শুভায়ন বসু

Classics Children

4.1  

শুভায়ন বসু

Classics Children

ডেড লেটার

ডেড লেটার

5 mins
933


"কি সব চিঠি আসে দেখুন অনিলদা, কি যে করব এদের নিয়ে!" বিরক্তির সঙ্গে একটা সুন্দর গোলাপী খাম, পোস্টমাস্টার অনিল ঘোষের হাতে প্রায় জোর করে ধরিয়ে দিয়ে পালায় পোস্টম্যান হারু।

অনিল বাবু খামটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে একটু দেখলেন। এরকম বেশ কিছু চিঠি প্রতিদিনই জমা পড়ে, যার হয় ঠিকানা লেখা নেই বা ভুল লেখা আছে। এসব চিঠি ডেডলেটারের খোপে জমা হয় আর কয়েক বছর পর পর অনেক জমে গেলে, অকশন করে দেওয়া হয় বা পুড়িয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এই চিঠিটা হারু কেন যে তার হাতেই দিয়ে গেল বুঝে পেলেন না অনিলবাবু। হাতের লেখাটা বাচ্চার আর চিঠিটা লেখা হয়েছে ভগবানকে ।খামের উপর ডাকটিকিটও ঠিকঠাক বসানো । চিঠিটা পাশে রেখে নিজের কাজে ডুবে গেলেন তিনি। মফস্বলের পোস্টঅফিস হলেও, স্টাফ কম বলে চাপ খুবই বেশি। তার ওপর তিনি আবার পোস্টমাস্টার।

টিফিন টাইমে ভিড় একটু পাতলা হতেই তিনি চিঠিটা হাতে নিয়ে আবারও দেখলেন। একটা বাচ্চা ভগবানকে কি চিঠি লিখেছে তা জানতে বড় কৌতুহল হয়। ডেডলেটার বলেই শেষে খামটা আস্তে আস্তে খুলে, চিঠিটা বার করে ফেলেন অনিলবাবু। গোটা গোটা অক্ষরে কয়েক লাইনের চিঠি ,একটা বাচ্চারই কান্ড। চিঠিটা এরকম।

প্রিয় ভগবান,

তুমি তো আকাশে থাক, মা বলেছে। আমার বাবাও তো আকাশে চলে গেছে ।সবার বাবা আছে,কিন্তু আমি কখনো আমার বাবাকে দেখিনি ।শুনেছি,বাবা নাকি তোমার কাছে আছে ।সবাই কি মরে গেলে তোমার কাছে চলে যায়? ভগবান, আমার বাবাকে তুমি কোথায় লুকিয়ে রেখেছ? আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে বাবাকে ।বাবা কেমন আছে ? আমার আর মা'র কথা বলে ? বাবা কি আমাদের কাছে আর কখনো আসবে না ?তুমি বাবাকে আমার কথা বোল, আর বোল আমি বাবাকে খুব ভালবাসি। বাবার কি আমাকে দেখতে একটুও ইচ্ছে করে না ?তাহলে আসে না কেন?আমার এবারের জন্মদিনে একবার আসতে বল না, প্লিজ। ভগবান,আমার এই কথাটা বাবাকে জানিও,তাহলেই বাবা ঠিক চলে আসবে,আমি জানি।

শুভ্র দাস


পড়তে পড়তে চোখে জল এসে যায় অনিলবাবুর। চোখটা রুমালে মুছে, চিঠিটা যত্ন করে খামে ভরে রেখে দেন । ঠিকানাও লেখা আছে ছেলেটার, চিঠির এককোণে। একবার ভাবলেন চিঠিটা ফেরত পাঠিয়ে দেবেন 'আনডেলিভার্ড' বলে। কিন্তু তাতে ছেলেটার সরল বিশ্বাসে আঘাত দেওয়া হবে। এত আশা করে, এত ভালবাসা নিয়ে চিঠিটা লেখা, ফেরত গেলে ভীষণ দুঃখ পাবে ছেলেটা। কিন্তু কি করা যায়!

অনিলবাবু আনমনে ভাবতে থাকেন নিজের জীবনের কথা ।তার বাবাও এইভাবেই একদিন খুব ছোটবেলায়, দুম করে মরে গেছলেন, ক্যান্সারে। তখন অনিল বাবুর বয়স মাত্র দশ। সেই থেকে কত খুঁজেছেন বাবাকে, আকাশে নক্ষত্রমন্ডলের দিকে তাকিয়ে, শীতের নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘের দিকে তাকিয়ে বা বাজারে হঠাৎ কারও দিকে চোখ আটকে গেলে। বাবার অল্প চেনা ছবিটা খুঁজে গেছেন কতদিন। যদি পাওয়া যায়! মন মানেনি যে বাবা নেই।শুভ্র বলে এই ছেলেটারও ঠিক তাই। জন্মের আগে বা পরপরই হয়ত বাবাকে হারিয়েছে ।কে জানে কি ভাবে ? হয়তো কোন অ্যাক্সিডেন্টে! বড় হয়ে যখন বুঝতে শিখেছে, শুভ্র তখন প্রানপণে বাবাকে খুঁজেছে, পায়নি। সে না পাওয়ার মধ্যে যে কি দুঃখ আছে, তা অনিলবাবু জানেন। অবুঝ মনের আর কি দোষ? তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।


