নো ম্যানস ল্যান্ড
নো ম্যানস ল্যান্ড


আমার ছোটবেলার অনেকটা সময়ই কাটত মামাবাড়ি শোভাবাজার রাজবাড়িতে ।গ্রে স্ট্রীটের ধারে রাজা কালীকৃষ্ণ স্ট্রিট ,সেখানেই ছিল পেল্লায় মেজরাজার বাড়ি। বিশাল দোতলা বাড়ি ,কত শরিক, বড় উঠোন, নাচঘর, পড়বার ঘর, বিশাল ছাদ,বড় বড় অয়েল পেন্টিং,ঝাড়লন্ঠন,দামি দামি আসবাবপত্র ,আরও কত কি।বনেদি আদব-কায়দা,দারুন খাওয়া দাওয়া,আর হৈ হৈ-এর মধ্যেই আনন্দে কেটে যেত দিনগুলো।তবে সবচেয়ে আনন্দের ছিল, রহস্যময় সেই বাড়িটার কোণে কোণে আমার একলা দুপুরে ঘুরে বেড়ানো।আমার ছোটবেলার স্বপ্নময়,মায়াময় দিনগুলোর কত যে স্মৃতি এখানে রয়ে গিয়েছে, তার শেষ নেই। কৈশোরের কত কল্পনা আর ভাবনার রসদ ছিল এই বাড়ি। শুধু তো একটা বাড়ি নয়,এ ছিল আমার গোটা ছোটবেলাটাই।
আজ সে বাড়ি আর নেই।কালের নিয়মে যা হয় আর কি।ভগ্নপ্রায় বাড়িটা শরিকি বিবাদে,শেষে প্রোমোটারের লোলুপ হাতে গিয়ে পড়ল।তাই সে বাড়ি আজ ঝাঁ চকচকে চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ি।ভেঙে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে আমার ছোটবেলার স্মৃতিবিজড়িত বাড়িখানি ,সেইসঙ্গে সেই সব রহস্যময়,রোমাঞ্চকর দিনগুলোও।
মামাবাড়ির অনেক রহস্যের মধ্যে, একটা বড় রহস্য ছিল, সে বাড়ির লাগোয়া একটা সরু গলি।এতটাই সরু, যে একজনের বেশি দু’জন পাশাপাশি হাঁটা যায় না।মামাবাড়ির পাশেই যে দোতলা বাড়িটা নতুন উঠল, তাকে আমরা বলতুম ‘হলুদবাড়ী’, তার রঙের জন্য। তো সেই বাড়ি আর আমার মামাবাড়ির মাঝখানেই ছিল সেই সরু গলিটা। সেই ছিল আমাদের ছোটবেলার ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’।
হলুদ বাড়িটা ওঠার আগে ওখানে একটা পোড়ো বাড়ি ছিল।আমি জানতুম সেটা ছিল ভুতের বাড়ি। সেই বাড়িতে থাকত এক ভয়ঙ্কর তান্ত্রিক, কি সব সাধনার জন্য, সে নাকি সাতটা মড়ার খুলি পুঁতে, বেদীতে বাঁধিয়ে রেখে দিয়েছিল। আমরা ছোটরা মাঝে মাঝেই সেসব দেখতে চাইতুম বলে,ওই গলিপথে যাবার একমাত্র রাস্তা, যেটা ছোটমামাদের রান্নাঘরের পিছন দিকে ছিল,সেটা দাদুরা কষে বন্ধ করে দিলেন।দরজাটাও আলমারি-টালমারি কিছু দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল।
তবু আমার উৎসাহের অন্ত ছিল না।বাইরের কলঘরের জানালাটা বন্ধই থাকত, কিন্তু বিশাল জানলাটার ফাঁকফোকর দিয়ে ওই গলিটা দেখা যেত।পরে যখন দোতলা বাড়িটা হল,তান্ত্রিকও পাশে কোথায় যেন পাট চুকিয়ে চলে গেল।তবুও,ওই বাড়ির লোকজনই কালেভদ্রে গলিটা ব্যবহার করত।আমার দাদুরা তাতে কোনদিন কোন অধিকার ফলায়নি,সে মাথাব্যথাও ছিল না।
শুধু কলঘরের জানলার ফাঁক দিয়ে দেখা যেত সেই নো ম্যানস ল্যান্ড, আমার ওয়ান্ডারল্যান্ড, সেই রহস্যময় গলি। শুনেছিলুম, গলিপথে বেরিয়ে আর একটা দরজা খুলে সরাসরি গ্রে স্ট্রীটে পড়া যেত ।যাহোক তান্ত্রিক , ভুত, মড়ার খুলি আর নিষিদ্ধ গলি-এসব আমার কিশোর মনে নানা উন্মাদনার সৃষ্টি করেছিল, উৎসাহের কোন অন্ত ছিল না।সে বয়সে কল্পনা আর বাস্তব কখনো কখনো মিলেমিশে একটা অদ্ভুত গল্পের জগৎ তৈরি করত।আমার ছোটবেলার একটা বড় অংশই ছিল ,এসব নিজস্ব কল্পনা আর ভাবনার স্রোতে ভেসে যাওয়া ।
একদিন কি কারণে যেন কলঘরের বড় জানলাটা খোলা হয়েছিল। আমি দেখে নিয়েছিলুম, যে ওই জানলা খুলে একজন অনায়াসেই বেরিয়ে পড়তে পারে গলিটাতে।ব্যাস আর যায় কোথায়! একদিন নির্জন
দুপুরে সেই সুযোগটাই কাজে লাগালুম।মা ঘুমোচ্ছে দেখে, বাথরুমে যাবার নাম করে, নীচের কলঘরে ঢুকে হাঁসকল দিলুম।তারপর অনেক কষ্টে, কায়দা ক’রে জানলাটা খুলে ফেললুম।ব্যাস, আমার সামনে সেই রহস্যময় নো ম্যানস ল্যান্ড উন্মুক্ত হয়ে গেল।টুক করে লাফিয়ে নেমে পড়লুম। নীচে চারিদিকে ডাঁই করে রাখা জন্জাল, গোটা গলিটাই বেশ নোংরা,এখানে ওখানে আগাছা জন্মেছে, নুড়ি-পাথর পড়ে আছে।খিড়কি পথ বলে খুব একটা ব্যবহারই হয় না, পরিষ্কারও কেউ করে না। খেলার সময়, আমাদের ছাদ থেকে ক্যাম্বিস বল অবশ্য কয়েকবার পড়ে গিয়েছিল এই গলিটাতে,তবে আর ফিরে পাওয়ার কোন প্রশ্নই ছিল না। আজ এতদিন পরে সে কি আর খুঁজে পাওয়া যাবে? তবু ভাবলুম একটু খুঁজেই দেখি না।আর সেইসঙ্গে গলিটাও ঘুরে দেখা হয়ে যাবে, যদি রহস্যময় কিছু পাওয়া যায়। হঠাৎ দেখি একতলার একটা জানলা দিয়ে একটা দাড়িওলা বুড়ো জুলজুল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।বুড়োটাকে দেখেই ভয়ে আমি পালিয়ে যেতে গেলুম। একে তো দুপুরে অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় এক নিষিদ্ধ রাজ্যে ঢুকে পড়েছি, মনটা ভয়ে দুরদুর করছে, ওদিকে আবার ওরকম একটা বেঢপ বুড়ো আমাকে চুপচাপ দেখে যাচ্ছে,অথচ কিছুই বলছে না,কে রে বাবা। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলুম,ধুর, পাগল-টাগল হবে হয়তো। সাহসটা একটু বেড়ে গেল।
পালিয়ে না এসে আবার ঘুরেফিরে জায়গাটা ভাল করে দেখতে লাগলুম।অবশ্য খুঁজেপেতেও সেই সাতটা নরকরোটির চিহ্নও দেখতে পেলুম না ।তখনই দেখলুম এক কোণে কয়েকটা সিমেন্টের স্ল্যাবের আড়ালে, একটা সুন্দর কাঠের বাক্স পড়ে আছে, তার মুখ আঁটা। যাহোক বল টল যখন খুঁজে পাওয়া গেলই না, ভাবলুম বাক্সটা একবার খোলার চেষ্টা করি, যদি কোন গুপ্তধন পাওয়া যায়।এই নোংরার মধ্যে বাক্সটা এলই বা কোথা থেকে? আসলে গোয়েন্দা আর অ্যাডভেঞ্চার গল্পের বইয়ের পোকা ছিলুম, রাতদিন সেসবই মাথায় ঘুরঘুর করত।বাক্সটাতে হাত দিতেই,বুড়োটা আমার দিকে কটমট করে তাকাতে লাগল, আর মুখটা লম্বাটে করে,দুলিয়ে দুলিয়ে অদ্ভুত একটা আওয়াজ করতে লাগল। এবার সত্যিই ভয় করতে লাগল।বুড়োটারই হবে হয়তো বাক্সটা, তাই ওরকম করছে। যাহোক, পরের বাড়িতে ঢুকে, পরের জিনিসে হাত দেওয়াটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে ভেবে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলুম।তাছাড়া বেশি সময়ও ছিল না হাতে।শিগগির না ফিরতে পারলে কপালে বেদম মার জোটার কথা। ওদিকে কলঘরের দরজা ধাক্কানোরও আওয়াজ পেলুম,মনে হয়। তড়িঘড়ি ফিরে এলুম।
লাফ মেরে জানলাটায় চেপে, আবার বাথরুমে ঢুকতে যাব, তখনই পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল ‘যাঃ,চলে গেল। ওঃ হো, চলে গেল‘, আরো কি সব। সেই পাগলটাই বোধহয় ।তখন আর সেসব দেখার বা শোনার মতো সময় নেই, জানলাটা আগের মতো বন্ধ করতে না করতেই, বাইরে থেকে মার হাঁক শুনতে পেলুম, ‘সেই কখন বাথরুমে যাব বলে বেরিয়েছে,পাত্তাই নেই! কোথায় তুই?’ ‘বেরোচ্ছি’, বলে জানলাটা ঠেসে ঠিকঠাক বন্ধ করে, ভালো মানুষের মতো বেরিয়ে এলুম। মা হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে চলল, সঙ্গে অজস্র বকুনি। দুপুরে আমার দুষ্টুমির চোখে ঘুম হচ্ছে না, বাবা এলে আজ বলতে হবে, চারিদিকে ছেলেধরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি ।
যেতে যেতে তখনও ভাবছিলুম, ধুর বাক্সটার ভিতর কি ছিল দেখাই হল না।ইসস্, সত্যিই যদি গুপ্তধন থাকতো!