুঃখ পেতে, তাদের খুশিতে আত্মহারা হতে। তার বাবার হাতে গড়া ছেলেরা সবাই আজ সমাজের গণ্যমান্য লোক। বিজনবাবুরও খুব সাধ ছিল শিক্ষক হওয়ার, কিন্তু হতে আর পারলেন কই। পড়াশোনায় তো তেমন ভালো ছিলেন না, তা সে আক্ষেপ অনেকটুকু মিটেছে স্কুলে চাকরি করতে এসে। কিন্তু যে ধারনা নিয়ে এসেছিলেন সে ধারনা এখন গভীর সমুদ্রে। এই স্কুলে তার ভালো লাগে না। বদলির জন্য অনেক দরখাস্ত করেছেন, কিন্তু তার আর বদলি হচ্ছে না। স্কুল না থাকলে বসে বসে মাইনে নেওয়ার লোক তিনি নন। সেদিন এই অনাদি বাবু যখন ওদের কথা শুনে শুধু মুখ টিপে হেসেছিলেন তখন অনাদি বাবুকে ওদেরই লোক বলে মনে করেছিলেন। ভেবেছিলেন শেষের শুরু তাহলে এখন থেকেই। কিন্তু ভুল ভাঙলো ঠিক ক'দিন পরেই। পুজোর ছুটি পড়ার সপ্তাহখানেক আগে অনাদি বাবু স্কুলে একটা মিটিং ডাকলেন। সকলে ভেবেছিলেন এমনি মিটিং। যেমন হয় আর কি। একটু চা বিস্কুট খাওয়া, আড্ডা, আর যদি বাজারের মিষ্টির দোকানে গরম সিঙ্গারা ভাজা শুরু করে তাহলে দারোয়ান গিয়ে সেই সিঙ্গারা নিয়ে এলে সেই সিঙ্গারা খাওয়া। এর বাইরে কোনোদিন এই স্কুলে আর কিছু হয় নি আর হবেও না। কিন্তু সকলের ভাবনাকে একবারেই পাল্টে দিলেন সেদিন অনাদি বাবু
- ভাবছি এবার পুজোর ছুটির আগে এলাকার সমস্ত মানুষজনকে নিয়ে একটা মিটিং করব। এলাকার মান্যগণ্য ব্যক্তিরাও থাকবেন। বিডিও সাহেবকেও অনুরোধ করব যদি সময় দেন। আর হ্যাঁ, অঞ্চলের প্রধান, পঞ্চায়েত সদস্য, আর এম এল এ, এম পি কেও আসতে অনুরোধ করব। কিন্তু কোনও একটা অনুষ্ঠানকে তো উপলক্ষ্য করতে হয়, তা আপনারা সকলে একটু ভাবুন না, কোন অনুষ্ঠানে তাদের আমন্ত্রণ জানানো যায়?
- সামনেই তো পুজো, তা পুজোর আগে সেরকম কোনও অনুষ্ঠান তো নেই। আর আমাদের স্কুলে এই তো কজন ছাত্র, অনুষ্ঠান আর করবেন কাদের নিয়ে।
বললেন সুমিত বাবু।
অচিন্ত্য বাবু বললেন -
- সত্যি কথা বলতে কি স্কুলে ছাত্রদের কোনও অনুষ্ঠান কোনোদিনই হয়নি আজ পর্যন্ত। অনুষ্ঠান বলতে পার্টির সভা সমাবেশ। তা আপনার যখন ইচ্ছা তখন একটা কাজ করলে হয়, স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে পারেন। যে জনা দশেক ছাত্র আছে তাদের দিয়েই অনুষ্ঠান করানো যেতে পারে। সকলেই কিছু না কিছু করুক।
অবিনাশ বাবু বললেন -
স্কুলের টিচার, দারোয়ান, সকলেই অংশ নিক। আর যাদের নিয়ে আসার কথা ভাবছেন, তাদের কে কি আর নিয়ে আসতে পারবেন?
- আসলে সবাই তো হাল ছেড়ে দিয়েছে, আমি না হয় শেষ চেষ্টা করি একবার। যদি কিছু করতে পারি।
অনাদি বাবু বললেন।
- দেখুন, কি হয়। অনেকটা বাঁকা সুরে বললেন দেবেশ বাবু। করতে চাইছেন করুন, কিন্তু ভেবে দেখেছেন টাকা পয়সা কোত্থেকে আসবে? স্কুলের ফান্ডে এক পয়সা নেই। থাকলেও সেটা বের করা সহজ হবেনা। প্রেসিডেন্টের সই লাগবে। আর এইসব ফালতু অনুষ্ঠানের জন্য প্রেসিডেন্ট টাকা তুলতে দেবেন না। একেই তো স্কুল উঠে যাবে । মরণকালে হরিনাম করতে এলেন নাকি আপনি?
দেবেশ বাবু রাজনীতি করেন। শাসক শ্রেণীর সমর্থক। খুব ইচ্ছা ভোটে দাঁড়াবেন কিন্তু এখনও সেই সুযোগ আসেনি। কিন্তু স্বভাবগত বিরোধিতা করা তার অভ্যাস।
- আমি স্কুলের ফান্ডে হাত দেব না। দেবেশ বাবু। আপনাকে ও নিয়ে ভাবতে হবে না।
- তবে কি ছাত্র দের কাছ থেকে টাকা তুলবেন? জানেন এটা বেআইনি?
- আমি তো তা বলিনি।
- ও, তাহলে কি আমরা টাকা দেব? ওটি হচ্ছে না। আমরা এক পয়সা দেব না। মামদোবাজি নাকি?
- ভাষা সংযত করুন দেবেশ দা। প্রতিবাদ করলেন সুমিত বাবু। আমরা যদি কিছু করে টাকা স্কুলে ডোনেট করি তাহলে আপনার অসুবিধা কোথায়?
- না না, আমরা দেব ১০০ টাকা, খরচ হবে ১০ টাকা। বাকি ৯০ টাকা হেডস্যারের বাড়িতে হাওয়া খেতে যাবে। আমি কিছু বুঝি না ভেবেছেন?
আশ্চর্য মানুষ বটে অনাদি বাবু। উত্তেজিত না হয়ে ঠান্ডা মাথায় বললেন, চিন্তা করবেন না কেউই। আমি পুরো টাকাটাই নিজে খরচ করব। বলতে পারেন স্কুলের প্রতি এটা আমার একটা দায়। অনেকতো নিলাম। এবার কিছু তো ফিরিয়ে দিই।
সবাই আশ্চর্য হলেন কথা শুনে। অচিন্ত্য বাবু বললেন, না না স্যার আপনি একা কেন, আমরা সবাই যে যেমন পারব দেব।
- ধন্যবাদ, কিন্তু আমি কোনও বিতর্কের মধ্যে থাকতে চাই না। আমরা অনুষ্ঠান কি করে সুন্দর করা যায় সেটা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করুন। আর বাকি টা আমার উপর ছেড়ে দিন স্যার। বিজনবাবু আপনি সবার একটা লিস্ট বানান। আমন্ত্রণ পত্র ছাপাতে হবে। ছাত্রদের অভিভাবকদেরও আমন্ত্রণ পত্র দিয়েই অনুরোধ করা হবে। সুমিত বাবু আপনি সুন্দর করে একটা লেখা লিখে দিন কার্ডের জন্যে, আর এই নিমন্ত্রণের কাজ টা কিন্তু আমরা সকলে মিলে করব।
বিজনবাবু নতুন করে চিনলেন সেদিন অনাদি বাবুকে। মনে মনে ভাবলেন পারলে ইনিই পারবেন। না পারলে কেউ পারবে না। কেমন যেন ভালো লেগে গেল মানুষটাকে।
তারপর বেশ কিছুদিন খুব ব্যস্ততা। কার্ড ছাপা হল। সকলকে বিলি করা হল। বিলি করার কাজে একমাত্র দেবেশ বাবু ছাড়া সবাই অংশ নিয়েছিলেন। শুধু নেতাদের নিমন্ত্রণ করার সময় তিনি গেছিলেন। স্কুল ছুটির পর হেডস্যার সহ সকল শিক্ষক, বিজন বাবু, দারোয়ান রমেশ সবাই মিলে যাওয়া হত ছাত্রদের বাড়ি । গ্রামে বেশ একটা সাড়া পরে গেল। সবাই বুঝলো এবার ভালো একটা কিছু হতে চলেছে। গ্রামের লোক একটু অবাকই হয়েছিল। কোনোদিন হেডস্যার তো দূরের কথা স্কুল থেকে কেউই বাড়ি আসেনি। সেখানে এখন সকলে একসাথে। তার মানে পরিবর্তন কিছু একটা হলেও হতে পারে।
অনুষ্ঠানের দিনটাও ভালোভাবে কেটে গেল। স্কুলের সামনের মাঠে মঞ্চ বানানো হয়েছিলো। স্কুলের ছেলেরা গান করল, আবৃতি করল, যে যেমন পারে। বিডিও, এম এল এ, এম পি, পঞ্চায়েত সদস্য, সকলেই এসছিলেন। সকলে হেডস্যারের ভুয়সী প্রশংসা করলেন মঞ্চে উঠে । সকলেই বললেন হেডস্যারের আন্তরিক আমন্ত্রণ তারা ফেলতে পারলেন না। আসতেই হল। আর স্কুল যাতে আরও উন্নতি করে সে বিষয়ে তারা প্রত্যেকে যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন।
এরপর এল ছাত্র ভর্তির মরসুম। আবার শুরু হল হেডস্যারের নেতৃত্বে ছাত্র খুঁজতে বাড়ি বাড়ি যাওয়া। স্কুলের টিচারদের মধ্যেও পরিবর্তন এল। তারাও উৎসাহে যেখান থেকে পারতেন ছাত্র জোগাড় করতে লাগলেন। ১০ জন থেকে ছাত্র হল ৭০ জন। আর এই বছরই হরেন ভর্তি হল এই স্কুলে। বয়স একটু বেশি থাকায় ক্লাস টু এ ভর্তি করা হল তাকে। সেই প্রথম দিন থেকে হরেন স্কুলে এসে হেডস্যারের ঘরের সামনে ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। স্যার এলে তাকে ফুল দিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে। সত্যি তো যে ছেলে একদিনও কামাই করে না, সে সাতদিন না এলে চিন্তা হয় বইকি।
- স্যার ওর বাড়ি এই গ্রামে নয়। পাশের গ্রাম নলাহাটিতে থাকে। মাইল চারেকের রাস্তা। যাবেন ?
- যে তে হবেই বিজন বাবু। খুবই চিন্তায় আছি। আপনি পুরো ঠিকানাটা একটা কাগজে আমাকে লিখে দিন। ভাবছি এখনই বেরিয়ে যাই। সুমিত বাবুকে আপাতত দায়িত্ব দিয়ে যাই।
বলে অনাদি বাবু নিজেই গেলেন টিচার্স রুমে।
- সুমিতবাবু আপনি একটু আজকের দিনটা স্কুলটা সামলে নিন। আমি একটু বেরোব।
- কেন স্যার, কোনও সমস্যা?
- ওই হরেন এক সপ্তাহ ধরে আসছেনা স্কুলে, একটু ওর বাড়ি থেকে খোঁজ নিয়ে আসি, দেখে আসি কোনও বিপদ আপদ হল কিনা।
- স্যার, আপনি একা যাবেন কেন, আমিও যাব আপনার সাথে। সেরকম হলে দুজন থাকলে সুবিধা হবে। সুমিত বাবু বললেন।
- যাবেন, তাহলে চলুন। কিন্তু স্কুলের দায়িত্ব? অনাদি বাবু চিন্তিত ভাবে বললেন।
- অচিন্ত্য বাবু আছেন, কোনো চিন্তা করবেন না। আপনি অচিন্ত্য বাবু কে বলে দিন।
- সেই ভালো। দুজন থাকলে সুবিধাই হবে।
বলে তিনি অচিন্ত্য বাবুকে ক্লাসে গিয়ে বলে এলেন স্কুল সামলানোর কথা। তারপর দুজনে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন হরেনের বাড়ির দিকে।
ভবানিচক গ্রামের শেষে বাঁদিকে নেমে যাচ্ছে কাঁচা রাস্তা। এই রাস্তাই নলাহাটি গ্রামের রাস্তা। এখনও কংক্রিটের ঢালাই হয়নি। কাঁচা রাস্তা। গ্রামের অবস্থা ভালো নয়। পাকা বাড়ি নেই বললেই চলে। রাস্তার দুধারে চাষ জমি আর অনেক দূরে দূরে একটা দুটো বাড়ি। লোকজন রাস্তায় তেমন নেই যে কাউকে জিজ্ঞেস করবেন হরেনের বাড়ি কোথায়।
আর কত টা যেতে হবে বলুন তো সুমিত বাবু, কাউকেই তো দেখতে পাচ্ছিনা।
চলুন আর কিছুটা যাই, তারপর দেখছি।
আরও খানিকটা যাওয়ার পরে দেখলেন দূরে একটা লোক মাথায় খড়ের বোঝা নিয়ে এদিকেই আসছে। লোকটা আরও কাছে এগিয়ে আসতে সুমিত বাবু তাকে দাঁড় করালেন।
এই যে শুনছেন?
- ইজ্ঞে আমাকে বলছেন বাবু? লোকটা জিজ্ঞেস করল।
- হ্যাঁ তোমাকেই। বলছি তুমি কি এই গ্রামে থাক?
- হ্যাঁ বাবু।
- বলছি হরেনের বাড়ি কোথায় যান? বাচ্চা ছেলে বছর আট নয় বয়স। বাবার নাম গগন। চেনো ওদের বাড়ি।
- আপনেরা কারা বাবু? হরেনের খোঁজ করতিছেন? মাথা থেকে খড়ের বোঝা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল লোকটা।
- আপনি চেনেন ওকে? অনাদি বাবু জিজ্ঞেস করলেন। আমরা ওর স্কুল থেকে আসছি। খুব দরকার। ওর বাড়ি একবার যাব। যদি আমাদের নিয়ে যান তো খুব ভালো হয়।
- আপনেরা ওর ইস্কুল থেকে আসতিছেন?
- হ্যাঁ, ইনি আমাদের হেডস্যার। সুমিত বাবু অনাদিবাবুকে দেখিয়ে বললেন।
- আসলে ও এক সপ্তাহ ধরে স্কুল আসছে না, তাই খোঁজ নিতে আসছি। একটু যদি ওর বাড়ি নিয়ে যান আমাদের খুব ভালো হয়। অনাদি বাবু বললেন।
- আসেন স্যার আসেন । এই পাশেই আমার বাড়ি আমারই ছেলে হারু। সাত দিন ধরে খুব জর। গা একেবারে আগুন ।
- বলেন কি? ডাক্তার দেখাননি?
- কি যে বলেন স্যার, এ গেরামে আর ডাক্তার কোথায়। ওই ওখানে মায়ের থানে জল পড়া দেয়, জর হলে ওটি খাওই দিই। সব বার সেরে যায় কিন্তু এবার আর সারতিছে না।
কথা বলতে বলতে তারা হরেনের বাড়ির সামনে এল। ছোট একটা মাটির বাড়ি । জির্ণদশা অবস্থা। দরজা জানলা ঘুন ধরে গেছে।
- হরেন, হারু দেখ কে এয়েছে তোকে দেখতে। তোর ইস্কুল থেকে মাষ্টারমশাই এয়ছে। ওঠ বাবা, একটু উঠে বোস তো বাবা।
তারপর অনাদি বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, কোথায় বসতে দিই আপনাদের বলুন তো, এই ভাঙ্গা ঘর, এই এখানে বসেন। বলে মেঝেতে যেখানে মাদুরের উপর হরেন শুয়ে ছিল তার পাশে দুটি আসন পেতে দিলেন।
আসনের উপর বসে অনাদি বাবু হরেনের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, বাব হরেন খুব কষ্ট হচ্ছে না। গা তো পুরে যাচ্ছে।
হরেনের বাবা কে বললেন ওর মা কোথায়?
- সে তো গেছে জন খাটতে। একদিন ফাঁকি দিলে তো তিনদিনের টাকা কেটে নেবে। কি করবে বলুন। এই ছেলেকে ঘরে রেখেই তাই বেরোতে হয়।
- কি আশ্চর্য। ওকে তো এখুনি ডাক্তার দেখাতে হবে । আমি ডাক্তার ডেকে আনছি ভবানীচক থেকে। আপনি এখানে থাকুন সুমিত বাবু,
বলে অনাদি বাবু বেরিয়ে গেলেন । কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তার ডেকে আনলেন অনাদি বাবু।
ডাক্তার এসে ওষুধ দিলেন। কিছু ওষুধ অনাদি বাবু আসার সময় কিনেই এনেছিলেন। পরম স্নেহে হরেন কে আসতে আসতে খাইয়ে দিতে লাগলেন।
সুমিত বাবু আপনি বাড়ি চলে যান। আমি থেকে যাই। ওর মা আসুক তারপর না হয় যাব।
সুমিত বাবু শুনে বললেন, তা কি করে হয় স্যার। আমিও থেকে যাচ্ছি আপনার সাথে। দরকার হলে সারা রাত এখানে আমরা থেকে যাই।
অনাদি বাবু খুশী হলেন। বললেন সেই ভাল। তারপর হরেনের বাবাকে বললেন আপনি কাজে চলে যান। আমরা আছি, আমরাই দেখাশোনা করব হরেনের।
আমার যে কি লজ্জা লাগতিসে সে আর কি বলবো। হরেনের বাবা বলল ।
না না আপনি যান। কোনও চিন্তার কোনো কারণ নেই।
সুমিত বাবু বললেন।
হরেনের বাবা চলে গেলেন কাজে। অনাদি বাবু সুমিত বাবু ক্রমাগত হরেনের মাথায় জল পটি দিতে লাগলেন। ঘনটাখানেক বাদে হরেনের গা একটু ঠান্ডা হল। ঘরে থার্মমিটার যে নেই তা বুঝেই অনাদি বাবু একটা থার্মোমিটার কিনে এনেছিলেন। এখন জর ১০০ মত। হরেন আসতে আসতে চোখ খুলল।
স্যার, ভালো আছেন? বলে উঠে নমস্কার করতে গেল। অনাদি বাবু বাধা দিলেন।
হরেন বলল - স্যার আজ ফুল তোলা হয়নি।