বিকেলে পোস্টঅফিস ফাঁকা হতে, যে যার ফাইলপত্র গুছিয়ে বাড়ি ফেরার জন্য তৈরী হতে থাকে। তখনই বন্ধু ও সহকর্মী মাধববাবুকে ডেকে চিঠিটা দেখান তিনি। মাধববাবু চিঠিটা পড়ে হেসে বলেন "আহা রে, ছেলেমানুষের কান্ড! নাও, এবার এটা ভগবানের কাছে পাঠাও দেখি! ছেলেটা কিন্তু উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে থাকবে।" বলে উঠে পড়েন।

অনিলবাবু ভাবনায় পড়ে যান ।চিঠিটা ডেডলেটারের খোপে পাঠাতে তারও বাধে। ছেলেটার আশায় তাহলে একরাশ জল ঢেলে দেওয়া হবে। বাচ্চা ছেলেটা নিষ্পাপ ভালবাসা নিয়ে,না দেখা প্রিয় বাবার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে,নিদেনপক্ষে একটা চিঠির উত্তর। আর তিনি ডেড বাবার মত চিঠিটাও ডেডলেটার করে দেবেন! নাঃ, একবার অন্তত, ছেলেটার মুখে হাসি ফোটাতেই হবে । একবার অন্তত, পিতৃহীন ছেলেটিকে পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করবেন না। নিজের ছোটবেলার যন্ত্রণার কথা মনে পড়ে গেল। পিতৃস্নেহ তো হারিয়েই ছিলেন।সে সময় বাবার মত একটা মানুষকে, পাগলের মত কত খুঁজেছিলেন। মনে আছে স্কুলে সন্তোষস্যার খুব ভালবাসতেন অনিলবাবুকে। পিতৃহারা ছেলেটিকে আগলে রাখতেন বাবারই মত। বাড়ি এসে খবরাখবর নিতেন , পড়াও দেখিয়ে দিতেন ।অনিল বাবু আজও সে কথা ভোলেননি। স্কুল থেকে পাশ করে যাবার পর, আর সেরকম যোগাযোগ ছিল না ।কলেজে পড়ার সময় হঠাৎ একদিন খবর পেলেন, সন্তোষস্যার হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। ছুটে গিয়েছিলেন স্যারের বাড়ি। স্যারের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, সেদিন অনিলবাবুর মনে হয়েছিল ,যেন দ্বিতীয়বার পিতৃহারা হলেন।

পুরোনো সব দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।সেই সঙ্গে একটা অকারণ দায়িত্ববোধ,অবুঝ স্নেহ। সব স্টাফেরা চলে গেলে, নিজের ডেস্কে একটা সাদা খাম আর সাদা কাগজ টেনে নিলেন অনিলবাবু। চোখের জল আজ আর বাঁধ মানছে না। চোখটা রুমালে মুছে ফেলে, লেখা শুরু করেন।


প্রিয় শুভ্র,

তোমার চিঠি পেয়েছি। পোস্টম্যান অনেক কষ্টে অনেক তারা আর উল্কা পেরিয়ে, শেষমেষ আমার ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। তোমার বাবা আমার কাছেই আছেন। এই আকাশে উনি খুব ভাল আছেন। রোজ বিকেলে আমরা এখানে বসে তোমাকে দেখি ।তোমার বাবা খুব ভাল মানুষ, তোমার কত কথা আমাকে বলেন। তুমি কখন খাও ,কি খাও, কি বই পড়, কখন খেল, মার সঙ্গে কখন দুষ্টুমি কর, আর কখন মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়,সব । ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তুমি কি স্বপ্ন দেখ, সেটাও তোমার বাবা বলেন ।বলেন, তুমি একদিন খুব বড় হবে। তোমার মন হবে উদার, তোমার দৃষ্টি হবে স্বচ্ছ। তুমি গরিবদের, অসহায়দের ভালবাসবে। তোমার বাবা তো আর তোমার কাছে যেতে পারবেন না। শুধু তুমি যখন এক একটা ভাল কাজ করবে, পড়াশোনা- খেলাধূলা-ছবি আঁকা বা যে কোন ভাল কাজে সফল হবে, তখনই তোমার বাবা খুব খুশী হবেন আর তুমি তোমার মন দিয়ে তখনই সেটা বুঝতে পারবে। এই ভাবেই তুমি তোমার বাবাকে পাবে ।তোমার বাবা জানেন, তুমি তাকে কত ভালবাস। তাই তোমার জন্য পৃথিবীতে , অনেক খুশি, আনন্দ আর ভালবাসা সাজিয়ে রেখে এসেছেন ।বড় হবার পথে, ধীরে ধীরে ,তুমি সেগুলো খুঁজে পাবে আর বুঝতে পারবে ।তোমার বাবা সব সময় তোমার কাছে আছেন।ভালথেকো।ইতি

ভগবান


পোস্টঅফিসের দরজা বন্ধ করে ,চিঠিটা লেটারবক্সে ফেলে ,আকাশের দিকে তাকিয়ে অনিলবাবুর মুখে একটা প্রশান্তি ফুটে ওঠে। যদিও তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে, আকাশ অন্ধকার। তবু দূর কোন দেশের কোন দূরতম তারার ঝিকিমিকি দেখে, একটা মনের বার্তা পান তিনি, তার মনটা ভারি ভাল হয়ে যায়।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics